১৯৬৫ সালে কোন এক দিন প্যারিসের রাস্তায় প্রাতভ্রমণে বেরিয়েছেন ফরাসি উকিল, আন্দ্রে ফ্রান্সোয়া রাফরে। পথের পাশে দৃষ্টিনন্দন একটা বাড়ি দেখে তাঁর দৃষ্টি সেদিকে আটকে গেল। মনে মনে ভাবলেন, আহ্! আমার যদি এরকম একটা বাড়ি থাকতো।

উকিল সাহেবের মুগ্ধতা ক্রমে লোভে রূপান্তরিত হয়। খোঁজখবর নিয়ে জানতে পারলেন, বাড়িটি জিন কালমেন্ট নামে একজন ৯০ বছরের মহিলার। তাঁর তিন কুলে কেউ বেঁচে নেই। তিনি একাই সে বাড়িতে বাস করেন।

আন্দ্রে-ফ্রান্সোয়া দেন দরবার করে মহিলার সাথে চুক্তি করলেন, যতদিন মহিলা বেঁচে থাকবেন ততদিন পর্যন্ত উকিল প্রতি মাসে তাকে ২,৫০০ ফ্রাঙ্ক মাসোয়ারা দিতে থাকবেন। চুক্তির শর্ত অনুযায়ী, বৃদ্ধার মৃত্যুর পর বাড়ির মালিক হবেন উকিল আন্দ্রে-ফ্রান্সোয়া।

উকিল সাহেব ভেবেছিলেন, বৃদ্ধা আর কত দিনই বা বাঁচবেন? তাঁর মৃত্যুর পর তিনিই হবেন বাড়িটির মালিক। হৃদয়ের নিভৃত কোণে লালিত স্বপ্ন পূর্ণ হতে যাচ্ছে দেখে তার মনে খুশির বন্যা বয়ে গেল‌। মনে মনে ভাবলেন, এমন ভাগ্য কয়জনেরই বা হয়? কিন্তু নিয়তি তার জন্য লিখে রেখেছিলেন ভিন্ন কাহিনী।

দিন যায়, বছর যায়, দেখা গেল জিন কালমেন্টের পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে অজানা গন্তব্যে যাওয়ার কোন লক্ষণ নাই। জিন কি সঞ্জীবনী সুধা পান করেছিলেন তা ভেবেই কুল কিনারা পাচ্ছিলেন না। এদিকে তাকে মাসোহারা দিতে দিতে তিনি ক্লান্ত।

জিন কালমেন্টের ডাক্তারের কাছে খোঁজ খবর নিলেও কোন আশার বাণী শুনতে পেলেন না। তার রোগীর শরীর-স্বাস্থ্য কেমন যাচ্ছে জিজ্ঞেস করলে একই উত্তর শুনতে হয়, ফার্স্ট ক্লাস। ডাক্তারের কথা শুনে উকিলের মেজাজ বিগড়ে যায়‌। মনে মনে গালি দেয়, “ব্য্যটা, তুমি তো বলেই খালাস। এদিকে মাসে মাসে এক কাড়ি টাকা গুনতে গুনতে আমার দফা সারা– একেবারে থার্ড ক্লাস।”

উকিলের হতাশা আরও বেড়ে গেল যখন দেখতে পেলেন জিনের বয়স যখন ১০০ বছর পূর্ণ হয়েছে তখনও নিয়মিত সাঁতার ও টেনিস খেলে চলেছেন। এমনকি সাইকেলে চড়ে চলাফেরা করছেন, রোলার স্কেটে চড়ে মজা লুটছেন।

একে একে ৩০টি বছর কাটিয়ে জিন যখন ১২০ বছর পৌঁছে দুনিয়ার সবচেয়ে দীর্ঘজীবী মানব সন্তানের খাতায় নাম লিখে ফেলেছেন, উকিল নিজেই একরাশ হতাশা এবং না পাওয়ার বেদনা সঙ্গে নিয়ে পরপারের পথে যাত্রা করেন। তখন তার বয়স ৭৮ বছর। বাড়িটা ভোগ করার সুযোগ তো পেলেনই না, বরং আরো দুই বৎসর তার পরিবার বৃদ্ধাকে মাসোহারা দিতে বাধ্য হয়।

পরিশেষে ১২২ বছর বয়সে পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি বয়সী মানবসন্তান হিসেবে তিনি পরপরের পথে যাত্রা করেন। ততদিনে, উকিল এবং তার পরিবার তাকে যে পরিমাণ মাসোয়ারা দিয়েছেন তা বাড়ির মূল্যের চেয়ে দ্বিগুণেরও বেশি।

অনেকেই সবচেয়ে দীর্ঘজীবী বলে দাবি করলেও জিন কালমেন্ট প্রমাণিত দলিলপত্রের ভিত্তিতে নিশ্চিত ভাবে সর্বকালের সবচেয়ে দীর্ঘজীবী মানুষ হিসেবে মাইল ফলক স্পর্শ করে গেছেন বলে দাবি করা হয়।

জিন কালমেন্টের জন্ম হয়েছিল ১৮৭৫ সালে, মৃত্যুবরণ করেন ১৯৯৭ সালে। তাঁর জন্মের ১৪ বছর পর আইফেল টাওয়ার নির্মাণ শুরু হয়; তিনি তা তৈরি হতেও দেখেছিলেন। তাঁর জন্মের ১৫ বছর পরে শুরু হয় সিনেমা নির্মাণ। চলচ্চিত্রের আবির্ভাবের প্রায় ১৫ বছর আগে। তার বয়স যখন এক বছর আলেকজান্ডার গ্রাহাম বেল তখন টেলিফোনের পেটেন্ট করেন।

জিন কালমেন্টের জীবনযাত্রা ছিল টেনশন মুক্ত, দুশ্চিন্তাহীন। ১৮৯৬ সালে এক দূর সম্পর্কীয় ধনবান কাজিন ফার্নান্ড নিকোলাস ক্যালমেন্টের সাথে তাঁর বিয়ে হয়। অর্থ বিত্তের অভাব না থাকার কারণে জিনকে জীবিকা নির্বাহের জন্য কোন দুশ্চিন্তা করতে হতো না। নিজের কোন কাজকর্ম করারও প্রয়োজন পড়েনি।

দুশ্চিন্তাহীন জীবনে রোগ ব্যাধি সহজে তার স্বাস্থ্যের উপরে তেমন কোন প্রভাব ফেলতে পারে নাই। তিনি বলতেন, ‘কোন সমস্যা কিংবা বিপদ আপদ যদি এড়াতে নাই পারো, তা নিয়ে দুশ্চিন্তা করে লাভ কি?’ মানসিক চাপকে তিনি মোটেই পাত্তা দেন নাই। ‌তার দীর্ঘায়ু লাভের এটাই ছিল অন্যতম প্রধান মূলমন্ত্র।

সময় কেটে যায়, নিকট আত্মীয়রা একে একে পৃথিবী ছেড়ে বিদায় নিতে থাকে। তাদের মধ্যে ছিলেন তার স্বামী কিলমেন্ট যিনি ৭৩ বছর বয়সে নষ্ট চেরি খেয়ে তার বিষক্রিয়ায় মারা যান। তার মেয়ে ইভোন ১৯৩৪ সালে নিউমোনিয়ায় মারা যান। এমনকি তার নাতি ফ্রেডেরিক গাড়ি দুর্ঘটনায় মারা গিয়েছিল ১৯৬৩ সালে। কিন্তু যমদূত তখনও জিনকে এড়িয়ে চলছিলেন।

জিন তার জীবনের বেশিরভাগ সময়ই সুস্বাস্থ্যের অধিকারী ছিলেন। এমনকি ৮৫ বছর বয়সে ফেন্সিং (তরোয়ালবাজি) ক্রিয়ায় অংশ গ্রহণ করতেন।

জিন কালমেন্ট স্বাস্থ্যসম্মত খাবার দাবারে খেতেন, কিন্তু খুব যে সংযমের পরিচয় দিতেন তা নয়। অল্প বিস্তর মদ্যপান করার অভ্যাস ছিল; তবে, সীমা ছাড়াতেন না। চকলেটের প্রতি ছিল তার বিশেষ অনুরাগ, প্রতি সপ্তাহে এক কেজিরও বেশি পরিমাণ চকলেট খেতেন। তার ধুমপানেরও অভ্যাস ছিল। স্বামীর প্ররোচনায় ২১ বছর বয়সে ধূমপান শুরু করেন, ১১৭ বছর বয়সে সে অভ্যাস পরিত্যাগ করেন। অলিভ অয়েল ছিল তার প্রিয় প্রসাধনী। শরীরে অলিভ অয়েল ব্যবহার করতেন, খাবারও রান্না হতো অলিভ অয়েলে।

জিন কালমেন্টের ১১৫ তম জন্মদিনের এক মাস আগে পর্যন্তও একাই চলাফেরা করতে পারতেন। দুর্ভাগ্যক্রমে, সেবার পড়ে গিয়ে

তার ফিমার বোন ভেঙে যায়। এরপর চলাফেরা করার জন্য হুইলচেয়ার সাহায্য নিতে হয়।

তিনি ১৯৯০ সালে ১১০ বছর বয়সে ভ্যান গগের জীবনীভিত্তিক প্রধান নারী চরিত্রে অভিনয় করেন। এ কারণে তাকে সর্বকালের সবচেয়ে বয়স্কা চলচ্চিত্র অভিনেত্রী হিসেবেও গণ্য করা হয়।

চলচ্চিত্রে অভিনয়ের পূর্বেও ভ্যানগগের সাথে তার পরিচয় ছিল। বাবার দোকানে কাজ করার সময় তিনি ভ্যান গগের কাছে চিত্র অংকন করার জন্য ক্যানভাস বিক্রি করতেন। জিন স্মৃতি হাতড়ে বলতেন, “ভ্যান গগের চেহারা ছিল কুৎসিত, মেজাজ ছিল খিটখিটে, কথা বলার সময় চারিদিকে শরাবের গন্ধ ছড়িয়ে পড়তো।”

জিন তার বুদ্ধিমত্তা ও রসিকতার জন্যও বিখ্যাত ছিলেন। তিনি পরামর্শ দিতেন, “হাসিখুশি জীবন যাত্রা দীর্ঘায়ু লাভের জন্য মোক্ষম দাওয়াই।”

জিনের ১২০ তম জন্মদিনে একজন সাংবাদিক বিদায় নেওয়ার সময়

“আশা করি আগামী বছর ফের দেখা হবে” মন্তব্য করলে জিন বললেন, “দেখা না হওয়ার কোন কারণ দেখছি না। তোমার শরীর স্বাস্থ্য তো এত খারাপ মনে হয় না।”

About Post Author

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Pin It on Pinterest