October 30, 2025

গল্পটির পটভূমি পাকিস্তানের বাণিজ্যিক রাজধানী করাচি। তখন বাংলাদেশের নাম ছিল পূর্ব পাকিস্তান।

এখনকার মেগা নগরী করাচি ছিল  নির্ঝঞ্ঝাট শান্তিপূর্ণ শহর। তখনো মোহাজের এবং বিভিন্ন প্রদেশের জনগণের মধ্যে  জাতিগত সংঘাত ও রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব শহরের পরিবেশ বিষিয়ে তোলে নি। আফগান যুদ্ধে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলোও  শহরটিকে যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত করেনি। জীবন চলত আপন গতিতে ধীর লয়ে, শান্তির পরশ বুলিয়ে।

আমার কর্মস্থল ছিল অখন্ড পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় ব্যাংক, স্টেট ব্যাঙ্ক অব পাকিস্তানের  ফরেন এক্সচেঞ্জ ডিপার্টমেন্টে। বিভাগ থেকে কারো পদোন্নতি বা বদলি হলে পার্টির আয়োজন করার ট্র্যাডিশন চালু ছিল। বাঙালি সহকর্মীদের মধ্যে ছিলেন পরবর্তীতে বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর মরহুম মাহবুবুর রহমান খান এবং আমার একান্ত ঘনিষ্ঠ নির্বাহী পরিচালক প্রয়াত শান্তি রঞ্জন কর্মকার। 

তখন সরকারি স্কেলের সাথে সামঞ্জস্য রেখে যে বেতন ভাতা পাওয়া যেত তা দিয়ে বিলাসবহুল পার্টির আয়োজন করার সুযোগ ছিল না। অফিসেই কয়েকটি টেবিল একত্র করে সাজিয়ে চা বিস্কুট কলা চানাচুর সহকারে অনুষ্ঠানগুলো পালন করা হতো। খাবার-দাবারের চেয়ে গালগল্প হাসি-তামাশা ছিল অনুষ্ঠানের প্রধান আকর্ষণ। 

স্টেট ব্যাংক পাকিস্তানের বিল্ডিংয়ের অদুরে আরব সাগরের তীরে বীচ লাক্সারি হোটেল। হোটেলে সহনীয় মূল্যে সুস্বাদু বুফে লাঞ্চের ব্যবস্থা ছিল। সে হোটেলের লোভনীয় খাবার দাবারের হাতছানিতে সাড়া দিয়ে মাঝে মাঝে সেখানেও অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হতো। 

জনপ্রিয় এ হোটেল জনপ্রতি ১২ টাকায় বুফে লাঞ্চ খাওয়া যেত; সে সময়ের  বিনিময় হারে ৩ ডলারেরও কম। পাকিস্তানে  অর্থনীতির অব্যবস্থাপনার ফলে আকাশচুম্বী মুদ্রাস্ফীতির কারণে এখন সে দেশের রুপির‌ বিনিময় হার প্রতি ডলার ৪.৭৬ রুপি থেকে বেড়ে প্রায় ১৮৬ রুপিতে পৌঁছে গেছে।‌ বুফে খাবারের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে দুই হাজার রূপিরও বেশি।

সে স্বস্তির দিনগুলো কালের গর্ভে বিলীন হয়েছে। পাকিস্তান থেকে বিচ্ছেদ হওয়ার পর কনসালটেন্সি এবং অন্যান্য কাজে সে দেশে বেশ কয়েকবার ভ্রমণ করার সুযোগ হয়েছে। করাচিবাসীরা পুরনো সে স্বস্তির দিনগুলোর কথা স্মরণ করে বেজায় আফসোস করে। পাকিস্তানি সামরিক জান্তার খপ্পর থেকে মুক্তি না পেলে আমাদেরও সে আফসোসের ভাগীদার হতে হতো সন্দেহ নেই। যাহোক, বীচ লাক্সারি হোটেলে ফিরে যাওয়া যাক।

আমরা রেস্টুরেন্টে পৌঁছার পর দেখতে পেলাম খাবার টেবিলে প্রচুর সংখ্যক সুস্বাদু খাবারের আইটেম থরে থরে সাজানো রয়েছে। অনেকেরই বাড়িতে সেসব খাবারের স্বাদ গ্রহণের সুযোগ খুব কমই জুটত। সুতরাং, বিচ লাক্সারি হোটেলের বুফেটিতে  পছন্দ মতো’ খাওয়ার বিলাসিতা উপভোগ করার জন্য ক্ষুদার্থ নেকড়ে বাঘের মত ঝাঁপিয়ে পড়ার উপলক্ষ হতে দেরি লাগত না।

সুস্বাদু খাবার ছাড়াও, মজার মজার গল্প, কৌতুক এবং একে অপরকে টিজ করার ফলে পার্টি প্রাণবন্ত হয়ে উঠত। এযুগের রেষারেষি, সম্পদ কুক্ষিগত করার প্রতিযোগিতা, একে অপরকে টেক্কা মেরে উপরের সিঁড়িতে ওঠার প্রতিযোগিতার কারণে মানবসমাজ তখনও কলুষিত হয়ে ওঠেনি। বরং, বিভিন্ন প্রদেশের জাতিগত বৈচিত্র্য অনুষ্ঠানে প্রাণ সঞ্চার করতো। 

সব দেশেই ‘যত খুশি খাও’ রেস্টুরেন্টে যথেচ্ছ উদরপূর্তির প্রতিযোগিতা লেগে যায়। একবার মাছের ঝাঁকের মত ঢেউ তুলে সবাই এক টেবিলে ভিড় জমায়, সেখান থেকে আবার ছড়িয়ে পড়ে চারিদিকে। কেউ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে খেতে থাকে, টেবিলের কত দূরে বা কাছে অবস্থান নেয় সেদিকে খেয়াল থাকে না, অন্যান্য ভোজনরসিকদের চলাচল হয় বিঘ্নিত। 

আমাদের কলিগদের মধ্যে বেশ কয়েকজন পেটুক ছিলেন। এ ধরনের অনুষ্ঠানে তাদের বুভুক্ষ আচরণ সবারই নজর কাড়তো। তাদের নেতৃত্বে ছিলেন সহকর্মী মিয়া মেহেরবান আলী। মাঝারি গড়নের একজন সাধারণ অবয়বের ব্যক্তি, কিন্তু অনেকেই সন্দেহ করতেন তার পাকস্থলীতে সম্ভবত একটা জ্বলন্ত চুল্লি রয়েছে। খাদ্যদ্রব্য গলার নিচে নামতেই চুল্লি পুড়িয়ে সাবাড় করে ফেলত। 

মেহেরবান আলি ভারত থেকে উৎখাত হয়ে আসা মুহাজির। হিজরত করে আসার পর ক্ষুধার যন্ত্রণায় কেটেছে অনেকদিন। কাজেই ক্ষুধা নিবারণের তাড়ণা স্বাভাবিকভাবেই তীব্র। সুযোগ পেলে ক্ষুধার বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণা করতে দ্বিধা করতেন না।

মেহেরবান আরবি শব্দ, অর্থ সদয়, কিন্তু  রেস্তোরাঁর লোকদের কাছে হয়ে উঠলেন একজন জীবন্ত ত্রাস। খাবারের মজুদে টান পড়ার ভয়ে তারা শঙ্কিত হয়ে উঠলো। 

 প্রথম পর্যায়ে মিয়া সাহেব খাবারের লাইন থেকে প্রতিটি আইটেম জড়ো করে তার প্লেট পূর্ণ করলেন। পরিশেষে প্লেটটি মাউন্ট এভারেস্টের অব্য়ব ধারণ করল।

আমাদের টেবিলে বসা সহকর্মীদের অনেকেই ধারণা করলেন যে মেহেরবান পাহাড়তুল্য খাদ্য স্তুপের অর্ধেকটাই নষ্ট করবেন। একজন রসিক সহকর্মী দশ বনাম পাঁচ টাকার অনুপাতে বাজি ধরলেন যে মিয়া সাহেব তার  খাবার শেষ করতে পারবেন না। মেহেরবান খাবার শেষ করতে পারলে তিনি দিবেন ১০ টাকা, ব্যর্থ হলে ৫ টাকা পকেটে ঢুকাবেন।

আকর্ষণের মধ্যমণি মেহেরবান আলী আমাদের টেবিল থেকে একটু দূরে অন্য একটা টেবিলে বসেছিলেন। ‌ সবাইকে অবাক করে দিয়ে মেহেরবান আলী তাঁর খাদ্যস্তুপ শুধু খালিই করলেন না বরং প্লেটটি  পুনরায় বোঝাই করার জন্য উঠে পড়লেন। সহকর্মী সৌখিন বাজিগরের বাজির অংক ডবল হয়ে গেল ৫:২০।

 দ্বিতীয় রাউন্ডে মেহরবান আলি আরেকটি পাহাড়তুল্য খাদ্যের ঢিবি প্লেটে সাজিয়ে নিজের টেবিলে এসে নিঃশব্দে চেটে পুটে প্লেটটি পরিষ্কার করে ফেললেন ।  এবার অতিভোজনের কারণে তাঁর শারীরিক কি অবনতি হয় তা চিন্তা করে আমাদের কৌতুহল ক্রমশ উদ্বেগে পরিণত হতে শুরু করে।‌ 

এদিকে মেহেরবান থেমে নাই। তিনি আসন থেকে গাত্রোত্থান করে‌ ফলমূল এবং মিষ্টান্নের টেবিলের  দিকে রওনা দিলেন। ফিরে এলেন দু’টো মাঝারি সাইজের প্লেট পূর্ণ করে। একটিতে মৌসুমী ফল, অন্যটিতে মিষ্টির ভাণ্ডার।  .

 ইতোমধ্যে আমরা সবাই খাবার পর্বের সমাপ্তি টেনেছি। বলাই বাহুল্য, যে যার মত ‌সবাই নিজেদের অপেক্ষাকৃত ছোট পাকস্থলী পূর্ণ করতে ত্রূটি করেনি। 

চূড়ান্ত পর্বে আমাদের মনোযোগ কেড়ে নিল রেস্টুরেন্টে মেহেরবান আলির উদরপূর্তির নতুন রেকর্ড গড়ার দিকে।  তিনি আমাদের কৌতূহলের তোয়াক্কা না করে অখন্ড মনোযোগ দিয়ে রেকর্ড গড়ার দিকে এগিয়ে চললেন।

অনুষ্ঠান শেষে অফিসে ফিরে এসে আলাপ আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিলাম, মেহেরবানকে ভোজন বিলাসের খেসারত দিতে অন্তত সাত দিনের ছুটি নিতে হবে। 

আমাদের অবাক করে দিয়ে পরদিন তিনি যথা সময়ে অফিসে হাজির হলেন।  কয়েকজন একসঙ্গে তার সাথে লিফটে উঠছিলাম।  একজন পাঞ্জাবি রসিক সহকর্মী, সৈয়দ ফারোগ নাভিদ, তির্যক চোখে তার দিকে লক্ষ্য করে  ঠাট্টাচ্ছলে জিজ্ঞেস করলেন, “মিয়া সাহেব,গতকালের বুফে কেমন ছিল”?

আমরা মনে করলাম তিনি পেট খারাপের কথা বলবেন কিন্তু ফ্যাসফেসে ভাঙ্গা গলায় বললেন, “খাবার ঠিক ছিল কিন্তু তারা মাটন স্টুতে খুব বেশি ঘি ব্যবহার করেছিল। তার ফলে গলাটা একটু নষ্ট হয়েছে।” তার কাহিনী অনেক রং মিশিয়ে সেদিনের আলোচনায় মুখ্য বিষয়ে পরিণত হয়। 

সে সহজ সরল রঙিন দিনগুলোর স্মৃতি এখনো মনের গলিতে আনাগোনা করে । সে সহকর্মীদের অনেকেই পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে অন্য জগতে পৌঁছে গেছেন। যেখানেই থাকুন, কামনা করি সবার আত্মা শান্তিতে থাকুক।

About Post Author

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Pin It on Pinterest