স্বপ্নের দেশ আমেরিকায়।
না জানি কোন এক দুর্নিবার আকর্ষণে দুনিয়ার তাবৎ মানুষ স্বপ্নের দেশ আমেরিকার মাটিতে একবারের জন্য হলেও পদস্পর্শ করার জন্য হৃদয়ের নিভৃতে রঙ্গিন স্বপ্ন লালন করে থাকে।
১৯৭৫ সালে, প্রায় অর্ধশতাব্দী আগে, নাটকীয় ভাবে প্রথমবারের মতো আমেরিকার মাটিতে পা রাখা সম্ভব হলো। এরপর বেশ কয়েকবার সে দেশে যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল, তবে, প্রথমবারের উৎসাহ উদ্দীপনা ছিল আলাদা।
এবার গিয়েছিলাম সরকারি ডেলিগেশনের সদস্য হিসাবে। তখনো বিদেশ ভ্রমণ সংক্রান্ত হাল হকিকত সম্পর্কে অভিজ্ঞতা পোক্ত হয়নি। পদে পদে সংশয়।
এপিকে, বাংলাদেশ দূতাবাস থেকে যাদের রিসিভ করতে আসার কথা তাদের দেখা নাই। রবিবার ছুটির দিনে একজন নগণ্য ডেলিগেশনের সদস্যকে রিসিভ করতে আরাম-আয়েশ পরিত্যাগ করে দূতাবাসের ম্যান্ডারিনরা কেনই বা আসবেন? রাষ্ট্রের প্রতিনিধি বলে কথা।
খোদায় মালুম, গরিবের কাছ থেকে ট্যাক্স আদায় করে, ইথিওপিয়া, কেনিয়া, আলজেরিয়া, মৌরিতাসের মত জায়গায় অজায়গায় বিদেশে আশীটি মিশন কেন রাখতে হবে? এ সব দেশে না আছে বাণিজ্য সম্প্রসারণের সম্ভাবনা, না আছে শ্রমিক রপ্তানির তেমন বড় সুযোগ।
আমলাতন্ত্রের এটাই মজা। নিজেও আমলাতন্ত্রের বেড়াজাল ডিঙিয়ে এসেছি। আমলাতন্ত্রের ব্যাপারে কিছু না বলাই ভালো। হাজারো গুণীজন হাজার কথা বলে গেছেন। তার মধ্যে একটা: If you’re going to sin, sin against God, not the bureaucracy; God will forgive you but the bureaucracy won’t. Hyman Rickover.
দূতাবাসের কাউকে না পেয়ে ওয়াশিংটন বিমানবন্দরে আমার অবস্থা জীবনানন্দের মলয় সাগরে হাল ভেঙে দিশেহারা নাবিকের মত।
ভাবছেন, একটা ট্যাক্সি ডেকে যে কোনো হোটেলে উঠলেই তো ল্যাটা চুকে যায়। খোদা আপনার মঙ্গল করুন, কিন্তু প্রথম দিনেই যদি সে সময় বিধ্বস্ত বাংলাদেশে তৃণসম যে ফরেন এক্সচেঞ্জ দেয়া হতো তা নয় ছয় করে ফেলি তাহলে বাকি কয় দিন উপোস থাকতে হবে। তাছাড়া, আসার সময় গিন্নি একটা লম্বা শপিং লিস্ট হাতে ধরিয়ে দিয়েছিল। সেদিকে খেয়াল না রাখলে গৃহ বিবাদের সমূহ সম্ভাবনা।
সেবার আমেরিকা ভ্রমণের সুযোগ আসে বিশ্ব ব্যাংকের সাথে ঋণ চুক্তি সম্পর্কে দেন-দরবারে বাংলাদেশ ডেলিগেশনের সদস্য হিসাবে। স্বাধীন বাংলাদেশের জন্য বিশ্ব ব্যাংকের প্রথম সাহায্য।
প্রতিশ্রুত ঋণের পরিমাণ ছিল, ১০০ মিলিয়ন ডলার। বিপর্যস্ত অর্থনীতি চাঙ্গা করতে এ আর্থিক সহায়তা ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ডেলিগেশনের নেতৃত্বে ছিলেন পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের তখনকার ইকোনমিক অ্যাফেয়ার্স ডিভিশনের সচিব, সাইদুজ্জামান সাহেব।
বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে প্রথমে নমিনেট করা হয় নির্বাহী পরিচালক আমিনুল হক চৌধুরীকে। ডেলিগেশন রওনা হওয়ার অল্প কয়েক দিন আগেই বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় ট্রাজেডির নাটক রচিত হয়। নাটকটির স্ক্রিপ্ট লিখেছিল আমেরিকার পররাষ্ট্র মন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার। মুখ্য ভূমিকায় ছিলেন বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সহকারি ও মন্ত্রি পরিষদের সদস্য খন্দকার মোশতাক– মীরজাফরের অশরীরী আত্মা।
পার্শ্ব চরিত্রে ছিলেন বঙ্গবন্ধুর নিজস্ব দল আওয়ামী লীগের বেশ কয়েকজন সুযোগ সন্ধানী নেতা-কর্মী, উচ্চাভিলাষী কিছু সেনা কর্মকর্তা।
জরুরি পরিস্থিতিতে আমিনুল হক সাহেবের দেশে উপস্থিতি থাকা প্রয়োজন। কি ছিল গভর্নরের মনে, চৌধুরী সাহেবের পরিবর্তে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে আমাকেই নমিনেট করলেন।
তখন আমি সবে মাত্র এক্সচেঞ্জ কন্ট্রোল ডিপার্টমেন্টে অ্যাসিস্টেন্ট কন্ট্রোলার। পদমর্যাদায় চৌধুরী সাহেব ও আমার মধ্যে ছিল বিস্তর ফারাক। মাঝখানে সশরীরে অবস্থান করছিলেন অন্তত তিন জন উঁচু দরের কর্মকর্তা। তাদের উপেক্ষা করে আমাকে ডেলিগেশনের দলভুক্ত করায় তাঁরা তো অবাক। বলা বাহুল্য, ঈর্ষান্বিতও বটে। কয়েক জন ঘনিষ্ঠ কলিগের দিলেও চোট লেগেছিল। এটাই নিয়ম। যতই ঘনিষ্ঠতা থাক না কেন, কলিগের সৌভাগ্যে অজান্তে মনটা খারাপ হয়ে যায়। মুখে অভিনন্দন, অন্তরে ঈর্ষা। কারো সৌভাগ্যের কথা শুনলে পাড়াপড়শিদের রাতের ঘুম নষ্ট হয়।
বঙ্গভবনে মোশতাকের ডেরা থেকে আমেরিকা ভ্রমণ সংক্রান্ত গভর্নমেন্ট অর্ডার বিদ্যুৎ গতিতে চলে এল। অর্ডারে স্বাক্ষর করেছেন স্বঘোষিত প্রেসিডেন্ট খন্দকার মোশতাক আহমেদ। খুনি মোশতাকের স্বাক্ষর দেখে মনটা খারাপ হয়ে গেল।
অন্যদিকে, সরকারি দায়িত্ব পালনের বাধ্য-বাধকতা, সে সঙ্গে স্বপ্নের দেশ আমেরিকা ভ্রমণের হাতছানি।
আগেই বলেছি, সরকারি আধা-সরকারি চাকরিতে এটাই মজা। সরকার বদল হলে রাজনৈতিক নেতাদের মত জেলে যেতে হয় না। যে কেউ বন্দুক উঁচিয়ে বা হ্যাঁ-না ভোটের মাধ্যমে বৈধতা নিয়ে যে ভাবেই ক্ষমতায় আসুক না কেন, তাঁর সেবায় লেগে যায়।
অন্যদিকে, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র, সর্বহারা নানা কিসিমের স্লোগান সম্বল করে চিল্লাচিল্লি করার দায়িত্ব নেন রাজনীতিবিদরা। তাঁরা মাঝে মাঝে জেলে যান। সুযোগ এলে গাড়িতে পতাকা উড়ান। পিংপং বলের মত, একবার টেবিলের এপাশে, পরের বার ওপাশে। এ করে করেই মওদুদ আহমদের বাড়িটাও গেল, শেষমেষ দুঃখ ভারাক্রান্ত মনে পৃথিবী থেকে বিদায় নিলেন। ভদ্র মানুষ। প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে তার সাথে সারা বাংলাদেশ সফর করেছি ক্ষুদ্র শিল্প অর্থায়নের কাজে। তিনি শিল্প মন্ত্রণালয়েরও দায়িত্বে ছিলেন।
ডেলিগেশনের কেউ কেউ আগেই চলে গিয়েছেন। অন্যরা যার যার আলাদাভাবে যাওয়ার প্রোগ্রাম করেছেন। আমাকে একাই যেতে হবে।
হাওয়াই জাহাজে ভ্রমণের রীতিনীতি প্রায় এক ছকে বাঁধা। বিমানবন্দরে ঢোকার পথেই ম্যাগনেটিক গেট তো আছেই, তারপরেও সিকিউরিটির লোকজন শরীরের জায়গায় অজায়গায় হাত বুলিয়ে সুড়সুড়ি দেয়। কোন কোন এয়ারপোর্টে জুতা, মোজা, কোমরের বেল্ট খুলে ময়না তদন্ত করে।
নতুন যারা সফর করেন তারা নানা ধরনের ভ্রান্তিতে ভোগেন। শুনেছি, একজন প্যাসেঞ্জারকে সিকিউরিটি লোকজন বলল, তোমার বেল্ট খুলেন। প্যাসেঞ্জার শুনলো, প্যান্ট খুলেন। বিরক্ত হয়ে দিগম্বর হয়ে বলল, দেখো কিছু খুঁজে পাও কিনা।
কয়েক মাস আগে সংবাদপত্রে পড়েছিলাম অভ্যন্তরীণ রুটে একজন প্রথমবারের মত বিমানে ভ্রমণের জন্য উঠেছেন। প্লেন ছাড়ার কিছুক্ষণ পর তার মূত্রাশয়ে বেজায় চাপ। বিমানে টয়লেট থাকতে পারে তাঁর ধারণা ছিল না। তিনি মনস্থ করলেন, প্লেনের দরজা খুলে নিচের বিস্তীর্ণ শস্য ক্ষেত সেচ দিবেন। তার ভাগ্য ভালো, তার আগেই বিমানের কর্মীরা তাকে আটকে দেয়।
গেরো শুরু হয় বিমানবন্দরে যাওয়ার পর। যাত্রার প্রাক্কালে ইমিগ্রেশনের লোকজন সন্দেহ করতে থাকেন, বিদেশ যাত্রীরা সবাই দাগী আসামি। পাসপোর্ট ওলট-পালট করে কম্পিউটার টিপতে টিপতে কাটিয়ে দেন অনন্ত কাল। ততক্ষণে প্লেন ছেড়ে যাবে যাবে অবস্থা।
প্লেনে উঠতেই ভিন্ন দৃশ্যপট। ইমিগ্রেশনের ক্রিমিনালের তালিকা থেকে বিমানের ভিআইপি তালিকায় প্রমোশন। বিমানে পা রাখতেই বিগত যৌবনা বিমানবালা লিপস্টিক চর্চিত ঠোঁট কিঞ্চিত ফাঁক করে জানায় সুস্বাগতম, গুড মর্নিং। এক জন সম্মানের সাথে সিটের রাস্তা দেখিয়ে দিবেন।
প্লেনে বসলেই নাটকের তৃতীয় অংক শুরু হয়। প্লেনে ভ্রমণের আদব-কায়দা এবং সাবধান বাণী। কি ভাবে সিট বেল্ট বাঁধতে হয়, প্রাকৃতিক ডাকে সাড়া দিতে কোথায় যেতে হবে, প্লেন জরুরি অবতরণ করলে কোন কোন ইমারজেন্সি গেট দিয়ে বেরোতে হবে তমিজের সাথে দেখিয়ে দেওয়া হয়।
হাওয়াই জাহাজ সমুদ্র নাক গুজলে, ভারতনাট্যমের মুদ্রা তুলে দেখানো হয় কিভাবে লাইফ জ্যাকেট পরে নেমে পড়তে হবে, সাথে থাকবে একটা বাঁশি, কোথায় আছেন তা জানান দেওয়ার জন্য ফু দিতে থাকবেন।
হাঁ খোদা, সমুদ্রের অথৈ জলে উড়োজাহাজ মাথা গুজলে কেউ কোনদিন লাইফ জ্যাকেট পরে বাঁশি ফুঁ দিতে দিতে বেরিয়ে আসতে পেরেছে বলে শুনিনি। তবুও, আশার কোন শেষ নাই।
উড়োজাহাজে আগে যে ভ্রমণ করা হয়নি, তা নয়। ঘরোয়া রুটে ও আশেপাশে কয়েকটি দেশে।, বিদেশ ভ্রমণের অল্পস্বল্প অভিজ্ঞতা ছিল। তবে,পশ্চিমাদের দেশে এবারই প্রথম। তাও আবার সাত সমুদ্র তেরো নদীর ওপার খোদ স্বপ্নের দেশ আমেরিকায়।
বুদ্ধি সুদ্ধি বরাবরই কম, একা একা অত দূর যেতে কি বিড়ম্বনায় পড়তে হয় সে ভয় তো ছিলই। একবার মনে হচ্ছিল,উপরওয়ালারা ভালোবেসে কিই না গেরোর মধ্যে ফেলে দিলেন। স্বপ্নের দেশে স্বপ্নেই যাওয়া ভালো ছিল।
আমেরিকা যাওয়ার সরাসরি কোন ফ্লাইট নাই। প্রথমে যেতে হবে লন্ডন। সেখানে রাত্রিবাস, পরদিন সকালে ওয়াশিংটনের উদ্দেশ্যে রওনা। লন্ডনও আমাদের এক পুরনো স্বপ্নের শহর।
ছোটকাল থেকেই শুনে এসেছি বিলাতের নাম। মনে গেঁথে রয়েছে যা কিছু উৎকৃষ্ট তা সবই বিলাতের মাল—বিলেতি কাপড়, প্রসাধন, বিলেতি সিগারেট, বিলেত ফেরত ডাক্তার, উকিল মোক্তার, এই সব আরকি।
কেউ বিলেতি মেম বিয়ে করে আনলে তো কথাই নেই। চারিদিকে হুলুস্থুল পড়ে যায়। প্রতিবেশীরা মেম দেখার জন্য কারণে অকারণে বাড়িতে ভিড় জমান। এলাকার কাজের বুয়ারা কনফারেন্স ডেকে রসাল মন্তব্য পরিবেশন করতে থাকে, মেমের শরিল এক্কেরে রসুনের নাহাল সাদা।
বিলাত সাদা মানুষের দেশ। একটু খানি দ্বীপ দেশ, তাদের কতই না সাহস, দুনিয়াব্যাপী আধিপত্য বিস্তারের কলাকৌশল মুখস্ত। প্রথমে পাঠাও অগ্রদূত হিসেবে মিশনারি। তারা বুঝিয়ে পড়িয়ে একটা গ্রুপ তৈরি করে মূল মিশনের জন্য রাস্তা তৈরি করে। একজন পশ্চিম দেশি সাংবাদিক আফ্রিকার একজনকে জিজ্ঞেস করেছিল মিশনারি আসার পর তাদের দেশে কি পরিবর্তন হয়েছে? সরল আফ্রিকানের সরল উত্তর, “তানারা যখন আসেন, তাদের হাতে ছিল বাইবেল, আমাদের ছিল জমি-জাতি। এখন আমাদের হাতে বাইবেল, তানাদের হাতে জমির দলিল”।
অল্প কিছু মানুষ সুদূর ইংল্যান্ড থেকে পাল তোলা জাহাজে আফ্রিকা মহাদেশ বেষ্টন করে, ‘সাত সাগর তেরো নদী’ পার হয়ে এসে ভারতবর্ষের ত্রিশ-চল্লিশ কোটি মানুষকে দোর্দণ্ড প্রতাপে প্রায় দুশো বছর শাসন করেছে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে হিটলার তাদের নাস্তানাবুদ করে ঠুঁটো জগন্নাথ না করে ফেললে এখনো হয়তো উপমহাদেশে তাদের রাজকীয় পতাকা ইউনিয়ন জ্যাক এদেশের অফিস-আদালত উড়তে দেখা যেত। রবি ঠাকুরের মত কবি সাহিত্যিকরা বিলেতের রাজাদের আবাহন করতেন ভারতের ভাগ্য বিধাতা বলে।
ব্রিটিশ ভারতে শ্বেতাঙ্গদের ‘অল হোয়াইট’ ক্লাবের সামনে নোটিশ টাঙ্গিয়ে রাখা হত Natives and dogs are not allowed– ‘নেটিভ এবং কুত্তা প্রবেশ নিষেধ’। তাদের হুকুম তামিল করতে প্রস্তুত থাকত এদেশেরই কিছু চেলা চামুন্ডা– সিপাহী সান্ত্রি, নবাব, জমিদার, রাজা-মহারাজা।
আমাকে যেতে হবে সে সব সাদা মানুষের ডেরায়। সাদা মানুষ দেখেছি কালে কম্মিনে। মনে করতাম, প্রত্যেকটা সাদা মানুষের বোধহয় মাথা ভরা জ্ঞান, পকেট ভরা পাউন্ড ডলার।
লন্ডনের হিথ্রো বিমানবন্দর থেকেই শুরু হলো কিছু অবাক করা অভিজ্ঞতা।
এত দিন দেশে ও আশে পাশের দেশে এয়ারপোর্টে চট করে প্লেন থেকে নেমে অন্যান্য প্যাসেঞ্জারদের সাথে কয়েক মিনিটের মধ্যে মোকামে পৌছে যেতাম।
এবার পথ ফুরায় না। এক করিডোর থেকে আরেক করিডোরে কিন্তু মোকামের দেখা নেই। এক সময় নতুন গেরোতে পড়লাম। চলমান জনতা, যাদের উপর ভরসা করে পিছু নিয়েছিলাম, হঠাৎ দু’ভাগ হয়ে গেল। এক দল ডাইনে, অন্য দল বায়ে। আমি কোন দলের পিছনে লাইন দিব? উপরে এক পাশে লেখা ট্রানজিট অন্য পাশে অ্যরাইভাল। চোখে পড়লো না। পড়লেই বা কি? ট্রানজিট ও অ্যরাইভালের মর্ম তখনও জানিনা। ভেবে চিন্তে অ্যরাইভালের পক্ষে ভোট দিলাম।
ইমিগ্রেশনে পড়া গেল নতুন গেরোয়। ইমিগ্রেশন অফিসার একবার আমার দিকে তাকায়, আরেক বার পাসপোর্টের ফটোর দিকে। বার কয়েক তাকাতাকির পর জিজ্ঞেস করল, ফটোতে গোঁফ আছে। তোমার মুখে নাই কেন?
ভেবে চিন্তে কিছু না পেয়ে রসিকতা করে পাড়ার মৌলভী সাহেবের উপর দোষ চাপালাম। বললাম, মৌলভী সাহেব বলেছেন, গোঁফ রাখলে নাকি স্বর্গে যাওয়া যাবে না। ব্রিটিশদের একটা গুণ, তারা সহজে রিএক্ট করে না।
অফিসার ভাবলেন, এ অর্বাচীনের সাথে কথা বলে লাভ নেই। পাসপোর্ট উল্টে পাল্টে দেখলেন, মার্কিন মুলুকের ভিসা আছে। হয়তো ভাবলেন, যার আমেরিকার ভিসা আছে সে ব্রিটেনে থাকতে আসেনি। পাসপোর্টে সিল মেরে ওয়েলকাম বলে ছেড়ে দিলেন।
দেশ থেকে ট্রাভেল এজেন্ট বলে দিয়েছিল, এয়ারপোর্টে নেমে ব্রিটিশ এয়ারওয়েজের বুথে রিপোর্ট করলে তোমার হোটেল এবং খাওয়ার ব্যবস্থা করবে। খুঁজে পেতে সেখানে হাজির হলাম। তারা হোটেলে থাকা খাওয়ার ভাউচার দিল। নাম পোস্ট হাউস হোটেল। আমি এক নজর দেখে ভুল করে পড়লাম পোস্ট অফিস হোটেল। মনে মনে ব্রিটিশ পোস্ট অফিসের তারিফ করলাম, তারা শুধু চিঠি-পত্র বিতরণ করে না হোটেলও চালায়। অন্যদিকে আমাদের দেশে পোস্ট অফিস…। সে যাক গে, দুর্নীতি-দুঃশাসন সত্বেও আমাদের দেশই সবচেয়ে সেরা।
এয়ারপোর্ট থেকে বের হয়ে চোখে পড়ল সাদা মানুষের ঢল। সবাই ধবধবে সাদা। তাদের ফেয়ার এন্ড লাভলী ও ফেয়ার এন্ড হ্যান্ডসাম জাতীয় হাবি জাবি মেখে রং সাদা করা লাগে না।
বিবর্তনবাদীরা অবশ্য বলে থাকেন বিশ লক্ষ বছর আগে সব মানুষই এসেছে পূর্ব আফ্রিকার দেশ কেনিয়া থেকে, হোমো স্যাপিয়েন্স, হোমো ইরেকটাস এত সব পর্ব পার হয়ে। তাহলে, কি করে এত কালো, ধলা, পীত বর্ণের, নানা আকৃতির লোকজনের আনাগোনা হলো? আমার মনে হয় অতিরিক্ত গঞ্জিকা সেবনের ফলে এ তত্ত্বের উদ্ভব হয়েছে।
এয়ারপোর্টে হোটেলের শাটৃল বাসে বসে কিছু দূর যেতেই অনভ্যস্ত চোখে অবাক করা দৃশ্য দেখে বিস্ময়ে বিমূঢ়। যাদের ভাবতাম, মাথাভর্তি বুদ্ধি, পকেট ভরা পাউন্ড ডলার, যারা এক কালে ব্রিটিশ ভারতে ক্লাবের সামনে লিখে রাখত ‘নেটিভ এন্ড ডগ আর নট অ্যালাউড’ তাদেরই দশ বার জন সাদা আদমী কোদাল শাবল নিয়ে মাটি কেটে রাস্তা মেরামত করছে। মনে মনে এই ভেবে তৃপ্তি পেলাম, এতদিন আমাদের দিয়ে মাটি কাটিয়েছো এখন মাটি কাটার মজা কি দেখে নেও।
কলোনিগুলো থেকে লুটপাট করলেও ব্রিটিশরা অন্তত সভ্য জাতি, পরমতসহিষ্ণু, শিক্ষাদিক্ষা ও সৃজনশীল কর্মকাণ্ডে যুগ যুগ ধরে পথিকৃতের ভূমিকা পালন করে আসছে। জাতি ধর্ম নির্বিশেষে দুঃসময় সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে কুণ্ঠাবোধ করে না। বর্ণ বৈষম্য দোষে আমেরিকার মত ততটা দুষ্ট নয়।
ব্রিটিশরা ধূর্ত বলে বদনাম আছে। ধূর্ত না হয়ে বা কি করবে? একটু খানি দ্বীপ রাষ্ট্র। চাষাবাদযোগ্য জমি তেমন নাই। যেটুকু খাদ্য শস্য উৎপন্ন হয় তা দিয়ে ৩-৪ মাসের বেশি চলে না। শীতকালে প্রায় ৬ মাস বৈরী আবহাওয়া, বরফ আর কুয়াশায় ঘরের বাইরে যাওয়া দুষ্কর। তারা বুদ্ধি সাহসের সাথে ধূর্তামির মিশেল দিয়ে যুগ যুগ ধরে নানা চড়াই-উৎরাই পার হয়ে কিছুদিন আগে পর্যন্ত পৃথিবী শাসন করেছে।
ব্রিটিশদের ইতিহাস আপাতত থাক। আমার সাথে চলেন আমেরিকায়।
আমাদের দেশের তো বটেই, লন্ডনের তুলনায়ও আমেরিকার বাড়ি-ঘর গাড়ি-ঘোড়া ডাঙ্গর সাইজের। সবারই ঢাউস গাড়ি। গাড়ি তাদের জীবনের অংশ, দ্বিতীয় আবাসস্থল, সেকেন্ড হোম। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জনসংখ্যা প্রায় ৩১ কোটি। বিশ্বের বৃহত্তম জাতীয় অর্থনীতি। আনুমানিক বিশ্ব জিডিপির ২৫%.
আমেরিকার আদিম অধিবাসীরা সম্ভবত এশীয়। প্রায় বিশ হাজার বছর আগে তারা উত্তরে বেরিং প্রণালী দিয়ে আমেরিকা মহাদেশে প্রবেশ করে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মূল ভূখণ্ডে এরা কয়েক হাজার বছর ধরে বসবাস করে আসছিল।
স্পেনের রাজা রানীর পৃষ্ঠপোষকতায় ১৪৯২ সালে কলম্বাস জলপথে ভারতে আসার অভিযানে বেরিয়ে আমেরিকা যেয়ে হাজির হন। তাতে কি? রাজার নামে দখল নিয়ে সেন্ট্রাল আমেরিকায় হিস্পানিঝয়ালা দ্বীপে (বর্তমান হাইতি এল সালভেদর) সোনা রুপা লুটপাটের মিশন শুরু করেন। সে সঙ্গে দাসব্যবস্থার সূত্রপাত ঘটে। শুরু হয়ে যায় আদিম অধিবাসীদের দুর্ভোগের পালা। মজার ব্যাপার, কলম্বাস চার চার বার লুটপাটের মিশন চালালেও একবারও উত্তর আমেরিকায় পা রাখেননি। এখন দেশে দেশে তার মুর্তি ট্রেনে নামানো হচ্ছে।
অচিরেই অন্যান্য ইউরোপীয় দেশগুলো আমেরিকা মহাদেশে লুটপাটের প্রতিযোগিতায় নেমে পড়ে। আদিম জনগোষ্ঠীকে গণহত্যা অথবা তাড়িয়ে দিয়ে কলোনি স্থাপন করতে লাগে। যুদ্ধ-বিগ্রহ ও ইউরোপ থেকে আমদানি করা রোগ ব্যাধিতে নেটিভদের অস্তিত্ব প্রায় বিলুপ্ত হয়ে যায়। তাদের নির্মম নিষ্পেষনে ধ্বংস হয় উন্নত ইনকা, আজটেক ও অন্যান্য কয়েকটি সভ্যতা।
প্রাথমিক পর্যায়ে ব্রিটিশরা আটলান্টিকের তীরে উত্তর আমেরিকার তেরোটি ব্রিটিশ উপনিবেশ স্থাপন করেছিল। নিপীড়নমূলক ব্রিটিশ শাসন থেকে মুক্ত হতে ১৭৭৬ সালের ৪ জুলাই উপনিবেশগুলি এক জোট হয়ে স্বাধীনতা ঘোষণা করে। অনেক যুদ্ধ-বিগ্রহ রক্ত ক্ষয়ের পর ব্রিটিশরা পরাজয় বরণ করে। আমেরিকা স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। জন্ম হয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের।
ঊনবিংশ শতাব্দীতে যুক্তরাষ্ট্র ইউরোপের অন্যান্য উপনিবেশবাদী থেকে কিছু অঞ্চল ক্রয় করে, কিছু অঞ্চল জবরদস্তি দখল করে দেশের সীমানা সম্প্রসারিত করে। নিউইয়র্ক, মেরিল্যান্ড, ফিলাডেলফিয়া এরকম কয়েকটি শহরে দেশটির রাজধানী স্থাপন করে শেষমেষ ১৮০০ সালে পটোটোম্যাক নদীর পাড়ে রাজধানী স্থাপন করে স্বাধীনতা যুদ্ধের নায়ক জর্জ ওয়াশিংটনের নাম অনুসারে নাম রাখে ওয়াশিংটন।
সে ওয়াশিংটন বিমান বন্দরে নেমে আমার ছ্যাড়াবেড়া অবস্থার কথা শুরুতেই বয়ান করেছি। আসার আগে দূতাবাসের কাছে টেলেক্স পাঠানো হয়েছিলো কিন্তু তাদের দেখা নাই।
দূতাবাসের নম্বরে টেলিফোন করার চেষ্টা করলাম কিন্তু টেলিফোন বুথ থেকে টেলিফোন করতে সে দেশের আনি-দূয়ানি অর্থাৎ পাঁচ সেন্ট, দশ সেন্ট লাগে।
দেখলাম, কাছে ধারে এয়ারপোর্টের টুরিস্ট কোম্পানির স্টলে এক মধ্যবয়সী মহিলা কাউন্টারে বসে আছেন। তার কাছ থেকে ডলার ভাঙ্গিয়ে খুচরো কিছু আমেরিকান কয়েন পেলাম।
টেলিফোন ডাইরেক্টরি ঘেঁটে বাংলাদেশ দূতাবাসের একটা নম্বর পাওয়া গেল। ওপাশে রিং বাজে, কেউ ধরে না।
হঠাৎ নজর পড়লো, নিচে একটা টেলিফোন নম্বর দেয়া আছে পাশে লেখা, বাংলাদেশ ইন্টারন্যাশনাল গেস্ট হাউস। ভাবলাম সদাশয় মিশনের কর্মকর্তারা আমাদের মত স্বল্প আয়ের লোকের জন্য কিছু একটা বাসস্থানের ব্যবস্থা করে রেখেছেন। ইউরেকা বলে নম্বর ঘোরালাম। এবার মনুষ্য কন্ঠ শোনা গেল। দু’দিনের মধ্যে প্রথম বাংলা ভাষা।
কন্ঠের মালিক কে জিজ্ঞেস করলাম এটা কি বাংলাদেশ এমব্যাসির কোন গেস্ট হাউস?
–না ভাই, এটা এমব্যাসির কোন গেস্ট হাউস নয়। প্রাইভেট বোর্ডিং হাউস বলতে পারেন। নোয়াব আলী নামে এক ভদ্রলোক ফ্ল্যাট ভাড়া করে বাংলাদেশ থেকে আসা লোকজনের জন্য অর্থের বিনিময়ে থাকার ব্যবস্থা করেন।
দু’দিন পরে মাতৃভাষায় কারো সাথে কথা বলতে পেরে পরমানন্দ বোধ করলাম। নাম বিনিময় করলাম। তিনি পরিচয় দিলেন, “আমার নাম ডাক্তার সুরমান আলী”। অল্প কথাতেই বুঝলাম ডাক্তার সাহেব সদাশয় মানুষ।
জিজ্ঞেস করলাম, আমি কি গেস্ট হাউসে থাকতে পারব?
তা পারবেন, তবে নওয়াব আলী সাহেব এখন বাইরে। গেস্ট হাউসে আমি একাই আছি। এখনই বেরিয়ে যেতাম। আপনি দেশ থেকে এসেছেন তাই আপনার জন্য অপেক্ষা করবো। সে সময়ে সবাই দেশের কারো মুখ থেকে সরাসরি দেশের খবর জানার জন্য উদগ্রীব হয়ে থাকতেন।
তিনি গেস্ট হাউজের ঠিকানা দিলেন। সে সঙ্গে পরামর্শ দিলেন, এয়ারপোর্টের বাইরে দেখবেন গ্রেহাউন্ড কোম্পানির বাস দাঁড়িয়ে আছে। তার একটাতে সওয়ার হয়ে ওয়াশিংটন শহরের কেন্দ্রস্থলে আসতে পারবেন। সেখান থেকে ট্যাক্সি নিয়ে আমাদের ঠিকানায় চলে আসেন।
এয়ারপোর্ট থেকে বেরিয়ে অদূরে দেখলাম গ্রেহাউন্ড কোম্পানির বাস শহরের কেন্দ্রে যাবে। বাসের সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে এক বিশাল কান্তি ড্রাইভার-কাম-কন্ডাক্টর। রসিক লোক, আমার হাতের ব্যাগ সুটকেস এক ঝটকায় কেড়ে নিয়ে বাসের পেটে চালান করে দিল।
ভাড়া দেওয়ার জন্য ডলারের বান্ডিল বের করলে সে ভাড়া বাবদ একটা নোট ছোঁ মেরে মেরে নিয়ে বলল, আমি এটা আমার মেয়ের জন্য নেব, তার পুরনো নোট জমানোর সখ, এ সিরিজের নোট এখন আমাদের দেশে খুব একটা পাওয়া যায় না।
কেউ পরিচয় না করিয়ে দিলে ব্রিটিশরা ঘন্টার পর ঘন্টা পাশে বসে থাকবে কিন্তু আলাপ করবে না। ব্রিটিশদের তুলনায় আমেরিকানরা খোলামেলা। অপরিচিত কারো সাথে আলাপ শুরু করতে জড়তা বোধ করে না।
বলল, বাসে উঠ, বাস ছাড়বো। দেখলাম বাস বিলকুল ফাঁকা। জিজ্ঞেস করলাম, আমাকে একাই নিয়ে যাবে নাকি?
বলল, সময় হয়ে গেছে। প্যাসেঞ্জার থাক আর না থাক আমাকে ছাড়তেই হবে।অনেক স্বস্তি নিয়ে বাসে চড়লাম।
কথায় বলে, বসতে পেলে শুতে চায়। আমার শোয়ার ইচ্ছা ছিল না, তবে ধূমপানের নেশা চেপে বসল। বাসে কোথাও ধূমপান সম্পর্কে নিষেধাজ্ঞা জারি করা আছে কিনা দেখার জন্য রেকি চালালাম।
স্বস্তির সাথে লক্ষ্য করলাম, বাসের একেবারে শেষ প্রান্তে একটি সিট ধূমপায়ীদের জন্য বরাদ্দ রাখা হয়েছে। সেদিকে পৌঁছে দেখি এক অবাক কান্ড, সিটের আড়ালে বসে আছে এক শ্বেতাঙ্গ তরুণী।
ধূমপানের মিশন নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্বে পড়ে গেলাম। নিজেকে যতই ফর্সা মনে করি না কেন, ইউরোপ-আমেরিকার চোখে আমরা কালো দলেরই শামিল। অল্প কিছু কাল আগেও আমেরিকার শ্বেতাঙ্গদের কাছে কালোরা ছিল অপরিসীম ঘৃণার পাত্র। স্কুল, কলেজ, রেস্টুরেন্ট ছিল আলাদা। যার নাম ছিল রেসিয়াল সেগ্রিগেশন, বর্ণ বিভাজন।
শ্বেতাঙ্গদের স্কুলে বা রেস্টুরেন্টে কালোদের প্রবেশ নিষিদ্ধ। তাই ভাবলাম, সাদা তরুণীর পাশে বসে সিগারেট ফুকলে তুলকালাম কাণ্ড হয়ে যেতে পারে। চাই কি, জেল জরিমানাও হতে পারে। জানতাম, ব্যক্তিস্বাধীনতার দেশ, কিন্তু কালো আদমিদের জন্য সে স্বাধীনতা কতটুকু বরাদ্দ আছে জানা ছিল না।
আমাকে অবাক করে দিয়ে তরুণী মিষ্টি স্বরে বলল, তুমি নির্দ্বিধায় সিগারেটের খেতে পারো। ‘এই বলে বিদেশির অঙ্গ হতে মুছে দিল ক্লান্তি অবসাদ’।
তার পাশে দেখলাম খাঁচায এক পাখি। সে বলল, আমি সিগারেট খাই না। সাথে পাখি আছে বলে পিছনের সিটে বসেছি। অপরূপ সুন্দরী নয়, তবে শ্বেতাঙ্গিনী ত বটে।
সিটের এক প্রান্তে আমি, অন্য প্রান্তে শ্বেতাঙ্গিনী। কথা বলার জন্য উসখুস করছে। জানালো, সে লন্ডন গিয়েছিল বেড়াতে। সেখানে তার ফুফু তাকে পাখিটা উপহার দিয়েছেন।
প্রশ্ন করল, তুমি কোন দেশের লোক।
বাংলাদেশে শুনে বলল, ইন্ডিয়া নাকি?
আমি বললাম, না ইন্ডিয়ার পাশে।
সে আবার বলল, তোমাদের দেশে আমার বাবা জাপানিদের সাথে যুদ্ধ করতে গিয়েছিলেন।
জিজ্ঞেস করলাম, কোন জায়গায়?
সে বলল, রেঙ্গুনে।
শুনেছিলাম আমেরিকানদের ভূগোল জ্ঞান টনটনে। তরুনীর জবাব শুনে অবাক হইনি।
আমেরিকা বিরাট দেশ অর্থ-সম্পদ প্রচুর। অন্য সব দেশের খোঁজ খবর রাখার ব্যাপারে তাদের আগ্রহ কম। এমন কি মেক্সিকো তাদের দেশের কোন দিকে তাও ৩০ শতাংশ আমেরিকান জানে না।
আলাপ থেমে থাকল না। জানালো, তোমাদের দেশের সেতার বাদক রবি শংকর আমাদের কয় ভাই বোনের খুবই প্রিয়। আমাদের কাছে তার সব সিডি রয়েছে।
আমি উৎসাহ নিয়ে বললাম, রবিশংকর তো জন্ম সূত্রে আমার যশোর জেলার লোক, আমাদের বাড়ি থেকে মাত্র কয়েক মাইল দূরে। এবার তার অবাক হওয়ার পালা। এক ঝটকায় আবার পাশে এসে বসলো।
—তাইত বলি, তোমার চেহারায় রবি শংকরের অল্প বয়সের চেহারার সাথে মিল আছে।
আমি বললাম, হবেই তো, রবি শংকর ও তার ভাই নৃত্য শিল্পী উদয়শংকর, আমরা একই নদী পাড়ের বাসিন্দা।
সে পথে নামকরা স্থাপনা বন-বাদাড়র সাথে পরিচয় করে দিতে লাগলো।
শহরে এসে বাস থেকে নামার আগে সাবধান করে দিলো, তুমি ১৫ নম্বর স্ট্রিটের ওপাশে যেও না। ওটা কালোদের এলাকা। সবকিছু লুটেপুটে নিতে পারে।
কালো চামড়ার মানুষের দলে আমাকে সামিল করে নাই দেখে মনে স্বস্তি পেলাম। কালো মানুষ বলে যে দুশ্চিন্তা ছিল তাও উধাও হয়ে গেল।
বাস থেকে নেমে ট্যাক্সি ডেকে ট্যাক্সিওয়ালাকে ভালো করে বুঝিয়ে বলল, এনাকে ১৫ নম্বর স্ট্রিটে পৌঁছে দিবেন। উনি আমাদের অতিথি, আমেরিকায় প্রথম এসেছেন। তাঁর যেন অসুবিধা না হয।
আমেরিকা যেমন বড় দেশ আমেরিকানদের অনেকেরই কলিজার সাইজও তেমনি বড়। এই তরুণীর হৃদয় হয়তো সোনা দিয়ে মোড়া।
গন্তব্যে পৌঁছে ট্যাক্সিতে নামতেই দেখলাম সুরমান আলী সামনে দাঁড়িয়ে। আমাকে অভ্যর্থনা জানানোর জন্য তিনি রাস্তায় দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিলেন। মুখে মৃদু হাসি নিয়ে আবার দিকে এগিয়ে এলেন।
যথারীতি উষ্ণ করমর্দনের পর আমার জন্য নির্ধারিত রুমে ঢুকে দেখলাম নামেই ইন্টারন্যাশনাল গেস্ট হাউস।
ইন্টারন্যাশনালের নাম গন্ধ নেই। ঘর অগোছালো, আসবাবপত্র যৎসামান্য। তবুও ভালো, ঘর তো একটা পাওয়া গেল। অল্পস্বল্প বিশ্রাম নেওয়ার পর ডাক্তার সাহেব বললেন চলেন আমরা শহরটা ঘুরি আসি।
রাস্তায় বেরিয়ে প্রথম আমেরিকার চলমান জীবনের কিছু ঝলক দেখতে পেলাম। এলাকাটা তত উন্নত নয়। বেশিরভাগ স্বল্পবিত্ত মানুষের বসবাস।
কিছু দূর এগোতেই এক গলির মোড়ে দেখলাম এক তরুণী জিন্সের আঁটোসাঁটো ড্রেস পরে দাঁড়িয়ে আছে। আমরা তার পাশ দিয়ে যেতে বলে উঠলো, ওয়ান্ট এ ডেট।
ডাক্তার সাহেব হঠাৎ ক্ষেপে বাংলাতে বললেন, কুত্তি ভাগ।
আমি বললাম ডেট মানে তো জানতাম খেজুর। তা ডেট দিতে চাচ্ছে শুনে আপনি এত রেগে গেলেন কেন্?
মুচকি হেসে বললেন, আমেরিকার ডেট আলাদা জিনিস। বন্ধু কিংবা বান্ধবীকে বোঝায়। তারা মাঝে মাঝে এক সঙ্গে বাইরে কোথাও কিছুটা সময় কাটায়।
আমেরিকানরা নিজেদের তৈরি বেশ কিছু শব্দ তাদের ভাষায় ঢুকিয়ে দিয়েছে। ডেট তার একটা। এ নিয়ে একটা জোক শুনিয়ে আমার গল্প শেষ করছি।
একবার ব্রিটিশ ও আমেরিকার দুইজন শিক্ষক আলাপচারিতা সময় আমেরিকার শিক্ষক জিজ্ঞেস করলেন, তোমাদের ডরমিটরিতে ছেলে-মেয়েদের কি ডেট অ্যালাও করো?
আমার মত ব্রিটিশ শিক্ষকের ধারণা ছিল, ডেট মানে খেজুর। তিনি উত্তর দিলেন, হ্যাঁ দেই, কিন্তু বেশি খেতে দেই না। পেট খারাপ হওয়ার ভয়ে।
