October 29, 2025

বাংলাদেশ একাল ও সেকাল

ব্রিটিশ শাসনের অবসানের পর ভারত পাকিস্তান ও বাংলাদেশের জীবনযাত্রার মান অনেক গুণ বেড়েছে। যেমন, বিশ্ব ব্যাংকের পরিসংখ্যান অনুযায়ী ১৯৬০ সালে সমগ্র পাকিস্তানের মাথাপিছু আয় ছিল ৮৯ ডলার। সে তুলনায় বাংলাদেশে ২০২০-২০২১ প্রান্তে সেটা বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ২০০০ ডলার। বৃদ্ধির পরিমাণ ২২ গুন‌। দুই যুগ আগেও বাংলাদেশের ৫০-৬০% জনগণ দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করত, এখন ১০% ও নিচে।

১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের আগে অখন্ড ভারতে মানুষের গড় আয়ুষ্কাল ছিল মাত্র ৪৯ বছর। ৫০ বছরের চেয়ে বেশি খুব কম লোকজনই দেখা যেত। বিশ্ব ব্যাংকের সর্বশেষ পরিসংখ্যানে দেখা যায় বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭৩ বছর, পাকিস্তানের ৬৭ বছর।
শিক্ষার ক্ষেত্রে অখন্ড ভারতের সাক্ষরতার হার ছিল মাত্র ১২%। বাংলার মুসলমানদের শিক্ষার হার ছিল একান্তই নগণ্য।

মানুষের স্মৃতি বড্ড ধোঁকা দেয়। বয়োবৃদ্ধদের বলতে শোনা যায় ব্রিটিশ আমল ভালো ছিল। মধ্যবয়সীদের কাছে ভালো ছিল পাকিস্তানী আমল। তরুণদের তো কথাই নেই, হাতে লাখ টাকার আইফোন মুখে আফসোস অভাব অনটনের, হাল ফ্যাশনের পোশাক পরিচ্ছদ, বিদেশে পড়ালেখার জন্য যাওয়ার আকাঙ্ক্ষা।

তবে এ কথা ঠিক, জীবনযাত্রার মান উন্নত হলেও মনের প্রশান্তি বাড়েনি, ভূলুণ্ঠিত হয়েছে মূল্যবোধ, স্বার্থপর চিন্তাভাবনা প্রকট হয়েছে, ধন সম্পদ জড়ো করা কেন্দ্র করে ইঁদুর ‌দৌড় শুরু হয়ে গেছে। চারিদিকে নাই নাই, আরো চাই, আরো চাই স্লোগান, মানববন্ধন, মিটিং-মিছিল, হরতাল-অবরোধ।

গ্রামের আশী-নব্বই ভাগ লোকই পাঁচ ছয় হাজার বছর আগের ব্রোঞ্জ বা নিওলিথিক যুগ থেকে খুব একটা এগোয়নি। আশী ভাগ লোক তাদের জন্ম স্থান থেকে পনেরো কিলো মিটার দুরের খবরও রাখার প্রয়োজন অনুভব করত না। মহিলাদের পৃথিবী সীমাবদ্ধ ছিল ‘খিড়কি থেকে সিংহ দুয়ার’ পর্যন্ত।

গ্রামের লোকের জীবন আবর্তিত হতো কৃষিকাজকে সম্বল করে। কিন্তু নিজের জমি কয়জনেরই বা ছিল? পরের জমিতে উদয়াস্ত খেটে যে টুকু ভাগ পেত তা বছরের অর্ধেক না পেরোতেই ফুরিয়ে যেত। কোন বছর বন্যা বা খরা হলে ত কথা নেই।‌ কোথাও কাজ জুটত না। জুটলেও পেটে ভাতে খাটতে হত; মজুরি পাওয়া যেত না বললেই চলে। বন থেকে কচু ঘেচু বা জলাভূমি থেকে শাপলা শালুক কুঁড়িয়ে কোন রকম দিন কাটিয়ে দিত।

চাল ডাল তখন সস্তা ছিল বটে কিন্তু কিন্তু লোকজনের ক্রয় ক্ষমতা, অর্থনীতিবিদ আমর্ত সেনের ভাষায় এন্টাইটেলমেন্ট, ছিল কম। চার-ছয় আনা সের চালের দামের যুগেও এন্টাইটেলমেন্ট যোগাড় করতে না পারায় অনাহারে ও অপুষ্টিতে লোক মারা যেত হাজারে হাজারে।

বেশীর ভাগ লোকজন লুঙ্গি পরে ঘাড়ে গামছা রেখে দিব্যি যত্রতত্র ঘুরে বেড়াত। জুতো পায় দেয়ার রীতি ছিল না বললেই চলে। অবস্থাপন্ন ঘরের লোকদের জুতো স্যান্ডেল থাকলেও তা সব সময় পরা হত না। গরীব ঘরের লোকেরা অনেক সময় তাদের কাছ থেকে জুতা ধার করে আত্মীয়স্বজনের বাড়ী যেত। তবে, ক্ষয় রোধ করতে শর্ত থাকত, পুরো পথ জুতো পায়ে দিয়ে যাওয়া যাবে না, আত্মীয় বাড়ীর খুব কাছে যেয়ে কোন পুকুরে পা ধুয়ে পরতে হবে।

আমাদের গ্রাম থেকে মাইল চারেক দূরে বাজারে হাটের দিনে কয়েক হাজার লোক সমাগম হত। বেশির ভাগ লোকের পরনে লুঙ্গি বা ধুতি, গা খালি, ঘাড়ে গামছা, পা নাঙ্গা। দু’চার জন উচ্চ শ্রেণীর লোকের পায়ে জুতা দেখা যেত। সাধারণ মানুষের কাউকে জুতো পরে আসতে দেখলে তাঁরা টিপ্পনী কাটতেন, পায়ে জুতা কেন, শরীর খারাপ করেনি ত?

দিন বদলেছে। এখন সে বাজারে বেশীর ভাগ লোকজনই জিন্সের প্যান্ট, অক্সফোর্ড জুতা, বাহারে জামা কাপড় পরে আনাগোনা করে। দাপিয়ে বেড়ায় বলাই ভাল। পাকিস্তান আমলে অবস্থার খুব বেশি হেরফের হয়েছিল তা নয়। ক্ষমতাসীনদের উন্নয়ন কর্মকান্ড সিংহ ভাগই সীমিত ছিল পশ্চিম পাকিস্তানে। বাঙ্গালীদের ছিটেফোঁটা নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হত।
তবুও, ব্রিটিশ ও পরবর্তীতে পাকিস্তান আমলের অনাহারক্লিষ্ট দিনগুলোর কথা বেমালুম ভুলে গিয়ে সে ভুখা-নাঙ্গা মানুষের অনেকেই আফসোস করেন, আহ, কি সস্তার দিনই না ছিল। এ জন্যই বলা হয় অতীতে পণ্যের মূল্য মানুষ মনে রাখে কিন্তু ভুলে যায় তার আয় কত ছিল। অর্থনীতিবিদরা এ ধরণের বিভ্রমকে বলেন ‘মানি ইলুশন’।

রোগ বালাইয়ের ধ্বংস যজ্ঞ

বসন্ত ঋতুতে প্রায় মহামারী লেগে যেত। কলেরা ও বসন্ত কোন কোন বছর গ্রামের লোক সংখ্যা প্রায় অর্ধেকে নামিয়ে দিয়ে বিদায় নিত।

রোগের উৎস সম্পর্কে অনেকেরই ধারণা ছিল না। রোগীর ব্যবহৃত কাপড় চোপড় আশে পাশের জলাশয়ে ধোঁয়ার কাজ সেরে নিত। সেখান থেকে ছড়িয়ে পড়ত সারা গাঁয়ে। প্রতিদিন ঘরে ঘরে কান্নার রোল উঠত। কলেরা বসন্তের দাপট শেষ হলে দেখা যেত গাঁয়ের জনসংখ্যা কয়েক শ’ কমে গেছে। কোন কোন জনবসতি প্রায় উজাড় হয়ে যেত। এ অবস্থাকে বলা হত পুষ্কর। শব্দটি কোন বাংলা অভিধানে খুঁজে পেলাম না। কোন বিদেশী ভাষার অপভ্রংশ হবে হয়তো।

অসুখ বিসুখে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই পানি পড়া কিম্বা ঝাড়ফুঁক ছিল প্রধান ভরসা। খাওয়ার স্যালাইন তখনও আবিষ্কার হয় নাই। সাধারণ স্যালাইনের ইনজেকশন ছিল কিন্তু খুব অল্প লোকেরই তা কেনার সামর্থ্য ছিল।

কাছে ধারে ডাক্তারই বা কোথায় পাওয়া যাবে? দূর কোথা থেকে ডাক্তার ডেকে আনার আগেই বেশির ভাগ রোগী শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করত। এ কারণেই হয়ত মাস্টার সাহেবরা পাস্ট পারফেক্ট টেন্সের উদাহরণ দিতে ট্রান্সেলেসন লিখতে বলতেন, ‘ডাক্তার আসিবার পূর্বেই রোগী মারা গেলো’।

এখন ঢাকা শহরে অবশ্য বড় বড় ডাক্তার সাহেবদের সাথে অ্যাপয়েন্টমেন্ট পেতে দু’ তিন মাস অপেক্ষা করতে হয়। তত দিনে হয় রোগী নয় ডাক্তার কিংবা দু’জনই ‘আল্লাহ্‌ কা পেয়ারা’ হয়ে যেতে পারেন।

দরিদ্র জনগোষ্ঠীতে যত অভাবই থাকুক, কুসংস্কারের অভাব থাকে না। হিন্দুদের ওলা দেবি ওরফে মুসলমানদের ওলা বিবি নামক কোন এক অশরীরী রহস্যময়ী নারী নাকি কলেরা রোগের দায়িত্বপ্রাপ্ত। ভয়ে কেউ কলেরা শব্দ উচ্চারণ করত না।

ওলা বিবিরা নাকি সাত বোন; প্রত্যেকের জন্য বরাদ্দ এক একটি রোগের পোর্টফলিও। বড় জন অপেক্ষাকৃত কম ডেঞ্জারাস, তিনার পোর্টফলিও হাম রোগ। অন্য একজন শীতলা দেবী স্মল পক্স বা গুটি বসন্তের দায়িত্বে নিয়োজিত। নামে স্মল হলেও কাজ কর্মে খুবই বিগ। তবে, একটুখানি রক্ষে এই যে তিনার একটা চোখ ছিল অন্ধ।

ঋতুরাজ বসন্ত শুরু হলেই তানারা ছদ্মবেশে লোকালয়ে রেকি করে কোথায় আক্রমণ করতে হবে সে সম্পর্কে প্লান প্রোগ্রাম আটতে থাকেন বলে জনশ্রুতি ছিল। তাই, অপরিচিত কোন লোক দেখা গেলে চারিদিকে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ত। একচোখা মহিলা হলে ত কথাই নেই। অনেক ক্ষেত্রে তাঁকে জনতার রুদ্র রোষে প্রাণ দিতে হত।

যে সময়ের কথা বলছি তখন ব্রিটিশ সরকার এ দেশে প্রতি গ্রামে একজন দফাদার নিয়োগ দিতেন। থানা থেকে খাকী রঙ্গের জামা, কোমরের জন্য চামড়ার চওড়া বেল্ট, জামার উপর আড়াআড়ি পরার জন্য লাল কাপড়ের ক্রস বেল্ট সাপ্লাই করত। লুঙ্গির উপর সরকারি তকমার প্রতীক বেল্ট ফেল্ট পরলে তাকে জোঁকার বলে মনে হত। তবুও, সে বিলাতের মহামান্য রাজা কিংবা রানীর প্রতিভূ; লোকজন সমীহ করেই চলত। সরকার থেকে বেতন কড়ি তেমন দিত বলে হয় না।‌ এ বাড়ি, সে বাড়ী থেকে আলুটা মুলোটা যোগাড় করে সংসার চালাতেন।

তার দায়িত্ব ছিল গাঁয় চুরি, ডাকাতি বা খুনখারাবী হলে থানায় জানানো, থানার লোকজন গ্রামে অপরাধের তদন্তে এলে সহযোগিতা দেয়া।
কলেরা বসন্তের বাহক ভগ্নীদ্বয়কে গ্রামে ঢুকতে বাঁধা দেয়ার বাড়তি দায়িত্ব ছবদু দফাদার স্বেচ্ছায় নিজের ঘাড়ে নিয়েছিলেন। রাতের বেলা গ্রামের লোকদের শুনিয়ে অতি উচ্চস্বরে অবোধ্য মন্ত্র-টন্ত্র, দোয়া-দরূদ পড়ে গ্রামের চার পাশে ঘুরে সকল প্রবেশ দ্বারে এক অদৃশ্য দেওয়াল তুলে দিতেন। এ সিস্টেমকে বলা হত ‘রণ’ দেয়া। দুষ্ট বোনেরা নাকি সে দেওয়াল টপকে গ্রামে ঢুকতে পারে না।

কোন কোন দিন তিনি শুনিয়ে যেতেন ভগ্মীদ্বয়কে মধুমতী নদীর ওপারে তাড়িয়ে দিয়ে এসেছেন। তবুও, দুষ্ট দেবীদ্বয় গাঁয়ে ঢুকত এবং সারা গ্রীষ্ম-বসন্ত তাণ্ডব চালাতে থাকত।

সব ধর্মে এ সব আচার অনুষ্ঠানের একটা বাণিজ্যিক দিক থাকে। ‘রণে’র জন্য আমাদের বাড়ী থেকে তাঁকে দেয়া হত পাঁচ সের চাল, কিছু ডাল ও রান্না-বান্নার অন্যান্য উপকরণ। এ সব নাকি ওলা ও শীতলা দেবীদের তাড়ানোর মোক্ষম দাওয়াই।

বেরসিক বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তৎপরতায় গুটি বসন্ত পৃথিবীর বুক থেকে বিদায় নিয়েছে আর ওরস্যালাইনের কল্যাণে উলা দেবী দুর্বল হয়ে যাওয়ার কারণে ছবদুরা এখন বেকার। তবে, একবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকে এসেও সেই ট্রাডিশন সমানে চলছে। অফ পিক আওয়ারে টিভি চ্যানেলে ঝাড়ফুঁক,স্বপ্নে পাওয়া ওষুধ, তাবিজ কবজের মহিমা শুনিয়ে অর্বাচীন জনগোষ্ঠীর পকেট কাটার ফন্দি-ফিকির থেমে নাই।

তবুও জীবন চলত আপন গতিতে। মাঠের ফসল, খাল বিল পুকুরের মাছ, বাড়ির পাশে সবজী দিয়ে কায়ক্লেশে বেশির ভাগ লোক দিন গুজরান করত। পাট বা অন্যান্য অর্থকরী ফসল বাজারে বিক্রি করে কাপড় চোপড়, তেল সাবান ও সংসারের অন্যান্য টুকিটাকি প্রয়োজন মিটত। তখনকার গ্রামে বাণিজ্যিক চিন্তাধারা তেমন ঢুকে নাই। নন-মনিটাইজড গ্রামীণ অর্থনীতিতে অর্থের ব্যবহার ছিল খুবই কম।

শাক-সবজি কিনতে বাজারে যাওয়া লাগত না। তা নিজের বাগানে থাকলে ভাল, না থাকলে পাড়া প্রতিবেশীর বাগান ত’ আছেই। খাল বিল পুকুরের মাছ পয়সা দিয়ে কেনার প্রয়োজন পড়ে না। এ সব পাওয়া না গেলেই বা ক্ষতি কি? মাছ মাংস খেতেই হবে এ রকম ত’ কোন গেজেটে লেখা নেই।

অভাব ছিল কিন্তু অভাব বোধ ছিল কম। অনেকেই বিদ্যুৎ দেখে নাই, রেডিও, টেলিফোন, মোটর গাড়ী, এমন কি রিক্সা পর্যন্ত দেখে নাই। কাজেই তার অভাব-বোধ জন্মে কি করে?

প্রেসিডেন্ট ওবামা তাঁর আত্মজীবনীতে লিখেছেন, তিনি যখন তাঁর পিতার জন্মভূমি কেনিয়ায় বেড়াতে যান তখন কেনিয়ায় তাঁর এক ফুফু আফসোস করেছিলেন—কি যে সময় এলো বাবা, আগে যখন টেলিফোন, টেলিভিশন, ফ্ল্যাশ টয়লেট ছিল না তখন এগুলোর অভাব বোধও ছিল না। অভাব বোধ আমদানি করছে শহর থেকে আসা মানুষগুলো। এখন কারো বাড়ী টেলিফোন এলে টেলিফোনের অভাবে পাড়া প্রতিবেশীদের মধ্যে হা-হুতাশ লেগে যায়। ইউসুফ নামের তাঁর এক আত্মীয় একটা পুরনো আমলের রেডিও নিয়ে এলে গ্রামে একটা নূতন অভাব বোধের জন্ম নিয়েছে।‌

ওবামা তা স্বীকার করে লিখেছেন,“ … perhaps the idea of poverty had been imported to this place, a new standard of need and want carried like measle … by Yusuf’s archaic radio..”.

About Post Author

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Pin It on Pinterest