October 29, 2025

ভাইকিংয়ের দেশ সুইডেনে

গত শতাব্দীর শেষ লগ্নে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে অবসর গ্রহণের আগে ব্যাংকের একঘেয়ে পেশা থেকে নতুনত্বের স্বাদ নিতে কয়েক মাসের জন্য টাকা ছাপানোর কাজের সুযোগ পেয়ে গেলাম। অনেক টাকা; কোটি কোটি টাকা পদদলিত করে হেঁটে বেড়ানোর সুযোগ। কিন্তু মাস শেষে তখনকার সরকারি তৃণসম তুচ্ছ বেতন স্কেলের নগণ্য পরিমাণ টাকা পকেট নিয়েই বাসায় ফিরতে হয়। বেতনের টাকা শেষ হয়ে যায় কিন্তু মাস শেষ হয় না।

স্কুলে টিচাররা কলুর বলদ বাগধারা দিয়ে বাক্য রচনা করতে‌ বললে সঠিক বাক্যের জন্য মাথা চুলকানো লাগতো। তখন জানা থাকলে চট করে উত্তর দেয়া যেত, টাকশালের কর্মীরা এক একটা কলুর বলদ। তবুও, কোটি‌ কোটি টাকার স্তুপের উপর দিয়ে নির্মোহ চিত্তে হেঁটে যাওয়ার মজাই বা কম কিসে?

টাকশালের পোশাকি নাম সিকিউরিটি প্রিন্টিং করপরেশন অব বাংলাদেশ। কারখানা গাজীপুরে। টাকা ছাপানোর হরেক রকমের যন্ত্রপাতি, মাল-মসাল্লা, সাথে মেলা ঝুট ঝামেলা। সে সবের সাথে প্রাথমিক পরিচয়ের পর, টাকা ছাপানোর মাল মসাল্লার উৎস সন্ধান ও সাপ্লাইয়ার্সদের সাথে দেন দরবারের উদ্দেশ্যে এবার গন্তব্য সুইডেন। সঙ্গে একজন জেনারেল ম্যানেজার।

সুমেরু বৃত্তের গা ঘেঁষে স্ক্যান্ডিনেভিয়া অঞ্চলে হাজার হাজার হ্রদ, বরফ আচ্ছাদিত পাহাড় পর্বতের দেশ সুইডেন। দেশের পূর্বাঞ্চলে রাজধানী স্টকহোম ১৪টি দ্বীপের সমন্বয়ে গঠিত। বিভিন্ন দ্বীপের সাথে যোগসুত্র স্থাপনের জন্য রয়েছে ৫০টি ছোট বড় সেতু। দক্ষিণ পশ্চিমে রয়েছে গোথেনবার্গ এবং মালমো। সে মালমোতে সফরসূচি অনুযায়ী আমাদের প্রথম যাত্রা বিরতি করতে হবে। সেখান থেকে স্থলপথে মালমোর অদূরে ট্রেলেবোর্গ শহরে কয়েকদিন কাটিয়ে রাজধানী স্টকহোমের যাওয়ার প্রোগ্রাম করা হয়েছিল।

সফরসূচিতে লেখা ছিল ঢাকা থেকে ব্যাংকক হয়ে কোপেনহাগেন, সেখান থেকে মালমো। তিনটি গন্তব্যের জন্য বিমানের তিনটি কুপন।

কোপেনহেগেন বিমানবন্দরে অবতরণের পর বাল্টিক সাগরের অপর প্রান্তে ৪২ কিলোমিটার দূরে মালমো যাওয়ার জন্য একটা কুপন বাকি ছিল। আধ ঘন্টা পর এয়ারপোর্টে অপেক্ষারত বাসে উঠে বসার জন্য মাইক্রোফোনে ঘোষণা শুনতে পেলাম। আমরা ভাবলাম বাসটা যথারীতি প্লেনের পাশে পৌঁছে দিলে জাহাজে উঠতে হবে। কিন্তু আমাদের অবাক করে ড্রাইভার এয়ারপোর্টের চারিদিকে পুরো একবার চক্কর দিয়ে থেকে হঠাৎ কোপেনহেগেন শহরে ঢুকে পড়ল। কিছু বুঝে ওঠার আগেই প্যাসেঞ্জারদের জমা করে দিল বাল্টিক সাগরের উপকূলে অপেক্ষারত নৌযানের পাশে। তখনই জানতে পারলাম,সে নৌযানেই আমাদের মালমো যেতে হবে। জীবনে এই প্রথম প্লেনের টিকিটে নৌকা ভ্রমণের অভিজ্ঞতা।

যান্ত্রিক ফেরি সাইজের বড় নৌযান হলেও হরে দরে নৌকা শ্রেণীর যানবাহন বলা যায় বৈকি? প্রথমে মনে করেছিলাম, আমার গল্পের নাম ‘এ জার্নি বাই বোট টু সুইডেন’ রাখলে কেমন হয়? সস্তা চমক বলে মনে হতে পারে ভেবে সে চিন্তা বাতিল করে দিলাম।

আমাদের শৈশবে স্কুলে টিচাররা যে‌ সব রচনা লিখতে দিতেন তার মধ্যে সব চেয়ে জনপ্রিয় ছিল ইংরেজি শিক্ষকের ‘এ জার্নি বাই বোট’ বাংলা টিচারের ‘নৌকা ভ্রমণ’।

সভ্যতা থেকে অনেক দূরে অজ পাড়াগাঁয়ের ইস্কুল, নাম মাত্র বেতনে সে জামানার অল্প শিক্ষিত স্যার প্লেনে চড়েননি, মোটরগাড়ি দেখেননি, রেল গাড়িতে ভ্রমণের সুযোগ পাননি। তাঁদের দৌড় ছিল অতি পরিচিত সাদামাটা নৌকা পর্যন্ত।

কল্পনার সবটুকু রঙ ঢেলে রচনা লিখতে কথার মালা সাজাতাম যাত্রা পথে নদীর দুই কূলে গ্রাম বাংলার সারি সারি বৃক্ষরাজির অনবদ্য সৌন্দর্য,‌ কূলে কূলে স্নানরত নারী পুরুষ, কলসি কাঁখে দুলকি চালে চলা সারি বেঁধে চলা রমণীকুল, শরতের স্নিগ্ধ হাওয়ার মিষ্টি পরশের সুখানুভূতির বর্ণনা দিয়ে। ছোট বড় নৌকার মাঝিদের ভাটিয়ালি গানের সুর নদীর বুকে মৃদু মন্ধ ঢেউ তুলে, দিগন্ত বিস্তৃত শস্য ক্ষেতের‌ ধানের শীষের দোলা লাগিয়ে বিদেশ থেকে প্রিয়জনের ফিরে আসার অপেক্ষারত প্রোষিতভর্তৃকা গ্রাম্য বধুর বিষন্ন হৃদয়ে শিহরণ তোলার কল্পিত দৃশ্য আমাদের বর্ণনা থেকে বাদ যেত না।

অতীতকে সাদামাটা আড়ম্বরহীন সোনালী সে দিনগুলো কালের গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। আমাদের প্রিয় শিক্ষকরা তাদের যথোচিত ধামে পৌঁছে গেছেন।
কল্পনার জগত থেকে বাল্টিক সাগরে দেখতে পেলাম যন্ত্রচালিত অজস্র নৌযান ঘরঘর শব্দ তুলে এদিক ওদিক ছুটে চলেছে। আজকের বস্তুতান্ত্রিক ইউরোপে পাল তোলা নৌকা, ভাটিয়ালি গানের সুর, কোথায় পাব? রবি ঠাকুরের বুক ভরা মধু বাংলার বধু জলকে চলার দৃশ্যও আশা করা বৃথা।
২।
এক কালের বর্বর দারিদ্র্যপীড়িত শোষক শ্রেণী কর্তৃক নিষ্পেষিত যাযাবর স্ক্যান্ডিনেভিয়ান জনগণ তাদের অতীত দিনগুলো পিছনে ফেলে এখন ঐশ্বর্যশালী, নির্ভেজাল গণতান্ত্রিক আবহাওয়ায় কল্যাণকামী অঞ্চলে পরিণত হয়েছে। চার দিকে উচ্চাভিলাষী যুদ্ধংদেহী শক্তিশালী রাষ্ট্রবেষ্টিতে হয়েও তারা নিজেদের আদলে শান্তির বাতাবরণ সৃষ্টি করতে পেরেছে। অস্ত্র ভান্ডার গড়ে তোলার দিকে তাদের আগ্রহ নাই। এমন কি ডেনমার্কের তেমন কোন স্ট্যান্ডিং আর্মি নাই। তাদের কাছে অস্ত্র প্রতিযোগিতার চেয়ে অস্ত্র বানানোই বেশি লাভজনক। তা দিয়ে কে কোথায় কাকে মারল তা নিয়ে চিন্তাভাবনা করে লাভ কি? সুইডেনের তৈরি বোফোর্স গান শক্তিশালী কামান। সে কামান ক্রয় কেন্দ্র করে ভারতীয় রাজনীতিতে এক সময় ঝড় বয়ে গিয়েছিল। মারণাস্ত্র বানাবার কান্ডারী ছিলেন আলফ্রেড নোবেল। সে কলঙ্ক থেকে কিছুটা পরিত্রাণের আশায় পরিণত বয়সে তার সম্পদ উৎসর্গ করেছেন নোবেল পুরস্কার প্রতিষ্ঠা করে।

৩।

স্ক্যান্ডিনেভিয়ানরা চিরকাল শান্তির অনুসারী ছিল না। অষ্টম শতাব্দীতে ভাইকিং, যারা পরবর্তীতে নর্মান নামে পরিচিত, ইউরোপে হত্যা লুণ্ঠন অগ্নিসংযোগ নারী হরণে লিপ্ত হয়। ভাইকিংরা পাল তোলা দ্রুতগামী নৌযানে দক্ষিণমুখী অভিযানে ভূমধ্যসাগর থেকে বড় বড় নদী বেয়ে গ্রাম ও শহরে লুটপাট চালাতে থাকে। এমনকি তাদের লুটপাট থেকে রোম শহরও নিস্তার পায়নি। কনস্টান্টিনোপলে হোলি রোমান এম্পায়ারকেও তারা ব্যতিব্যস্ত করে রেখেছিল।

কাল ক্রমে প্রভূত ধন সম্পত্তির অধিকারী হয়ে ভাইকিংরা ইউরোপের কয়েকটি অঞ্চলে থিতু হয়ে বসে এবং অচিরেই কেউ হয় সম্মানিত ব্যারন কেউ বা লর্ড। আমাদের দেশেও তাদের নমুনা রয়েছে। ব্রিটিশের দালালি করে কেউ হয় নবাব, কেউ রায় বাহাদুর, খান বাহাদুর, পরাক্রমশালী জমিদার। ফ্রান্সের নর্মন্ডি এলাকায় বসতি স্থাপনকারী নরমানরা উইলিয়ামের দ্য কংকোয়েরারের নেতৃত্বে ইংলিশ চ্যানেল পার হয়ে ১০৬৬ সালে বৃটেন দখল করে ফেলে।

৪।

ইউরোপের অধিকাংশ দেশ এখন অতীতের বৈরিতা ভুলে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের পতাকাতলে এক অভিন্ন অর্থনীতি, আইনকানুন প্রতিষ্ঠা করেছে। সদস্য দেশের নাগরিকদের ইউনিয়নের মধ্যে চলাচলের কোনো বাঁধা নেই। দেশের সীমান্তে পরিচয় পত্র দেখিয়ে অবাধে যেতে পারে যে কোনো ইউনিয়নভুক্ত দেশে। পাসপোর্ট-ভিসার ঝামেলা নেই। ইমিগ্রেশন অফিসারদের বিরক্তিকর প্রশ্নের উত্তর দিতে হয় না।

ফেরিতে আমাদের সহযাত্রীরা সবাই ইউরোপিয়ান ইউনিয়নভুক্ত দেশের সাদা চামড়ার নাগরিক। মালমোতে নেমে সবাই ইমিগ্রেশনের জন্য দাঁড়ালে বিশাল লাইন লেগে গেল। তবে, তাদের পরিচয় পত্রে এক নজর বুলিয়ে ইমিগ্রেশন অফিসার হাত নেড়ে পার করে দিল। এক নাগাড়ে হাত নাড়তে নাড়তে তার হয়তো ঘুমের আমেজ এসে পড়েছিল।

আমাদের সবুজ রংয়ের পাসপোর্ট দেখে নিদ্রা ভেঙ্গে হঠাৎ জেগে উঠলো। ইউরোপে ইমিগ্রেশনের লোকজনের ধারণা কোন এক দিন হয়তো এশিয়ানদের ছদ্মবেশে ভিন‌ গ্রহের লোকজন তাদের দেশ আক্রমণ করে বসবে। নিশ্চিন্ত হতে প্রশ্ন ছুড়তে থাকে যার শুরু হয় শুরু হয় কি মতলবে আগমন, চাকরি-বাকরি করার খায়েশ আছে কিনা? মাঝে মাঝে সন্দেহ হয় যাদের মস্তকের তালুর নিচে কোন গ্রে ম্যাটার নাই তাদেরই ধরে এনে ইমিগ্রেশনে বসিয়ে দেয়া হয়।

আমাদের বিষাদ হরিষে পরিণত হতে বেশি সময় লাগল না। ইমিগ্রেশনের বাইরে মিস্টার হিরস দাঁড়িয়ে ছিলেন আমাদের অভ্যর্থনা জানাতে। সুইডেনের ব্যাংক নোটের জন্য নিরাপত্তা কালি প্রস্তুতকারী ‌কোম্পানির প্রতিনিধি।‌ উষ্ণ করমর্দনে পর তিনি আমাদের সুইডেনে স্বাগতম জানালেন। হিরস অত্যন্ত সুরসিক মানুষ। পরবর্তী কয়েক দিন আমাদের সঙ্গ দিলেন। ফাইফরমাশ করলে সঙ্গে সঙ্গে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন। কিছুটা হয়তো বাণিজ্যিক স্বার্থ ছিল, কিন্তু মিষ্টভাষী হিরস একজন অপরিচিতকেও সহজে বন্ধু বানিয়ে ফেলতে পারেন।

৫।

সুইডেন পৃথিবীর মধ্যে অন্যতম সমৃদ্ধশালী দেশ। নাগরিকদের জন্য রয়েছে বহুমুখী সামাজিক নিরাপত্তা জাল। ছেলে-বুড়ো এমনকি নবজাতকের জন্য রয়েছে সব রকম সুযোগ সুবিধা। বেকার ভাতার পরিমাণ নিয়মিত চাকরির আয় থেকে খুব একটা কম নয়। চলাফেরা, চিন্তা চেতনা, মতামত প্রকাশের, যেমন ইচ্ছা নিজে জীবন পরিচালনা করার অবাধ স্বাধীনতা।

সুইডেন স্বাধীনতার ধারণা এত উচ্চ স্তরে নিয়ে গেছে যে বিবাহ নামক প্রতিষ্ঠানটি প্রায় লুপ্ত হতে বসেছে। তার জায়গায় স্থান করে নিয়েছে লিভিং টূগেদার।‌ কুমারী মা বলে কেউ তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে না। স্কুলে ভর্তি হওয়ার সময় বাচ্চার পিতার নাম জিজ্ঞেস করে না।‌ অধিকাংশ লোকজনের ধর্মের প্রতি কোন বিশ্বাস নেই।

এত প্রাচুর্য, সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী, বাক স্বাধীনতা, যেমন ইচ্ছা জীবন পরিচালনা করার অধিকার যে দেশে রয়েছে সেখানে বাস করার কতই না মজা! কিন্তু সৃষ্টিকর্তা ঐশ্বর্যের অনুপাতে মানব সমাজে সুখ-শান্তি বন্টন করেন না। সেফটি নেট থাকার কারণে সামনে কোনো চ্যালেঞ্জ থাকে না। পারিবারিক বন্ধন শিথিলতার কারণে একাকীত্বের যন্ত্রণা বয়ে বেড়াতে হয়। যন্ত্রণা এড়াতে, এমনকি আবহাওয়া বৈরী হয়ে গেলে, আত্মহননের পথ বেছে নেয়। ‌

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কর্তৃক প্রণীত ২০১৮ সালের ‌তথ্য অনুযায়ী সুইডেন আত্মহননকারীদের আত্মহত্যার তালিকায় উপরের দিকে ২৮ নম্বরে রয়েছে; প্রতি এক লাখে ১৪.৬ জন আত্মহননের পথ বেছে নেয়। তুলনামূলক ভাবে বাংলাদেশের অবস্থান ১২০ নম্বরে, সুইসাইডের হার লাখে ৫.৯ জন।‌

৬।

সুইডিশ কোম্পানির হেডকোয়ার্টার্স মালমো থেকে অল্প কিছু দূরে একটা ছোটখাটো শহর ট্রেলবুর্গৈ আমরা পরবর্তী কয়েক দিন কাটালাম। সে ক’দিন কোম্পানির কর্মকর্তাদের সাথে ‌ আলাপ আলোচনা, কল কারখানা পরিদর্শন, সংরক্ষণের ব্যবস্থা ইত্যাদি কাজে কালির জগতেই ডুবে ছিলাম।

একদিন কোম্পানির কনফারেন্স রুমে দেখলাম একজন জমি চাষরত কৃশকায় ছিন্নভিন্ন পোশাক পরিহিত কৃষকের তৈলচিত্র টাঙ্গানো রয়েছে। হিরসকে জিজ্ঞেস করলাম, তোমাদের অত্যাধুনিক কনফারেন্স রুমে বিধ্বস্ত চেহারার দারিদ্র-লাঞ্ছিত কৃষকের তৈলচিত্র টানিয়ে রাখার রহস্য কী?
রসিক মানুষ। উত্তর দিলেন, কোম্পানির কর্মচারীদের জন্য সাবধান বাণী; তারা যদি কাজকর্মে গাফিলতি করে তাদেরও‌ এমন অবস্থা হবে।

পরক্ষণে নিজের ব্যাখ্যাও যোগ করলেন,‌ ইউরোপে অতীতের নিপীড়নমূলক সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থায় নিষ্পেষিত জনগণের করুন অবস্থা তৈলচিত্রটিতে পরিস্ফুটিত করা হয়েছে। জমিদার শ্রেণীর লর্ডস ব্যারনরা প্রজাদের বিনা পরিশ্রমে শ্রম দিতে বাধ্য করত, নানা ধরনের ট্যাক্সের বোঝা চাপিয়ে দিত। ‌মধ্যযুগে ইউরোপে নিপীড়িত জনগণ সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে দীর্ঘকালব্যাপী নিরন্তর লড়াই করে পরিশেষে মুক্তির দিশা পেয়েছিল।‌ পরবর্তীতে তারাই আবার অন্যান্য মহাদেশে উপনিবেশ স্থাপন করে স্থানীয় জনগণের উপর অমানবিক অত্যাচার নিষ্পেষণ শাসন-শোষণ চালাতে থাকে। মানুষ কত সহজেই নিজেদের অতীতকে ভুলে যায়।

এক দিন হিরস জানালেন, শহরটির অনতিদূরে মাটি খুঁড়ে একটা ভাইকিং ভিলেজের সন্ধান পাওয়া গেছে। অতীতের সে দুর্ধর্ষ ভাইকিংদের বাসস্থান না দেখে যাই কি করে? তারা দ্রুতগামী নৌযানে সাগরের নীল পানি চিরে দূর দূরান্তে অভিযান চালিয়ে লুটতরাজ হত্যাকান্ড চালিয়ে যেত। কলম্বাস ‘ভুল করে’ আমেরিকা আবিষ্কারের অনেক আগেই তারা সে ভূখণ্ডে অহরহ যাতায়াত করত। মাঝখানে দুর্ধর্ষ কলম্বাস আমেরিকা আবিষ্কারকের খেতাব নিয়ে নেয়।
মাটি খুঁড়ে বের করা ভাইকিংদের গ্রামটি নেহায়েত সাদামাটা। হয়তো কোনো গরিব শ্রেণীর ভাইকিংদের গ্রাম। ঘরবাড়ি পাথর দিয়ে গড়া, আসবাবপত্র যৎসামান্য, দুঃসহ আবহাওয়া রক্ষা পেতে তাদের চিরন্তন প্রচেষ্টার লক্ষণ বাসস্থানটি দেখে অনুমান করা গেল।

৭।

কয়েক দিন পর দেশের পূর্ব প্রান্তে রাজধানী স্টকহোমের উদ্দেশ্যে যাত্রা করলাম। প্লেন থেকে দেখা‌ যায় চারিদিকে জলরাশি বেষ্টিত নগরটির বিভিন্ন দিক দিয়ে পানির খাল নাল ঢুকে পড়েছে। ইউরোপের উত্তরের দেশগুলোর বলতে গেলে পানির সাথেই বসবাস। তাদেরই একটা জনপদ হলান্ড সমুদ্র থেকে বাঁধ ও ব্যারেজ দিয়ে পানি ঠেকিয়ে উদ্ধার করা হয়েছে।

স্টকহোম সুইডেনের আধুনিক রাজধানী। প্রাক্তন রাজধানী উপসালা। সেখান থেকে সুইডিশ রাজারা সুইডেন, নরওয়ে, ফিনল্যান্ড সমন্বয়ে গঠিত সাম্রাজ্য শাসন করতো। ১৯০৫ সাল নাগাদ নরওয়ে সুইডেনের সাথে যুক্ত ছিল। সে বছর তারা আলাদা ভাবে নিজেদের স্বাধীন রাষ্ট্র হিসাবে পরিচালনার সিদ্ধান্ত নেয়। ‌তা নিয়ে অন্যান্য দেশের মত যুদ্ধ-বিগ্রহ ঝগড়া-ফাসাদ হয়নি। আপসে আলাদা হয়ে যায়।

সুইজারল্যান্ন্ডের মত সুইডেনও যুদ্ধ-বিগ্রহ এড়িয়ে চলছে। ১৮১২ সালের পর তারা কোন যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে নি। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শুরুতে হিটলার পশ্চিমমুখি অভিযানে‌ এক ঝটকায় সুইডেনের দোরগোড়ায় হাজির হয়ে তার সাথে সহযোগিতা করতে বাধ্য করে। সুইডেন নিজেদেরকে একটি নিরপেক্ষ দেশ বলে চালাতে চাইলেও তলে তলে হিটলারকে সমর্থন দিয়ে আসছিল।
যুদ্ধ-বিগ্রহ মানুষের চিন্তা চেতনার উপর বিশাল প্রভাব রাখে। নিজেদের বাঁচার তাগিদে বা স্বার্থ চরিতার্থ করতে শান্তিপ্রিয় সাধারণ জনগণ শত্রুর সাথে হাত মিলিয়ে থাকে। একই কারণে ‘৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় রাজাকার, আলবদর, আলশামস নামধারী পাকিস্তানি হানাদারদের সাথে সহযোগিতা করেছিল। সুইডিশরা অন্ধকার অধ্যায় ভুলে থাকতে চায়। ঐতিহাসিকেরাও সে কাহিনী এড়িয়ে চলে।‌

যুদ্ধের এক পর্যায়ে রাশিয়া ফিনল্যান্ড দখল করে সুইডেনের দোরগোড়ায় পৌঁছে যায়। সম্ভাব্য হামলা প্রতিরোধ করার উদ্দেশ্যে প্রধান মন্ত্রী হ্যান্সেন কমিউনিস্ট পার্টিকে বাদ দিয়ে সর্বদলীয় মন্ত্রিসভা গঠন করেন। তিনি জনগণকে হিটলারের বিরোধিতা করা থেকে নিবৃত্ত করেন। সুকৌশলে যুদ্ধের দিনগুলো পার করে সুইডেনকে নিরাপদে রাখেন।

সংক্ষিপ্ত সময় কৌশলগত কারণে নাজীদের সহযোগিতা করলেও‌ সুইডেন ইউরোপের ক্ষমতার দ্বন্দ্ব থেকে দূরে রাখতে পেরেছে। তারা শান্তির পথ বেছে নিয়ে সভ্য জনপদ গঠনে মনোযোগ দিয়েছে। দেশে শিক্ষা-সংস্কৃতি বিকাশ লাভ করেছে। তাদের দেশের এক সঙ্গীত গোষ্ঠী আব্বা তাদের সংগীতের মূর্ছনায় বিশ্বব্যাপী সঙ্গীত পিপাসুদের মন জয় করেছিল। তার ঢেউ বাংলাদেশে এসে পৌঁছেছিল।তাদের দেশেই আলফ্রেড নোবেল সব চেয়ে মূল্যবান নোবেল পুরস্কার প্রবর্তন করেছেন। পুরস্কার বিতরণের দায়িত্বে নিয়োজিত সুইডিশ একাডেমি অব সায়েন্স ভবন ভিজিট করার প্রোগ্রাম বানিয়ে ফেললাম।

আলফ্রেড নোবেল কি কারণে পুরস্কারটি প্রবর্তন করেছিলেন সে সম্পর্কে একটা ইন্টারেস্টিং কাহিনী পড়ার সুযোগ হয়েছে। তার ভাইয়ের মৃত্যু হলে ফ্রান্সের একটি সংবাদ পত্র আলফ্রেড নোবেলেরই মৃত্যু হয়েছে মনে করে শোক সংবাদ ছাপে। ডিনামাইট ও অন্যান্য মারণাস্ত্র তৈরিতে তার ভূমিকার জন্য পত্রিকাটিতে নিন্দা জানানো হয়। দুর্নাম কাটাতে নোবেল তার সম্পদের একটা বড় অংশ নোবেল পুরস্কারের জন্য বরাদ্দ করেন। একাডেমি ভবনের বিভিন্ন কক্ষ পরিদর্শন করতে আমাদের মনে পড়ল‌ বহুযুগ ধরে কতইনা বিখ্যাত মনীষী এখানে পদধূলি রেখে গেছেন। মনে গর্ব হল বেশ কয়েকজন বাঙালিও সে দলে সামিল ছিলেন।

৮।

বলা হয়ে থাকে, বিদেশে বাঙালি মাত্রই সজ্জন। তাদেরই একজন দুর সম্পর্কের ভাগ্নে ফরিদ তখন থেকে দুই যুগ আগে সুইডেনে বাস করছে। একজন সুইডিশ মেয়েকে বিয়ে করে সংসার পেতেছে। নাম মারগারেথা। মিষ্টি স্বভাবের সহজ-সরল মহিলা। তার সাথে আগেও সুইডেন ভিজিটের সময় পরিচয় হয়েছিল। ঢাকায় বেড়াতে আসলে পরিচয় আরো নিবিড় হয়।
সুইডেনে আসবো জেনে ফরিদের মা এক বোতল আচার দিয়েছিল। ফরিদ নাকি আচার খুব পছন্দ করে।‌ মায়েদের সংবেদনশীল মন বলে কথা।

তখন মোবাইল ফোন আবিষ্কার হয়নি। ল্যান্ড ফোনে ডায়াল করলে ওপার থেকে মার্গারেথার আওয়াজ পাওয়া গেল। ফরিদের মামা শুনে সে খুবই উচ্ছসিত। ফরিদ কাজে গিয়েছে। মারগারেথা নিমন্ত্রণ জানালো, সন্ধ্যায় আমাদের সাথে নৈশভোজে যোগ দিলে খুবই খুশি হব।

সূর্যাস্তের আগেই ফরিদ হোটেল থেকে তার বাসায় নিয়ে গেলে দেখলাম বাসার সামনে মারগারেথা তার দুই পুত্র সহ আমার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে।

সন্ধ্যা ভোজের সময় ফরিদ জানালো, মারগারেথা বাংলাদেশী খাবারের রন্ধনপ্রণালী বই জোগাড় করে, দিনভর বাজার থেকে মাল মসালা যোগাড় করে রান্নাবান্না করেছে। আনাড়ি হাতের রান্না আহামরি ধরনের মুখরোচক না হলেও, যেটুকু ঘাটতি তাদের হৃদয়ের উষ্ণতা দিয়ে পূরণ করে দিয়েছিল।

সুইডেন ভ্রমণের শেষ পর্যায়ে ডেনমার্ক ঘুরে যাওয়ার ইচ্ছা ছিল। আমাদের সর্ব কাজের সহযোগী হিরস সর্বাত্মক চেষ্টা করেও স্থানীয় ডেনমার্ক এম্বাসি থেকে ভিসা জোগাড় করতে পারেনি। তাদের যুক্তি, ঢাকা থেকে কেন ভিসা দিয়ে আসা হয়নি?

আবার সেই ‘জার্নি বাই বোট’।‌ এবার কিন্তু বাল্টিক সাগরের উপকূলে ইমিগ্রেশন অফিসার কাউকে দেখতে পেলাম না। বাল্টিক সাগর পাড়ি দিয়ে ডেনমার্ক ভূখণ্ডেও ইমিগ্রেশনের কাউকেও দেখা মিলল না।‌ ভাবলাম, তারা হয়তো সবাই একযোগে ছুটি নিয়েছে, কিংবা ধর্মঘট করে বসেছে। স্ক্যান্ডিনেভিয়ায় পুলিশের লোকজন নাকি ট্রেড ইউনিয়ন করতে পারে। ধর্মঘট করতে পারে কিনা জানা নাই।

যা হোক, ফেরি থেকে নেমে বাসে কোপেনহেগেন শহরের মাঝ দিয়ে এয়ারপোর্টের বাইরে আমাদের ছেড়ে দিয়ে ড্রাইভার বিদায় নিল। সেখান থেকে ইচ্ছে করলে পুরো শহরটা ঘুরে দেখতে পারি। অথচ,‌তাদের স্টকহোমের দূতাবাস ভিসা দিতে কি টালবাহানাই না করেছিল।

কিন্তু আমাদের হাতে সময় নাই। ঘন্টা খানেক বাদে আমাদের ফ্লাইট ছাড়বে। ‌ আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে ছায়া সুনিবিড় শান্তির নীড় আমাদের অতি পরিচিত গৃহকোণ।

About Post Author

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Pin It on Pinterest