স্কুলে ছোটবেলায় ভূগোল বইতে পড়েছিলাম তাবৎ দুনিয়ার মধ্যে ভারতের মেঘালয় অঞ্চলের চেরাপুঞ্জিতে সব থেকে বেশি বৃষ্টিপাত হয়। কি পরিমানে বৃষ্টি হয় এত দিন বাদে স্মরণ নাই।
বৃষ্টিপাতের পরিসংখ্যানটি অবিশ্বাস্য। বছরে গড়ে ১১৫০ সেন্টিমিটার–বৃষ্টির দেশ বাংলাদেশের চেয়ে প্রায় ১০ গুণ বেশি। কোন কোন বছর আকাশ ভেঙ্গে এত বৃষ্টি হয় যে তা’ পরিমাপ করতে ইঞ্চি, মিলিমিটারে কূলোয় না; ফুট বা মিটার ব্যবহার করা লাগে। যেমন, ১৮৬১ সালে চেরাপুঞ্জিতে আকাশ ভেঙ্গে ৬৫ ফুট পানি নেমে চার দিক সয়লাব করে ফেলে।
বছর বিশেক আগে কোন এক গ্রীষ্মের দিনে সূর্য তার তিন নম্বর গ্রহের উপর অকরুণ আগুন ঝরাচ্ছিল, সঙ্গে ছিল ঢাকার দূষিত আবহাওয়া। প্রচন্ড দাবদাহ থেকে কয়েক দিনের জন্য হলেও মুক্তি পেতে বাল্য বয়সে ভূগোলে পড়া মৃদু আবহাওয়ার মেঘালয়–শাব্দিক অর্থে, মেঘের আবাস ভূমি– ভ্রমণের প্লান প্রোগ্রাম বানাতে বসে গেলাম।
যে সাত জন নিকট জন সফরসঙ্গী হতে নাম লিখিয়েছিলেন, তাদের প্রত্যেকেরই কিছু না কিছু নিজস্ব অগ্রাধিকার ও খামখেয়ালীপনা ছিল।
মেঘালয় হোক অথবা মেসোপটেমিয়া, কোথাও গেলে মহিলা সদস্যদের তালিকায় প্রথমেই থাকে কেনাকাটা। তাদের কাছে টাকা পয়সা হাতের ময়লা। যত তাড়াতাড়ি ঝেড়ে ফেলা যায়, ততই স্বস্তি। এ চরিত্রের দু’জনও নাম লেখালেন।
অন্য দু’জন ইয়াং ম্যান ভিন্ন প্রকৃতির। তাদের কাছে টাকার প্রধান চারটা ভূমিকার মধ্যে শেষেরটা, অর্থাৎ স্টোর অব ভ্যালু, সোজা বাংলায় জমা করাটাই আসল। অন্য একজন ছিলেন ভোজন রসিক। পাহাড় ভক্ষণকারী হিসাবে নাম কুড়িয়েছেন।
দলের তিন বছরের কনিষ্ঠতম সদস্য সামনে যা পায় ধ্বংসস্তূপে পরিণত করে। তার অন্য অভ্যাস, বিছানা সোফা কার্পেট জায়গায়-অজায়গায় মূত্র বিসর্জন করে ভিজিয়ে দেওয়া। আমরা কীভাবে তার ধ্বংসাত্মক কার্যাবলী থেকে হোটেলওয়ালাদের দৃষ্টি ফাঁকি দিতে পেরেছিলাম তা ভিন্ন কাহিনী।
প্রবীণতম সদস্য হওয়ার কারণে বুদ্ধিশুদ্ধি কম হলেও দলটির পরিচালনার দায়িত্ব আমার উপর অর্পণ করা হলো। কঠিন দায়িত্ব বৈকি! ভিন্ন ভিন্ন চরিত্রের অর্ধ ডজন সফর সঙ্গীদের পরিচালনা কত কঠিন কাজ তা ইনিয়ে বিনিয়ে বলার দরকার হয় না। তবে, এটাও সত্যি, রংবেরঙের সফরসঙ্গী থাকার মজাটাই আলাদা। একে অন্যকে টিজ করে ভ্রমণের আনন্দ অনেকখানি বাড়িয়ে দেয়।
বাংলাদেশের উত্তর-পূর্ব কোণে মেঘালয় ভারতের একটি ক্ষুদ্র রাজ্য। আয়তন মাত্র ২২,৪২৯ বর্গ কিলোমিটার। রাজ্যটি অনিন্দ্য সুন্দর প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর। আবহাওয়া ও ভৌগলিক পরিবেশে স্বতন্ত্র সৌকর্য। স্কটল্যান্ডের মত প্রসিদ্ধ কুয়াশার আবরণে প্রায় ঢেকে থাকার কারণে ব্রিটিশরা এলাকাটির নাম রেখেছিল ‘স্কটলান্ড অব দি ইস্ট’। জনসংখ্যা মাত্র বিশ লক্ষ; বাংলাদেশের কোন কোন বৃহত্তর জেলার চেয়েও কম।
গারো, খাসিয়া ও জয়ন্তিয়া পাহাড়ের কোলে মেঘালয়ের বিস্তীর্ণ এলাকা ছোট-বড় পাহাড়ে ভরপুর। রাজধানী শিলং থেকে ৫৮ কিলোমিটার দূরে চেরাপুঞ্জি বাংলাদেশের সুনামগঞ্জ জেলার সীমান্ত থেকে খুবই কাছের জনপদ।
ঢাকা থেকে খাসিয়া পাহাড়ের পাদদেশে সিলেটের তামাবিল চেক পোস্ট দিয়ে শিলংয়ে যাওয়ার সবচেয়ে সহজ পথ। বাংলাদেশ সীমান্তের নো ম্যানস ল্যান্ডের এক ফালি জমিন পার হলেই ভারতের ডাউকি বর্ডার কিন্তু বাংলাদেশের সমতল ভূমির তুলনায় পাহাড় পর্বতে ঘেরা মেঘালয় একটা ভিন্ন জগৎ। ডাউকি থেকেই শুরু হয় ধরণীর বুক চিরে, সপ্তসুরের ঐক্যতান তুলে আকাশের গায়ে হেলান দিয়ে মৌনব্রত ছোট ছোট পাহাড়ের ঐক্যবদ্ধ সারি।
দু’দেশের রাস্তায়ও গাড়ি ঘোড়ার ভিন্ন চেহারা। বাংলাদেশের গাড়ি বেশির ভাগই জাপানের তৈরি, ওপারের গাড়ি নিজ দেশের তৈরি এম্বাসেডর, মারুতি সুজুকি, টাটা সুমো অথবা কমান্ডার।
সব চাইতে অবাক লাগল মেঘালয়বাসীর চ্যাপ্টা নাক ও অর্দ্ধনিমীলিত চক্ষুদ্বয়। তাদের ভাষা আমাদের কাছে গ্রিক ভাষার মতোই দুর্বোধ্য। শীঘ্রই বুঝতে পারলাম আমরা এসে গেছি গারো, খাসিয়া ও জয়ন্তিয়াদের নিজস্ব আবাস ভূমিতে।
তারা এশিয়ার বিভিন্ন স্থান থেকে এসে উপমহাদেশে বসতি স্থাপন করেছিল। গারো পাহাড়ের পাদদেশে গারো উপজাতি এসেছিল তিব্বত থেকে। হিন্দুকুশ পার হয়ে আর্যদের উপমহাদেশে আগমনের অনেক আগেই এ-সব নৃগোষ্ঠী মেঘালয় অঞ্চলে থানা গেড়েছিল।
আমাদের বাহন ‘কমান্ডার’ যতই আঁকাবাঁকা পাহাড়ি রাস্তার সর্পিল পথ পেয়ে উপর দিকে উঠছিল যাত্রী দলের হৃদপিন্ডের স্পন্দন ততই বেড়ে চলছিল। এমনকি দু’বছরের দুরন্ত সদস্য রাস্তার পাশের গভীর গিরিখাত দেখে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে তার বাকযন্ত্র কিছুক্ষণের জন্য বন্ধ করে দিলো।
এদিকে স্টিয়ারিংয়ে বসা খাসিয়া ড্রাইভার তার গাড়ি চালানোর পারদর্শিতা প্রদর্শনে লেগে গেল। পাহাড়ি রাস্তার কড়া বাঁকে গতি না কমিয়ে গভীর গিরিখাতের কিনারা দিয়ে বাঁক অতিক্রম করার সময় আসন্ন পতনের আশঙ্কায় দুর্বল চিত্তের সহযাত্রীরা যে যা দোয়া-দরুদ জানতেন পড়তে লাগলেন–কেউ নীরবে, কেউ উচ্চ স্বরে। এক জন তো উত্তেজনায় দোয়া-দরুদ ভুলে গিয়ে বিকল্প হিসাবে কান্না শুরু করে দিলেন।
ভয়ের সাথে বাস করতে করতে অভ্যাস হয়ে গেলে মন থেকে ভয়ও নাকি পালিয়ে যায়। সহযাত্রীরাও ভয়কে মনের এক কোনে চালান করে দিগন্তব্যাপী সবুজ বনানীর পার্বত্যভূমির সৌন্দর্য উপভোগের দিকে মনোনিবেশ করলেন।
‘দুর্গম গিরি কান্তার’ পার হয়ে তিন ঘন্টা পরে সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে সাড়ে চার হাজার ফুট উপরে মেঘালয় রাজধানী শিলং পৌঁছানো গেল। গত শতাব্দীর সপ্তদশ দশকে মেঘালয় বিগ ব্রাদার আসাম থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার আগে শিলং অখন্ড আসামেরও রাজধানী ছিল। বিচ্ছিন্নতার পর আসাম গৌহাটিতে নতুন রাজধানী স্থাপন করে।
ঢাকার প্রচন্ড দাবদাহ থেকে এসে শিলংয়ের সাড়ে চার হাজার ফুট উচ্চতায় ২০ ডিগ্রী শীতল আবহাওয়া আমাদের গায় শান্তির পরশ বুলিয়ে প্রশান্তিতে ভরিয়ে দিল। বাক্স পেটরা খুলে গরম কাপড় চোপড় পরে নিলাম।
আমার এক রোটারিয়ান পুত্রধন শিলংয়ের রোটারিয়ানদের সাথে যোগাযোগ করে শিলং ক্লাবে অভিযাত্রী দলের বসবাসের বন্দোবস্ত করে রেখেছিল। আমাদের সীমিত তহবিলের তুলনায় বাসস্থান হিসাবে ভালোই ছিল, খাবার-দাবার ও বেশ মুখরোচক। কিছুটা বিশ্রাম নিয়ে শহরটি পরিভ্রমনে বেরিয়ে পড়লাম।
রাজ্যের কয়েকটি সবচেয়ে বড় বড় উঁচু পাহাড়ের পাদদেশে অনেকগুলো উপত্যকায় বিস্তৃত শিলং শহর। উপজাতীয় উপকথায় শহরের প্রতিটি পর্বত শৃঙ্গ, হ্রদ, জল প্রপাতকে ঘিরে রয়েছে কিংবদন্তি।
এক কৃষক কন্যার গর্ভে জন্ম নেওয়া শিলং নামের দেবতার নামানুসারে শহরটির নাম রাখা হয়েছে। কথিত আছে, তিনি রাজ্যটিতে গণতান্ত্রিক ও ন্যায় বিচারের শাসন ব্যবস্থা প্রচলন করেন। ভাবতে ভালো লাগে, পাহাড়ী জনগোষ্ঠী যাদের আমরা উপজাতি বলে হেলাফেলা করি, তারা সে কোন আমলে গণতন্ত্র ও সুবিচারের মর্ম বুঝতে পেরেছিল। অন্য দিকে আমাদের সোনার বাংলায় একবিংশ শতাব্দীতেও গণতন্ত্রের শেষ রেশটুকু মুছে দেওয়ার জন্য সবাই তৎপর। এমন কী উচ্চ আদালতের সম্মানিত বিচারকবৃন্দ অনেক ক্ষেত্রে বিব্রত বোধ করে বিচারকার্য পরিচালনা করতে অস্বীকৃতি জানান।
গ্রীষ্মে শিলংয়ের শীতল আবহাওয়া, পরিকল্পিত রাস্তাঘাট, ফল-ফুলের বাগান এমনিতেই খুব আকর্ষণীয় বেড়ানোর জায়গা। তবুও, অনেক টুরিস্ট খুঁজতে থাকেন টুরিস্ট পয়েন্টস। আকর্ষণীয় টুরিস্ট পয়েন্টগুলো সম্পর্কে গাড়ি চালকরা নানান গল্প ফেঁদে ভ্রমণ পিপাসুদের উৎসাহ উসকে দেয়।
বেশির ভাগ টুরিস্ট পয়েন্টস খুব যে আকর্ষণীয় তা নয়। তবুও রুজি রোজগারের জন্য মানুষকে কতই না বাহানা খুঁজতে হয়। আমার সফরসঙ্গীরা তাদের গল্পে মজে গেল। টুরিস্ট পয়েন্টসগুলোর পয়েন্ট বাই পয়েন্ট পরিভ্রমণের জন্য তারা পুরো এক দিন কাটানোর সিদ্ধান্ত নিল।
শহরের ৫ কিলোমিটার দূরে যমজ দুই ফলস বিডন আর বিশপ। দুটোই একই পাহাড় থেকে নেমে এসেছে। বাঁ দিকে বিডন আর ডানপাশে বিশপ। দূর থেকে দেখা যায় সবুজ পাহাড়ের বুক চিরে নেমে আসা বিডন-বিশপের সৌন্দর্য। সৈয়দ মুজতবা আলীর কয়েকটি লেখায় বিডন-বিশপ জলপ্রপাতের কথা উল্লেখ থাকায় ভেবেছিলাম তাদের বিশাল জলধারা বোধ হয়তো পাহাড়ের উপর থেকে বিকট গর্জন তুলে নিচে আছড়ে পড়ছে। কিন্তু হতাশ হতে হলো। শুকনো মওসুমে প্রপাতগুলোর জলের ধারা ক্ষীণ হয়ে গেছে। দলের দুই একজন রসিক সদস্য মন্তব্য রাখলেন, একটু চেষ্টা করলে দলের কনিষ্ঠতম সদস্য তার চাইতে বেশি জলধারা নির্গত করতে পারে।
আরো দু’টো পয়েন্টও বেশ আকর্ষণীয়। তার একটা শহরের অভ্যন্তরে বড়পানি নামের কৃত্রিম সার্পেন্টাইন লেক– সর্পিল আকারের হ্রদ। লেকটির আরো দুটো নাম আছে–পলক লেক ও ওয়ার্ডস লেক। লেকে জলকেলি করার সুযোগ আছে।লেক সংলগ্ন বটানিক্যাল গার্ডেনে আছে শতাব্দী প্রাচীন পাইন গাছ ও দুষ্প্রাপ্য অর্কিড।
অন্যটি শহর থেকে দশ কিলোমিটার দূরে শিলং পাহাড়ের চূড়া। ছয় হাজার ফুট উচ্চতায় পাহাড়ের চূড়া থেকে পাখির দৃষ্টিতে দেখা যায় শহরের দৃশ্য এবং শহর ছাড়িয়ে দূর দিগন্ত পর্যন্ত বিস্তৃত সবুজ বনরাজি এবং গিরিখাত। ভারতের বিভিন্ন স্থান এবং বাংলাদেশের অনেক টুরিস্ট সে দৃশ্য উপভোগের জন্য চূড়াটিতে ভিড় জমায়।
১৮৮৯ সালে নির্মিত শিলংয়ের ১৮ হোলের গলফ কোর্সের দুনিয়া জোড়া নাম আছে। সম্ভবত, দেশের সবচেয়ে পুরনো গলফ কোর্স। গলফ কোর্সটি স্মরণ করে দেয় ব্রিটিশরা কলোনিতে তাদের মনোরঞ্জনের জন্য বিলেতি কায়দায় জায়গায় জায়গায় সুযোগ-সুবিধার আয়োজন করে রেখেছিল। তাই, ৫২০০ উচ্চতাও তাদের গলফ খেলার শখ চেপেছিল। বিলেত থেকে তো আর টাকা আনতে হয় নি। সে জন্য নেটিভরা তো আছেই। বাড়তি মনোরঞ্জনের জন্য মাঠের পাশেই রয়েছে পোলো গ্রাউন্ড।
রবী ঠাকুর তিন বার শিলংয়ে গিয়েছিলেন। ১৯১৯ সালে লিখেছিলেন ‘শেষের কবিতা, ১৯২৩-এ রক্তকরবী, শিলঙের চিঠি। তবে রবীন্দ্র স্মৃতিবিজড়িত বাংলোটি কেবলমাত্র বাইরে থেকে দেখার সুযোগ মেলে। তাই সই, কবিগুরু বলে কথা। বাইরে থেকে দেখেই দুধের স্বাদ ঘোলে মিটানো লাগে।
শিলংয়ের ট্যুরিস্ট স্পটগুলো পরিদর্শন পর্ব শেষ হলে পরের দিন বহু আকাঙ্ক্ষিত মেঘমালার সাথে মোলাকাতের জন্য চেরাপুঞ্জির পথে রওনা হলাম। চেরাপুঞ্জির স্থানীয় নাম সোহরা। এবার আমাদের বাহন মেঘালয় সরকারের টুরিস্ট বাস। বাহনটি কয়েকটি আকর্ষণীয় টুরিস্ট স্পটে ১৫ মিনিটের জন্য বিরতি দিতে লাগল।
পথিমধ্যে দর্শনীয় স্থান গুলোর মধ্যে একটি ছিল বিখ্যাত জল প্রপাত। জলের ধারা বহু উঁচু স্থান থেকে নিচে চুনা পাথরের পাহাড়ের গা বেয়ে গভীর গিরিখাতে আছড়ে পড়ে; নায়াগ্রা জলপ্রপাত থেকে অন্ততঃ ছয় গুণ উচ্চতা থেকে। আমাদের গাইড জানালেন, জলপ্রপাতটি ভারতের মধ্যে দ্বিতীয়, বিশ্বের চতুর্থতম উচ্চ প্রপাত। তুলনাটি একটু বাড়াবাড়ি রকমের মনে হল। জলপ্রপাতটি থেকে শুকনা মৌসুমে যে ক্ষীণ জলধারা নেমে আসে তার সাথে ভিক্টোরিয়া কিংবা নায়াগ্রা জলপ্রপাতের সাথে তুলনা করা যায় বটে কিন্তু যুক্তি খুঁজে পাওয়া যায় না।
জল প্রপাতটির নাম Nohkalikai. উচ্চতা প্রায় এগারো’শ ফুট। নামের সাথে কিছুটা সাদৃশ্য থাকলেও নোয়াখালীর সাথে কোন সম্পর্ক নেই। তবে, জলপ্রপাতটির নামকরণের পিছনে একটা করুন কাহিনী রয়েছে। কাহিনীটি কালি কাই নামের একটা দুঃখী নারীর মন্দভাগ্যকে ঘিরে।
অন্যান্য খাসিয়াদের মত কালি কাই ছিলেন অতি সুন্দরী, কিন্তু ভাগ্যের ফেরে অল্প বয়সেই বৈধব্য বরণ করতে হয়। বিধবা হলেও সোনার বরণ কন্যা, বয়সেও কাঁচা। কাছে দূরে উপত্যকা থেকে দলে দলে পাণিপ্রার্থী তাঁর কুটিরে ভিড় জমাতে থাকে। নতুন সংসারে মহিলার ছোট বাচ্চাটি লালন-পালনের জটিলতা চিন্তা করে আবার বিয়ের পিঁড়িতে বসতে রাজি ছিলেন না। পরিশেষে,একজন নাছোড়বান্দা যুবকের পীড়াপীড়ীতে কবুল বলে দিলেন।
হানিমুন পর্ব শেষ হওয়ার অল্প দিনের মধ্যেই মহিলার সন্তানকে ঘিরে সে পাহাড়ি রোমিওর মহব্বত ফিকে হয়ে আসে। শেষমেষ বাচ্চাটিকে হত্যা করে পথের কাঁটা সরিয়ে ফেলল। অসহায় নারীর আর কি-ই বা করার ছিল? তিনি বাড়ির কাছের গভীর গিরি খাতে লাফিয়ে পড়ে জীবন বিসর্জন দিলেন। তার নামানুসারে প্রপাতটির নাম রাখা হয় Nohkalikai.
প্রতিকূল পরিবেশে সন্তান পালনের দুর্লঙ্ঘ্য প্রাচীর ডিঙ্গিয়ে চিরকাল অসহায় নারীকুলের দু’ নয়ন থেকে বিসর্জিত অশ্রুর প্রতীক হিসাবে জলপ্রপাতটিও নিজের অশ্রুধারা পাহাড়ের পাষাণ-বেদীতে নিবেদন করে তাদের প্রতি সহমর্মিতা জানিয়ে চলেছে।
চেরাপুঞ্জির কাছাকাছি পৌঁছে বহু কথিত আকাশ ভেঙ্গে মুষলধারায় বৃষ্টিপাত মোকাবেলার জন্য প্রস্তুতি নিতে শুরু করে দিলাম। তবে, বছরের এ সময় চারদিক থেকে খন্ড খন্ড মেঘ আসন্ন বর্ষা মৌসুমে আক্রমণ চালাবার জন্য শুধু মাত্র ড্রেস রিহার্সেল শুরু করেছে। তারা উঠে আসছে পাহাড়ি বনের ঘন সবুজ গাছপালার ফাঁক দিয়ে, কঠিন শিলার বুকে কম্পন তুলে, নিকটের পাহাড়ের গভীর গিরিখাত ও উপত্যকা থেকে সর্পিল পথ বেয়ে। দুষ্ট বালক দলের মত পাহাড়ের ঢালে তাদের লুকোচুরি খেলার দৃশ্য সমতল ভূমির যাত্রীরা অবাক হয়ে দেখছিলাম।
রাস্তার কোন কোন এলাকায় আমাদের বাহন পঙ্খিরাজের মত মেঘের মধ্য দিয়েই এগিয়ে চলছিল। দলছুট এক উৎসুক মেঘ বাসের জানালার ফাঁকে ঢুকে আমাদের পরিচয় নেওয়ার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে অন্য জানালা দিয়ে বিদায় জানিয়ে সঙ্গী সাথীদের সাথে পুনরায় মিলিত হল।
অঝোর ধারায় বৃষ্টি ছাড়াও চেরাপুঞ্জিতে দর্শনীয় অনেকগুলো পার্বত্য গুহা রয়েছে। আমার চির কৌতুহলী সফরসঙ্গীরা একটা দীর্ঘ গুহার ভিতরে ঢুকে তাদের অভিজ্ঞতার ঝুলিতে নতুন একটা আইটেম যোগ করার সুযোগ হেলায় হারাতে দিবে কেন? আমার ক্লস্ট্রোফোবিয়া; বদ্ধ স্থানের ভীতি, অল্পতেই দম বন্ধ হয়ে আসতে চায়। গুহার মুখে বসে বিভিন্ন স্থান থেকে ট্যুরিস্টদের আনাগোনা দেখতে লাগলাম।
পৃথিবীর সব চেয়ে বেশি বৃষ্টিস্নাত চেরাপুঞ্জির মেঘ মালার সাথে মোলাকাতের পর এক ফোঁটাও বৃষ্টির ছাঁট গায়ে না লাগানোর অভিজ্ঞতা নিয়ে শিলংয়ের পথে রওনা হলাম। ফিরতি পথে কোচ ড্রাইভার একটা পাহাড়ের ঢালে কিছুক্ষণ থামিয়ে ব-দ্বীপীয় পলি মাটিতে গড়া আমাদের মাতৃভূমির দিগন্ত বিস্তৃত সমতল ভূমি দেখার সুযোগ করে দিলেন।
(Noakalikai waterfalls)
