October 29, 2025

‘উপরি’ শব্দটি এখন খুব একটা শোনা যায় না। এটা ঘুসের বিকল্প ভদ্র পরিভাষা; রেখে ঢেকে মার্জিত ভাষায় প্রকাশ করার কৌশল।

এখন আর কেউ রেখে ঢেকে বলে না, টেবিলের নীচ দিয়ে ‘উপরি’ নেয়ার চলও উঠে গেছে। লেন দেন টেবিলের উপর দিয়েই চলে। কিছু দিনের মধ্যে হয়ত ঘুষ নিয়ে রিসিপ্ট দেয়ার ব্যবস্থা চালু হবে ইনকাম ট্যাক্সের রিটার্নে খরচ হিসাবে দেখানোর জন্য।

রোগটা অনেক পুরনো; ১৯৭৫ সাল থেকে তা অসাংবিধানিক শাসকদের কর্তৃক দুর্নীতি জাতীয়করণের পর সময়ের পরিসরে মহামারীর রূপ নিয়েছে। ভ্যাক্সিন দিয়ে এ রোগ থামানো যাবে না। এখন দরকার অপারেশনের।

ইন্দোনেশিয়ায় সুহার্তের শাসনামলে ঘুষ স্বীকৃত লেনদেন বলে গণ্য করা হতো। ‌ আশির দশকে বাংলাদেশ জুট মিল কর্পোরেশনের এক ডেলিগেশন সেখানে পাটের বস্তা বিক্রি করার জন্য গিয়েছিল। ‌ যে সরকারি সংস্থা বস্তা কিনার জন্য আগ্রহ প্রকাশ করেছিল তারা ঘুষ দাবি করলে কর্পোরেশনের লোকজন বলল, আমরা সরকারি সংস্থা ঘুষের হিসাব দিব কি করে? তারা বলল, চিন্তার কারন নাই আমরা রিসিপ্ট দিয়ে দিব।

উপরি সম্পর্কে ব্রিটিশ আমলের এক মজার গল্প শোনা যায়। সরকারের এদেশীয় এক ঘুষখোর কেরানী বাবুর গল্প। সে বাবু সুযোগ পেলে ঘুষ খেতেন।

একবার অফিসের এক চাপরাশি তাঁকে এক লোকের কাছ থেকে ঘুষ নেবার সময় দেখে ফেলেন। তিনি কেরানী বাবুর শ্বেতাঙ্গ বসের কাছে গিয়ে নালিশ জানালেন, স্যার কেরানী বাবু ঘুষ খাচ্ছেন।

সাহেব ঘুষ শব্দটির অর্থ জানতেন না। তবুও, বিষয়টি কি তা সরেজমিনে দেখার জন্য কেরানী বাবুর রুমে হাজির হলেন।

ততক্ষণে, ঘুষ-দাতা চলে গেছে, কেরানী বাবু কলা খাচ্ছেন। তিনি ঘুষ নেয়ার পরপরই একটি করে কলা খান। তার ধারণা ছিল কলা খেলে পাপ মোচন হয়ে যায়।

সাহেব নিজের চেম্বারে ফিরে এসে চাপরাশিকে ডেকে ধমকালেন, তুমি খামাকা অভিযোগ করেছ; ঘুষ খাওয়া ভাল, স্বাস্থ্য ঠিক থাকে। আমাদের সবারই ঘুষ খাওয়া উচিত।

ফিরিঙ্গি সাহেব সেই যে স্বাস্থ্য ঠিক রাখার পন্থা বাৎলালেন তা পাকিস্তান আমলে জাতীয় স্বাস্থনীতির অংশ হিসাবে সবাই বরণ করে নিলো।

পাকিস্তান আমলে যখন করাচীতে চাকরি করি তখন আমার বাড়ী সংক্রান্ত কাজে মিউনিসিপাল অফিসে গিয়েছিলাম। সেখানে দেখলাম একজন কর্মকর্তা বহিরাগত একজনকে ধমকাচ্ছেন, রিশমত দেনে মে শরমাতে কিউ, টেবিল-কা নীচ ছে নেহি, উপরসে দো–ঘুষ দিতে কেন লজ্জা পাচ্ছ, টেবিলের নীচে কেন, উপর দিয়েই দেও।

করাচিতে স্টেট ব্যাঙ্ক অব পাকিস্তানের হেড অফিসে ফরেন এক্সচেঞ্জ বিভাগে চাকরিকালীন কয়েকটি ইন্টারেস্টিং ঘুষের কাহিনী শুনেছিলাম।‌ একজন করণিক পদের কর্মচারী, মেহেদী রাজা ‌ বিদেশ ভ্রমণের জন্য ফরেন এক্সচেঞ্জ পারমিট ইস্যু করার সেকশনে কাজ করত। ‌

ভারত ভ্রমনের জন্য ৫০ রুপি‌র পারমিট ইস্যু করা হতো। পারমিট ইস্যু করার জন্য তার ঘুষের রেট ছিল ৫ টাকা।‌ তবে, সে টাকা দিতে হতো দশটা সিগারেটসহ প্যাকেটে ঢুকিয়ে।‌ একবার এক পুলিশ খোলাখুলি ৫ টাকা পেশ করলে, মেহেদী রাজা তাকে ধমক দিয়ে বলল, ‘পুলিশের চাকরি করো কিভাবে ঘুষ দিতে হবে তাও জানো না। ব্যাংকের বাইরে থেকে এক প্যাকেট সিগারেট কিনে তার ভিতরে ঢুকিয়ে তমিজের সাথে পেশ করো’।

সে সময়েই ফরেন এক্সচেঞ্জ বিভাগে পলিসি সেকশনের দায়িত্বে ছিলাম। এক লোক তাঁর একটা কাজ অনুমোদনের জন্য কয়েক দিন ধর্না দিচ্ছিল। তাঁর আবেদন আইনে পড়ে না। এক পর্যায়ে সে প্রস্তাব দিল, তাঁর কাজটা করে দিলে একটা মোটর সাইকেল উপহার দিবে।

তরুণ বয়স, উচ্চ আদর্শের অঙ্গীকার নিয়ে চাকরি শুরু করেছি। তাঁর প্রস্তাব শুনে রেগে কাই, চোখ মুখ লাল।

পরে সহকর্মী উর্দুভাষী মাসরুরের পরামর্শ চাইলাম, এ লোকের কত সাহস, মোটর সাইকেল ঘুষ দিতে চায়। মাশরুর বাংলাদেশ ব্যাংকের ঢাকা অফিসে চাকরি করে গিয়েছে।

সে পরামর্শ দিল, তুম এতনা গোস্বা কিউ হোতা হায়, লে লো–তুমি এত রেগে গেছ কেন? নিয়ে নেও। বুঝেন ঠেলা। এধরনের ঘুষের আলামত বয়ান দিলে অনেকে রুষ্ট হবেন। তাই আগে বাড়লাম না।

আমার সোনার বাংলায়ও ব্যাধিটা নতুন নয়। তবে, পাকিস্তানীদের মত একে শিল্প পর্যায়ে নিতে কিছুটা দেরী হয়েছিল। এখন সে শিল্পে পাকিস্তানী ওস্তাদদের ছাড়িয়ে গেছে।

আমাদের ছোট সময় থেকে ঘুষ সামাজিক মর্যাদা পেতে শুরু করে। মেয়ে বিয়ের কথাবার্তার সময় ছেলে কি করে, কত টাকা বেতন পায়—এ সব প্রশ্ন জিজ্ঞেস করলে ছেলে পক্ষের লোকজনকে বলতে শোনা যেত, ছেলে অমুক অফিসে কেরানীর চাকরি করেন, বেতন একশ বিশ টাকা, কিন্তু ‘উপরি’ আছে। তখনকার দিনে কেরানি পদের চাকরিও মূল্যবান মনে করা হত। উপরির সুযোগ থাকলে তো কথাই নেই। ‌

ব্যস,কথা পাক্কা, আলহামদুলিল্লাহ। তারপর, বর কবুল। কিছু লোক দেখানো ইতস্তত করে সবার পীড়াপীড়িতে কান্না জড়িত কন্ঠে কনেও অস্ফুটে উচ্চারণ করে, কবুল কবুল কবুল। মধুরেণ সমাপয়েত!

কাজী সাহেবের নেতৃত্বে পরম করুণাময় আল্লাহর দরবারে মোনাজাত করা হয়, “আল্লাহ্‌, এ নতুন দম্পতি যেন পরহেজগার সৎ বান্দা-বান্দি হিসাবে আয় ইনকাম করে রুজি রোজগার জোগাড় করতে পারে সে তৌফিক দাও!”

About Post Author

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Pin It on Pinterest