শেয়ার মার্কেটের গল্প
যারা শেয়ার মার্কেটে বিনিয়োগ করে রাতারাতি বড়লোক হওয়ার স্বপ্ন দেখছেন তাদের জন্য একটি গল্প। আমার এ লেখাটি ডেইলি স্টার পত্রিকায় প্রকাশিত গল্পের বাংলা ভার্শন।
…………………………………
আমার প্রতিবেশী তালুকদার সাহেবের আফসোসের সীমা নাই। কোম্পানি বাহাদুর তার পূর্বপুরুষদের যে তালুকদার খেতাব দিয়েছিল, সে খেতাবটাই শুধু রয়ে গেছে, তালুকদারি নাই। ২০১০ সালে শেয়ার মার্কেটে তেজী ভাব দেখে তিনি ভাবলেন, তালুকদারী ফিরিয়ে আনা যাবে না, কিন্তু বংশের গৌরব পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে কয়েক বস্তা টাকা প্রয়োজন।
এ সময় শেয়ার মার্কেটের ইনডেক্স প্রতিদিন লাফিয়ে লাফিয়ে আকাশের দিকে ছুটে চলেছে। আকাঙ্ক্ষা পূরণের এইতো সুবর্ণ সুযোগ। তিনি ‘beg, borrow or steal’ পন্থা অবলম্বন করে ২০ লাখ টাকা জোগাড় করে অবিলম্বে শেয়ার মার্কেটে ঝাঁপিয়ে পড়লেন। তার মতো শত শত ভাগ্যান্বেষী রাতারাতি বড় হওয়ার এই সুযোগে শেয়ার মার্কেটে আক্ষরিক অর্থে ঝাঁপিয়ে পড়লেন।
এ উচ্ছ্বাসের অবারিত জোয়ার চার্লস ডিকেন্সের এ টেল অব টু সিটিজ থেকে কয়েক লাইন ধার করে বর্ণনা করা যেতে পারে, “It was the best of times. It was the worst of time. It was the age of foolishness, it was the epoch of belief, it was the epoch of incredulity…” এ ছিল সবচেয়ে সুসময়।এ ছিল সবচেয়ে দুঃসময়। এ ছিল নির্বুদ্ধিতার যুগ, এ ছিল আস্থার যুগ, এ ছিল অবিশ্বাসের যুগ….
এ আপাত সুসময়ের পিছনে ছিল কয়েকজন সুযোগসন্ধানী ফরচুন হান্টার। তারা নানা কৌশলে মার্কেটকে অবিশ্বাস্য উচ্চতায় পৌঁছে দেওয়ার আবহ সৃষ্টি করে চলে।
জনগনকে ধোকা দেয়া কতই না সহজ। সৃষ্টিকর্তা তাদের ডিএনএ তে লিখে দিয়েছেন আগে পিছে না ভেবে গুজবের পিছনে ছোটা, আগুনে ঝাঁপ দেওয়া, চিটফান্ড, মাল্টিলেভেল মার্কেটিং জাতীয় হায় হায় কোম্পানিতে টাকা বিনিয়োগ করে সর্বস্বান্ত হওয়া। ইদানিং ইভালি নামে এক কোম্পানি এ খেলা খেলতে মাঠে নেমেছে।
২০১০ সালে রাতারাতি বড়লোক হওয়ার সর্বনাশা নেশায় গা ভাসিয়ে দেয় ব্যাংকের ম্যানেজার ও তার ক্যাশিয়ার, ছাত্রসমাজ ও তাদের শিক্ষক, ইঞ্জিনিয়ার ও ওভারশিয়ার, ধনী দরিদ্র, বালক বৃদ্ধ, গৃহবধূ এমনকি তাদের বাসার কাজের মহিলারাও এ গুপ্তধন উদ্ধারের অভিযানে যোগ দেয়।
বছরের শুরুতে স্টক এক্সচেঞ্জে ইনডেক্স ছিল তিন হাজারের নিচে, বছরের শেষ প্রান্তে এসে তা বেড়ে দাঁড়ায় আট হাজারে।
ডিম ফোটার আগেই তালুকদার মুরগীর বাচ্চার হিসেব করতে লেগে গেলেন। হিসাব-নিকাশ করে ঘোষণা দিলেন তাঁর ২০ লক্ষ টাকার বিনিয়োগ ৬০ লক্ষ টাকায় পৌঁছে গেছে। তিনি যা শুনতে ব্যর্থ হলেন তা ছিল আগামী দিনের বিপর্যয়ের পদধ্বনি।
তালুকদার এবং আমাদের পরিচিত জনের সকলকে সর্বনাশা নেশা থেকে নিবৃত রাখার চেষ্টা ব্যর্থ হলো। তাদের পরামর্শ দিলাম, যেটুকু লাভ হয়েছে তাই নিয়ে খুশি থাকো।
কিন্তু কে শোনে কার কথা? তাদের নেশা চেপে বসেছে। আমার কথায় কান দেয়ার সময় কোথায়? আমার কাছে যারা আগে পরামর্শের জন্য আসতো, তারাই এখন আমাকে পরামর্শ দেয়া শুরু করলো। উৎসাহ দিতে লাগলো, তুমিও এ ব্যবসায় নেমে পড়ো। যাকে বলে, ভূমিকার অদল-বদল।
“তুমি বলছো মার্কেট ক্রাশ করবে?” তাদেরই একজন গলায় বিদ্রূপের রেশ তুলে বলল,”তোমার সদয় অবগতির জন্য জানাচ্ছি, মার্কেট আজ আরও বেড়ে গেছে শতকরা দুই ভাগ।”
আরেকজন বলল, মার্কেটে বিনিয়োগকারীদের বিও একাউন্ট সংখ্যা এখন ৩৫ লক্ষে পৌঁছে গেছে। এত মানুষ যখন মার্কেট এর পক্ষে ভোট দিয়েছে তারাই মার্কেটকে ধরে রাখবে।
এদের হাবভাবে দেখে আমার মনে পড়ল ভারতীয় প্রেস কাউন্সিলের প্রাক্তন চেয়ারম্যান, জাষ্টিস মারকেন্ডে কাটজুর একটি তির্যক বক্তব্য যা শুধু ভারতের নয় বাংলাদেশসহ সব দেশের বেলায় খাটে। “Ninety per cent Indians vote in droves like sheep and cattle. They are like a herd of cattle voting along caste and religious lines…..”
এতদিনে মার্কেট বাস্তবতার লাগাম ছিঁড়ে ঊর্ধ্বপানে ধেয়ে চলেছে। কোন কোম্পানির কতটা মূলধন, তাদের ব্যবস্থাপনার মান, ভবিষ্যতের সম্ভাবনা এবং রিজার্ভের পরিমাণ সেদিকে কারো খেয়াল নেই। বোঝাই যাচ্ছিল…. “Something is rotten in the state of Denmark”.
যা হওয়ার কথা ছিল তাই ঘটল ২০১১ সালের শুরুতেই মার্কেট মুখ থুবড় পড়লো। আবারো প্রমাণ হলো, যা উপরে উঠে, তা নিচে নেমে আসে। হাজার হাজার মানুষ সর্বস্বান্ত হয়ে গেল, কেউ কেউ আত্মহত্যার পথ বেছে নিল। চার্লস ডিকেন্সের সেই দুঃসময। ইতোমধ্যে যারা মার্কেটে পেছন থেকে কলকাঠি নাড়াচ্ছিল তারা কয়েক হাজার কোটি গুছিয়ে নিয়ে কেটে পড়েছে।
এটা শুধু বাংলাদেশের গল্পই নয়। সব মার্কেটে এ ধরনের পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় লক্ষ লক্ষ মানুষ সর্বস্বান্ত হয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ১৯২৯ সালে আমেরিকার ওয়াল স্ট্রিট স্টক এক্সচেঞ্জের দুনিয়া কাঁপানো ধ্বস।
১৯২৯ আমেরিকার পাবলিকদের ওয়াল স্ট্রিটের পথ ধরে রাতারাতি ধনী হওয়ার দুরাশা আকাশ পানে ধেয়ে চলছিল। শেয়ার মার্কেটের ইন্ডেক্স লাফিয়ে লাফিয়ে নতুন নতুন উচ্চতায় পৌঁছে যাচ্ছিল। এ কারসাজির পিছনে যারা ছিলেন তাদের মধ্যে একজন আমাদের অতি পরিচিত প্রেসিডেন্ট কেনেডির পিতা, জোসেফ কেনেডি।
বেশ কিছু সমালোচকরা বলছেন, মার্কেটের তাতিয়ে ফেলে বেহাল অবস্থা তৈরি করার পিছনে জোসেফ কেনেডির হাত ছিল। তিনি ছিলেন শেয়ার মার্কেটের একজন বড় ডিলার, আমেরিকার ১২ জন ধনাঢ্য ব্যক্তির একজন।
ফরচুন’ ম্যাগাজিনে একটা রিপোর্ট অনুযায়ী, জোসেফ কেনেডি ওয়াল স্ট্রিটের বাইরে তার জুতো পালিশ করাচ্ছিলেন। পালিশ ওয়ালা তাকে পরামর্শ দিয়েছিল, স্যার অমুক অমুক শেয়ার কিনেন; দাম বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে।
জোসেফ কেনেডি ভাবলেন যে মার্কেটে জুতা পালিশ ওয়ালা ভবিষ্যৎ বাণী করা শুরু করেছে, সে মার্কেটে থাকা ঠিক হবে না। তিনি অফিসে পৌঁছে সবগুলো শেয়ার ছেড়ে দেওয়ার জন্য নির্দেশ দেন। কয়েকদিন পরেই মার্কেট ক্রাশ করে।
শুধু জুতা পালিশ ওয়ালা নয়, ট্যাক্সি ড্রাইভার প্যাসেঞ্জারকে পরামর্শ দিত কোন শেয়ার কিনতে হবে । ভিক্ষুক তার দিনের কামাই কামাই দিয়ে শেয়ার কেনা শুরু করল। বাসার রাঁধুনি ব্রোকারেজ একাউন্ট খুলে শেয়ার মার্কেটের উঠনামা রীতিমতো মনিটর করত।
একজন কমেন্টেটর লিখলেন, যাদের টিপস দেয়ার কথা নয় তারাও দেওয়া শুরু করেছে, তাদের মধ্যে রয়েছে হটডগ বিক্রেতা, গৃহহীন লোকজন, বাঁশি বাদক, টোল আদায়কারী, বলরুমের নাচনেওয়ালি।
ওয়াল মার্কেটের ধ্বস আমেরিকায় ডেকে আনে দীর্ঘমেয়াদী অর্থনৈতিক মন্দা। এর অনুরণন পড়ে অর্থনীতির সবক্ষেত্রে। লক্ষ লক্ষ লোক বেকার হয়ে যায়, চাকরির ধান্দায় দুনিয়া চষে বেড়ায়, ক্ষুধার যন্ত্রণা ডাস্টবিন হাতড়াতে থাকে হাজার হাজার মানুষ। হেনরি কিসিঞ্জারের সেই তলাবিহীন ঝুড়ির অবস্থা।
কিনেসীয় অর্থনীতির মূলমন্ত্র অবলম্বন করে প্রেসিডেন্ট রুজভেল্ট নিউ ডিল খ্যাত প্রোগ্রামের আওতায় বেশ কিছু সরকারি প্রকল্প হাতে নিয়ে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করেন।
এ সময়েই আমেরিকার সবচেয়ে উঁচু স্থাপনা এম্পায়ার স্টেট বিল্ডিং, হুভার ড্যাম তৈরি করা হয়। এত কিছু করার পরেও মন্দা কাটছিল না। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর তাদের কপাল খুলে যায়। মিত্র শক্তির কাছে অস্ত্রশস্ত্র বিক্রি করে তারা মন্দা সামাল দিতে সক্ষম হয়।
মানুষের স্মৃতি বড্ড ক্ষণস্থায়ী। তারা বারবার আগুনে হাত দিয়ে আঙুল পুড়িয়ে ফেলে। ১৯২৯ এর পর মানুষ বারবার ছ্যাকা খেয়েছে বারবার আবার সেই পথে হেঁটেছে।
সবচেয়ে বড় ধ্বস নামে ১৯৮৭ সালে ব্ল্যাক মানডে বলে খ্যাত এক সোমবারে। ওয়াল স্ট্রিটে এক দিনেই ইন্ডেক্স ২২.৫% পড়ে যায়। আমেরিকার অর্থনীতি তছনছ হয়ে যায়। ১৬ টি ব্যাংক দেউলিয়া হয়, অনেক ব্যাংক সরকার অধিগ্রহণ করে কোনরকম বাঁচিয়ে রাখে। সর্বস্বান্ত হয়ে কেউ কেউ উঁচু বিল্ডিং থেকে লাফ দিয়ে আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়।
২০০৮-৯ সালে আবারো আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর হঠকারী বিনিয়োগের কারণে স্টক এক্সচেঞ্জে তার প্রতিফলন পড়ে। আমেরিকার এবং বিশ্বের অনেক দেশে এক দীর্ঘস্থায়ী ব্যাপী মন্দার কবলে পড়ে।
এর পরে ছোট বড় সব স্টক এক্সচেঞ্জ স্টক এক্সচেঞ্জে করো না কোন সময় মন্দার কবলে পড়ে। লন্ডন স্টকহোম মুম্বাই ঢাকা সিঙ্গাপুর টোকিও সবখানেই কমবেশি দরপতন লক্ষ্য করা গেছে।
একদিন অবস্থা স্বাভাবিক হবে। লোকজন আবারও শেয়ার মার্কেটের দিকে ঝুঁকে পড়বে। কেউ লাভ করবে কেউ ধরা পড়বে। ইতিহাস তাই বলে।
