এই ভ্রমন কাহিনীটি লেখা হয়েছিল প্রায় ২০ বছর আগে বাংলাদেশের ডেইলি স্টার, এবং পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন এর ইনফ্লাইট ম্যাগাজিন ‘Humsafar’ এর জন্য। সে কাহিনী পালিশ করে, নয়া রংচং চড়িয়ে বাংলা ভার্সন যোগ করা হলো। যাদের ধৈর্য আছে চোখ বোলাতে পারেন।
কারাকোরাম মহাসড়কের সফরনামা
পাহাড়ের রাজ্য বলে কথা! পাকিস্তানের উত্তর প্রান্তে আকাশের নীলিমায় মহামিলন মেলায় আড্ডা জমিয়েছে বেসুমার আকাশ ছোঁয়া পাহাড়-পর্বত। দুনিয়ার সবচেয়ে ডাঙ্গর ১৪টি পর্বত শিখরের মধ্যে ৫টিই এ অঞ্চলে আসর জমিয়েছে। আকাশের বুকে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সবচেয়ে উঁচু কে-২ শৃঙ্গ; মাউন্ট এভারেস্টের পরেই দ্বিতীয় সর্বোচ্চ পর্বত শৃঙ্গ। এছাড়া, ২৩ হাজার ফুটের বেশি উচ্চ শৃঙ্গ রয়েছে ৫০টিরও বেশী। মেরু অঞ্চলের বাইরে বিশ্বের দীর্ঘতম হিমবাহের তিনটিই আস্তানা গেড়েছে এ অঞ্চলে।
পাহাড়-পর্বত, গ্লেসিয়ার (হিমবাহ) সমন্বয়ে গঠিত প্রাকৃতিক বৈচিত্র্যময় ভূখণ্ডের নাম গিলগিট-বালতিস্থান। পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল। আয়তনে বাংলাদেশের অর্ধেক, ৭৩,০০০ বর্গ কিলোমিটার, কিন্তু লোক সংখ্যা মাত্র ১৮ লক্ষ।
বালতিস্থানের উত্তর প্রান্তে জনবসতি শূন্য ২১ হাজার ফুট উচ্চ সিয়াচেন গ্লেসিয়ারের একাংশের মালিকানা নিয়ে মাঝে মাঝে দুই চির প্রতিবন্ধী ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধের দামামা বেজে ওঠে। রেডিও টেলিভিশনে জাতীয় সংগীত ধ্বনিত হয়, হতাহত হয় অনেকে। প্রচন্ড ঠান্ডায় মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে আরো অনেকে। এক সময় আবার নীরবতা নেমে আসে। ফিরে আসে না শুধু হতভাগ্য মৃত্যু সেনারা।
কারাকোরাম, পামির ও হিমালয় পর্বতমালার অসংখ্য পাহাড়-পর্বত ডিঙ্গিয়ে পাকিস্তান থেকে চীন পর্যন্ত বিস্তৃত গিরিপথটির নাম কারাকোরাম হাইওয়ে। গত শতাব্দীর শেষ প্রান্তে কনসালটেন্সি কাজের সুবাদে কারাকোরাম রাজপথ বেয়ে সে পাহাড়ের রাজ্য ভ্রমণ করার সুযোগ হয়। চীন আফগানিস্তান এবং কাশ্মীর বেষ্টিত জনপদের নাম ছিল নর্দান রিজিওন। কয়েক বছর আগে নতুন নাম হয়েছে গিলগিট-বালতিস্থান। রাজধানী শৈল শহর গিলগিট, ভ্রমণ পিপাসুদের আকর্ষণীয় গন্তব্য।
পাহাড়ের ফাঁকে, সিন্ধু নদীর বাঁকে বাঁকে ও দুর্গম মালভূমিতে বাস করে দারিদ্রক্লিষ্ট নানা জাতি উপজাতি। দেশের উন্নয়ন পরিকল্পনায় তাদের ভাগ্যে জোটে বঞ্চনা। পাকিস্তানের ধন সম্পদ, বিদেশি দান-খয়রাত কুক্ষিগত করে উপর তলার কিছু মানুষ। ধনতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় সোনার বাংলায়ও এ কালচার চালু হয়েছে।
বালতিস্থানে দারিদ্রের কষাঘাতে জর্জরিত জনপদের উন্নয়নের জন্য রোমভিত্তিক একটি আন্তর্জাতিক সংস্থার আর্থিক সাহায্য দিতে সম্মত হয়েছে। সাহায্যের অর্থ ব্যবহারের সম্ভাব্যতা ও প্রণালী যাচাই মিশনের সদস্য হিসাবে পাহাড়ের রাজ্যে এ ভ্রমণের আয়োজন।
ইসলামাবাদে পাকিস্তান সরকারের সাথে প্রকল্পটি সম্পর্কে ব্রিফিংয়ের সময় জানা গেল আমাদের গিলগিট যেতে হবে কারাকেরাম হাইওয়ে দিয়ে। আকাশের বুক চিরে পাহাড় পর্বতের দুর্গম পথে ভ্রমণের কথা শুনে সদস্যদের মনে যুগপৎ রোমাঞ্চ ও শির দাঁড়ায় ভীতির শিহরণ বয়ে গেল ।
আমাদের গন্তব্য, ইসলামাবাদ থেকে ৪০০ কিলোমিটার দূরে গিলগিট, অঞ্চলটির রাজধানী। বাহন জাপানের তৈরি ফোর-হুইল ল্যান্ড ক্রুজার। প্রায় আকাশের কোল ঘেঁষে যেতে হবে চিন্তা করে মিশনের সদস্যরা আদর করে বাহনটির নাম দিল পঙ্খিরাজ।
পাহাড় পর্বতের উপর দিয়ে গাড়িতে বসে সবেমাত্র ভয় মিশ্রিত রোমাঞ্চ অনুভব করতে শুরু করেছি, তখন পঙ্খিরাজ হঠাৎ কয়েকবার হাঁচি এবং বার তিনেক কাশি দিয়ে পরিশেষে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে নিশ্চুপ হয়ে গেল। এলাকাটির নাম কোহিস্থান, আক্ষরিক অর্থে পাহাড়ের দেশ। উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের একটি জেলা। এখন প্রদেশটির নতুন নাম খাইবার-পাখতুনখোয়া।
এদিকে মরুভূমিসম ভূখণ্ডে সূর্য প্রচন্ড উত্তাপ ছাড়িয়ে পশ্চিমে অস্ত যাওয়ার আয়োজন করছে। কি দুর্ভাগ্য আমাদের? সবার মনে প্রশ্ন, বেরসিক পঙ্খিরাজ বিকল হওয়ার আর কোন জায়গায় খুঁজে পেল না?
বলা হয়, যেখানে বাঘের ভয় সেখানে সন্ধ্যা হয়। কোহিস্থানের নির্জন গিরি কান্তারে বাঘ না হোক, নিশাচার জন্তু-জানোয়ার রাতের বেলা ডিনারের খোঁজে হানা দিবে কিনা তাই বা কে জানে? তার চেয়ে ভয়ংকর, দর্সু-তস্করের হাতে পৈতৃক প্রাণ হারাণোর ভয়।
কারাকোরাম মহাসড়ক শুরু হয়েছে ইসলামাবাদের দক্ষিণে এবোটাবাদ শহরের সন্নিকটে। এবোটাবাদ সেনা শহর। এখানে সপরিবারে লুকিয়ে ছিলেন ওসামা বিন লাদেন। সেখানে ফিল্মি কায়দায় অভিযান চালিয়ে আমেরিকান কমান্ডোরা তাঁকে হত্যা করে।
কারাকোরাম নানা বর্ণে সজ্জিত বিচিত্র একটা সড়ক বটে। সে মহাসড়কের গা ঘেঁষে একটা মধ্যম সাইজের গিরিশৃঙ্গে আটকা পড়লে কার না কলজে শুকিয়ে যায়?
এদিকে আমাদের পাঠান ড্রাইভার মোহাম্মদ ইয়াকুব খান আকন্ঠবিস্তৃত মুখে শিশুসুলভ সরলতা মেখে আনুষ্ঠানিকভাবে পঙ্খিরাজের জীবনলীলার সমাপ্তির ঘোষণা দিল। একটু থেমে চারিদিকে চোখ বুলিয়ে আহ্লাদে আটখানা হয়ে স্বীকারোক্তি দিল, “বাহনের সমস্যাটা কি হয়েছে তা আমিও জানিনা।” এদিকে পশ্চিম দিগন্তে সূর্য অস্তগামী। শ্বাপদসংকুল বিরান পাহাড়শৃঙ্গে রাত্রি যাপনের সম্ভাবনা চিন্তা করে দুর্বল বাঙালি হৃদয়ের হৃদয়ের স্পন্দন থেমে যাওয়ার কথা।
আমাদের বাহনের প্যাসেঞ্জার তালিকায় ছিল আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলের আবহ। টিম লিডার জার্মান কৃষি বিশেষজ্ঞ, একজন ব্রিটিশ ইঞ্জিনিয়ার, একজন আমার স্বদেশী বন-জঙ্গল বিশেষজ্ঞ কাতেবি সাহেব। এবং আমি– কাগজে কলমে ক্ষুদ্র ঋণ বিশেষজ্ঞ। ব্যাংকে বৃহদাকার ঋণ নিয়ে কারবার করেছি। ডক্টর ইউনূসের ক্ষুদ্র ঋণের কারিশমা আমার তেমন জানা নাই। ঢাকার কনসালটেন্সি এজেন্সি ভরসা দিল, বড় বড় ঋণ সম্পর্কে যখন অভিজ্ঞতা আছে, তখন ক্ষুদ্র ঋণের ব্যাপার-স্যাপার একেবারেই নস্যি। আইনস্টাইনের গোয়ালঘর তৈরির কাহিনীর মতো। মিস্ত্রিকে বললেন দুটো দরজা রাখতে। একটা বড়, গরু মহিষের জন্য, অন্যটা ছোট, ছাগল ভেড়ার জন্য। মিস্ত্রি বলল, বড় একটা দরজা হলেই তো চলে, গরু ছাগল সবই ঢুকতে পারবে। তিনি মেনে নিলেন, “তাই তো, ঠিকই বলেছ।” আইনস্টাইনকে নিয়ে কত যে গল্প চালু রয়েছে তার কোন ঠিক ঠিকানা নাই।
ব্যস, কন্সাল্টেন্সি এজেন্সির উপর ভরসা করে রাতারাতি ক্ষুদ্র ঋণের বিশেষজ্ঞ বনে গেলাম।
আর একজন বিশেষজ্ঞ আমাদের টিমে ছিলেন। নারী উন্নয়ন বিশেষজ্ঞ জার নিগার। ইদানিং আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো নারী উন্নয়নের গুরুত্ব অনুধাবন করে টিমে একজন নারী বিশেষজ্ঞকে অন্তর্ভুক্ত করা শুরু করেছে।
টিম লিডার জার্মান কৃষি বিশেষজ্ঞ চারিদিকে চোখ বুলিয়ে আমরা কোথায় আটকা পড়েছি তা আন্দাজ করার চেষ্টা চালাচ্ছেন। এ সময় পাঠান ড্রাইভার, আরেকটা স্বীকারোক্তি দিল, “এ হাইওয়েতে এবারই আমার প্রথম ট্রিপ।” তারপর সে উর্দু-পশতু মিশিয়ে বিড়বিড় করে কি যেন বলতে লাগলো যার মাথা মুন্ডু কোনটাই বুঝলাম না। পশতুভাষী পাঠান মহিলা বিশেষজ্ঞ তরজমা করে বুঝালেন, ড্রাইভার বলেছে “আমরা কোন ঠিকানা বিহীন অজানা মুল্লুক থেকে অন্তত একশো মাইল দূরে আটকা পড়েছি।” বলেই সে খালাস, কিন্তু আমাদের আর এক দফা হৃদকম্পন শুরুর পালা সূচিত হলো।
কয়েক দফা “Oh! No’, “My God” স্বগতোক্তি করে টিমের ব্রিটিশ সদস্য তার প্রকৌশল দক্ষতা প্রয়োগ করে পঙ্খিরাজের ইঞ্জিনে প্রাণসঞ্চারের চেষ্টায় লেগে গেলেন।
স্বদেশী ফরেস্ট বিশেষজ্ঞ কেতাবি সাহেব আদিগন্ত প্রসারিত মরুভূমিসম শুষ্ক প্রান্তরে কোথাও সবুজের চিহ্ন আছে কিনা তা আবিষ্কারে লেগে গেলেন। কিন্তু সে ভূখণ্ডে বছরে মাত্র গড়ে ৪ ইঞ্চি বৃষ্টিপাত হয়। সেখানে সবুজের চিহ্ন খুঁজে পাবেন কোথায়? কেতাবি সাহেব পবিত্র কেতাবের একনিষ্ঠ অনুসারী। বিপদ থেকে উদ্ধার করার জন্য একটু পর পর নফল নামাজ পড়ে সৃষ্টিকর্তার কাছে আবেদন জানাচ্ছেন।
টিম লিডার ভাববাদী দর্শনের প্রবক্তা হেগেল, কান্টের দেশ জার্মানের লোক। তিনি আকাশছোঁয়া পাহাড় পর্বতের পটভূমিতে বিরান মরুভূমির আজব ভূতাত্ত্বিক গঠনের দার্শনিক ব্যাখ্যা খুঁজছেন।
পাকিস্তানের উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত অঞ্চলের সুদর্শনা নারী বিশেষজ্ঞ জার নিগার পাহাড়ের ঢালে একটা বড় পাথরে আশ্রয় নিলেন। কি জানি কি মনে করে, আমাকে পাথরখণ্ডটি শেয়ার করার আমন্ত্রণ জানালেন। সম্ভবত তিনি একজন ভীত সন্ত্রস্ত বিদেশির মনে সাহস যোগাতে চেয়েছিলেন। পাঞ্জাবের দুইজন ইয়াং সদস্যের চোখে দেখা গেল ঈর্ষার আভাস।
ইতোপূর্বে পাঠান রমণীদের দেখেছি দূর থেকে, বেশিরভাগই পর্দার আড়ালে। যানবাহন বিভ্রাটের কারণে এবারই প্রথম একজন রক্তমাংসের পাঠান রমণীকে কাছ থেকে দেখার সুযোগ পাওয়া গেল। তাও বোরকা হিজাব ছাড়া।
“চিন্তা করো না”, নিগার অভয় বাণী শোনালেন। শুনেছিলাম পাঠানরা বিপদগ্রস্ত দুর্বল কাউকে, বিশেষ করে বিদেশীদের, বিপদ থেকে উদ্ধার করতে তাদের অফুরন্ত শক্তির কিছুটা হলেও ব্যয় করতে দ্বিধা করে না। তবে জানা ছিল না পাঠান মহিলারাও উদ্ধার কর্মে পিছিয়ে নেই।
আমাকে অভয় দিলেও আসন্ন বিপদের কথা চিন্তা করে তাঁর কপালেও দুশ্চিন্তার ভাঁজ দেখতে পেলাম। আমার এবার অভয় দেয়ার পালা। বললাম, ইনশাল্লাহ, আমরা ঘন্টাখানেকের মধ্যে আবার যাত্রা শুরু করতে পারবো। আমি ভাবি নাই, আমার রসিকতা করে বলা অভয়বানী নতুন ঝামেলা টেনে আনবে। নিগার আমাকে একজন গণক ঠাকুর ভেবে বসলেন। জিজ্ঞেস করলেন, তুমি আর কি কি ভবিষ্যৎবাণী করতে পারো। প্রমাদ গুনলাম। এরপর হয়তো বলবে, আমার হাত দেখে দাও। নিজের ভবিষ্যৎ জানার জন্য মানুষ, বিশেষ করে মহিলারা, বড্ড উদগ্রীব থাকে।
নিগার অসম সাহসী প্রতিবাদী নারী। পাঠান সমাজের নানাবিধ বিধি নিষেধের নিগড়ে স্বাধীনভাবে জীবন পরিচালনার জন্য বাঁধা হয়ে দাঁড়াতে দেননি। চিকিৎসক বাবার কন্যা, নিগারের এক সময় মনে হল, তাঁর জন্ম হয়েছে ফরেস্ট্রি পড়ার জন্য। কিন্তু পেশোয়ারে পাকিস্তানের একমাত্র ফরেস্ট্রি কলেজ কোন মহিলাকে ভর্তি করতে রাজি নয়। তাদের ধারণা, বনে জঙ্গলে মহিলাদের বিচরণ করা মোটেই নিরাপদ নয়। নিগার এত সহজে দামবার পাত্রী নয়। আমেরিকায় এক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফরেস্ট্রি সাবজেক্টে উচ্চ ডিগ্রী নিয়ে দেশে ফিরে আসেন। পাকিস্তানের একমাত্র ফরেস্ট্রি পোস্টগ্রাজুয়েট। তবে, আমাদের টিমে যোগ দিয়েছেন নারী উন্নয়ন স্পেশালিস্ট হিসেবে। স্বেচ্ছায় টিমের সদস্যদের বালতিস্থান জনপদের বিচিত্র সব কালচারের সাথে পরিচয় করার দায়িত্ব গ্রহণ করলেন।
ইতোমধ্যে, কাকতালীয়ভাবে গাড়ির ইঞ্জিন পুনরায় প্রান ফিরে পেয়ে সম্মিলিত করতালির মধ্যে পঙ্খিরাজ পুনরায় যাত্রা শুরু করার প্রত্যাশা জাগিয়ে তুললো।
কারাকোরাম হাইওয়েকে বলা যায় প্রাচীন যুগের সিল্ক রোডের আধুনিক সংস্করণ। চীনা-পাকিস্তান সংস্করণ বলাই উচিত। সুদূর অতীতে এ বিপদ সংকুল বিখ্যাত সিল্ক রোড আধুনিক সিরিয়ার কোন এক ভূমধ্যসাগরীয় বন্দর পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। আন্ত মহাদেশীয় বণিকেরা চীনের জিয়ান প্রদেশ থেকে সিল্ক, মনিরত্ন এবং মসলা বোঝাই বাণিজ্য বহর নিয়ে সে বন্দরে পৌঁছে দিত। আধুনিক কারাকোরাম মহাসড়কের পাশাপাশি ভগ্নদশা পুরনো সিল্ক রোড এখনো এঁকেবেঁকে পাহাড়-পর্বতের শিরা বেয়ে নয়া সড়ককে সঙ্গ দিয়ে চলেছে।
গিলগিটের উদ্দেশ্যে ইসলামাবাদ থেকে আমাদের রোলার কোস্টার পথচলা শুরু হয়েছিল সেদিন সকালে ব্রেকফাস্টের পর। সেখান থেকে পিচ ঢালা সড়ক বেয়ে ১২০ কিলোমিটার দূরে সিন্ধু নদের সাথে মোলাকাত হয়। মোলাকাত পর্ব শেষ হলে সড়কটি, এবং সে সঙ্গে আমাদের পঙ্খীরাজ, ক্রমশ উদ্ধমুখী হয়ে পর্বতারোহনের দিকে মনোযোগ দেয়। শুরু হয় পৃথিবীর ছাদের উপর দিয়ে ভ্রমণের শিহরণ।
সে পয়েন্ট থেকে কারাকোরাম মহাসড়ক সিন্ধু নদের সাথে হাতে হাত মিলিয়ে, বরং বলা উচিত কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে, উত্তরমুখী কয়েক শত কিলোমিটার অভিযান শেষে গিলগিট থেকে ৪০ কিলোমিটার দূরে সিন্ধু নদকে বিদায় জানিয়ে চীন মুখী অভিযান অব্যাহত রাখে। সিন্ধু নদীর সাথে গাঁটছড়া বেঁধে পথ চলার কারণে সন্দেহ হচ্ছিল, মহাসড়কটি হয়তো সিন্ধু নদের জন্মভূমির খোঁজে বেরিয়েছে।
বাস্তবে, কোন সরোবর বা একটিমাত্র উৎস থেকে সিন্ধু নদের জন্ম হয়নি।
পাহাড় পর্বত থেকে উত্থিত অসংখ্য জলধারা সিঞ্চন করে তরঙ্গ-বিক্ষুব্ধ সিন্ধু নদকে পরিপূর্ণতা দিয়েছে।
গিলগিটে এসে কারাকোরাম সিন্ধু নদকে বিদায় জানিয়ে একে একে নয়া তিনটি সঙ্গী গিলগিট, হুন্জা ও অন্য একটি নদীর সাহচর্যে কারাকোরাম রেঞ্জের আকাশছোঁয়া উচ্চতায় অভিযান চালাতে থাকে।
কোহিস্থান, বালতিস্থানের বুক চিরে একে বেঁকে ৪,৭৩৩ মিটার উচ্চতায় খুন্জেরাব গিরিদ্বার অতিক্রম করে চীনের ভূখণ্ডে প্রবেশ করে। গিরিদ্বারটি পৃথিবীর সর্বোচ্চ পিচঢালা রাস্তার দু দেশের সীমান্তের গিরিপথ।
খুঞ্জেরাব থেকে মহাসড়কটি মধ্য এশিয়ার পামির মালভূমির মধ্য দিয়ে চীনের শিন জিয়াং প্রদেশের প্রাচীন মরুভূমি শহর কাশগড় পৌঁছে সমাপ্তি টানে।
কারাকোরাম মহাসড়ক নির্মাণে প্রকৌশল প্রয়োগের উৎকর্ষতার একটা চমৎকার নমুনা। পাকিস্তান এবং চীনা সেনাবাহিনীর প্রকৌশলীরা ১৯৬৬ থেকে ১৯৭৮ সাল নাগাদ বিশ বছর ধরে বিস্ময়কর মহাসড়কটি নির্মাণ করেছে। তবে, মাশুল গুনতে হয়েছে অনেক মানুষের জীবন এবং অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের বিনিময়ে। সরকারী তথ্য অনুসারে, বিশাল কর্মযজ্ঞে ৮১৯ জন পাকিস্তানি এবং ৮২ জন চীনা প্রকৌশলী এবং নির্মাণ শ্রমিক তাদের জীবন দিয়েছে। জানা গেল, সড়কের প্রতি কিলোমিটারের জন্য গড়ে একজন মানব সন্তানকে জীবন বিসর্জন দিতে হয়েছে। সড়কে নিয়মিত বিরতিতে মৃত্যু প্রকৌশলী ও নির্মাণ কর্মীদের স্মরণে সহকর্মীরা প্রস্তর ফলক স্থাপন করে রেখেছে।
সবুজ ব-দ্বীপ সমভূমিতে অভ্যস্ত আমাদের চোখে, ধূসর বর্ণের প্রস্তরপূর্ণ পাহাড়, গভীর গিরিখাত এবং অশান্ত সিন্ধু নদের উপর দিয়ে যাত্রা স্বপ্নের দেশে ভ্রমণের মতো মনে হয়েছিল। তবে, খাড়া পর্বতের ঢাল বেয়ে ল্যান্ড রোভার যতই উপরে উঠছে, আমাদের স্বপ্নগুলো দুঃস্বপ্নে পরিণত হতে
লাগলো।
আমাদের দুঃসাহসী পাঠান ড্রাইভারের মুখে কিন্তু কোন ভীতির লক্ষণ দেখা গেল না। গাড়ির গিয়ার এবং তার মুখের অভিব্যক্তি কোনটাই পরিবর্তন না করে সড়কের কড়া বাকগুলো একই স্পিডে অতিক্রম করে চলেছে। সড়কের কিনারে কয়েক ইঞ্চি দূরে দেখা যায় কয়েক হাজার মিটার নিচে সিন্ধু নদের জলধারার রুপালি রেখা। গাড়ির চাকা পিছলে গভীর খাদে পড়লে নশ্বর অস্তিত্বের অবসানের ষোল আনা সম্ভাবনা। লাশ খোঁজার মিশন নিয়ে গঠিত এনজিওর হয়তো সময় লাগবে সপ্তাহ খানেক।
ক্রমাগত ভয়ের সাথে বাস করে ভয়ও ক্রমশ ফিকে হতে থাকে। ভয়কে দূরে ঠেলে দিয়ে সড়কের দুপাশের দৃশ্য উপভোগের দিকে মনোযোগ দিলাম। আপাতত আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে চলেছে ইয়াকুবের বেপরোয়া ড্রাইভিং স্টাইল। কৌশলটি আকর্ষণীয় হলেও আমাদের জন্য মোটেই স্বস্তিদায়ক নয়। আফটার অল, মহাসড়ক থেকে গভীর খাদে যানবাহন পতনের সংবাদ মোটেই নতুন ঘটনা নয়।
সকাল গড়িয়ে দুপুর আসে, তারপরে বিকেল। ল্যান্ড-ক্রুজার মালভূমি থেকে পাহাড়ের পাদদেশে, চূড়া থেকে সুড়ঙ্গে এবং আবার মালভূমি পার হয়ে এগিয়ে চলে। পথে কিছু ক্ষয়িষ্ণু পাহাড়ী বনের চিহ্ন ব্যতীত সমগ্র ভূখণ্ডে, যতদূর চোখ দেখা যায়, বিস্তীর্ণ ভূখন্ডে অনুর্বর পাহাড়ের চূড়া ছাড়া আর কিছু নজরে আসে না।
উত্তরমুখী পথ পরিক্রমায় ক্রমশ দৃষ্টিগোচর হতে থাকে সংকীর্ণ চারণভূমি বা পাহাড়ের ঢালে খাঁজ কেটে তৈরি সরু সরু জুম চাষের কৃষিজমি, ছোট ছোট মানব বসতি।
কোথাও দেখা যায় কোন মহিলা পাহাড় ডিঙ্গিয়ে অতি অতি দূরের পথ হেটে চলছে জ্বালানি কাঠ এবং পানি সংগ্রহের জন্য। নারী উন্নয়ন বিশেষজ্ঞ জার নিগার এ অঞ্চলে আগেও এসেছিলেন। জানালেন, বিপজ্জনক পাহাড়ি পথ পেরিয়ে দূরের জঙ্গল বা নীচের নদী থেকে জ্বালানি বা জল সংগ্রহ করতে কয়েক ঘন্টা, এমনকি পুরো দিন লেগে যায়। বড্ড কঠিন জীবন পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর।
আমরা উত্তর দিকে অগ্রসর হওয়ার পথে ক্রমশ গাছপালা, উর্বর উপত্যকা, আলপাইন বন এবং ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র গুচ্ছগ্রাম দৃষ্টিগোচর হতে লাগলো। দূরে নজরে এলো তুষারাবৃত রাজকীয় K-2 এর রূপরেখা আপন মহিমায় দীপ্তি ছড়াচ্ছে।
কারাকোরাম রেঞ্জের শেষ প্রান্তে এক অবাক করা দৃশ্য দৃষ্টিগোচর হল। একটি বিন্দুতে সূচনা (নাকি শেষ?) হয়েছে কারাকোরাম, হিমালয় এবং পামির পর্বতমালা। তিনটি ছোট ঢিবি তিনটি বিশাল রেঞ্জের প্রতিনিধিত্ব করার জন্য একটি ত্রিভুজাকারে দাঁড়িয়ে আছে। টিমের সদস্যদের ক্যামেরা একযোগে ক্লিক করে উঠলো।
প্রায় ষোল ঘণ্টা, রবি ঠাকুরের ভাষায়, “অন্ত বিহীন পথ”পেরিয়ে অবশেষে আমরা গিলগিটে পৌঁছলাম। অবিশ্বাস্য সে ভ্রমণের একটি মিষ্টি অনুভূতি এখনো স্মৃতির পটে বারবার ভেসে ওঠে।
