September 30, 2023

১৯৯৪ সালে আমেরিকান এক্সপ্রেস ব্যাংকের নিমন্ত্রণে আন্তর্জাতিক ব্যাংকিং সেমিনারে অংশ নেয়ার জন্য আমেরিকা ভ্রমণের সুযোগ আসে।

আগে বেশ ‌কয়েকবার বিদেশে যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল। একাই গিয়েছিলাম। এবার আমেরিকান এক্সপ্রেস সস্ত্রীক আহার ও বাসস্থানের ব্যবস্থা করেছে বলে জানায়। বিবিজানের আবদার, তাকে সাথে নিয়ে যেতে হবে।

সেমিনারের আয়োজক আমেরিকান এক্সপ্রেস আমাদের বাসস্থানের ব্যবস্থা করেছিল বিলাসবহুল ম্যারিয়ট হোটেলে। ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারের টুইন টাওয়ারের পাশে। এলাকাটির পোশাকী নাম লোয়ার ম্যানহাটন; বিশ্ব বাণিজ্য ও অর্থনীতির প্রাণ কেন্দ্র। বিশ্ব রাজনীতির দাবার ছকে কূটকৌশলের শিকার হয়ে টাওয়ার দুটি কালের গর্ভে হারিয়ে গেছে। সে‌ সঙ্গে প্রাণ কেড়ে নিয়ে গেছে ‌তিন হাজার মানব‌ সন্তানের, আহতদের সংখ্যা ছিল ২৫,০০০।

প্রথম যেদিন টাওয়ারের সাথে দৃষ্টি বিনিমকয় হয় সেদিন এক খন্ড হালকা সাদা রঙের মেঘ টাওয়ারের সাথে লুকোচুরি খেলছিল। মেঘ খণ্ডটি দূরে আটলান্টিকের বুক থেকে ডানা মেলে হয়তো অজানা কোন বার্তা নিয়ে আমেরিকা রওনা দিয়েছিল।

আটলান্টিক মহাসাগর থেকে উঠে আসা বার্তাবাহক মেঘটির পথ আগলে দাঁড়িয়ে ১৩০০ ফুট উচ্চ টুইন টাওয়ার। দলছুট অসহায় মেঘটি টাওয়ারের অলিগলি দিয়ে মুক্তির পথ খুঁজে ফিরছে। কিন্তু টাওয়ার তাকে ছাড়তে চাইছে না; তার ইচ্ছা আরো কিছুক্ষণ লুকোচুরি চালিয়ে যেতে।

পথ হারা সে শুভ্র মেঘ খন্ড ও টাওয়ারকে ঘিরে বেশ কিছু স্মৃতি এত দিন পরেও মনের কোণে জমা রয়ে গেছে। নিউইয়র্ক আবার কখনো যাওয়া পড়লে দূ’ চক্ষু বিস্ফারিত করেও দেখা মিলবে না আকাশ ছোঁয়া প্রত্যয় নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা জমজ টাওয়ার।

নিউইয়র্ক দ্বীপের দক্ষিণ প্রান্তে লোয়ার ম্যানহাটন অঞ্চলটি ব্যবসা বাণিজ্যের প্রাণ কেন্দ্র; পৃথিবীর অঘোষিত বাণিজ্যিক রাজধানী। এক মাত্র ম্যানহাটন এলাকার জিডিপি বছরে ৬০০ বিলিয়ন ডলার; আমাদের ১৭ কোটি লোকের দেশের প্রায় দ্বিগুণ। পুরো নিউইয়র্কের জিডিপি ২,৬০০ বিলিয়ন ডলার।

নিউ ইয়র্কে রয়েছে পৃথিবীর সব চাইতে বেশি আকাশ ছোঁয়া দালান কোঠা। গত শতাব্দীর ত্রিশ দশকে নির্মিত ১০৪ তলা এম্পায়ার স্টেট বিল্ডিং প্রায় চার দশক ধরে পৃথিবীর সবচেয়ে উঁচু ভবনের গৌরব বহন করে চলছিল।

তার স্থান দখল করে নেয় ১৯৭৩ সালে নির্মিত ১১০ তলা টুইন টাওয়ার। টাওয়ারের উচ্চতা ছিল প্রায় ১৩০০ ফুট, সে সময়ের উচ্চতম ভবন। দিনের বেলা টাওয়ার দুটিতে জনসমাগম ঘটত প্রায় পঞ্চাশ হাজার লোকের। তাদের ব্যবহারের জন্য লিফটের সংখ্যাই ছিল ১৯৮টি। ছোটখাট একটা শহর বৈকি।

একজন জাপানি স্থপতিবিদ এর নকশা তৈরি করেছিলেন। বলা হয়েছিল, ঘন্টায় ২০০ মাইল বেগের ঝড়-ঝঞ্ঝাও এর ক্ষতি করতে পারবেনা। বিধাতার কি শান! সে গর্ব চূর্ণ করে মহামান্বিত টাইটানিক জাহাজের মত টুইন টাওয়ারও ধরাধাম থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়।

টুইন টাওয়ারের অদূরেই ম্যারিয়ট হোটেলের পূর্বে ইষ্ট রিভার। একটু দূরে আকাশে মাথা তুলে অভয় বাণী সহকারে হাতে মশাল উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে স্ট্যাচু অফ লিবার্টি। স্ট্যাচুটি‌ শান্তি ও স্বাধীনতার প্রতীক হিসাবে ফ্রান্সের তরফ থেকে আমেরিকাকে উপহার দেওয়া হয়েছিল।

স্ট্যাচু অফ লিবার্টির কাছেই এলিস আইল্যান্ড, যুগ যুগ ধরে ইউরোপ থেকে জলপথে আগত দারিদ্র্যপীড়িত অভিবাসীদের আমেরিকায় প্রবেশদ্বার। প্রবেশদ্বারটি এখন বন্ধ হয়ে গেছে কিন্তু স্মৃতি স্বরূপ রয়ে গেছে অভিবাসীদের ফেলে যাওয়া ছেঁড়া কাঁথা বালিশ, ভাঙ্গা সুটকেস।

কাজের ফাঁকে বা ছুটির দিনে সময় পেলেই টুইন টাওয়ারে বেড়াতে যেতাম। আগের বছর গাড়ি বোমা বিস্ফোরণ করে টুইন টাওয়ার গুঁড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা হয়েছিল। দেখতে পেলাম, নির্মাণ কর্মীরা ক্ষতিগ্রস্ত এলাকাগুলো মেরামত করছে।‌ বারবার টাওয়ারটিকে টার্গেট করার পিছনে হয়তো কোন রহস্য ছিল।

সে রহস্যের পিছনের রহস্য হয়তো জানা ছিল তখনকার আমেরিকার প্রেসিডেন্ট জুনিয়র বুশের। টুইন টাওয়ারের উপর যেদিন আঘাত আসে সে দিন বুশ‌ বাচ্চাদের একটা স্কুলে দ্বিতীয় গ্রেডের ছাত্র-ছাত্রীদের সাথে গল্প পড়ছিলেন। কি নিয়ে গল্প বলছিলেন তা শুনে অবাক হওয়ার কথা। গল্পটা একটা ছাগলকে নিয়ে। বার্তাবাহকের কাছে খবরটা শুনে তিনি উত্তেজিত হয়ে পড়েছিলেন, তা নয়। ছাগলের গল্পটা শেষ করে সমস্যার দিকে নজর দেন।

বর্তমানে আমরা সে বিলুপ্ত টুইন টাওয়ারের একটা বড় সড় ডিপার্টমেন্টাল স্টোরে ঢুকেছি। দোকানের অজস্র সেলফে সাজানো নানা বর্ণের, নানা ফ্যাশনের পণ্য সামগ্রী। স্মার্ট বিক্রয় কর্মীরা সবাইকে শুধায়, মে আই হেল্প ইউ। গতানুগতিক কিন্তু শুনতে মিষ্টি লাগে বৈকি।

গিন্নি হঠাৎ হালফ্যাশনের একটা শার্ট সেলফ থেকে নামিয়ে উৎসাহের সাথে বলল, কি সুন্দর শার্ট! তাই না? বুঝলাম, কেনার ইচ্ছা রয়েছে। শার্টের গায়ে লাগানো ট্যাগে দাম লেখা বিশ ডলার।

বেগম সাহেবা সাইন্সের ছাত্রী‌ ছিল; অংকের মেধা ভাল। চট জলদি হিসেব করে বের করল, তখনকার হিসেবে এক হাজার টাকা। শার্টটি উল্টে পাল্টে হটাৎ আবিষ্কার করে বসল, মেড ইন বাংলাদেশ। অচিরেই আমেরিকান শার্টের প্রতি তার আগ্রহ চুপসে গেল।‌ হ্যা খোদা! এ জিনিস ঢাকার বঙ্গ বাজারে দুই শ’ টাকায় পাওয়া যায়।

দোকানে এসেছি, কিছু না কিনেই বা যাই কি করে? টুকি টাকি কয়েকটি জিনিষ‌ শপিং বস্কেটে ভরা হল। একটা ফুলদানী সঙ্গিনীর পছন্দ হয়ে গেল। দাম ৬.৩০ ডলার। কিন্তু তার ইলেকট্রনিক বার‌ কোড‌ যা স্ক্যান করে ক্যাশিয়ার মালামালের মূল্য হিসাব করে, তা ড্যামেজ হয়ে গেছে।

আমাদের কেনা আইটেমগুলোর মূল্য হিসাব করতে যেয়ে নষ্ট ট্যাগটি ক্যাশিয়ারের জন্য বড় সমস্যার কারণ হয়ে দেখা দিল। অন্যান্য আইটেমের সাথে ফুলদানির মূল্য কিভাবে যোগ দিবে তা নিয়ে মহা চিন্তা।‌ কৃত্রিম বুদ্ধির যন্ত্রপাতির উপর নির্ভরের ফলে আমেরিকার ছেলে মেয়েরা সামান্য যোগ করতেও প্রকৃতির দেওয়া বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করতে ভুলেই গেছে।‌

অদূরে দাঁড়িয়ে ছিল কালো চামড়ার একজন অংকের ‘জাদুকর’‌। বিব্রত বালিকা আমাদের দিকে অপাঙ্গে সলাজ দৃষ্টিপাত করে জাদুকরকে অনুরোধ করলো, জন, তুমি কি একটু সাহায্য করতে পারবে? জন কম্পিউটারের দু-একটা বোতাম টিপে বলল, it’s done, ব্যস, হয়ে গেছে। বালিকার চোখে মুখে স্বস্তি, ‘অংকের জাদুকরের’ ঠোঁটে বিজয়ের স্মিত হাস্য। আমাদের চোখে বিস্ময়।

তাদের কান্ড দেখে বিবি তো অবাক, “যে দেশ চাঁদে মানুষ পাঠিয়েছে, টুইন টাওয়ারের মতো উঁচু ভবন গড়েছে তারা এই সামান্য যোগটা করতে পারে না কেন?”
বেগম সাহেবা ধারণা, “তাদের বোধ হয় খুব কম বেতন দেওয়া হয়”?

আমি ফোড়ন কাটলাম, “আমার জানা নেই, তবে ঘন্টায় ছয় ডলারের কম নয়। (বর্তমানে নিউ ইয়র্কে স্থান বিশেষে সর্বনিম্ন মজুরি ১০ থেকে ১৫ ডলার)। আবারও মনে মনে হিসাব করার পালা। হিসাব শেষে পুরোপুরি ধাঁধায় পড়ে গেল,“সে কি কান্ড! আমেরিকার বালিকারা মাত্র ৪-৫ ঘন্টা কাজ করে যে পারিশ্রমিক পায় আমাদের দেশের গার্মেন্টের মেয়েরা মাস ভর কাজ করে তার চেয়েও কম পায়”।

আমি বিজ্ঞজনের মত বাণী ছাড়লাম, এ-সব শাসন-শোষণের ব্যাপারে কাল মার্কস অনেক কিছুই বলে গেছেন, কিন্তু দুনিয়া সেই পুরনো নিয়মে চলছে, চলতে থাকবে; যে যা বলুক, আখেরে ‘রাজার হস্ত করে সমস্ত গরিবের ধন চুরি’। তা সে রাজতন্ত্র, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মতন্ত্র যা-ই হোক না কেন।

সেমিনার নিয়ে আমাদের তেমন ব্যস্ততা ছিল না। এ সব সেমিনার থেকে কিছু যে শেখা যায় না, তা নয়। তবে, বহুজাতিক কোম্পানিগুলো সেমিনারের আয়োজন করে অপরাপর দেশের সাথে ব্যবসায়িক সম্পর্ক উন্নয়নের জন্য। আনুকূল্য লাভের জন্য বিভিন্ন দেশের সংশ্লিষ্ট লোকজনকে সেমিনারে নিমন্ত্রণ করে নিয়ে আসে।

সেমিনারে আমন্ত্রিতদের জন্য ছিল‌ হরেক রকম বিনোদনের প্রোগ্রাম ও দর্শনীয় স্থানগুলো ভ্রমণ, অপেরা উপভোগ, এই সব আরকি। সঙ্গে ছিল উপাদেয় পানাহারের ব্যবস্থা।‌ সে‌ সব গল্প আরেকদিন হবে। এখন কিছু প্রবাসী বাঙ্গালীদের গল্প করা যাক।

নিউ ইয়র্কে প্রচুর প্রবাসী বাঙালি। বলা হয়ে থাকে, প্রবাসে বাঙালি মাত্রই সজ্জন। এ ধরনের সজ্জন কয়েক জন প্রবাসী বাঙালি আমাদের মন‌ জয় করে ফেলেছিল।

এক সকালে আমরা কোন একটা কাজে ইউনাইটেড নেশনস প্লাজায় বাংলাদেশ কনস্যুলেটের পথে রওনা হয়েছি। আমাদের তাড়াহুড়ো নাই। পাতাল রেল থেকে নেমে ম্যানহাটনের ৪৩ নম্বর স্ট্রিটের পথ ধরে বাবুয়ানা গতিতে চলছি।

সকাল বেলার এ সময়টায় ক্ষ্যাপা ষাড়ের তাড়া খাওয়া মানুষের মত সবাই হট‌ ডগ, স্যান্ডউইচ, বার্গার খেতে খেতে ছুটে চলেছে। ফাস্ট ফুড খেয়ে শরীরটা মাশাল্লাহ বানিয়ে ফেলেছে ছোট খাটো তাবুর মত। বিশাল ভুড়ি বাগিয়ে রাস্তায় চলাফেরা করে জগন্নাথের রথের মত সবকিছু দুমড়িয়ে মুচড়িয়ে। এ জগন্নাথ রথ কথাটি ইংরেজদের মনে ধরেছিল। তাই ইংরেজি ভাষায় juggernaut শব্দটি আমদানি করেছে।

মাঝে মাঝে একটু বৃষ্টির ছাট আসছিল। এক বিশাল বপু মহিলা মাথায় বড় সড় ছাতা মাথার ‌উপরে তুলে অতি যত্নে গড়ে তোলা শরীরটাকে বৃষ্টি‌ থেকে বাঁচানোর চেষ্টা করছিলেন। কিন্তু ছাতা তার অর্ধেক শরীরও ঢাকতে পারেনি। তার দরকার দুটো ছাতার, একটাতে চলবে কেন? মাথা বাঁচলেও পশ্চাৎদেশ বৃষ্টির পানিতে ভিজে জেরবার অবস্থা।

দু’পাশের ভবনগুলো মাথা তুলে আকাশ ছোঁয়ার প্রতিযোগিতায় নেমেছে।‌ তার ফাঁক ফোকর দিয়ে সূর্যের আলো মাঝে মাঝে উঁকি দিচ্ছে। আটলান্টিক থেকে উড়ে আসা সামুদ্রিক হাওয়া গলিতে আটকা পড়ে তেজের সাথে বেরোবার পথ খুঁজছে। বাতাসের তোড়ে গিন্নি শাড়ি সামলাতে ব্যস্ত।

কিছুক্ষণ পর উপমহাদেশের আদলের চেহারায় একজন আমাদের পাশ কাটিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে চলেছে। কয়েক গজ এগিয়ে ঘাড় ফিরিয়ে আমাদের উপর এক দফা নজর বুলিয়ে গতি মন্থর করে ব্রেক কষে দিল। তার চোখে মুখে ছিল সদ্য বাংলাদেশ থেকে আসা কারো সাথে একটুখানি কথা বলার আকুতি।

সম্ভবত, পৃথিবীর অপর প্রান্তে ফেলে আসা প্রিয় মাতৃভূমি থেকে নবাগত বাঙ্গালীদের চিনতে তাদের ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় সজাগ থাকে।

তাছাড়া, আমার গিন্নি শাড়ি পরেছিল রক্ষনশীল বাঙালি মহিলাদের মত।
অন্যদিকে, যে সব বাঙালি মহিলা আমেরিকায় স্থায়ীভাবে বাস করেন তাদের পোশাক পরিচ্ছদ ও পরার স্টাইল আলাদা। চলা ফেরায় থাকে লাপরোয়া ভাব।‌ তাদের থেকে নবাগতাদের আলাদা করে চিনতে বেগ পেতে হয় না।

প্রবাসীরা বাংলাদেশ থেকে আগত লোকজনের জন্য বাড়তি মাইল ভর হাঁটতেও দ্বিধা করে না।‌ ভেবেছিলাম, আমেরিকার বাঙালিরা হয়তো ভিন্ন প্রকৃতির হবে। আমেরিকাকে বলা হয় ল্যান্ড অব অপরচুনিটি।‌ ধন-সম্পদ কামানোর অফুরন্ত সুযোগ। তাই, তারা ডলার কামানোর জন্য হন্যে হয়ে ঘুরে।‌ ডলার আমেরিকানদের‌ ধ্যান জ্ঞান। তার আঁচ কি প্রবাসীদের লাগেনি?

আমাকে ভুল প্রমাণ করে হঠাৎ থেমে যাওয়া পথচারী আন্তরিকতার সাথে কুশল বিনিময়ে লেগে গেলেন। আবারো প্রমাণ হলো, প্রবাসী বাঙ্গালীদের হার্ট অন্য ধাতু দিয়ে গড়া; হয়তো সোনা দিয়ে। তারও তাড়াহুড়ো ছিল, কিন্তু দু’মিনিট কথা বলার সুযোগ কেন ছাড়বেন?

নাম বললেন, শামসুল আলম। বাংলাদেশ থেকে পড়াশোনা করতে আমেরিকা এসে পিএইচডি করে ফাইজার কোম্পানিতে ডাঙ্গর একটা চাকরি পেয়েছেন।

কথা বলতে বলতে আমাদের গন্তব্যে পৌঁছে গেছি। কিছু ভণিতা না করেই শামসুল আলম আমন্ত্রণ জানালেন, “আমার অফিস কনস্যুলেটের কাছেই। কিছু যদি মনে না করেন, কনস্যুলেটে কাজ শেষ হয়ে গেলে আমি আপনাদের লাঞ্চে নিয়ে যেতে চাই”।

তার চোখে-মুখে আন্তরিকতার ছাপ। অধীর আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছিলেন সম্মতির আশায়।

প্রবাসী বাঙালিদের আতিথেয়তা নিয়ে বাড়াবাড়ি সম্পর্কে আমার সন্দেহ ছিল না। কিন্তু তাই বলে মাত্র দুই মিনিটের আলাপের পর লাঞ্চ খাওয়ার নিমন্ত্রণ কখনো ভাবতে পারিনি।

বললাম,”তোমাকে অশেষ ধন্যবাদ”।
এত অল্প পরিচয়ে তাকে লাঞ্চ খাওয়ানোর ঝামেলায় ফেলতে চাচ্ছিলাম না। বললাম, বানিয়েই বললাম, আমাদের দুপুরে একটা প্রোগ্রাম আছে।

শামসুল আলম রাখঢাক না করেই বললেন, “আমি নিরাশ হলাম”। পরক্ষণেই নিজেকে গুছিয়ে হোটেলের ঠিকানা নিয়ে বললেন, “আমি আপনাদের সাথে যোগাযোগ করে হোটেল থেকে‌ অন্য আরেকদিন লাঞ্চে নিয়ে যাব”।

পর দিন বাইরে থেকে হোটেলে ফিরে দেখলাম কল রেকর্ডিং মেশিনে শামসুল আলমের দু’ তিনটা টেলিফোন এসেছিল। নানা ব্যস্ততায় তার সাথে যোগাযোগ করা হয়ে ওঠেনি।

ব্যস্ততার ফাঁকে আরো বেশ কয়েক জন প্রবাসী বাঙ্গালীদের সাথে দেখা হয়। কারো সাথে আগেই জানাশোনা ছিল, কারো সাথে আলাপ হয় হঠাৎ।

ততদিনে নিউ ইয়র্কে প্রবাসী বাঙ্গালীদের সংখ্যা এক লক্ষে পৌঁছে গেছে। তারা সবাই জ্যাকসন হাইটে জড়ো হয়ে থাকতে পছন্দ করে। তবুও তাদের অনেকেরই মন পড়ে থাকে ফেলে আসা পরিবেশ ও আত্মীয়-স্বজনের জন্য।

এক দিন ৩৪ নম্বর স্ট্রিটে দেখলাম আমাদের দেশের চেহারার এক যুবক দোকানের সামনে মেশিনে পপকন ভেজে বিক্রি করছে। প্রতি প্যাকেট এক ডলার। তার চেহারায় ছাপ রয়েছে বাংলাদেশের মার্কা মারা মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে সদ্য আমেরিকায় আসা নিরীহ যুবকের প্রতিচ্ছবি। অসহায়ত্বের বাতাবরণ চারদিক থেকে ঘিরে রেখেছে।

ছেলেটির অসহায় ভাব দেখে গিন্নির নারী মনে হয়তো করুণার উদ্রেক হয়েছে। স্বগোক্তি করলো, ছেলেটা কি বাংলাদেশ থেকে এসেছে? আলাপ করার বাহানা খুজছিল।

আমি এক ডলার দিয়ে বললাম, এক প্যাকেট পপকর্ন কিনে এনো। সে সাথে কৌতুহল নিবৃত্ত করো। তরুণকে ডলার নোট হাতে দিয়ে বলল, গিভ মি এ প্যাকেট।

ইংরেজিতে বললেও তরুণের সন্দেহ গেল না। আমাদের ভালো করে সার্ভে করে তরুণের সন্দেহ হল আমরা হয়তো বাংলাদেশ থেকে এসেছি। তার চোখে মুখে মাখা রয়েছে বাংলা ভাষায় কথা বলার জন্য সাত সাগরের তৃষ্ণা। সদ্য দেশ থেকে আসা বেচারা ইংরেজি ভাষায় কথা বলতে তেমন অভ্যস্ত নয়।আমেরিকান উচ্চারণ তার জন্য একটা বাড়তি সমস্যা। কয়েক দিন কাস্টমারদের সাথে কথা বলতে বলতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে।

সে জানালো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে মাস্টার্স ডিগ্রি করেছে। মাত্র দিন দশেক আগে আমেরিকায় এসে, তার ভাষায়, “খই ভাজার কাজে লেগে গেছি”। ‌

স্বপ্নের দেশ আমেরিকায় আসতে অনেক সময়, চেষ্টা চরিত্র, অর্থ ব্যয় করতে হয়েছে। ‌অশ্রু রুদ্ধ কণ্ঠে বলল, “এখন তো‌ দেখছেনই, এম এ পাশের সার্টিফিকেট পকেট নিয়ে রাস্তায় দাঁড়িয়ে খই ভাজছি। স্বপ্ন ভেঙ্গে গেছে, সম্ভব হলে আজই বাড়ি ফিরে যেতাম”।

জানি তার হতাশা একদিন কেটে যাবে। দেশের জন্য নস্টালজিয়া এতটা প্রকট থাকবে না। সময়ের পরিসরে মোটামুটি ভালো একটা চাকরি পাবে, বাড়ি গাড়ি কিনবে, পরিবার গড়ে তুলবে‌, মনের কোনে পুষে রাখবে টাকা পয়সা কামিয়ে একদিন দেশে ফিরে যাওয়ার আশা। কিন্তু বিদেশ-বিভুঁইয়ে নানা বন্ধনে জড়িয়ে বেশির ভাগ প্রবাসীরই দেশে আর ফেরা হয়ে উঠে না।

আর্থিক স্বচ্ছলতা কি তাদের দেশের জন্য আকুতি কমাতে পারবে? ঢাকায় আমাদের মহল্লার পরিচিত হেনা নিশ্চিত নয়।বছর খানেক আগে হেনা তার স্বামী ফারুকের সাথে আমেরিকা এসেছে।

অল্প দিনের মধ্যেই ফারুক নিউ ইয়র্কের ক্রমবর্ধমান বাঙ্গালী ট্যাক্সি ড্রাইভারদের কাতারে যোগ দেয়। দীর্ঘ সময় ধরে ট্যাক্সি চালিয়ে দৈনিক প্রায় দুই শ ডলার আয় হয়। এখনকার টাকার হিসাবে দৈনিক সতের হাজার টাকা।

আর্থিক স্বচ্ছলতা থাকলেও হেনার মনে শান্তি নেই। দেশের চেনা পরিবেশ, রাস্তাঘাট, গলির মোড়ে ছোট্ট দোকান, রিকশার টুংটাং আওয়াজ সে মিস করে।

সপ্তাহের ছুটির দিন ফারুক ও হেনা আমাদের হোটেল থেকে তাদের নিজস্ব ট্যাক্সিতে সারা শহর ঘুরিয়ে দেখাবার প্রোগ্রাম বানিয়ে ফেলল। আমরা আপত্তি জানালাম, তোমাদের একদিনের ইনকাম নষ্ট হয়ে যাবে। আমাদের আপত্তি হেসেই উড়িয়ে দিল। তাদের কল্যাণে নিউইয়র্কের বেশকিছু উল্লেখযোগ্য স্থান দেখার সুযোগ পেলাম।

নিউ ইয়র্ক অনেক রোমাঞ্চকর ঘটনা যুদ্ধ বিগ্রহের সাক্ষী। আমেরিকা মহাদেশে ইউরোপীয় উপনিবেশবাদীদের হানা দেওয়ার আগে এলাকাটি‌ ছিল নেটিভ আমেরিকানদের বাসভূমি। তারা সুখে শান্তিতে প্রকৃতির সাথে তাল মিলিয়ে বাস করছিল। ইউরোপীয় হানাদাররা তাদের সে সুখ শান্তি কেড়ে নেয়।

১৬২৪ সালে‌‌ হল্যান্ডের ডাচ ওয়েস্ট ইন্ডিজ কোম্পানি‌ নিউইয়র্ক দ্বীপের ম্যানহাটন এলাকায় বাণিজ্য কুঠি স্থাপন করে। তাদের দাবি বৈধতা দিতে নেটিভদের থেকে কিনে নেয় মাত্র ২৪ ডলারে।
সহজ-সরল নেটিভ জনগোষ্ঠী ধূর্ত ইউরোপীয়রা চুক্তির মধ্যে কি কারসাজি ঢুকিয়ে রেখেছিল বুঝতে পারেনি।‌ কি ছিল সে চুক্তিতে তারাই জানে, তার ভিত্তিতে ডাচ কোম্পানি পুরো এলাকা দাবী করে বসল। বেশ কয়েক বছরের যুদ্ধ-বিগ্রহে নেটিভ ও ডাচদের দূই হাজার লোক প্রাণ হারায়। ডাচ কোম্পানি তাদের দখল করা দ্বীপটির নাম রেখেছিল নিউ আমষ্টার্ডাম‌।

তবে, ডাচ কোম্পানি বেশি দিন দখল টিকিয়ে রাখতে পারেনি। ১৬৬৪ সালে ইংরেজরা তাদের থেকে এলাকাটি কেড়ে নিয়ে নাম রাখে নিউ ইয়র্ক। বৃটেনের সাথে স্বাধীনতা যুদ্ধে জয় লাভ করে আমেরিকা ১৭৮৯ সালে নিউইয়র্কে রাজধানী স্থাপন করে। পরের বছর অবশ্য রাজধানী ফিলাডেলফিয়ায় সরিয়ে নেয়।

নানা জায়গায় ঘুরে দর্শনীয় স্থানগুলো দেখার সাথে দেশের স্মৃতি রোমন্থন করে হেনা মনের ভার কিছুটা হলেও হালকা করতে চাইছিল। যে বাংলাদেশ তার খুব পছন্দের দেশ ছিল না, সে দেশের কথা মনে করে তার চোখ আর্দ্র হয়ে গেল।

বাংলাদেশের কথা মনে করে সন্ধ্যায় ফারুক আমাদের তিন নম্বর এভিনিউয়ের একটা বাংলা রেস্টুরেন্টে সান্ধ্য‌ ভোজনর আয়োজন করেছিল।‌ রাস্তার দু’ পাশে ডজন দুই দেশী রেস্টুরেন্ট। কোনটির নাম পদ্মা, কোনটির গঙ্গা বা তাজমহল। সবগুলো রেস্টুরেন্টে জমজমাট ভিড়। উইকএন্ডে সাদা কালো আমেরিকান তরুণ তরুণী মসলাযুক্ত খাবার খেতে হুমড়ি খেয়ে পড়েছে। কোন রেস্টুরেন্টে খালি সিট পাওয়া মুশকিল। অনেকেই লাইনে দাঁড়িয়ে বাইরে অপেক্ষা করছে।

একটা রেস্টুরেন্টে ঢুকে জায়গা না পেয়ে ফিরে আসছিলাম। রেস্টুরেন্টের লোকজন আমাদের দেখে তটস্থ হয়ে গেল। তাড়াহুড়া করে একে উঠিয়ে, তাকে সরিয়ে আমাদের জন্য জায়গা করে দিল। আমেরিকান লোকজন ভাবলো আমরা বোধ‌ হয় কোন রাজা মহারাজা, তাই এতো খাতির।

দেশে আমরা সাদা মানুষ দেখলে যত্নআত্তি করতে অস্থির হয়ে পড়ি। ইয়েস স্যার, ইয়েস স্যার বলতে বলতে মুখে ফেনা তুলে ফেলি। রেস্টুরেন্টের বাঙালি কর্মচারীদের সাদা মানুষের প্রতি মোহ নাই। আমরা দেশ থেকে এসেছি শুনে তাদের যত্নের মাত্রা বেড়ে গেল। শুভেচ্ছা স্বরূপ বেশ কয়েকটি উপাদেয় ডিশ বিনামূল্যে বিনয়ের সাথে নিবেদন করল।

আহারেরর শেষ পর্যায়ে রেস্টুরেন্টের একজন সুদর্শন কর্মচারী করজোড়ে জানালো সে আজই আমেরিকার চিকিৎসা শাস্ত্রে এম ডি ডিগ্রি পেয়েছে। আমাদের কাছে আশীর্বাদ প্রার্থনা করল। পায়ে হাত দিয়ে সালাম করতে গেলে থামিয়ে দিলাম।
জানতাম আমেরিকায় এমডি ডিগ্রি কতটা মূল্যবান। তবুও, সে যেন বিনয়ের অবতার। সুদূর বাংলাদেশ ফেলে আসা গুরুজনদের কথা স্মরণ করে তাদের প্রক্সি হিসেবে আদর, আপ্যায়ন, সম্মান করে কিছুটা হলেও স্বস্তি লাভের চেষ্টা।

অন্য এক প্রবাসী বাঙালি যুবকের আতিথিয়তার পরিচয় পেলাম আক্ষরিক অর্থে আকাশ ছোঁয়া উচ্চতায়। ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারের টুইন টাওয়ারের এক শ’ দুই তলায়।

আমেরিকার বিখ্যাত ইনভেস্টমেন্ট কোম্পানি মেরিল লিন্চ সেমিনারে আগতদের সান্ধভোজের জন্য টুইন টাওয়ারের ১০২ তলায়,১২০০ ফুট উপরে, রূপক অর্থে আকাশের গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়ানো একটা অভিজাত রেস্টুরেন্টে।

আমার বুকে ঝুলানো ছিল আমার নাম ও বাংলাদেশ লেখা একটা কার্ড। একটু দূরের টেবিলের দায়িত্বে একজন ওয়েটার আমাদের দিকে বারবার তাকাচ্ছিলো কিন্তু এগিয়ে আসতে সাহস পাচ্ছিল না। রেস্টুরেন্টের কোড অনুযায়ী অন্য টেবিলের অতিথিদের সাথে ওয়েটারদের সামাজিকতা কড়াকড়ি বারণ ছিল। চাকরিও যেতে পারে। একটুখানি আলাপ করার জন্য ছটফট করছিল।

সান্ধ্য ভোজ শেষে আমরা লবিতে লিফটের কাছে গেলে, ছেলেটা চুপিসারে কাছে আসে সালাম জানিয়ে বলল, আমার নাম আবুল বাশার। দুই একটা কথার পরে বলল, আপনারা যদি আমার বাসায় আপ্যায়নের সুযোগ দেন তাহলে খুব খুশি হব। তার একটা কার্ড দিয়ে বলল, আসবেন তো দয়া করে? আমি হা না বলার আগেই আমার স্ত্রী দাওয়াত কবুল করে নিল।

নানা ঝামেলায় আবুল বাশারের সাথেও যোগাযোগ করা হয়নি, কিন্তু তার আন্তরিকতা হৃদয় স্পর্শ করে গিয়েছিল।‌

জানিনা, সে বাঙালি ওয়েটার, টুইন টাওয়ার শপিং মলের বিব্রত বালিকা কিংবা অংকের ‘জাদুকর’ কালো রঙ্গের মানুষ ২০০১ সালে সেপ্টেম্বর মাসের ৯ তারিখের সে মহাপ্রলয় থেকে বেঁচে উঠতে পেরেছিল কিনা। যেখানেই থাকুক, তাদের এবং অন্য যারা সে দুর্যোগে প্রাণ হারিয়েছিল তাদের জন্য রইল শুভ কামনা।

About Post Author

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Pin It on Pinterest