October 29, 2025

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাঙ্গণে লাল দালানের দুর্গের মত ইমারতের নাম কার্জন হল। যার নাম থেকে ইমারতটির নাম করা হয়েছিল তিনি ছিলেন ভারতের ভাইসরয়, এ দেশে ব্রিটিশ রাজের প্রতিভূ, লর্ড কার্জন। তখন বাংলা প্রদেশ ছিল বেশ বড়—লোক সংখ্যার বিচারে ফ্রান্সের চেয়ে ডাঙ্গর। এখনকার বাংলাদেশ ও পশ্চিম বাংলা ছাড়াও হিন্দি ভাষাভাষী অংশের বিহার, উড়িয়া ভাষাভাষী অংশের উড়িষ্যা ও আসাম নিয়ে ছিল বাংলাদেশ। রাজধানী কলকাতা।

কার্জন বললেন, কলকাতা থেকে এ বিশাল অঞ্চল শাসন করা মুস্কিল, তাই ভাঙ্গ একে। যেমনি কথা তেমনি কাজ। লর্ড সাহেব ১৯০৫ সালের অক্টোবর মাসে বাংলাকে দুই ভাগ করে ফেললেন। পশ্চিম অংশের নাম হল বেঙ্গল, পূর্বের অংশের নাম ইস্ট বেঙ্গল এন্ড আসাম।

বঙ্গ ভঙ্গের জন্য আর একটা কারণও তিনি বললেন। তা হল, পূর্ববঙ্গ ছিল লেখাপড়ায়, শিল্প কারখানায় অনগ্রসর। এ বঙ্গের কাঁচামাল নিয়ে পশ্চিম অংশের লোকজন রপ্তানি করত, শিল্প কারখানা গড়ে তুলত। পূর্বের এ বাঙ্গাল দেশ ছিল তাঁদের কাঁচামালের যোগানদাতা এবং তৈরি পণ্যের বাজার।

অর্থ সম্পদ, শিক্ষা দীক্ষায় বলীয়ান কলকাতার জমিদার উকিল-মোক্তার আমলারা পূর্বাংশকে কালো মেঘের মত ছেয়েছিল। অন্য দিকে পূর্ব বঙ্গ, যেখানে বেশির ভাগ লোকই মুসলমান, ধান-চাল চা-পাট নীল চাষ করতে করতে ক্লান্ত। লেখা পড়া চাকরি বাকরির তেমন সুযোগ নেই। কার্জন বললেন, ব্রিটিশ রাজ যদি তাঁদের কথা না ভাবে তা’হলে কে ভাববে? বাংলা ভাগ হলে তাঁদের ভাগ্যে কিছুটা হলেও ছিকে ছিঁড়বে। হক কথা। কিন্তু ভাগাভাগির পিছনে ব্রিটিশদের আর কোন মতলব নাই ত?

প্রথমদিকে সরকার ঘেঁষা হলেও কংগ্রেসের সুর নরম থেকে ক্রমশ: গরম হচ্ছে। অবস্থা সামাল দিতে কার্জন সাহেব পুরনো ট্রাম্প কার্ড বের করলেন—ডিভাইড এন্ড রুল। হিন্দুরা দেখল মহা মুস্কিল। বাংলা ভাগ হলে এক দিকে পূর্ব বাংলায় তাঁরা মাইনরিটি হয়ে যাবে, অন্যদিকে পশ্চিম অংশের সাথে বিহার-উড়িষ্যা যোগ হওয়ার ফলে তাঁদের দাপট কমে যাবে। শুরু হল বঙ্গভঙ্গ বানচাল করার জন্য আন্দোলন।

মুসলমানদের অনেকেই ব্রিটিশদের ছোড়া টোপ গিলল। সত্যিই ত’, সারা প্রদেশে একটি মাত্র বিশ্ববিদ্যালয়, তাও কলকাতায়। চাকরি-বাকরি আলুটা, মুলোটা পশ্চিমের লোকেরাই কুড়িয়ে খাচ্ছে। পূর্ব বাংলা আলাদা হলে তাঁর ছিটে ফোঁটা তাঁদের ভাগে হয়ত আসবে। তাঁরা ভাবলেন, সিপাহি বিদ্রোহের পর ইংরেজরা মুসলমানদের যে আস্তা-কুড়ে ঠেলে দিয়েছিল সেখান থেকে উঠে আসার একটা মই বোধ হয় লাট বাহাদুর দয়া করে নামিয়ে দিয়েছেন। হয়তবা, ব্রিটিশ রাজের বিলম্বিত অনুশোচনা!

শ্রীমান কার্জন বুঝতে পারেননি তিনি কোন মৌচাকে ঢিল ছুঁড়েছেন। বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন বানচাল করার জন্য কলকাতা-ওয়ালারা মরিয়া হয়ে উঠলেন। আন্দোলনের পুরোভাগে ছিলেন পশ্চিম বঙ্গের হিন্দু মধ্যবিত্ত পরিবারের লোকজন। সে দলে কলকাতার উচ্চ শ্রেণীর মুসলমানরাও যোগ দিয়েছিলেন। তাদের অনেকেই কলকাতায় শিকড় গেড়ে বসে ছিলেন। স্বজাতি বা দেশ প্রেমের সাথে ব্যক্তি স্বার্থের সংঘাত হলে অনেক ক্ষেত্রে ব্যক্তিস্বার্থই প্রাধান্য পায়। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের একাংশ স্বদেশপ্রেম জলাঞ্জলি দিয়ে পাকিস্তান সেনাদের সাথে হাত মিলিয়েছিল।

বাংলার পশ্চিম প্রান্তে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন দানা বাঁধতে লাগল।‌ অহিংসাত্মক কর্মকাণ্ডের পাশাপাশি হিংসাত্মক ঘটনাও ঘটতে লাগল। বাংলার গভর্নরকে হত্যার চেষ্টা করা হল। স্বদেশী ক্ষুদিরাম বসু ও প্রফুল্ল চাকি বিহারের মোজাফফারপুরের এক ইংরেজ ম্যাজিস্ট্রেটকে বোমা মেরে মারতে যেয়ে ভুল করে অন্য এক ইংল্যান্ডবাসীকে মেরে ফেললেন। শহীদ ক্ষুদিরামের কণ্ঠে বাণী চড়িয়ে এক গীতিকার রচনা করলেন, একবার বিদায় দেও গো মা, ঘুরে আসি।

ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের অনুরণন সাংস্কৃতিক অঙ্গনেও পৌঁছে গেল। জোড়াসাঁকোর কবি গুরু লিখলেন ‘বাংলার মাটি, বাংলার জল’। অখণ্ড বাংলার আদর্শে উদ্বুদ্ধ করার জন্য তিনি লিখলেন, ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি’। নিয়তির পরিহাস, সে সংগীতটি বাংলাদেশের আজ জাতীয় সংগীত।

বঙ্গ ভঙ্গ রদ করার আন্দোলনের বিরুদ্ধে মুসলমানরাও আওয়াজ তুলল। কিন্তু শিক্ষা দীক্ষায় পিছিয়ে পড়া দুর্বল সম্প্রদায়ের আওয়াজ কতই বা জোরদার হবে? ইংরেজরা অবশ্য চাচ্ছিল মুসলমানরা আরও সক্রিয় হোক। সম্ভবত তাদেরই অনুপ্রেরণায় নওয়াব সলিমুল্লাহ এগিয়ে এলেন আন্দোলনের পুরোভাগে।

সলিমুল্লাহ বঙ্গভঙ্গের জন্য আগে থেকেই ইংরেজদের সমর্থন যুগিয়ে আসছিলেন। বঙ্গভঙ্গের প্রথম দিন ১৯০৫ সালের ১৬ই অক্টোবর তিনি পূর্ব বাংলার মুসলিম নেতৃবৃন্দের নিয়ে ঢাকার নর্থব্রুক হলে এক সভায় সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। সেখানে মোহামেডান প্রভিন্সিয়াল ইউনিয়ন নামে এক রাজনৈতিক দল গঠন করেন। এর পর তিনি সর্ব ভারতীয় রাজনৈতিক দল গঠনের তোড়জোড় করতে থাকেন। ১৯০৬ সালের ডিসেম্বর মাসে নিজ খরচে ঢাকায় অল ইন্ডিয়া মোহাম্মেডান এডুকেশনাল কনফারেন্সের বিংশতম সভার আয়োজন করেন।

সারা ভারত থেকে শাহবাগে নওয়াবের পারিবারিক গার্ডেনে দুই সহস্রাধিক নেতৃবৃন্দ এ সভায় যোগদান করেন। কনফারেন্সের শেষ দিনে নেতৃবৃন্দ যে দলটি গঠন করেন তার নাম হল অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগ। সলিমুল্লাহ সাহেবের উপর দায়িত্ব পড়ল দলটির গঠনতন্ত্র তৈরি করার। পূর্ব বাংলার মুসলমানদের নেতৃত্বের পুরোভাগে এসে গেলেন। সলিমুল্লাহ সাহেবের সঙ্গ দিলেন মূলত মুসলিম সমাজের নবাব বাহাদুর, খান বাহাদুর শ্রেণীর লোকজন। সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের সম্পৃক্ততা ছিল না বললেই চলে। অনেক পরে যখন শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক কৃষক শ্রমিক পার্টি গঠন করেন তখন সাধারণ মানুষ গুটি গুটি পায়ে রাজনীতির অঙ্গনে ঢোকার সুযোগ পায়।

ইংরেজরা এত দিন ধরে তাই চাচ্ছিলেন; দুইটা ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল। একটি ত হল। হিন্দুরাও নিরাশ করলেন না। তাঁরা গঠন করলেন হিন্দু মহাসভা। দু’ সম্প্রদায়ের মধ্যে রচিত হল এক দুর্ভেদ্য বেড়াজাল যা পরিণতি পেল ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের মাধ্যমে। তার আগে প্রচণ্ড আন্দোলনের কারণে মাত্র ছয় বছর পরে ১৯১১ সালে বাংলা আবার একত্রিত করা হল।‌

ইতোমধ্যে যে ছয় বছর ঢাকা পূর্ব বাংলার রাজধানীর সাময়িক লেবাস পরার সুযোগ পেয়েছিল তখন এখানে ওখানে নতুন নতুন ইমারত মাথা চাঁড়া দিয়ে উঠলো। হাইকোর্ট বিল্ডিং তৈরি হল। আমলাদের বসবাসের জন্য মিন্টু রোড, বেলী রোড এলাকায় বাংলো তৈরি হল। প্রশাসনিক কর্মকাণ্ডের জন্য তৈরি হল কার্জন হল–আমাদের রফি মৌলানার ‘লাল দুর্গের’ কার্জন হল যেখানে তিনি মোক্তারি পরীক্ষা দিয়েছিলেন বলে গর্ব করতেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

বঙ্গভঙ্গ রদের খবর শুনে নওয়াব সলিমুল্লাহ নাকি জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলেন। হুশ ফিরলে অভিমান করে বড় লাটকে একটা কড়া চিঠি লিখলেন। কার্জন সাহেব সান্ত্বনা দিলেন, যা হবার তাত হয়েই গেছে; উই আর সরি। এস, তোমাদের জন্য একটা ইউনিভার্সিটি বানাই। তিনি একটা কমিটি গঠন করলেন যাতে অন্যান্যদের সাথে নওয়াব সলিমুল্লাহ, এ কে ফজলুল হককে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এ সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধেও পশ্চিম বাংলার হিন্দু এমনকি মুসলমান নেতৃবৃন্দ নাখোশ হয়ে যা তা বলতে থাকেন। সলিমুল্লাহ সাহেব তাঁদের কড়া জবাব দিয়ে থামিয়ে দেন। পরিশেষে যখন বিশ্ববিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠা হয় তাঁরা একে বলতে লাগলেন মক্কা বিশ্ববিদ্যালয়। দিন বদলেছে, এখন যেখানে ঢাকার অলিতে গলিতে শ’খানেক বিশ্ববিদ্যালয় গজীয়ে উঠেছে সেখানে সারা পূর্ব বাংলার জন্য একটিমাত্র বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার জন্য এ কি কাকস্য পরিবেদনা!

About Post Author

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Pin It on Pinterest