প্রায় এক হাজার বছরের দীর্ঘ সময়ের ব্যাপ্তিতে মিশরের ফারাওরা তাদের সমাধি হিসাবে পিরামিড নির্মাণ করার প্রথা চালু রেখেছিলেন। কয়েক হাজার পরেও মিশরব্যাপী সে বিস্ময় জাগানিয়া স্থাপনাগুলো এখনও স্বমহিমায় আকাশের বুকে মাথা তুলে মানুষের মনে অনেক প্রশ্নের জন্ম দিয়ে চলেছে। যে সব প্রশ্ন ঘুরে ফিরে মাথায় আসে তার মধ্যে রয়েছে কেনইবা পিরামিড নির্মাণ করা হয়, নির্মাণের জটিল কলা-কৌশল তারা কিভাবে রপ্ত করেছিল, এবং কেনই বা হঠাৎ নির্মাণ বন্ধ করে দেয়া হয়?
মিশরের দুইটি পিরামিড
আমরা তো দূরের কথা, মিশরের ফারাও বংশের শেষ সম্রাজ্ঞি বিশ্বসুন্দরী ক্লিওপেট্রা যখন সিংহাসন আরোহণ করেন তারও দেড় হাজার বছর আগে পিরামিড নির্মাণ বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। আমাদের মত মিশর সম্রাজ্ঞীর মনেও হয়তো প্রশ্ন জেগেছিল, পিরামিড তৈরি কেন বন্ধ করা হয়েছিল। ক্লিওপেট্রা এ সম্পর্কে কিছু লিখে রেখে যাননি। সম্ভবত তিনি নিজেও এ সম্পর্কে সন্দিহান ছিলেন। ভাই-ব্রাদারের সাথে সিংহাসন নিয়ে টানাটানি, গ্রীক সম্রাট জুলিয়াস সিজার এবং মার্ক অ্যান্থনির সাথে রেষারেষি, মাখামাখি, যুদ্ধ-বিগ্রহ নিয়ে তিনি বড্ড ব্যস্ত ছিলেন। পিরামিড নিয়ে মাথা ঘামানোর সময় কোথায়?
মিশরের ফারাওরা যুগ যুগ ধরে পিরামিডের নিচে তাদের দেহ রক্ষা করার ব্যবস্থা রেখে গিয়েছেন। সাক্কার অঞ্চলে সর্বপ্রথমে পিরামিড নির্মাণ শুরু হয় রাজা জোসের (Djoser)রাজত্বকাল (খ্রিস্টপূর্ব ২৬৩০ থেকে ২৬১১) সময়ে । এখন থেকে ৪৬০০ বছর আগে।
অনেক যুগ পেরিয়ে আবিদোস এলাকায় সর্বশেষ রাজকীয় পিরামিডটি নির্মাণ করা হয় রাজা আহমোসের রাজত্বকালে (খ্রিস্টপূর্ব ১৫৫০ থেকে ১৫২৫)।
এযাবত সমগ্র মিসরে ১৮০টি ছোট-বড় রাজকীয় পিরামিড চিহ্নিত করা গেছে। ফারাওদের শৌর্যবীর্য, সম্পদ প্রদর্শন এবং নিজেদের অনুসৃত ধর্মীয় বিশ্বাসের সাথে সঙ্গতি রেখে পিরামিডগুলো নির্মাণ করা হয়েছিল।
রাজা আহমোসের পর মিশর রাজাদের সমাধি সংরক্ষণের জন্য পিরামিড নির্মাণের ভাটা পড়ে। ফারাওরা বরং মিশরের প্রাচীন রাজধানী থিবসের অদুরে একটি উপত্যাকায় সমাধিস্থ হওয়ার দিকে ঝুঁকে পড়েন। উপত্যকার নাম ভ্যালি অফ কিংস। পুরাতন রাজধানী থিবসের বর্তমান নাম লাক্সোর, পর্যটকদের জন্য আকর্ষণীয় গন্তব্য।
ভ্যালি অব দ্য কিংস মিশরের প্রাচীন রাজধানী থিবসের অদূরে।
ভ্যালি অফ কিংসে সর্বপ্রথম রাজকীয় সমাধি নির্মাণ করা হয় রাজা থুমোসের আমলে (রাজত্বকাল খ্রিস্টপূর্ব ১৫০৪-১৪৯২)। তারপূর্ববর্তী রাজা আমেনহোটোপকেও (রাজত্বকাল খ্রিস্টপূর্ব ১৫২৪-১৪৯২) সে ভ্যালিতে সমাধিস্থ করা হয় বলে অনেকে মনে করেন। তবে, এ সম্পর্কে মিশর বিশেষজ্ঞদের মধ্যে মতবিরোধ রয়েছে।
মিশর রাজ আমেনহোটেপ রাজত্বকাল খ্রিস্টপূর্ব ১৫২৪-১৪৯২। সমাধিস্থল: ভ্যালি অফ কিংস ।
কেন পিরামিড নির্মাণ বন্ধ করে দেওয়া হয় সে সম্পর্কে নানা মুনির নানা মত। তবে, রাজকীয় সমাধির নিরাপত্তা নিয়ে দুশ্চিন্তা একটি বড় কারণ বলে মনে করা হয়।
প্রাথমিক পর্যায়ে প্রায় হাজার বছর নাগাদ, পিরামিড নির্মাণ করা হতো অত্যান্ত গোপনীয়তার সাথে, লোকচক্ষুর অন্তরালে, দূরের কোনো মরুভূমি অথবা পার্বত্য উপত্যাকায় পাথর খুদে। এত গোপনীয়তার কারণ ছিল রাজার সাথে তার সমাধিতে দেয়া প্রচুর মূল্যবান উপহার সামগ্রী যাতে চোর-তস্করদের হাতে না পড়ে। কিন্তু বাস্তবে, গোপনীয়তা সত্বেও কবর লুটেরারা এত বিশাল অবকাঠামো সহজেই বের করে ফেলত। প্রচলিত আইন কানুন, ধর্মবিশ্বাস কোন কিছুই তাদের লুটপাট থেকে বিরত রাখতে পারেনি।
পিরামিডের নিরাপত্তাব্যবস্থা যখন এত ঠুনকো, সে পরিস্থিতিতে ঢাকঢোল পিটিয়ে, রাজকোষ খালি করে বিশাল স্থাপনা নির্মাণ করার জন্য মিশরের রাজন্যবর্গ যুক্তি খুঁজে পেলেন না। তাঁরা বিকল্প ব্যবস্থার দিকে মনোযোগ দিলেন। তাদের ইঞ্জিনিয়ার এবং আর্কিটেক্টরা অনেক খুঁজে পেতে বের করলেন একটা পছন্দের লোকেশন, পরবর্তীতে যার নাম হয় ভ্যালি অব দ্য কিংস।
ভ্যালি অফ দ্য কিংসের প্রাকৃতিক গঠনের কারণে সেখানে রাজন্যবর্গের মরদেহ সমাহিত করার জন্য পছন্দের স্থান হিসেবে রাজা অনুমোদন দেন। প্রচন্ড ক্ষমতাবান রাজার বিরুদ্ধে তো কথা বলা যায় না।
ভ্যালি অফ কিংসের পর্বত চূড়াটাকে দেখতে অনেকটা পিরামিডের মতো মনে হয়। অনেক চড়াই-উতরাই পার হয়ে সেখানে যেতে হয়। কাজেই এ পিরামিড সাদৃশ্য উপত্যাকার নীচে রাজকীয় সমাধিস্থল হিসেবে ব্যবহৃত হতে থাকে। এ কারণে প্রত্যেক রাজার জন্য ভিন্নভাবে আলাদা একটি করে পিরামিড নির্মাণ করার প্রয়োজনীয়তা ফুরিয়ে যায়।
অন্য কারণ ধর্মবিশ্বাসের পরিবর্তন।
মিশরের ফারাও রাজারা পিরামিডকে মনে করতেন নশ্বর দেহ পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে চিরস্থায়ী আবাসের সিঁড়ি হিসেবে। সে কারণে এত শান শওকত, প্রচুর অর্থ ব্যয় করে পিরামিড নির্মাণের হিড়িক পড়ে গিয়েছিল।
কুসংস্কার চিরকাল টিকে থাকে না। মিশরীয়রা ক্রমশ বিশ্বাস করতে থাকে দীর্ঘ জটিল পথ পেরিয়ে রাজারা স্বর্গের সিঁড়িতে পা রাখতে পারবেন। সে যুক্তিতে ভূগর্ভে আঁকাবাঁকা রাস্তা তৈরি করে স্বর্গে পৌঁছানোর জন্য জটিল প্লান প্রোগ্রাম তৈরি করে ভ্যালি অব কিংসে রাজাদের সমাধি নির্মাণ করার প্রথা চালু হয়। নয়া ধর্ম বিশ্বাসের সাথেও এ নির্মাণশৈলীর মেলবন্ধন ঘটে।
বলাবাহুল্য, পিরামিড নির্মাণ অত্যন্ত ব্যয়বহুল। রাজাদের সম্পদ ও অফুরন্ত নয়। যুদ্ধ-বিগ্রহ এবং অন্যান্য কর্মকাণ্ডে অর্থ জোগান দেওয়া সম্ভব হয়ে ওঠে না। ঝড়ঝঞ্ঝা মহামারী দুর্ভিক্ষ সামাল দিতে হয়। তাছাড়া, এত দক্ষ কারিগর, আর্কিটেক্ট ইঞ্জিনিয়ার চাইলেই তো পাওয়া যায় না। এসব সীমাবদ্ধতার কারণে পিরামিড নির্মাণের চল উঠে যায়।
তবে, ব্যক্তিগত পর্যায়ে ধনবান ব্যক্তিবর্গ ছোট-বড় পিরামিড নির্মাণ অব্যাহত রাখে। মিশর ছাড়াও পিরামিড নির্মাণের কালচার নামিবিয়া এবং সুদানে ছড়িয়ে পড়ে। এমনকি, বিশাল আটলান্টিক মহাসাগর পেরিয়ে উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকায় ইনকা, মায়া, অ্যাজটেক, মাচুপিচু এবং অন্যান্য সভ্যতার আমলে অজস্র পিরামিড নির্মাণ করা হয় কলম্বাসের তথাকথিত আমেরিকা ‘আবিষ্কারের’ কয়েক হাজার বছর আগে।
