September 29, 2023

বছর কয়েক আগে খুলনা বেড়াতে গিয়েছিলাম। আমার একজন আত্মীয়, পেশায় ডাক্তার, নাম কুদরতুল্লাহ। তার সেবার কুদরতে মুগ্ধ হয়ে একজন রোগীনি বেশ কয়েক বার তার বাড়িতে খেতে আমন্ত্রণ জানালে অবশেষে সম্মতি জ্ঞাপন করলেন।

বয়স হলেও মহিলার চেহারা, চালচলন, পোশাক-পরিচ্ছদে অভিজাত্যের ছাপ। মিষ্টভাষীনিও বটে।

রোগীনির বাড়ি শহর থেকে ৪০ মাইল দূরে গোপালগঞ্জ শহরের আশেপাশে কোথাও।

ডাক্তার আমাকেও সাথে নিয়ে যেতে ইচ্ছা প্রকাশ করলেন। আমার ইতস্ততা‌ দেখে গোপালগঞ্জ শহরের সন্নিকটে হাওড়ের বিশাল রুই, কাতলা, কৈ মাছের ব্যঞ্জনসহ অন্যান্য উপাদেয় ডিশ সহকারে রসনা তৃপ্ত করার সম্ভাবনার কথা বলে উৎসাহ জাগিয়ে তুলতে চেষ্টা করলেন। সে সাথে পথে সারি সারি বৃক্ষরাজি সজ্জিত ব্র্যান্ড নিউ রাজপথ, দুপাশে হেমন্তের সোনালী রোদে সোনালী ধানের ক্ষেতে ঢেউ তুলে মৃদুমন্দ বাতাসের কোমল পরশ উপভোগের করার টোপ দিতেও ভুললেন না। চিকিৎসা বিদ্যার পাশাপাশি ডাক্তারের কাব্যরসের প্রতিও দিলচশপি আছে।

বুঝা গেল, রসনা তৃপ্তি ও ভ্রমণের আনন্দ ভাগ করে নিতে সঙ্গী খুঁজছেন। একা একা এত আনন্দ রাখবেন কোথায়?

যাত্রা পথে ডঃ কুদরত উল্লাহর প্রতিশ্রুতি মোতাবেক হেমন্তের শেষ লগ্নে চিরায়ত বাংলার মাটির সোঁদা গন্ধ, খাল-বিলে শুভ্র মেঘের প্রতিচ্ছবি মুগ্ধ হয়ে উপভোগ করলাম।

কথায় আছে ‘মর্নিং শোজ দ্য ডে’–দিনটি কেমন যাবে প্রভাতেই তার আভাস মিলে। শুরুটা যখন এতো ভালো, রসনা‌ তৃপ্তির পর্বটা কতই না ভাল হবে।‌ ভাবতেই‌ রসনা সিক্ত হয়ে গেল। ক্ষুধার তীব্রতার কাউন্টডাউন শুরু হয়ে গেল।

চর্ব চোষ্য লেহ উপভোগের জন্য আমাদের প্রত্যাশা উচ্চগ্রামে পৌঁছে গেল আড়ম্বরপূর্ণ অভ্যর্থনা পর্বে। একেবারে ভিআইপি‌ বন্দনা।

প্রাসাদোপম অট্টালিকা, বাড়ির সামনে কেয়ারি করা ফুলের বাগান। মালি বেয়ারা ড্রাইভার‌ ও অন্যান্য পদের আধা-ডজন কর্মীবাহিনী আমাদের গার্ড অব অনার দিল। যথাযথ প্রশিক্ষণের অভাবে প্রশিক্ষিত বাহিনীর মতো তাদের পারঙ্গমতার অভাব থাকলেও চেষ্টার ত্রুটি ছিল না।

ইতোমধ্যে, আমাদের ক্ষুধা আরেক দফা বৃদ্ধি খেতে লাগলো। সে সাথে আনন্দ পর্ব শেষে নিরানন্দ পর্ব শুরু হয়ে গেল।

বাড়ির কর্তা যিনি ডাক্তারের রোগীনিরও কর্তা, নাম মোহাইমেন খান। তিনি আমাদের সুসজ্জিত ড্রইংরুমে বসিয়ে ‌ আলাপ পরিচয়ের পর ড্রিঙ্ক সার্ভ করার ব্যবস্থা করলেন। খান সাহেব উচ্চ পদে সরকারি চাকরি হতে অবসর গ্রহণ করে গোপালগঞ্জ শহরের অদূরে থিতু হয়ে বসেছেন। ডাক্তার আমার কানের কাছে ফিস ফিস করে জানালেন, তার এক সুযোগ্য সন্তান ঢাকায় ডাকসাইটে উকিল, অঢেল ইনকাম, গ্রামের এ বাড়িটাও তারই অর্থে নির্মিত।

মহাইমেন সাহেব চাকরি জীবনের বিচিত্র অভিজ্ঞতা আমাদের সাথে শেয়ার করে মনোরঞ্জনের ব্যবস্থা করেন। প্রথমদিকে তার গল্প বেশ ইন্টারেস্টিং মনে হল। শেষ দিকে ক্ষুধার তীব্রতা আমাদের কাবু করে ফেলেছিল। গল্পে আর মনোযোগ দেয়া গেল না। জানালার ফাঁক দিয়ে পূর্বাকাশে পূর্ণ চাঁদ সুকান্তের ঝলসানো রুটি মনে হতে লাগলো। মানচিত্র খেতেও আপত্তি ছিল না। কিন্তু ড্রয়িং রুমের দূর প্রান্তে ডাইনিং টেবিল আমাদের দৃষ্টি বারবার টেনে নিয়ে যাচ্ছিল। ঘন্টাখানেক পরেও টেবিলটি খা খা করছিল।

অল্প কিছু পরে ঢাকা থেকে তার সুযোগ্য পুত্র জন পাঁচেক সঙ্গী সাথী নিয়ে হাজির। অল্প-স্বল্প পরিচয়ের পর সঙ্গীদের সাথে আলোচনায় ব্যস্ত হয়ে পড়লেন।

আমি সেন্ট্রাল ব্যাংকের কাজ করেছিলাম শুনে ব্যাংকের গভর্নরের সাথে তার ঘনিষ্ঠতার কথা উল্লেখ করতে ভুললেন না। আমাদের ইমপ্রেস করার প্রচেষ্টা।

বাঙ্গালীদের এ এক বিচিত্র স্বভাব। কোন প্রতিষ্ঠানে কেউ চাকরি করছে শুনলে সে প্রতিষ্ঠানের পরিচিতজনদের মধ্যে প্রধান কর্মকর্তার নিচে নামতে চান না।

আমার একজন পরিচিত আমেরিকান কনসালটেন্ট যিনি বহুকাল যাবত বাংলাদেশ বাস করেছেন, একদিন জিজ্ঞেস করলেন, তোমাদের প্রধান মন্ত্রীর ড্রয়িং রুম কত বড়?‌ আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, কেন এ অদ্ভুত প্রশ্ন? একজন থাই রমণীকে বিবাহ করে তিনি তখন তিনি ব্যাংককে থিতু হয়েছেন।

তিনি ব্যাখ্যা দিলেন, ব্যাংককে যিনিই ব্যবসার উদ্দেশ্যে যান তিনি সে দেশের ব্যবসায়ীদের ইমপ্রেস করার জন্য গল্প দেন প্রধানমন্ত্রীর সাথে এত ঘনিষ্ঠতা যে যে কোন সময় তার ড্রইং রুমে হাজির হতে পারেন। তার হিসাব মতে, প্রধান মন্ত্রী যদি প্রত্যেককে এক মিনিট করেও সময় দেন তাহলে পুরো দিনই ‘ঘনিষ্ঠ’ লোকজনের সাথে কথা বলে কাটাতে হবে। বাকি দায়িত্ব মাথায় উঠবে। দেশেও অনেকে প্রধানমন্ত্রীর উপস্থিতিতে কোন অনুষ্ঠানে যোগ দিলে গল্প দেন তাদের প্রধান মন্ত্রীর সাথে উঠা বসা।

দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর বাসনপত্রের মিষ্টি টুংটাং শব্দে আমাদের আশার আলো জ্বলে উঠলো। টেবিল সাজানো হয়ে গেছে। এখন ডাকের অপেক্ষায়।

আমাদের অবাক করে দিয়ে আইন ব্যবসায়ি সন্তান তার সঙ্গী সাথীদের নিয়ে তড়িঘড়ি করে টেবিলের ছয় খানা চেয়ারই দখল করে বসলো। আমরা মুরব্বি কিসিমের ক’জন আমন্ত্রিত অতিথি অপেক্ষা করছি সে দিকে তার ভ্রুক্ষেপ নেই।

যুব সমাজের মধ্যে সৌজন্যের এতোখানি অভাব আগে কোথাও দেখিনি। হয়তো টাকার গরম কিম্বা আইন ব্যবসায়ীদের বিচিত্র চিন্তা ভাবনা অথবা তার অর্থে তৈরি বিল্ডিং বিধায় নিজের গুরুত্ব প্রকাশের প্রচেষ্টা। উঠতি বয়সে শিষ্টাচার সম্পর্কে‌ পিতা মাতা হয়তো নানান কাজে ব্যস্ত থাকায় তাকে ঠিকমত তালিম দিয়ে উঠতে পারেননি। মোটকথা, বিগড়ে যাওয়া যুবক।

মহাইমেন সাহেব, দিশেহারা হয়ে সন্তানের কাছে করুন আবেদন করলেন অন্তত দুইজন অপেক্ষারত গেস্টদের জন্য একটু জায়গা করে দিতে।

একবার চিন্তা হলো ভদ্রলোককে বলি, ভাই সাহেব, এবার আমরা উঠি। খাওয়া-দাওয়া বড় কথা নয়। আলাপ পরিচয় হল তাতে খুশি। কিন্তু নিরীহ মানুষটিকে মনে কষ্ট দেয়া থেকে বিরত থাকলাম।

অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ভোজনরত উকিল ও তার সাঙ্গ-পাঙ্গদের খাওয়া-দাওয়া শেষ হলে আমাদের‌ সিরিয়াল এল। ক্রমশ ঊর্ধ্বগামী অস্বস্তিকর পর্বগুলোর ধারাবাহিকতায় ভোজন পর্বটি অস্বস্তির মাত্রা উচ্চপর্যায়ে পৌঁছে গেল।

এ পর্যায় আমাদের যিনি নিমন্ত্রণ করে নিয়ে এসেছিলেন সে ভদ্রমহিলা অকুস্থলে উদয় হলেন। এতক্ষণ সম্ভবত তিনি বাবুর্চিদের রান্না বান্না তদারকি করছিলেন। মহাইমেন সাহেবের মত তারও সৌজন্যের অভাব নেই। ‘একটু’ বিলম্বে ‌ খাবার সার্ভ করা হয়েছে বলে দুঃখ প্রকাশ করলেন।

খাবার টেবিলের দিকে তাকিয়ে কাজী নজরুল ইসলামের একটা কবিতা মনে হল। ‘কোথা চেংগিস, গজনী-মামুদ, কোথায় কালাপাহাড়?’

কোথা সেই হাওড়ের বিশাল সাইজের রুই কাতলা কোথায় বা সে বিখ্যাত কই মাছ?

এক বাটিতে ছোট ছোট চিংড়ি মাছ বেগুন কুচি কুচি করে কেটে রান্না করা তরকারি। অন্য বাটিতে গভীর ঝোল জাতীয় লিকুইড পদার্থ থেকে উঁকি মারছে মাংসের টুকরা।

বেগুন এবং চিংড়ি মাছে আমার এলার্জি। মাংসের টুকরা চেষ্টা করে দেখলাম। কোন পশুর কিম্বা রাবারের তৈরি মাংস কিনা বোঝা গেল না। দুই সারির দাঁতের মাঝে চেপে ধরলে সারেন্ডারের ভঙ্গিতে চুপসে যায় বটে কিন্তু ছেড়ে দিলে ফের আগের আকৃতিতে ফিরে আসে। সে চেষ্টা বাদ দিলাম।

আমার পাশে বসা ডাক্তার কুদরতুল্লাহ মেডিকেল কলেজে অনেক কাটাকাটি করেছেন। তিনি চেষ্টা চরিত্র করে বেশ কতকগুলি মাংসের টুকরা সাইজ করে যথাস্থানে চালু করেছিলেন। মুখে আহ্ আহ্ ‌ করে গৃহকর্তী-কাম তার রোগিনীকে বললেন, খুব মজা পেলাম। গৃহকর্তী বললেন, হবে না আবার, ভাল রান্না করার জন্য আমার বাবুর্চির খুব নামডাক আছে।

টেবিলের এক প্রান্তে দেখলাম ডাল জাতীয় হলুদ রঙের জলীয় পদার্থ রয়েছে। পাশে আলু ভর্তা। ইউরেকা বলে আলু ভর্তা তার সাথে ডাল মিলিয়ে কিছুটা হলেও উদরে চালান দিয়ে ক্ষুন্নিবৃত্তি চেষ্টা করলাম।

ঢেকুর তুলতে তুলতে বাড়ির কর্ত্রীকে ধন্যবাদ জানালে তিনি আমাকেও বললেন, আমাদের বাবুর্চির রান্নার হাতটা খুবই ভালো। কাটা ঘায়ে নুনের ছিটা!

বিদায় পর্বটি অবশ্য গার্ড অব অনার সহ জাঁকজমকের সাথে সম্পন্ন হল। ডঃ কুদরত উল্লাহ মহাইমেন সাহেব ও তার রোগিনীকে উচ্ছ্বসিত ধন্যবাদ জানিয়ে বললেন, আপনাদের আদর আপ্যায়ন, ভুরিভোজনের আয়োজনে আমরা মুগ্ধ। আবার সময় পেলে ভিজিট করবো।

তারা জানালেন, আমরা সানন্দে আপনাদের আপ্যায়ন করবো। মনে মনে বললাম নেড়ে একবারই বেল তলায় যায়।

About Post Author

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Pin It on Pinterest