
বার্মা–বাড়ির পাশের অচেনা দেশ
১৯৮১ সাল ছিল বাংলাদেশের জন্য ঘটনাবহুল বছর। জিয়াউর রহমান, যিনি নানা জটিল গ্রন্থি খুলে নিজেকে দেশের সর্বোচ্চ পদে অধিষ্ঠিত করেছিলেন। আগের বছর মে মাসে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসে এক ঝাঁক বুলেটের আঘাতে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। তার ভাইস প্রেসিডেন্ট, দুর্বল চিত্তের জাস্টিস আব্দুস সাত্তার, অটো প্রমোশন পেয়ে প্রেসিডেন্টের হট সিটে বসেন। ইতোমধ্যে, আর এক জেনারেল, হোসেন মোহাম্মদ এরশাদ, সে সিটের দিকে লোলুপ দৃষ্টিতে তাকিয়ে সুযোগের অপেক্ষা করছিলেন।
সে বছরই প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে দেশে প্রচুর ফসলহানি হয়। জাস্টিস সাত্তার চাউলের সন্ধানে নানা দেশে ডেলিগেশন পাঠান। এক ডেলিগেশন রওয়ানা হয় বার্মার উদ্দেশ্যে। বার্মায় তখন বছরে প্রায় দশ লক্ষ টন উদ্বৃত্ত চাউল উৎপাদন হত। একজন ফাইনান্সিয়াল ‘এক্সপার্ট’ হিসাবে আমাকে সে দলে অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
আমি আদার ব্যাপারী, জাহাজের খোঁজ খবর রাখা আমার কম্ম নয়। বিদেশ থেকে চাউল কেনাকাটার ব্যাপারে ত নই। তবুও এক্সপার্টের ভূমিকা পালন করতে হবে। তাই সই। আমাদের দেশের দেয়াল ঘেঁষা কিন্তু একেবারেই বিস্মৃতপ্রায় দেশটাকে দেখার সুযোগ ত পাওয়া গেল।
বার্মায় পৌঁছে দুটো দৃশ্য আমাদের আকর্ষণ কেড়ে নেয়। একটা রেঙ্গুনের বিখ্যাত আকাশচুম্বী শ্বেডিগন প্যাগোডা, অন্যটা রাস্তাঘাটে, অফিস-আদালতে, দোকানে, হোটেলে সর্বত্রই কোমরে পেচিয়ে লুঙ্গি পরা মানুষের অবাধ বিচরণ।
লুঙ্গি আমাদের দেশে মোটেও অপরিচিত নাম নয়। লুঙ্গির নামটাই বার্মা থেকে ধার করা। যেটা আমরা অনেকেই জানিনা, তা হচ্ছে বৌদ্ধ সন্ন্যাসীরা যে পোশাক পড়ে তার নাম ফুঙ্গী। লুঙ্গি ও ফুঙ্গি, দুটোই ফানি নাম!
নামটা অভিন্ন হলেও লুঙ্গির বাংলাদেশ সংস্করণ কিছুটা ভিন্ন এবং ভদ্র লোকেরা তা পরেন নিজেদের ঘরের চার দেওয়ালের মধ্যে। অন্য দিকে বার্মিজ লুঙ্গির রয়েছে সব খানেই সগর্ব প্রবেশ-অধিকার, সাধারণ মানুষের পর্ণকুটির থেকে রাজপ্রাসাদ পর্যন্ত। ম্যানেজার ও তার মেসেঞ্জার, ম্যাডাম ও তার মেইড, প্রফেসর ও ছাত্র, প্রেসিডেন্ট ও তার চাপরাশি সবারই কটিদেশের শোভা পায় লুঙ্গি।
এ বিরামহীন লুঙ্গি পরিহিত মানুষের মিছিল দেখে শুরুতে অবাক হয়েছিলাম বৈকি। দু’দিন পর ভিনদেশের কালচারের সাথে দৃষ্টিভঙ্গির সমন্বয় ঘটলে, রেঙ্গুনের মানুষের সহজ সরল জীবন যাত্রা ও চলাফেরার অন্তর্নিহিত অকৃত্রিম সৌন্দর্য মন ছুঁয়ে গেল। এক টুকরো সাধারণ কাপড় পরিহিত ও তাদের মেকি আবরণ মুক্ত জীবনযাত্রা ভালো লাগতে শুরু করে।
ভাবতে অবাক লাগে, এ আপাত শান্তশিষ্ট বার্মার জনগোষ্ঠী যুগ যুগ ধরে যুদ্ধ-বিগ্রহ, মারামারি-কাটাকাটি করে জনজীবন অশান্ত করে রেখেছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে জাপানিরাও ছিল দুর্ধর্ষ যুদ্ধং দেহি জাতি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ছ্যাচা খেয়ে এখন তারা দুনিয়ার মধ্যে সবচেয়ে শান্ত এবং ভদ্র জাতিতে পরিণত হয়েছে। এই জন্যই বলে মারের উপর ঔষধ নাই।
মধ্যযুগে পর্তুগিজ জলদস্যুদের সাথে মিলে বার্মার আরাকান এলাকার দুর্ধর্ষ মগ জলদস্যুরা বাংলাদেশ দক্ষিণাঞ্চলে লুটপাট চালিয়ে প্রায় জনশূন্য করে ফেলেছিল। মগ ও পর্তুগীজ জলদস্যুরা যৌথভাবে আমাদের দেশে যে অরাজকতার সৃষ্টি করেছিল তার মাত্রা বোঝানোর জন্য এখনো একটা কথা চালু আছে, ‘মগের মুল্লুক’ অর্থাৎ খুশি মত লুটপাট করার দেশ। এমনকি আরাকান রাজা চট্টগ্রাম ও সন্দ্বীপে তাদের দখলে নিয়ে নিয়েছিল। ১৬৬৩ খ্রিষ্টাব্দে বাংলায় মোগল সুবেদার শায়েস্তা খাঁ তাদের শায়েস্তা করে আরাকান-রাজকে পরাজিত করে মোগলদের হৃত-ক্ষমতা পুনরুদ্ধার করেন।
শুধু লুঙ্গিই বার্মার একমাত্র বৈশিষ্ট্য নয়। দেশটি সম্পর্কে ভালো করে জানারও খুব একটা সুযোগ নেই। তারা বহুকাল যাবৎ নিজেদের বহির্বিশ্ব থেকে গুটিয়ে রেখেছিল। যুগ যুগ ধরে দেশটির সামরিক দুঃশাসনে নিষ্পেষিত। দুর্নীতি নিত্যদিনের সঙ্গী। বনে জঙ্গলে সন্ত্রাসী গ্রুপের দাপট। অবৈধ মাদক ব্যবসায়ী ও সামরিক বাহিনীর যৌথ প্রযোজনায় কোকেইন এবং অন্যান্য মাদকদ্রব্য বিদেশে চালান দিতে দ্বিধা করে না। মাদকদ্রব্য, বিশেষ করে ইয়াবা চালান দিয়ে বাংলাদেশের যুব সমাজকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিয়েছে। রাজনৈতিক প্রতিহিংসার কারণে লক্ষ লক্ষ রোহিঙ্গাদের নির্যাতন চালিয়ে যাচ্ছে।
স্বেচ্ছাচারী শাসন ব্যবস্থার অনুকূল আবহাওয়ায় অবধারিতভাবে গড়ে ওঠে রমরমা অবৈধ ব্যবসা। বার্মা তার ব্যতিক্রম নয়। দেশটি আফিম উৎপাদনে বহুদিন যাবৎ চ্যাম্পিয়নশিপের খেতাবটি ধরে রেখেছে–বছরে ২,০০০ মেট্রিক টন।
মাদকদ্রব্য চালান দেওয়ার জন্য গড়ে উঠেছে গোল্ডেন ট্রায়াঙ্গেল নামে কথিত সুবিস্তৃত চ্যানেল। পার্বত্য চট্টগ্রামের সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর সাথে শান্তি চুক্তি সম্পাদন করার আগে সে এলাকাটি ছিল গোল্ডেন ট্রায়াঙ্গেলের একটা গুরুত্বপূর্ণ রুট।
বার্মার সামরিক জান্তা গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার দাবি ও দেশের সমস্যাবলী থেকে পাবলিকের মনোযোগ ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার লক্ষ্যে সংখ্যালঘুদের উপর অত্যাচার নির্যাতন চালাতে ইন্ধন যুগিয়ে থাকে। তাদের প্রধান টার্গেট কারেণ ও রোহিঙ্গা উপজাতি। অং সাং সুচি, যিনি ১৯৯১ সালে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার লাভ করেছিলেন, সামরিক জান্তার সাথে হাত মিলিয়ে সংখ্যালঘু নিধনে সমর্থন যুগিয়ে আসছিলেন। এখন তো নিজের গেড়াকলে তিনি নিজেই আটকে গেছেন।
বার্মার সামরিক জান্তা কত কাল যাবত যে ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রেখেছে তা অনেকের ভুলেই গেছে। গত শতাব্দীর ষাটের দশকে বার্মার জনপ্রিয় নেতা উ নুকে সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতাচ্যুত করে সেই যে আসন জাঁকিয়ে বসেছে তা থেকে সরে যাওয়ার কোনো লক্ষণ নাই।
মাঝখানে অং সাং সুচি গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য আওয়াজ তুললেও তাতে ক্ষমতাসীনরা কান দেয়নি। পশ্চিমা বিশ্ব যারা গণতন্ত্রের অতন্দ্র প্রহরী হিসেবে দাবি করে তারা তেমন সাপোর্ট দেয় নি। সান্তনা হিসাবে তারা একটা নোবেল পুরস্কারে ব্যবস্থা করে।
সু চির সাম্প্রতিক কর্মকাণ্ড দেখে মর্মাহত হয়ে পৃথিবীর অনেক জায়গা থেকে তার কাছ থেকে নোবেল প্রাইজ ফেরত নেয়ার দাবি উঠেছে। প্রতিবাদ হিসাবে, একজন নোবেল লরিয়েট তার পুরস্কারটিই সারেন্ডার করার ঘোষণাও দিয়েছিলেন।
কয়েক বছর আগে শাসন কার্যে বেসামরিক সরকারের প্রলেপ দেওয়া হলেও প্রকারান্তরে পাকিস্তানের মতো তাদের হাতেই প্রকৃত ক্ষমতা রয়েছে।
আগেই বলেছি, বার্মা বহুদিন যাবৎ পৃথিবীর দৃষ্টির আড়ালে নিজেদেরকে লুকিয়ে রেখেছে। আমরা ভুলেই গেছি আমাদের ঘরের লাগোয়া সে দেশটির কথা, যার সাথে রয়েছে বাংলাদেশের ১৯৩ কিলোমিটার কমন বর্ডার।
অথচ, দুই দেশের অতীত বহুকাল যাবৎ একই সূত্রে গাঁথা ছিল। মধ্যযুগে আরাকান রাজ্যের রাজত্ব চট্টগ্রাম পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। ব্রিটিশ রাজ দেশটি দখল করে ভারতের সাথে যুক্ত করে একই শাসন ব্যবস্থার অধীনে নিয়ে আসার পর যোগসূত্র আরো মজবুত হয়। ব্রিটিশরা কিভাবে বার্মা তাদের করায়ত্ত্বে নিয়ে আসে সে সম্পর্কে কিছুটা আলোকপাত করা যায়।
বার্মা অতীতে কয়েকটি ছোটখাটো রাজ্যে বিভক্ত ছিল। সর্ব কালে রাজা-মহারাজারা নিজেদের সবচেয়ে শক্তিমান বলে ভাবতে বিশ্বাস করে। আশে পাশের জনপদ পদানত করার খায়েশ জেগে উঠে। যুদ্ধংদেহী বার্মার রাজাদের তো কথাই নেই। পরস্পরের বিরুদ্ধে যুদ্ধ-বিগ্রহ করে সময় কাটানো ছিল তাদের পছন্দের মাধ্যম। বহুদিন যাবত অন্তর্ঘাতমূলক বিবাদের কারণে দেশটি দুই ভাগ হয়ে পড়ে–একটা উত্তর, অন্যটা দক্ষিণ। মধ্যযুগে ষষ্ঠ শতাব্দীতে এক শক্তিশালী রাজা দুই অংশকে একত্রিত করে ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে এসে যান। এমন কি তিনি শ্যামদেশে– বর্তমান নাম থাইল্যান্ড– অভিযান পরিচালনা করার দুঃসাহস দেখান।
উনবিংশ শতাব্দীতে আর একজন শক্তিশালী রাজা নিজের ক্ষমতার দম্ভে বলিয়ান হয়ে ভারতের ব্রিটিশ রাজের সাথে শক্তি পরীক্ষায় লেগে যায়। তারা ব্রিটিশ ভারতের পূর্ব সীমান্তে আসাম দখল করে নেয়। ক্রোধান্বিত ব্রিটিশ রাজ এ সুযোগের জন্যই অপেক্ষা করছিল।
ব্রিটিশরা এমনিতেই অপরের দেশ দখল করার জন্য মুখিয়ে থাকতো। বার্মিজ রাজের আক্রমণাত্মক কর্মকাণ্ডের অজুহাতে তারা সে দেশে তিন বার অভিযান চালিয়ে প্রত্যেকবার একটু একটু করে পুরো দেশটাকে নিজেদের করায়ত্তে নিয়ে আসে। ১৮২৪ সাল থেকে ১৮৫৫ সাল নাগাদ তারা বার্মা গ্রাস করে ভারত সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করে ফেলে।
বিংশ শতাব্দীতে ভারতের স্বাধীনতার দাবি জোরদার হয়ে উঠলে ১৯৩৫ সালে ব্রিটিশ রাজ বার্মাকে ভারতের থেকে বিচ্ছিন্ন করে নেয়। তাদের উদ্দেশ্য ছিল ভারত স্বাধীন হয়ে গেলেও তারা যেন সে দেশে ধন-সম্পদ লুটতরাজ চালিয়ে যেতে পারে। তাদের সে আশা পূরণ হয়নি। ভারত বিভাগের কয়েক মাস পরেই বার্মা একটি স্বাধীন রাষ্ট্রে পরিণত হয়।
এককালের আমাদের সে ঘনিষ্ট প্রতিবেশী বার্মায় আমরা গিয়েছিলাম চাউলের সন্ধানে। আলাপ আলোচনার ফাঁকে ডেলিগেশনের একজন সদস্য খাদ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা হাসান ও আমি নতুন করে দেশটার রাজধানী রেঙ্গুন (বর্তমান নাম ইয়াঙ্গুন) আবিস্কারের দিকে মনযোগ দিলাম।
রেঙ্গুন নামটি দিয়েছিল ব্রিটিশ রাজ বার্মা নিজেদের দখলে আনার পর। পরবর্তী কয়েক যুগ ধরে পরিকল্পিত রাস্তাঘাট, আধুনিক শপিং মল, অফিস-আদালত, আবাসিক এলাকা গড়ে ছোটখাটো সাদামাটা একটি শহরকে আধুনিক নগরী হিসাবে সৌন্দর্যমন্ডিত করে তোলে।
শহরের চলাফেরার জন্য বার্মিজ কর্তৃপক্ষ আমাদের একটি গাড়ি সরবরাহ করেছিলেন। ড্রাইভারের নাম মঙ্গ। বার্মার, এমনকি পার্বত্য চট্টগ্রামের অনেক লোকের নামের সাথে মঙ্গ শব্দটা জুড়ে দেওয়া থাকে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমার একজন সহপাঠীর নাম ছিল মং কুয়া মং। আগে পিছে মং।
রেঙ্গুনে আমাদের ড্রাইভার মঙ্গ এখন আমাদের শহরের কেন্দ্রস্থলে নিয়ে চলেছে। গাড়ির গতির সাথে মিল রেখে সে বাক যন্ত্রটিও সচল করে আমাদের মনোরঞ্জনের জন্য রেঙ্গুনের নাম করা কিছু স্থাপনার সঙ্গে পরিচয় করে দিতে লাগলো। তবে, তার ইংরেজি উচ্চারণ ধাঁধায় ফেলে দিল। কিছুটা বুঝলাম, বাকিটা কল্পনা করে নিজেদের মতো অর্থ করে নিলাম।
আমরা সহসা আবিষ্কার করলাম, রেঙ্গুনই বোধ হয় পৃথিবীর একমাত্র শহর যেখানে সময় থেমে রয়েছে বহুকাল যাবত। ১৯৪৮ সালে ব্রিটিশরা বার্মা ছেড়ে দেয়ার তিন দশক পরেও আমরা যখন সে দেশে যাই রেঙ্গুন যেমনটি ছিল ঠিক তেমনি ছিল। সে পুরোনো ব্রিটিশ ধাঁচের দালান কোঠা, পরিচর্যার অভাবে ভগ্নদশা, পঞ্চাশ দশকের পুরানো গাড়ি ঘোড়া, মুড়ির টিনের মত বাস ধীরগতিতে রাস্তা বেয়ে চলছে। বার্মার ব্রিটিশ গভর্নর জেনারেল যদি আবার ভিজিট করতে আসতেন তিনি দেখতে পেতেন ১৯৪৮ সালে যেভাবে রেখে গিয়েছেন রেঙ্গুন ১৯৮১ সালে সে-ভাবেই রয়ে গেছে।
বেড়াতে বেরোবার আগে আমাদের টিম লিডার সাবধান করে দিয়েছিলেন, দেশটি পুরোপুরিভাবে সেনাবাহিনী কর্তৃক কঠোর হস্তে নিয়ন্ত্রিত। তোমরা কারো সাথে বেফাঁস কথা বলবেনা না। যেমন, কেউ যদি অন্য মহল্লায় আত্মীয়ের বাড়ি বেড়াতে যায় তবে সেখানে থানায় বৃত্তান্ত জানিয়ে নাম রেজিস্ট্রি করতে হবে। বিদেশে যাওয়ার জন্য কেউ পাসপোর্ট চাইলেই দেয়া হয় না, বেছে বেছে কিছু লোককে শুধু একবার ভ্রমণের জন্য দেয়া হয়। যারা সে মহামূল্যবান পাসপোর্ট পায় ফিরে আসার পরে বিমান বন্দরেই তা সারেন্ডার করতে হয়।
কিছুক্ষণ ঘুরাফেরার পর আমাদের মনে হল শহরটিতে কেমন যেন নীরবতায় ছেয়ে গেছে। লোকজন চুপচাপ রাস্তা দিয়ে হেটে চলেছে। এমনকি ইউনিফর্ম পরা স্কুলের বাচ্চারা, যারা অন্যত্র হইচই করে স্কুলে যাওয়া আসা করে, তারাও দলবেঁধে নীরবে পথ চলছে।
আমরা ভেবে অবাক হচ্ছিলাম নিরবতার কারণ কি বার্মিজ কালচারের গভীরে নিহিত, অথবা কঠোরভাবে সমাজব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণের আলামত। আমি নিজেই নীরবতা পছন্দ করি। যতই দিন যেতে লাগল আমরাও রেঙ্গুন শহরের নিরবতার মাঝে খুঁজে পেলাম এক ধরনের ছন্দ ও অনাবিল সৌন্দর্য।
বার্মিজ সমাজের অন্যতম বৈশিষ্ট্য অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনার জন্য মহিলাদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। যে পেশায়ই হোক না কেন বার্মার মহিলারা চিরন্তন অভ্যাসবশত নিজেদের আকর্ষণীয় করে তুলে ধরতে অবহেলা করে না। তবে বার্মিজ মহিলারা নাক কান গলায় স্বর্ণালঙ্কারের বোঝা বয়ে বেড়ায় না। সহজ সরল রূপচর্চার কায়দা রপ্ত করতে পেরেছে। অভিজাত শ্রেণীর মহিলা গাড়ির স্টিয়ারিংয়ে বসে গাড়ি চালাচ্ছেন, তার সাথে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে যে মহিলা ফুচকা বিক্রি করছেন তার পোশাক-পরিচ্ছেদ চেহারার মধ্যে তেমন কোন পার্থক্য নেই। উভয়েরই কটিদেশে লুঙ্গির নিচে গুঁজে দেওয়া হয়েছে ঝকঝকে ব্লাউজের নিম্নাংশ, গণ্ডদেশে তানাকা নামের স্থানীয়ভাবে প্রস্তুত রুজ, পরিপাটি করে আঁচড়ানো চুলের গোছা বেঁধে তৈরি হয়েছে শৈল্পিক ঝুটি। মাছের খোলাবাজারে দেখলাম সব বিক্রেতারাই মহিলা। তারাও পরিপাটি করে পরিষ্কার কাপড় চোপড় পরে গণ্ডদেশে তানাকা লাগিয়ে মাছ বিক্রি করছে।
আমার সাথী হাসান আফসোস করে বলল, আমাদের মহিলারা যদি এই সহজ-সরল পদ্ধতিতে রূপচর্চার কায়দা রপ্ত করতে পারত তাহলে স্বর্ণালঙ্কারের প্রয়োজন পড়তো না। তাতে একদিকে যেমন টাকা-পয়সা খরচ করা লাগত না, অন্যদিক পথে-ঘাটে ছিনতাইকারীদের হাতে তা খোয়াতে হতো না।
ব্রিটেন হোক কিংবা বার্মা, বিদেশে গেলে প্রিয়জনদের উপহার দেওয়ার জন্য কেনাকাটার প্রতি একটা সহজাত ঝোঁক থাকে। আমাদের গাড়ি চালক মঙ্গ প্রস্তাব দিলো আমাদের খায়েশ পূরণের জন্য স্মাগলার মার্কেট খুবই উত্তম জায়গা।
জিজ্ঞেস করলাম, মার্কেটটা শহর থেকে কত দূরে? মঙ্গের সহজ সরল উত্তর, দূরে নয়, শহরের একেবারে মধ্যিখানে। শহরের মধ্যেখানে স্মাগলার মার্কেট? তাও, বজ্র কঠিন হস্তে নিয়ন্ত্রিত শাসন ব্যবস্থায়? আর কত কি যে দেখার বাকি ছিল?
আমরা কল্পনা করলাম স্মাগলার মার্কেটে দেখতে পাবো ফিল্মের ভয়-জাগানিয়া ভিলেনের মত ভীষণ দর্শন মাসেলমানদের। আমাদের ধারণা মিথ্যা প্রমাণ করে দেখা গেলো মার্কেটে বেশির ভাগই দোকান পরিচালনা করছে সুদর্শনা মহিলা দোকানিরা। একটা দোকানে বিক্রয় কাজে নিয়োজিত ছিল এক দম্পতি।
আমরা সকল কাজে পুরুষদের উদ্যোগী ভূমিকা দেখতে অভ্যস্ত। তাই, অদূরে বসা পুরুষ দোকানির সাথে কথা বলার মনস্থ করলাম। কিন্তু তার মুখে দেখতে পেলাম এক রাশ বিরক্তি। তিনি আরামকেদারা থেকে গাত্রোত্থান না করে মহিলার দিকে তর্জনী তাক করে তার কাছে যেতে ইঙ্গিত করে আবার নিজস্ব ধ্যানে বসে ঝিমুতে লাগলো।
বার্মার অধিকাংশ পুরুষদেরই একই হালচাল। তারা বিবির উপর দায় দায়িত্ব ছেড়ে দিয়ে নিজেরা স্লিপিং পার্টনারের ভূমিকা নিয়ে খুশি থাকে। দোকানের মহিলা একটুখানি মিষ্টি হেসে আমাদের দিকে এগিয়ে এলেন। ভাঙ্গা ভাঙ্গা ইংরেজিতে তার সাথে আলোচনা, দরদস্তুর চলল।
মহিলাদের উপর দায় দায়িত্ব ছেড়ে দিয়ে আরাম-আয়েশে দিন গুজরানের জন্য ব্রিটিশ আমলে চিটাগাং নোয়াখালী এলাকার অনেকেই বার্মা মুলুকে হাজির হয়ে যেতেন। সেখান থেকে পরিবার-পরিজনের কাছে ফিরে আসার নামটি করতেন না। সঙ্গী হাসানের আবারো আফসোস, হায় সে ব্রিটিশ আমলে যদি জন্ম হতো কি মজাই না হত! ব্রিটিশ আমলের পক্বকেশ সে সব রোমিওদের এখনো কিছু কিছু জায়গায় দেখা যায়, তাদের স্ত্রীদের টুক টাক কাজে হাত বাড়িয়ে দিচ্ছে।
বার্মার শতকরা নব্বই ভাগ লোক বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী। মহামতি বুদ্ধের আলামত সবখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। তবে বুদ্ধের অহিংসা নীতি তারা বলতে গেলে ভুলেই গেছে। রোহিঙ্গা নিধনে বৌদ্ধ ভিক্ষুরা প্রধান ভূমিকা নিয়েছিল বলে জানা যায়।
কয়েকশো বছর ধরে বার্মার শাসকরা অনেক পরিশ্রম ও অর্থ-সম্পদ ব্যয় করে রেঙ্গুনে সুদৃশ্য আকাশচুম্বী প্যাগোডা তৈরি করেছে। শ্বেডিগন নামের এই প্যাগোডার গম্বুজের বহিরাংশ সম্পূর্ণভাবে স্বর্ণ দিয়ে মোড়ানো। পরে আমরা বারবার বার্মার পুরনো রাজধানীতে বেড়াতে যাই। সেখানে দেখা মেলে পৃথিবীর সবচাইতে দীর্ঘ বুদ্ধের অর্ধশায়িত মূর্তি।
রেঙ্গুনে আরো কয়েকটি দর্শনীয় স্থান রয়েছে। তার মধ্যে একটা মুঘল রাজপুত্র শাহ সুজার সমাধি। সম্রাট শাহজাহানের জীবনের শেষ লগ্নে ক্ষমতার দ্বন্দ্বে শাহ সুজা আওরঙ্গজেবের রোষানল থেকে বাঁচতে বার্মায় পালিয়ে যান। সে সময় তিনি বাংলার সুবেদার হিসেবে নিয়োজিত ছিলেন।
রেঙ্গুনে অদূরে রয়েছে ভারতের শেষ মোগল সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফরের সমাধি ক্ষেত্র। তিনি ছিলেন একজন উচ্চমানের কবি। সিপাহী বিদ্রোহের পর ইংরেজরা তাকে বার্মায় নির্বাসন দেয়।
বার্মায় সফরের শেষ প্রান্তে সেখানকার ট্রেডিং কর্পোরেশনের ম্যানেজিং ডাইরেক্টর একজন উচ্চপদস্থ সামরিক কর্মকর্তা আমাদের সম্মানে নৈশভোজের আয়োজন করেন। তার যথেষ্ট রসবোধের পরিচয় পাওয়া গেল। এ-সব অনুষ্ঠানে যা হয়, আলোচনার বিষয় থেকে অন্য বিষয়ে আবর্তিত হতে থাকে। আমাদের আলোচনার বিষয়বস্তু শেষমেষ গিয়ে ঠেকলো বার্মার বিবাহ সম্পর্কিত রীতিনীতিতে।
আমরা শুনে অবাক হলাম, বিয়ের পর কনে বরের বাড়ি আসে না, বরং বর তল্পিতল্পা গুটিয়ে কনের বাড়িতে গিয়ে উঠে। আমাদের দেশে এদের নাম ঘর জামাই। হুমায়ূন আহমেদের একটা নাটকে বদি নামের চরিত্রের একজন অভিনেতা ঘরজামাইয়ের ইংরেজিতে নাম রেখেছিলেন “হাউজ হাজবেন্ড।”
বার্মিজ টিমের ঘর জামাইয়ের কেচ্ছা শুনে আমরা ভাবলাম তা হয়তো রসিকতা বা জোক। তারপর এক এক করে বার্মিজ টিমের সম্মানিত সদস্যদের কাছে আদমশুমারি করে জানা গেল তাদের সবারই একই ঘটনা। স্বয়ং ম্যানেজিং ডাইরেক্টরও একই পথের পথিক।
বুঝা গেল বার্মিজ দর্শনে আরাম-আয়েশ স্বস্তির বিনিময়ে নিজস্ব স্বাধীনতা বিকিয়ে দিয়ে পরের অধীনে যেতে দ্বিধা করে না। সে কারণে অর্ধ শতাব্দি ধরে তারা সামরিক শাসন থেকে মুক্তির জন্য তেমন কোনো উদ্যোগী ভূমিকা নেয়নি।