October 29, 2025

তুরস্কের ইতিবৃত্ত ও তার ভূগর্ভস্থ শহর

গল্পটা এভাবে শুরু করা যায়।
এক ছিল গ্রাম। গ্রাম না বলে শহরও বলা যায়। কয়েক হাজার লোকের শহর। সকাল বেলা যে যার মত প্রাতরাশ সেরে ঘর থেকে বেরিয়ে পড়েছে। কৃষক জমিতে কাজ করছে, রাখাল মাঠে গরু-ছাগল চরাচ্ছে, গৃহ বধু ঝর্ণা থেকে জলভরা কলসী কাঁখে ঘরে ফিরছে।
বাচ্চারা কি করছে? সব দেশের বাচ্চারা যা করে–খেলা-ধুলা, হৈ হুল্লোড়, মান-অভিমান, হাতাহাতি। হঠাৎ পাহাড়ের উঁচুতে বসা পাহারাদার দিগন্তে দেখতে পেল একদল আক্রমণকারী তাদের মহল্লার দিকে ছুটি আসছে। সে সাবধান বাণী সব খানে ছড়িয়ে দিল, “মহল্লাবাসী, সাবধান! শত্রু দল আমাদের দিকে ধেয়ে আসছে। যার যার ঘরে ঢুকে পড়ো।“
তার সাবধান বাণী পাহাড়ের গায়ে প্রতিধ্বনি তুলে উপত্যকার চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ল। কয়েক মিনিটের মধ্যে কয়েক হাজার মানুষ হাওয়ায় মিলিয়ে গেল। পাথর দিয়ে সুড়ঙ্গের পথ বন্ধ–বাইরে থেকে বোঝার উপায় নাই তার মধ্যে এলাকার এতগুলো লোকজন লুকিয়ে থাকতে পারে।

হামলাকারীরা‌ অবাক, “এলাকার লোকজন কোথায় গেল–তারা কি অদৃশ্য হওয়ার যাদু জানে?”
ভাবছেন, সাইন্স ফিকশন‌ভিত্তিক কোন সিনেমার দৃশ্য। আসলে, মোটেই কল্পলোকের কাহিনী নয়। হঠাৎ অদৃশ্য হওয়া মানুষগুলো এক কালে আমাদের এ ধরাধামেই বাস করত। তারা জাদু জানতো না, কিন্তু মুহূর্তের মধ্যেই আক্ষরিক অর্থে পাহাড়ের নিচে সযত্নে গড়া গোপন শহরে শত্রুর দৃষ্টির অন্তরালে চলে যেতে পারত। পাহাড়ের নিচে যে একটা গুপ্ত শহর আছে তা শত্রুর কল্পনায়ও আসেনি।
আধুনিক তুরস্কের আনাতোলিয়ায় এ ধরনের অনেকগুলো ভূগর্ভস্থ শহরের সন্ধান পাওয়া গেছে। এ রকম একটা ‘শহরে’ ভ্রমণের পটভূমিতে এ কাহিনী। স্টেট ব্যাংক হেড অফিস করাচিতে চাকরি করি। এ সময় দুই সদস্যের ডেলিগেশনের একজন সদস্য হিসাবে অফিসিয়াল কাজে তুরস্কে যাওয়ার সুযোগ হয়।
প্রথম বারের মতো বিদেশে ভ্রমণের অভাবিত সুযোগ পেয়ে স্বভাবতই উৎফুল্ল।‌ ডেলিগেশনের অপর সদস্য মোহাম্মদ আসলম‌ খান। পাঞ্জাবের বয়স্ক সিনিয়র কর্মকর্তা। তিনি সস্ত্রীক তুরস্কে যাবেন।
আমাদের গন্তব্য মোস্তফা কামাল আতাতুর্কের স্মৃতি বিজড়িত তুরস্কের রাজধানী আঙ্কারা। গল্পের শুরুতেই সংক্ষেপে আধুনিক তুরস্কের ইতিহাসের দিকে চোখ বুলাতে পারি।
তুরস্কের ইতিহাসে সব চেয়ে উজ্জ্বল অধ্যায় ছয় শত বছর পৃথিবীর বুকে অটোমান সাম্রাজ্যের সদর্প বিচরণ। মধ্য এশিয়ার তুর্কি জনগোষ্ঠীর একটি শাখার নেতা ওসমান ত্রয়োদশ শতাব্দীর শেষ দিকে উত্তর আনাতোলিয়ায় একাংশ কব্জা করে ওসমানিয়া বা অটোম্যান বংশের পত্তন করেন।
অটোম্যানরা ক্রমে ক্রমে মধ্যপ্রাচ্য, দক্ষিণ পূর্ব ইউরোপ এবং উত্তর আফ্রিকা জুড়ে গড়ে তোলে বিশাল এক সাম্রাজ্য।
এমনকি অটোম্যান সম্রাট সুলতান মেহমেদ ১৪৫৩ সালে শক্তিশালী বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের দুর্ভেদ্য রাজধানী কনস্টান্টিনোপল দখল করে নতুন নাম রাখেন ইস্তাম্বুল। সেখানে প্রতিষ্ঠা করেন অটোমানদের নতুন রাজধানী। ক্রমে গ্রিস, সার্বিয়া বসনিয়া, হার্জেগোভিনা, হাঙ্গেরি, ইউক্রেনসহ দক্ষিণ পূর্ব ও সেন্ট্রাল ইউরোপের অনেকগুলো দেশ তাদের পদানত হয়।
অটোমানদের পশ্চিম মুখী অভিযাত্রা‌ অস্ট্রিয়ার রাজধানী ভিয়েনায় এসে থেমে যায়। ১৬৮৩ সালে শহরটি তারা বহু দিন অবরুদ্ধ করে রেখেছিল কিন্তু শীতকাল এসে যাওয়ায় প্রচন্ড শীত ও তুষার ঝড়ে তুর্কি সেনাবাহিনী বিপর্যস্ত হয়ে পড়লে অবরোধ উঠিয়ে নিতে বাধ্য হয়।
সে উপলক্ষে ভিয়েনাবাসীরা বিশেষ আকৃতি দিয়ে পেস্ট্রি তৈরি করে বিজয় উৎসব পালন করে। অটোমানদের পতাকার প্রতীক অর্ধচন্দ্র আকারের পেষ্টির নাম দেওয়া হয় ক্রসেন্ট (croissant), ইংরেজি ভাষায় ক্রিসেন্ট, বাংলায় অর্ধ চন্দ্র।
এখন পৃথিবীর সর্বত্র, এমনকি বাংলাদেশেও বেকারিতে পেস্ট্রিটি পাওয়া যায়। এ কাহিনী শোনার পর ক্রুসেন্ট খাওয়ার সময় হয়তো আপনার মনে পড়বে এর পিছনের ইতিহাস।

ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, সব সাম্রাজ্যর প্রথমে উত্থান ঘটে, মাঝখানে গৌরবের চরম শিখরে পৌঁছে পরিশেষে দুর্বল হয়ে বিলীন হয়ে যায়। সময়ের পরিসরে অটোমান সাম্রাজ্যও দুর্বল হয়ে পড়ে। অন্য দিকে ইউরোপিয়ানরা নতুন শক্তিতে বলিয়ান হয়ে ভূ-রাজনীতিতে তাদের শক্তিমত্তা প্রকাশ করতে থাকে। উনবিংশ শতাব্দী নাগাদ‌ তুরস্ক পরিণত হয়, রাশিয়ানদের ভাষায় ‘সিক ম্যান অব ইউরোপ’।
প্রথম বিশ্ব যুদ্ধে তুরস্কের অটোম্যান সাম্রাজ্য জার্মানির নেতৃত্বে অক্ষ শক্তির পক্ষে যোগ দেয়।‌ অক্ষ জোট পরাজিত হলে তুরস্কে নেমে আসে অমানিশার ঘন অন্ধকার। মিত্র শক্তির কয়েকটি দেশ তুরস্ক দখল করে নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি করে নেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছিল।
এ দুর্যোগের মুহূর্তে তুরস্ককের ত্রাণকর্তা হিসেবে আবির্ভাব ঘটে মোস্তফা কামাল পাশার।‌ তিনি তুরস্ককে শত্রু মুক্ত করে আঙ্কারায় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার প্রতিষ্ঠা করেন।
ইউরোপীয়দের বিরুদ্ধে কামাল আতাতুর্কের অসামান্য বীরত্বে সারা মুসলিম জাহানে আনন্দের ঢেউ বয়ে যায়। আমাদের‌ জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম তার স্বভাবসুলভ বাংলা-ফারসি-উর্দু শব্দ সম্ভার সাজিয়ে লিখলেন, ‘কামাল তুনে কামাল কিয়া’। কামাল তুমি অবাক কান্ড করেছ!
কামাল পাশার নামে খোদ তুরস্কে কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নামকরণ করার আগেই নোয়াখালীর উদ্যোগী জনতা কামাল আতাতুর্ক নামে‌ সে জেলায় একটা বিদ্যালয় স্থাপন করে। বাংলাদেশ সফরকালে তুরস্কের একজন প্রেসিডেন্ট বিদ্যালয়টি পরিদর্শন করেছিলেন।
মোস্তফা কামাল পাশা যাকে বলা হয় আতাতুর্ক বা তুরস্কের পিতা, ১৯২৩ সালে অটোমান বংশের রাজত্বের অবসান ঘটিয়ে তুরস্ককে প্রজাতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসাবে প্রতিষ্ঠা করেন। ইস্তাম্বুল থেকে রাজধানী সরিয়ে নেন আঙ্কারায়।
নতুন যুগের সাথে তাল মিলিয়ে কামাল পাশা ইউরোপীয় ধাঁচে আধুনিক ধর্ম নিরপেক্ষ দেশ হিসাবে গড়ে তোলার প্রত্যয় নিয়ে ব্যাপক সংস্কার মূলক কার্যক্রম হাতে নেন। পোশাক আশাক সংস্কৃতি সব ক্ষেত্রে পরিবর্তন আনেন। আরবি হরফের পরিবর্তে ল্যাটিন হরফ‌ চালু করেন।
তুরস্কে পদার্পণের আগে ধারণা ছিল একটা মুসলিম দেশ হিসাবে শহরের রাস্তার পাশে দেখতে পাওয়া যাবে তুর্কি ভাস্কর্যের সুদৃশ্য মসজিদের সুউচ্চ মিনার থেকে ধ্বনিত হচ্ছে নামাজে যোগ দেয়ার জন্য ‌আহ্বান।
কিন্তু তুরস্কের এক পা বসফোরাস প্রণালীর ওপারে ইউরোপে। দেশের ভূখণ্ডের বেশির ভাগ এশিয়ায় হলেও প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর তুর্কিরা পুরোপুরি মুখ ফিরিয়েছে ইউরোপের দিকে। তাদের নয়া রাজধানী আঙ্কারায় ইসলামিক চালচমন নজরে পড়ল না।
এখন অবশ্য শক্তিশালী তুর্কি প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান জাস্টিস এন্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টির ব্যানারে ইসলামিক কালচার ও শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার‌ চেষ্টা করছেন। এতে তাকে অনেক উজান ঠেলতে হচ্ছে। বছর কয়েক আগে সামরিক অভ্যুত্থানে ক্ষমতা হারাতে বসেছিলেন।

সেবার আঙ্কারা পৌঁছে শহরের সব খানে দেখতে পেলাম পুরোপুরি ইউরোপীয বাতাবরণ। ইউরোপিয় পোশাকে সজ্জিত‌ নারী পুরুষ, পরস্পরের বাহুলগ্ন হয়ে নির্বিকার চিত্তে রাস্তাঘাটে চলাফেরা করছে। আঙ্কারায় যে ক’দিন ছিলাম আযানের ধ্বনি কানে এসেছিল বলে মনে পড়ে না।
তবে শুনলাম, বেশ কয়েকটি নাইট ক্লাব রয়েছে। তুরস্কের সেন্ট্রাল ব্যাংক থেকে আমাদের সে একটা নাইট ক্লাবে ডিনারের আমন্ত্রণ জানানো ‌হল।
নাইট ক্লাব নাম শুনেছিলাম– তা কি জিনিস তেমন জানা ছিল না। সঙ্গী আসলাম সাহেব পাঞ্জাবের লোক। তাঁদের কাছে এ সব ক্লাব অজানা নয়।
তিনি সন্ধ্যায় আমাকে হোটেলের রুম থেকে কালেক্ট করে ডিনারের উদ্দেশ্যে রওনা হওয়ার সময় দেখলাম সাথে বিবিজান‌ নাই।
জিজ্ঞেস করলাম, ভাবীজী ডিনারে যাবেন না?
তিনি বললেন, তাকে ইয়োগার্ট (দই) দিয়ে ভাত খাইয়ে শুইয়ে রেখে এসেছি। ভাবিজীকে সাথে না নেওয়ার‌ মহিমা পরে বুঝেছি।
ভোজন পর্ব চলল গভীর রাত পর্যন্ত। তুরস্কের খাবার দাবার পৃথিবী বিখ্যাত। বলা হয়ে থাকে, খোদাতালা মানুষ সৃষ্টি করেছেন, মানুষ সৃষ্টি করেছে তুরস্ক, আর তুরস্ক সৃষ্টি করেছে মজাদার সব খাবার। সৃষ্টির প্রক্রিয়া আল্লাহর কাছ থেকে শুরু হয়েছে– কাজেই ভুরি-ভোজে কোন পাপ নেই।
তুরস্কের সুস্বাদু খাবার তাবৎ দুনিয়ার রেস্টুরেন্টের মেনুতে স্থান করে নিয়েছে। উপমহাদেশে শিক কাবাব, পোলাও, কোপ্তা, দোলমা ও অন্যান্য উপাদেয় খাবারের রেসিপি তুরস্ক থেকে আমদানি করা।
ভোজন পর্বে অন্যতম আকর্ষণ ছিল দ্রাক্ষারস। তুরস্কে ১৫ লক্ষ একর জমিতে আঙ্গুর চাষ হয়। তার থেকে তৈরি হয় উত্তম সোমরস। ভোজ সভার আয়োজক তুরস্কের সেন্ট্রাল ব্যাংকের একজন সিনিয়র কর্মকর্তা ব্যাখ্যা দিলেন, বেহেশতে যখন শরাবান তহুরা পাওয়া যাবে, আগে ভাগে আমরা একটু অভ্যাস করে নিলে দোষের কিছু নেই।
নাইট ক্লাবে সেদিন প্রধান আকর্ষণ ছিল স্পেন থেকে আগত এক বিখ্যাত নাচিয়ে দল। তারা কোন ঘরানার নাচিয়ে ‌ধারণা ছিল না। প্রথমেই স্টেজে কয়েকজন স্বল্পবসন নর-নারীর ধেড়েনাটা টাইপের নাচ। আমার মনে হল দাপাদাপি। এক জন নাচনেওয়ালি তো আমাদের সম্মানে খাবার টেবিলে উঠে এক‌ পশলা নাচ দেখিয়ে গেল। সবাই বাহবা দিতে লাগলো।
এর পর যে নাচ শুরু হল পরে জেনেছি তাকে বলে স্ট্রিপটিজ। এবার বুঝলাম, বস আসলাম সাহেব কেন তাঁর বিবিকে দই খাইয়ে হোটেলে তালা মেরে রেখে এসেছিলেন।
আসলাম সাহেব একটু দূরে আমার পাশের টেবিলে বসে ছিলেন। ইচ্ছাকৃতভাবে আমার দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে রেখেছিলেন। আমি অস্বস্তি বোধ করলেও তার মধ্যে সে রকম কোনো আলামত দেখতে পেলাম না।
ওদিকে তথাকথিত নৃত্য-নাট্যৈর কয়েক পরতা পোশাক পরিহিতা নায়িকা দেহ থেকে একে একে সাত-আট স্তরের বস্ত্র অপসারণ করে চলেছে। বুঝতে পারলাম, শেষ বস্ত্রখানা ছুড়ে ফেলার আগে তিনি উঠতে চাচ্ছেন না।
তবুও ইতঃস্তত করে বললাম, স্যার রাত অনেক হয়েছে ঘুম পাচ্ছে। ভাবি হয়তো চিন্তা করছেন– আমরা এবার যাই।, চক্ষু লজ্জার খাতিরে হোক, স্নেহবশত হোক, গড়িমসি করে সবার থেকে বিদায় নিয়ে হোটেলে ফিরে এলাম।
তিনি মনে মনে নিশ্চয়ই গালি দিয়েছিলেন, বিবিকে ভুলিয়ে-ভালিয়ে দই-ভাত খাইয়ে হোটেলে তালা মেরে আসলেও বেরসিক বাঙালি বালক শেষের আনন্দটা বরবাদ করে দিল। মনে মনে হয়তো ভেবে রেখেছিলেন ভবিষ্যতে আমাকে সাথে আনবেন না। সে সুযোগ আর হয়নি। পরের বছর শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ– বাংলাদেশ স্বাধীন হলে করাচির পাঠ চুকিয়ে আফগানিস্তান হয়ে দেশে পালিয়ে আসি।
আঙ্কারায় অফিসিয়াল কাজ-কর্ম এমন কিছু জটিল ছিল না। তিন দিন পরে আসলাম সাহেব সস্ত্রীক লন্ডন রওনা হয়ে গেলেন। ইরানের দুই‌ ডেলিগেশন মেম্বর ও আমি আনাতোলিয়ার রহস্যময় ভূগর্ভস্থ শহরের সন্ধানে বেরিয়ে পড়লাম।

ভুগর্ভস্থ ‘শহরটি’ আঙ্কারা থেকে প্রায় ৩০০ মাইল দূরে কাপাডোসিয়া অঞ্চলের গোরেমি শহরের কাছে। আমাদের গাইড ছিলেন তুরস্কের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একজন কর্মকর্তা।
আমাদের ল্যান্ড ক্রুজার দ্রুতবেগে আনাতোলিয়া বিস্তীর্ণ প্রান্তর দিয়ে ছুটে চলেছে। দু’পাশে জনবসতি খুব বেশি নয়, কিন্তু তারা বয়ে চলেছে অনেক ইতিহাস ও ঐতিহ্য।

প্রাচীনকাল থেকেই তুরস্কের আনাতোলিয়া অঞ্চলটি ছিল সভ্যতার সূতিকাগার, নানা জাতির মিলন কেন্দ্র। এলাকাটিতে আধিপত্য বিস্তারের জন্য যুগে যুগে‌ বিভিন্ন শক্তির মধ্যে বেজে উঠেছে অস্ত্রের ঝনঝনানি।

আনাতোলিয়ায় সভ্যতার বিকাশ ঘটতে থাকে নয়া প্রস্তর বা নিওলিথিক যুগে, প্রায় বার হাজার বছর আগে। তাদের শাসন কেন্দ্র কাটালহয়ুকের লোক সংখ্যা ছিল ছয় হাজার। বর্তমান প্রেক্ষিতে সংখ্যাটি এমন কিছু বড় নয়, তবে প্রাগৈতিহাসিক যুগে তা’ ছিল পৃথিবীর সব চেয়ে জনবহুল শহর।

সভ্যতা ক্রমবিকাশের ধারাবাহিকতায় চার হাজার বছর আগে কৃষ্ণ সাগরের ওপার থেকে প্রাচীন যুগের অন্যতম সভ্য হিট্টাইট জাতি আনাতোলিয়া হাজির হয়। তারা নিজস্ব কালচারের সাথে স্থানীয় জনগোষ্ঠীর কালচারের মেলবন্ধন এবং বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন করে উন্নত এক সভ্যতা গড়ে তোলে।
হিট্টাইটরা আনাতোলিয়া এসে থেমে যায়নি। সিরিয়া পর্যন্ত তাদের প্রভাববলয় বিস্তার করলে মুখোমুখি হয় সে যুগের অন্যতম বড় শক্তি মিশরের সাথে। তখন দ্বিতীয় রামেসিস ছিলেন মিশরের ফারাও বা ফেরাউন।
দুটি শক্তিশালী রাজ্য পাশাপাশি থাকলে তাদের মধ্যে ভারত-পাকিস্তান ইরাক-ইরানের মতো শক্তি প্রদর্শনের ইচ্ছা জেগে উঠে।
খ্রিস্টপূর্ব ১২৮৬ সালে হিট্টাইট ও মিশরীয়রা শক্তি পরীক্ষায় লেগে গেল। সে যুদ্ধের রণকৌশল ও অন্যান্য ঘটনার বিবরণ প্রথমবারের মতো ইতিহাসে লিপিবদ্ধ করে রাখা হয়। দুই বছর যুদ্ধের পরও জয় পরাজয়ের মীমাংসা না হাওয়ায় তারা শান্তি চুক্তি করে। এটাও ছিল ইতিহাসের প্রথম লিখিত শান্তি চুক্তি।

কোন শক্তি চিরকাল স্থায়ী হয় না। ইউরোপের উন্নত ফিজিয়ান জাতি হিট্টাইটদের পরাভূত করে আনাতোলিয়ায় একটি শক্তিশালী রাষ্ট্র রাজ্য গঠন করে। কিংবদন্তির মাইডাস যার হাতের ছোয়ায় সব কিছুই স্বর্ণে পরিণত হয়ে যেত, তিনি ছিলেন এই ফিজিয়ানদের একজন।

ফিজিয়ান রাজ্যকে ঘিরে আরো অনেক কিংবদন্তি আছে। তার একটি গর্ডিয়ান নট। বাংলায় বলা যায় গর্ডিয়ান গিট্টু। বড্ড জটিল গিট্টু। ফিজিয়ান রাজা রাজ্যের প্রবেশ দ্বারে একটা বিমে এ গিট লাগিয়ে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন যিনি তা খুলতে পারবেন তিনি ভবিষ্যতে এশিয়া শাসন করবেন।

কিংবদন্তি‌ বলে মহাবীর আলেকজান্ডার সে গর্ডিয়ান নট তরবারি একটা ঘাতের দ্বিখন্ডিত করে এশিয়ায় প্রবেশ করেন।

রাজা আসে রাজা যায়। খ্রিস্টপূর্ব ৭০০ সালে আনাতোলিয়ার পশ্চিমে লিডিয়ায় এক উন্নত সভ্যতার উদ্ভব ঘটে। লিডিয়ার রাজা ক্রয়েসাস সে যুগের অন্যতম সুন্দর রাজধানী গড়ে তোলেন। তারপর পারস্য সাম্রাজ্যের শক্তিশালী সম্রাট সাইরাস খ্রিস্টপূর্ব ৫৪৬ সালে রাজ্যটি দখল করেন।

ক্ষমতার পালাবদলের নিয়মে আলেকজান্ডার পার্শিয়ানদের হটিয়ে আনাতোলিয়া কেড়ে নেন। এর পর দৃশ্যপটে উদয় হয় রোমানদের।
রোমান সম্রাট জুলিয়াস সিজার বিনা যুদ্ধে আনাতোলিয়া দখল করে যে উক্তি করেছিলেন তা ইতিহাসের পাতায় স্থান করে নিয়েছে, veni vidi vici, আসলাম দেখলাম জয় করলাম।

আনাতোলিয়ার এন্টিওকে জুলিয়াস সিজারের মোলাকাত হয় সর্ব যুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সুন্দরী মায়াময়ী ক্লিওপেট্রার সাথে। বলাবাহুল্য, সিজার অচিরেই ক্লিওপেট্রার মহব্বতে হাবুডুবু খেতে লাগেন। কিন্তু অনেক ঘটনার জন্ম দিয়ে মায়াবিনী ক্লিওপেট্রা সিজারের সখা ও সেনাপতি মার্ক অ্যান্টোনিওর গলায় মাল্যদান করেন।
যে লোকেশনে তাদের শুভ বিবাহ অনুষ্ঠিত হয় সেখানে পৌঁছে হিসাব করে দেখা গেল অনুষ্ঠানে পৌঁছাতে দুই হাজার বছর লেট করে ফেলেছি। বিবাহের আমন্ত্রণ পত্রে অনুষ্ঠানের তারিখ ছিল খ্রিস্টীয় ৩০ সালের কোন এক তারিখে।
তখন মুসলমানদের ঈসা নবী, খ্রিস্টানদের যিশু‌ খ্রিস্টের বয়স ছিল ৩০ বছর। তাঁর কাছে হয়তো বিবাহের সংবাদ পৌঁছেছিল কিন্তু তিনি ব্যস্ত ছিলেন ইহুদিদের আল্লাহর বাণী শোনাতে। কিন্তু বেয়াড়া ইহুদিরা কবে পয়গম্বরদের কথায়‌ কান দিয়েছে? তারা চিরাচরিত স্বভাব অনুযায়ী ষড়যন্ত্রের আশ্রয় নিয়ে তখনকার রোমান গভর্নরের সাহায্যে যীশুকে ক্রুশবিদ্ধ করার ব্যবস্থা করে।

যিশু খ্রিস্টের তিরোধানর পর তার শিষ্যরা আনাতোলিয়ায়‌ আশ্রয় নিয়ে যীশুর বাণী প্রচার করতে থাকেন। তাদের মধ্যে ছিলেন সেন্ট পল। অন্য একজনের নাম সেন্ট নিকোলাস। তিনি সান্তাক্লজ নামেও পরিচিত। সান্তা ক্লজ ক্রিসমাসের সময় উত্তর মেরু থেকে বাচ্চাদের জন্য উপহার নিয়ে আসেন বলে ছোটদের গল্প শোনানো হয়। মোটকথা, জেরুজালেম নয়, আনাতোলিয়া ছিল খ্রিষ্টান ধর্মের প্রচার ও প্রসারের কেন্দ্রবিন্দু।

ইতিহাস থেমে থাকে না। ফ্রিজীয়, গ্রিক, পারসিক, রোমান এবং আরবদের পর‌ একাদশ শতাব্দীতে হানা দেয় মধ্য এশিয়ার দুর্ধর্ষ যাযাবর তুর্কি জাতি। তারা এখানে সেলজুক রাজবংশের পত্তন করে। তাদের শাসন আমলে অঞ্চলের জনগণ ও তুর্কি ভাষা ও সংস্কৃতির মিলন ঘটিয়ে গড়ে তোলে নয়া সভ্যতার বাতাবরণ।

১৩শ শতকে মোঙ্গলদের আক্রমণে সেলজুক রাজবংশের পতন ঘটে। তারপরই শুরু হয় অটোমানদের‌ ছয় শত বছর দীর্ঘস্থায়ী রাজত্ব যাদের কথা শুরুতেই বলেছি।
যিশু খ্রিস্টের তিরোধানের পর নব দীক্ষিত খ্রিস্টানদের উপর নির্যাতনের খড়্গ নেমে আসে। প্রায় তিন ‌শত বছর পর্যন্ত তারা মূর্তিপূজক রোমানদের হাতে নির্যাতনের শিকার হয়। ৩২৪ সালে রোমান সম্রাট কনস্টানটাইন আমলে খ্রিস্টানদের উপর অত্যাচার অবসান হয়। তিনি নিজেও খ্রিষ্টান ধর্ম গ্রহণ করেন।

ইতোপূর্বে, রোমানদের নির্যাতনের হাত থেকে বাঁচতে তারা গড়ে তোলে পাহাড়ের নিচে অদৃশ্য কয়েকটি ‘শহর’। গোরেমে থেকে ৫০ কিলোমিটার দূরে এ ধরনের একটা শহর দর্শনের জন্য আমাদের এতখানি পথ চলা। (গল্পের শেষে ছবিতে গোপন শহরে প্রবেশের জন্য প্রবেশদ্বার দেখতে পাবেন।)

গোপন ‘শহরে’ প্রবেশের জন্য রয়েছে একটা সুড়ঙ্গ। সুড়ঙ্গ দিয়ে নামতেই অনুভব করলাম দুই হাজার বছর আগের সেই ভীত-সন্ত্রস্ত লোকজনের কথা যারা শত্রুর ভয়ে এ সুড়ঙ্গ পথ দিয়েই লুকিয়ে পড়েছিল।
সুড়ঙ্গের পর সুড়ঙ্গ কেটে ১১ তলা পর্যন্ত অদৃশ্য শহর তৈরি করা হয়েছে। জানা গেল অন্য একটা অদৃশ্য জনপদ ছিল আঠারো তলা। সুড়ঙ্গের পাশে পাশে তৈরি করা হয়েছে ছোট ছোট চতুষ্কোণ বাসস্থান। কোনটা ১০×১০ ‌কোনটা ১০×৮ ফুট। গণ্যমান্যদের জন্য উন্নত বাসস্থান, অনেকখানি প্রশস্ত। ছোট বাচ্চাদের শোয়ার জন্য দেওয়ালের গায়ে ছিল ছোট ছোট গর্তের মত কুলুঙ্গি।‌ হ্যাভ এন্ড হ্যাভ নটদের ব্যবধানে চলে আসছে সে আদিকাল থেকেই।

ভূগর্ভস্থ জনপদে আলো প্রবেশের জন্য পাহাড়ের চূড়া থেকে একেবারে নিচ পর্যন্ত পাথর খুঁদে চিমনির ব্যবস্থা রেখেছিল। রান্নাবান্নার ধোঁয়া চিমনি দিয়ে বেরিয়ে যেত।

রান্নাবান্নার ধোঁয়ায় যাতে তাদের অবস্থান টের না পায় সেজন্য তারা রান্না করতো সপ্তাহে একদিন–তা-ও রাতের বেলা। তাদের এ অসাধারণ প্রকৌশল জ্ঞানের জ্ঞানের তারিফ না করে পারা যায় না।

জনপদে প্রবেশের মুখে বড় বড় পাথর দিয়ে ভিতর থেকে মজবুত করে এটে দেয়ার ব্যবস্থা থাকতো।
শত্রুর হাত থেকে বাঁচার জন্য অদৃশ্য শহর নির্মাণ করার দিন শেষ হয়েছে। তবে, পালানোর দিন শেষ হয়নি। পৃথিবীব্যাপী সংঘাতময় এলাকা থেকে জীবন বাঁচাতে এখনো প্রায় পাঁচ কোটি মানুষ নিজের ঘরবাড়ি ছেড়ে অন্যত্র আশ্রয় নিয়েছে।

About Post Author

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Pin It on Pinterest