October 29, 2025

বছর দেড়েক আগে সন্ধ্যাবেলায় অম্লতার কারণে অস্বস্তি ও মাঝে মাঝে ঢেকুর উঠছে। এদিকে, রমজান মাসে সন্ধ্যাবেলায় আমার পরিচিত নির্ভরযোগ্য ডাক্তাররা চেম্বারে বসেন না।

বিকল্প উপায় হাসপাতাল, কিন্তু মাত্র কয়েকদিন আগে খবরে বেরিয়েছে এক নাক কান গলার ডাক্তার রোগীর অসুস্থ কানের পরিবর্তে ভালো কানে ছুরি চালিয়ে দুটো কানেরই অবস্থা ছেড়াবেড়া অবস্থা করে ফেলেছে। মেডিকেল কাউন্সিল তাকে এক বছর নাগাদ চিকিৎসা সেবা প্রদানের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। অন্য দুটো ঘটনায় দুটো শিশুকে সামান্য খতনা দিতে গিয়ে মৃত্যু মুখে ঠেলে দিয়েছে। সেই থেকে হাসপাতাল ভীতি মনে খুঁটি গেড়েছে।

পরিবারের লোকজন ভরসা দিল, ভালো কোন হাসপাতালের ইমারজেন্সি বিভাগে গেলে ১০-১৫ মিনিটেই সমস্যাটা দূর করে দেবে।

পাঁচ তারা মার্কা হাসপাতালের ইমারজেন্সি বিভাগের ডাক্তাররা দ্রুততার সাথে সমস্যার সমাধান করে দিল কিন্তু, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষে বলির পাঠা হাতে পেয়ে সহজে ছেড়ে দেয় কি করে? রমজান মাসে এমনিতেই রোগীর সংখ্যা কম থাকে। হাসপাতালের মালিক পক্ষ সম্ভবত ডাক্তারদের নির্দেশ দিয়ে রেখেছেন, যতদূর সম্ভব রোগীদের নিংড়েতে থাকো। ব্যস, শুরু হয়ে গেল টেস্টের পর টেস্ট, বিভিন্ন বিভাগের ডাক্তারদের আনাগোনা।

দুই দিনেই বিলের মিটার দুই লক্ষ ছুই ছুই করছে। শুনতে পেলাম, আরো নাকি টেস্ট বাকি আছে। ভয় পেয়ে গেলাম, সে পথচারীর মত যে বাসের নিচে পড়া থেকে অল্পের জন্য বেঁচে গিয়েছিল। ঘর থেকে মোটেই বেরতে চায় না। কারণ জানা গেল, বাসের সামনে লেখা ছিল ‘আবার দেখা হবে’। আরো টেস্ট বাকি আছে শুনে আমিও ভয় পেয়ে বাসায় ফিরে এলাম।

কোন কোন হাসপাতাল এবং তাদের হয়রানি মূলক বাণিজ্যিক কর্মকাণ্ড এবং আরো কিছু সামাজিক অসঙ্গতি, দুর্নীতি, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে অব্যবস্থার পটভূমিতে একটা গল্প লেখার ইচ্ছা ছিল, কিন্তু এলেমের অভাবে সে কাজে হাত দেয়া হয়ে ওঠেনি।
যাহোক, বিদ্যমান চিকিৎসা সংকট ও চলতি ঘটনাবলীর খিচুড়ি পাকিয়ে হালকা রসিকতার ভিয়েন দিয়ে একটা গল্প দাঁড় করানো গেল। গল্পটা প্রতীকী, কিন্তু মূল উপাদান জীবন থেকে নেয়া।

দৃশ্য ১

আমার নাম সফদার মুন্সী। আমার পেশা…. না, থাক, আপাতত পেশার কথা নয়, বরং আমার বিড়ম্বিত ভাগ্যের কাহিনীটা শোনা যাক।

সেদিন গুলশান থেকে ফেরার পথে রিক্সা খুঁজছিলাম। কোথাও দৃষ্টিসীমার মধ্যে রিক্সা দেখা যায় না। শুনলাম, অভিজাত এলাকায় ব্যাটারি চালিত রিক্সা চালানো নিষিদ্ধ করায় রিক্সাওয়ালারা রাস্তা আটকিয়ে গ্যাঞ্জাম বাঁধিয়েছে।

রিক্সার জন্য অনুসন্ধিৎস দৃষ্টিতে চারদিকে রেকি করছিলাম। চোখের ভ্রান্তি কিনা জানিনা, হঠাৎ অদৃশ্যলোক থেকে দেবদূতের মত উদয় হয়ে এক সুদর্শন রিক্সাওয়ালা পাশে এসে ব্রেক করে আমার ক্লান্ত চিত্তে আশার আলো জ্বালিয়ে দিল।

সৃষ্টিকর্তাকে ধন্যবাদ জানিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, এই রিক্সা যাবে?
–রিক্সাকে জিজ্ঞেস করে লাভ নাই, স্যার। রিক্সা যাবে না, আমি যাব। দয়া করে উঠে বসুন।
–তুমি তো বেশ স্মার্ট লাড়কা, শুদ্ধ ভাষায় রসিকতা। কোথায় যাব, তা তো জিজ্ঞেস করলে না?
—যেখানেই যেতে চান সেখানেই যাব। জাহান্নামেও আপত্তি নেই, কিন্তু গুলশানে আর নয়।
– গুলশানের উপর এত অভিমান কেন?
—অভিজাত এলাকায় রিকশা চালালে নাকি এলাকার ইজ্জত থাকে না। দেখেন না, গুলশানে রিক্সা চালানোর জন্য মারধর করে শরীরের কি হালাত করেছে? জামা কাপড় ছিঁড়ে একাকার।
— গুলশানে তো ভদ্রলোকদের বাস, তারাও তোমাদের মারধর করলো?
— মারধর করে বেরহম পাবলিক। গরিব ও গোলাম শ্রেণী একে অন্যের দুশমন, সুযোগ পেলে কিছু না বুঝেই কিল ঘুষি দিয়ে পরম তৃপ্তি অনুভব করে।

রিক্সাওয়ালার কথা শুনে জ্ঞানীগুণীদের কথা মনে হল। তাঁরা বলেন, যে দেশে বিচার ব্যবস্থা যত ঢিলেঢালা, সে দেশে মব-জাস্টিস ততটা উগ্র এবং নির্মম। তাৎক্ষণিক বিচার এবং শাস্তি দুটোই নিজেদের হাতে তুলে নেয়। কত যে নিরীহ মানুষ তাদের হাতে প্রাণ হারায় তার কোন হিসেব নেই।

ইতোমধ্যে, স্মার্ট রিক্সাওয়ালার নাম জেনে গেছি, আব্দুস সালাম। তাকে বললাম,

–আব্দুস সালাম, তুমি তো কার্ল মার্ক্সের মত কথাবার্তা বলছো। পড়াশুনা করলে উন্নতি করতে পারতে।

–কার্ল মার্কস কি বলেছেন জানিনা স্যার, কিন্তু পড়াশোনা যে করিনি তা নয়, বিএ পাস করে চাকরি-বাকরি জুটোতে না পেরে রিক্সা চালাই।
– কেন, উন্নয়নের জোয়ারে এখন তো কারো বেকার থাকার কথা না।
–কি যে বলেন স্যার, আপনাদের হেয়ালীপূর্ণ কথা শুনে কান্না পায়।
–না বাপু,! তোমার কান্নাকাটির দরকার নাই, তোমাকে একমাস পরে আমার প্রাইভেট চেম্বারে রোগীদের দেখাশোনার জন্য দায়িত্ব দিব। আয়কর, অন্যান্য সংস্থা, এলাকার চাঁদাবাজদের সামলাতে তোমার মত একজন স্মার্ট লাড়কা আমার খুব প্রয়োজন। তাছাড়া আমি সাকিবের মত একটা মৎস্য খামার করার চিন্তা করছি। মৎস্য খামারের আয় দেখিয়ে নাকি কালো টাকা সাদা করা যায়।

—এবার বুঝলাম,আপনি ডাক্তার।
–ডাক্তার ছিলাম, কিন্তু ভাগ্যের ফেরে এখন নাই।
–বুঝলাম না স্যার, ছিলাম কিন্তু নাই–এমন আজব কথা আগে শুনিনি।
–দুনিয়াটা বড্ড আজব, আব্দুস সালাম, তোমার ক্ষুদ্র মাথায় ঢুকবে না।
–আপনার দয়ার শরীর স্যার, চাকরি দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেওয়ার জন্য আপনার অনুগ্রহের কথা জীবনেও ভুলবো না।
–শুনে খুশি হলাম, কিন্তু দুদিন পরেই তুমি আমার চৌদ্দগোষ্ঠির উদ্ধারে লেগে যাবে। বলা হয় Kindness never goes unpunished.

–শুনতে বেশ ভালো লাগলো কিন্তু ‌ আমি ইংরেজিতে দুর্বল। বাংলায় বলেন।
ইতিমধ্যে স্মার্ট রিক্সা চালকের নামটা জেনে গিয়েছি, আব্দুস সালাম। বললাম,

–শুনো, আব্দুস সালাম,কথাটার অর্থ, দয়া করলে তার খেসারত দিতেই হয়। এর উদাহরণ তো অহরহ দেখতে পাচ্ছ।

দৃশ্য ২

হা, আমি নাক-কান-গলার ডাক্তার। ডাক্তার সফদার মুন্সি। শিশুতোষ ছড়ার সফদার ডাক্তারের মত মাথা ভরা টাক নেই, পানিও চিবিয়ে খাই না। তবে, দুষ্টু লোকজন বলে আমি নাকি লাল পানি চিবিয়ে চিবিয়ে খাই। যত্ত সব বেহুদা পাবলিক।

মাস দুই আগে আমার প্রাইভেট চেম্বারে এক রোগীনি চিকিৎসার জন্য আসেন। চেহারা ভালো কিন্তু কানের অবস্থা ভালো না। বাম কান একেবারে বন্ধ। সে কানের কাছে ঢাক বাজালেও শুনতে পান না।

রসিকতা করে বললাম, এক কান বন্ধ তাতে কি? অন্য কান দিয়ে শুনলেই হয়।
রোগিনীর কন্ঠে প্রতিবাদের আভাস– আপনিতো দাঁত কেলিয়ে হাসছেন, এদিকে, পাড়া প্রতিবেশী আত্মীয়-স্বজন বন্ধু-বান্ধব সংবাদ মাধ্যম, ভুয়া ইউটিউব ও অর্বাচীন পাবলিকের গা জ্বালানো কথা বার্তা এক কান দিয়ে শুনে অপর কান দিয়ে বের করে দেবো, তার উপায় নেই। কথাগুলো মাথার ভেতর ঘুরপাক করতে থাকে। রাতের ঘুম হারাম।

তাঁর প্রতিবাদের ভাষা পছন্দ হলো না তবে, দুনিয়ার নিয়ম, রূপসী রমণীদের কিছুটা ছাড় ত দিতেই হয়। ভরসা দিলাম–সমস্যা নেই, দুদিনের মধ্যেই কানের জট খুলে দেব।

দৃশ্য ৩

এককালের ধনধান্যে পুষ্প ভরা, বর্তমানে অভিজাত বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার পাঁচ তারা হাসপাতালে রোগীনির দু’দিন হরেক রকমের টেস্ট করার ব্যবস্থা হল, পেটের এন্ডোসকপি, আল্ট্রাসোনো, মাথার ক্যাট স্ক্যানিং, কলিজার ইসিজি, বুকের এক্সরে। হাসপাতালে নতুন পুরাতন যত মেশিনপত্র আছে সবই কাজে লাগিয়ে বিলের অংক বাড়তে থাকলো, জ্যামিতিক হারে।
টেস্টের ফাঁকে ফাঁকে হসপিটালের সব বিভাগের আট জন ‘বিশেষজ্ঞ’ ডাক্তার একে একে এসে, কেউ নাড়ী টিপে, কেউ “হাই! কেমন আছেন‌” বলে নার্সের স্টেশনে রাখা হাজিরা খাতায় নাম লিখে যান।
প্রতিবার হাজিরার জন্য কারো ফিস দুই হাজার, কারো আড়াই। চোখের ডাক্তার তো কেবিনে না ঢুকেই দরজা থেকে দাঁড়িয়ে দেখে নাম স্বাক্ষর করে গেলেন। তাঁর নামের পাশে লেখা হলো দূই হাজার টাকা। ইনাদের ডিকশনারিতে চক্ষু লজ্জা বলে কোন কথা নাই। ছাত্র বয়সে এনারা রচনা লিখতেন, আমার জীবনের লক্ষ্য ডাক্তার হয়ে আমি দুস্থ মানুষের পাশে দাঁড়াবো।

দৃশ্য ৪

ডাক্তার ও হসপিটালের কান্ড কারখানা দেখে রোগীনির আত্মীয়-স্বজন ধৈর্য হারা, বিলের অংকের উল্লম্ফন দেখে বেচারীর স্বামী জ্ঞান হারা। জ্ঞান ফিরে পেলে জিজ্ঞেস করলেন, সমস্যাটা আমার বিবির কানে। আপনারা এখানে ওখানে মেশিন লাগিয়ে কি খুঁজে বেড়াচ্ছেন?

ডাক্তারদের ট্রেডমার্ক ব্যাখ্যা, আপনি ডাক্তার হলে বুঝতেন। সমস্যা বুঝতে হলে আমাকে শুধু পেট নয়, পায়ের নখ পর্যন্ত চেক করতে হবে।

ডাক্তারের কথা, বেদবাক্য যথা। তিনি বুঝতে চান না রোগীর ব্যাথা। ব্যাখ্যা তো নয়, রোগীর আত্মীয়-স্বজনের অসহায়ত্ব পুঁজি করে ব্ল্যাকমেইলিং।
প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে রোগীর শরীরে ছোট-বড় যত ছিদ্র আছে তার প্রত্যেকটিতে নল বা তার ঢুকিয়ে ছবি তুলতে থাকেন। রঙ্গিন ছবি। কখনো বেহুশ করে, কখনো আধা বেহুশ।
আত্মীয়-স্বজন কিই বা করবে? ডাক্তারদের কাণ্ডকারখানা দেখে স্বজনেরা বাক রুদ্ধ। অগতির গতি আল্লাহর কাছে আবেদন জানিয়ে দোয়া কালামের ব্যবস্থায় লেগে যান।
ইতোমধ্যে এলান হলো, পরের দিন অপারেশন। এখন শুধু অপেক্ষা করার পালা।

দৃশ্য ৫

পরের দিন ডাক্তার একের পর এক নাক, কান, গলার রোগীদের অপারেশন চালিয়ে যাচ্ছেন। যত বেশি রোগী তত বেশি লাভ। কুয়ালালামপুরে সেকেন্ড হোম কেনার জন্য বেশ কিছু টাকার অর্থের প্রয়োজন। ডাক্তার সফদার সৃষ্টিকর্তার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানালেন, যত দিন যাচ্ছে দেশের লোকের চোখ- কান অচল হয়ে যাচ্ছে। এত ব্যস্ততার মাঝে একজন রোগী নিয়ে পড়ে থাকলে চলে কি করে?
তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে, ডাক্তার সাহেব বাম কানের পরিবর্তে ডান কানে ছুরি চালালেন।
অপারেশন রুমের বাইরে এসে একগাল মিষ্টি হাসি দিয়ে উদ্বিগ্ন স্বজনদের বললেন, অপারেশন সাকসেসফুল।

সমবেত কন্ঠে আওয়াজ উঠল, মাশাল্লাহ, আলহামদুলিল্লাহ।

পর দিন ব্যান্ডেজ খোলা হলে‌ সাকসেসের আসল নমুনা দেখা গেল–রোগিনীর দুই কানই বন্ধ। এবার এটম বোমা ফাটলেও তার কর্ণকুহরে ঢুকবে না।

দৃশ্য ৬

কেসটা বিচারের জন্য কোর্টে তোলা হলে ডাক্তার সফদার মুন্সিকে জেলখানায় পাঠানো হয়। যথারীতি তার জামিনের জন্য আবেদন করা হয়।
জামিনের শুনানির সময় ডাক্তারের উকিল, অ্যাডভোকেট রায়হান মুন্সী হাতের পাঁচ আঙ্গুল তুলে বিচারপতিকে কিছু একটা বোঝাতে চেষ্টা করলেন।

বিচারপতি তাঁকে ধমক দিয়ে বললেন, আপনার মতলব বুঝতে পেরেছি। জামানা পাল্টেছে, আঙ্গুল গুনে জামিন দেওয়ার রীতি নেই। নিয়মিত শুনানি না হওয়া পর্যন্ত হাজত বাস করতে হবে।

দৃশ্য ৬

শুনানির দিন আদালতে উকিল, ব্যারিস্টার এবং কৌতূহলী দর্শকে পরিপূর্ণ।
বাদী পক্ষের উকিল, এডভোকেট রাফিসা খানম, জ্বালাময়ী উদ্বোধনী ভাষণে ভুল চিকিৎসা করে একটা যুবতী মহিলাকে চিরদিনের মত নিঃশব্দের জগতে ঠেলে দেয়ার মর্মান্তিক যন্ত্রণা বয়ে বেড়ানোর কষ্টের কথা নিবেদন করলেন।

তিনি আরো যোগ করলেন, ডাক্তার সফদার মুন্সির হঠকারিতার কারণে প্রিয়জনের কথাবার্তা, সংগীতের মূর্ছনা, আজানের সুমধুর ধ্বনি তার কর্ণ কুহরে কখনো প্রবেশ করবে না। এজলাসে উপস্থিত কারো কারো চোখের কোনে অশ্রুর আভাস দেখা গেল। হুজুর কিসিমের কয়েকজন সমস্বরে বলে উঠলেন মাশাআল্লাহ।

অ্যাডভোকেট রাফিসা স্মরণ করিয়ে দিলেন, বিদেশে ভুল চিকিৎসার জন্য কোটি কোটি টাকার মাশুল গুনতে হয়। ডাক্তারি লাইসেন্স বাতিল হয়। আমাদের দেশে কেস হয়, কিন্তু অন্য কোন ডাক্তার সাক্ষী বা মতামত দিতে এগিয়ে আসতে চান না।

এ সময় দর্শকদের গ্যালারি থেকে একজন ছোকরা টাইপের বালক বলে বসলো। Thief thief maternal brothers. চোরে-চোরে মাসতুতো ভাই।

ডাক্তারের উকিল, এডভোকেট রায়হান, মুন্সী বিচারকের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বললেন,
অবজেকশন ইউর অনার, এ লাড়কা ইংরেজি ভাষার গ্রামার না মেনে ডাক্তারি প্রফেশনের উপর কটুক্তি করেছে। তাকে আদালত থেকে বের করে দেয়ার জন্য আবেদন জানাচ্ছি।
–অ্যাডভোকেট মুন্সী, আপনার আপত্তি কি ডাক্তারদের সম্পর্কে মন্তব্যের কারণে না গ্রামার না মেনে ভুলভাল বলার কারণে?

–ইওর অনার, আজকাল গ্রামারের কেউ ধার ধারে না। যেভাবে মুখে আসে তাই বলে, বড় বড় পদে বসে যায়। আমার আপত্তি ডাক্তারি পেশা সম্পর্কে অশালীন মন্তব্য।

এবার ডাক্তার সাহেবকে জেরা করার পালা। অ্যাডভোকেট রাফিসা খানম জিজ্ঞেস করলেন,অপারেশনের আগে আপনি ভালো করে দেখেননি সমস্যাটি কোন কানে।

–তা কি আর দেখিনি? রোগীনির কানের কাছে মুখ নিয়ে কুহু শব্দ করলে তিনি হেসে দিলেন, কিন্তু কথা বললেন না। আরো কাছে গিয়ে কানের সাথে মুখ লাগিয়ে কুহূ করলে আবারও হাসলেন, কিন্তু মুখে কথা নেই। রোগিনীর যা মেজাজ, আরো ঘনিষ্ঠ হয়ে পরীক্ষা করার চিন্তা বাতিল করলাম। ধারণা করলাম সমস্যাটা ডান কানেই।

– এত টেস্ট-ফেস্টা করার পরেও রোগীনির কানে কুহু কুহু করে বোঝা লাগলো, কোন কানে অপারেশন করতে হবে? নাকি রোগীর রূপে মুগ্ধ হয়ে বেহাল হয়ে গিয়েছিলেন? দুঃখে হোক আনন্দেই হোক আমার মক্কেল ত মুখ খুললেই হাসি হাসি মনে হয়। সে কৃত্রিম হাসিতেই মজে গিয়ে এত বড় একটা ভুল করে বসলেন?

অ্যাডভোকেট রায়হান মুন্সি এক লাফে চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, অবজেকশন ইউর অনার, অবজেকশন। আমার মক্কেলকে নিয়ে হাসি তামাশা করা অবমাননাকর। তাঁর মন্তব্য রেকর্ড থেকে অপসারণ করার জন্য আবেদন জানাচ্ছি।

এবার বিচারক মুখ খুললেন, তা না হয় মানলাম, কিন্তু মহিলার হাসিতে ভুলে আপনার মক্কেল কি করে বুঝলেন তার ডান কান বন্ধ?
– ইউর অনার, স্পার্টার রানী বিশ্ব সুন্দরী হেলেনের মুখের হাসিতে মুগ্ধ হয়ে ট্রয়ের প্রিন্স প্যারিস তাকে অপহরণ করলে দুই রাজ্যের মধ্যে যুদ্ধ বেঁধে যায়। এমনকি সমৃদ্ধশালী ট্রয় নগরী ধ্বংস হয়ে যায়। মিশর সুন্দরী ক্লিওপেট্রার কথা নাইবা বললাম। তাকে কেন্দ্র করে জুলিয়াস সিজার এবং মার্ক এন্টনির কাহিনী সবারই জানা আছে।

চতুর অ্যাডভোকেট আরো যোগ করলেন, আমার মক্কেল রোগীর মিষ্টি হাসিতে যে বিচলিত হয়ে গিয়েছিলেন, সেই জন্য তাঁকে অভিযুক্ত করা যায় না। রোগিনী নিজেই তাঁর সর্বনাশা হাসি দিয়ে তাকে বিপদে টেনে এনেছেন।। আমি তাকে নির্দোষ বলে মামলা ডিসমিস করার জন্য আবেদন জানাই।

উকিল সাহেব তাঁর গলায় আবেগ চড়িয়ে বলতে থাকলেন, এ ধরনের অযথা মিষ্টি হাসি দিয়ে তানারা রোজ কত যে অঘটন ঘটাচ্ছেন তার হিসাব কে রাখে? যদি কাউকে অভিযুক্ত করতে হয় তাহলে ঐ মহিলাকেই করতে হবে।

দর্শকদের মধ্যে গুঞ্জন উঠলো, তাইতো অ্যাডভোকেট রায়হান ঠিকই বলেছেন। যত দোষ ঐ সুন্দরী রোগীনির।

জনতার মগজ ধোলাই করতে খুব বেশি কথা ব্যয় করা লাগে না। লাগসই একটি কথাতেই কুপোকাত। টার্গেট যদি সুন্দরী মহিলা হয়, তাহলে তো কথাই নেই। ফেসবুকের মন্তব্য কলাম হা-হা হি-হি’তে ভরে যায়।

এবার এডভোকেট রাফিসা মৃদু হাসি দিয়ে সমাপনী ভাষণ দিতে উঠলে বিচারক মহোদয় তাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, আজ থেকে আমার এজলাসে মহিলাদের হাসতে মানা। আমি আদেশ করছি, আদালতের বাইরে এ নির্দেশ টাঙ্গিয়ে দেওয়া হোক।

ইউর অনার,অ্যাডভোকেট রাফিসা পুনরায় তাঁর বক্তব্য শুরু করলেন, আপনি হাসতে মানা করলেও কাঁদতে নিশ্চয়ই বাঁধা নেই। আমার কান্না পাচ্ছে এ ভেবে, ইনার মত অল্প কয়েকজন অর্থ লোভী ডাক্তার হাসপাতাল খুলে এত টেস্ট-ফেস্ট করেও কুহু কুহু শব্দের ‌তরঙ্গের সাহায্যে রোগ নির্ণয় করার কারণে রোগীরা বিদেশে ছুটে যায়।

সুচতুর অ্যাডভোকেট, রাফিজা খানম, তার বক্তব্য মজবুত করার জন্য ফরেন এক্সচেঞ্জ সংকটের প্রসঙ্গটাও টেনে আনলেন। “আমাদের প্রবাসী ভাই বোনের কষ্টে অর্জিত ফরেণ এক্সচেঞ্জ ব্যয় করে হাজার হাজার মানুষ বিদেশে চিকিৎসার কারণে ডলার ক্রাইসিস লাগিয়ে দেয়। বিশ্বব্যাংকের কাছে ঋণের জন্য কাকুতি মিনতি করতে হয়। বিদেশে যাওয়ার খরচ পাতি, ঝক্কি ঝামেলা, ভিসা সংক্রান্ত জটিলতার কথা সবারই জানা আছে।”

পরিশিষ্ট

অনলাইন সংবাদপত্রে বিচারের রায় সম্পর্কে বিস্তারিত বিবরণ না দিলেও বুঝা গেল এবার ডাক্তার সাহেব অপচিকিৎসার কারণে ছাড় পাননি।
কত টাকা জরিমানা গুনতে হয়েছিল তার উল্লেখ না থাকলেও তাকে আপাতত মালয়েশিয়ায় সেকেন্ড হোম প্রকল্প স্থগিত করতে হয়েছিল। মামলার ব্যয় এবং ক্ষতিপূরণের অর্থ জোগাড় করতে নিজের গাড়িটাও বিক্রি করে দিয়েছেন।
এদিকে মেডিকেল কাউন্সিল ডাক্তার সফদার মুন্সিকে এক বছরের জন্য চিকিৎসা সেবা দেওয়া, এমনকি ডাক্তার নামে পরিচয় দেওয়ার উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে।
(নাম ও চরিত্র সবই কাল্পনিক।)

About Post Author

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Pin It on Pinterest