প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার আগে একটা গল্প বলে শুরু করা যেতে পারে।
এক লোক গাড়ি নিয়ে গ্রামের রাস্তা দিয়ে চলছিলেন। হঠাৎ এক জায়গায় তার গাড়ি কাঁদায় আটকা পড়ে। তিনি কিছুতেই গাড়ি মুক্ত করতে পারছিলেন না। এ সময় দেখতে পেলেন অদূরে এক জন গ্রামবাসী ঘোড়া নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। গাড়ির মালিক তার সাহায্য প্রার্থনা করলেন। ঘোড়াওয়ালা ১০০ টাকার বিনিময়ে ঘোড়ার সাহায্যে গাড়িটা উদ্ধার করতে রাজি হলেন।
ঘোড়ার সাহায্যে গাড়িটা টেনে ওঠানোর পর গাড়িওলা জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কি প্রায়ই এ-রকম গাড়ি টেনে উঠানোর কাজ করো?
—নিশ্চয়, তোমাকে নিয়ে সকাল থেকে সাত খানা গাড়ি টেনে উঠিয়েছি।
—তুমি যদি দিন ভর টানাটানির কাজ করতে থাকো তাহলে নিজের কাজ কখন করো?
—কেন, রাত্রে?
—রাত্রে কি করো?
—কাদা যাতে শুকিয়ে না যায়, সেজন্য পানি ঢালি।
পাটকল থেকে যাতে আয়ের উৎস বন্ধ না হয়ে যায় সে জন্য বহু মহল কাদায় পানি ঢালতে থাকে।
লোকসানি পাটকল বন্ধ করার প্রধান যুক্তি একটাই। সস্তা কৃত্রিম তন্তু আবিষ্কারের ফলে আন্তর্জাতিক বাজারে পাটের বস্তা, ব্যাগ এবং অন্যান্য প্যাকিং সামগ্রীর চাহিদা সাংঘাতিক ভাবে কমে গেছে। পাট কলের প্রাণ কেন্দ্র ইংল্যান্ডের ডান্ডি সে কারণে এক মুহূর্ত দেরি না করে ১৯৭২ সালেই সব পাটকল গুটিয়ে ফেলে। কৃত্রিম নীল আবিষ্কারের ফলে জমিতে নীল চাষ যেমন বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। সে সাথে ব্রিটিশ ভারতে বন্ধ হয়ে গিয়েছিল নীলকর সাহেবদের অত্যাচার।
বাংলাদেশ ও ভারতে নানা রকম সাবসিডি ও পাটজাত দ্রব্য ব্যবহারে বাধ্যবাধকতা ও পৃষ্ঠপোষকতার কারণে পাটকলগুলো টিকে আছে। এতে বেশিরভাগ লাভ হচ্ছে পাটকল মালিকদের, লোকসান গুনতে হচ্ছে সাধারণ ভোক্তাদের। পাটকলগুলোকে বাঁচিয়ে রাখতে ভর্তুকি বাবদ ট্যাক্সের বোঝা আখেরে পাবলিককেই টানতে হয়।
পাট চাষীরা খুব যে লাভবান হচ্ছে তা নয়। প্রায় বছরে পাটের উৎপাদন মূল্য উঠাতে না পেরে হতাশ হয়ে আগুন লাগিয়ে পুড়িয়ে ফেলে প্রতিবাদ জানায়।
প্রভাবশালী পাটকলের মালিকরা পাটের ভবিষ্যতের কাল্পনিক সোনালী আঁশের দিন ফিরে আসার সম্ভাবনার গল্প শুনিয়ে নিয়মিত বিরতিতে হাজার হাজার কোটি টাকা সাবসিডি ও ব্যাংক ঋণ মওকুফ করিয়ে নেয়। পাট উন্নয়ন বোর্ড ও গবেষণাকেন্দ্র সে কাহিনীতে নতুন নতুন রং যোগ করেন। কাদা যাতে শুকিয়ে না যায় সেজন্য ঘোড়ার মালিকের মত পানি ঢালতে থাকেন।
কিছু দিন আগে পাটের জন্ম রহস্য বের করে চারিদিকে হৈ হুল্লোড় লাগিয়ে দিয়েছিল। পাটের চাহিদাই যখন এতটা নিম্নমুখী তার জন্ম রহস্য জেনে কি লাভ? তবুও, বাংলাদেশের আপামর জনসাধারণকে বিজ্ঞরা স্বপ্ন দেখাতে ভালবাসেন যদিও সে স্বপ্নের বেশির ভাগই বাস্তবে ধরা দেয় না।
মোট কথা, সরকারি পর্যায়ে শত বর্ষ পুরনো যন্ত্রপাতি, উৎপাদন ব্যবস্থাপনা, দুর্নীতিগ্রস্থ পাট কলগুলো চালু রাখা সাদা হস্তী পালনের সমান। প্রকারান্তরে আমরা পাট বস্ত্র ব্যবহারের জন্য বিদেশি ব্যবহারকারীদের সাবসিডি দিচ্ছি। তবুও নানা স্বার্থান্বেষী মহল নিজেদের স্বার্থে এগুলো টিকিয়ে রাখতে তৎপর থাকে।
দেরিতে হলেও লোকসানগ্রস্থ পাটকলগুলো বন্ধ করার জন্য সরকার বাস্তব মুখী সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। অন্যান্য লোকসানমুখী সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোও যত শীঘ্র বিক্রয় বা বন্ধ করে দেওয়া যায় ততই দেশের মঙ্গল। আশির দশকে ইংল্যান্ডের আয়রন লেডি মার্গারেট থ্যাচার প্রবল বাধা সত্ত্বেও এ নীতি অবলম্বন করে মৃত্যু প্রায় ব্রিটিশ অর্থনীতি চাঙ্গা করতে সক্ষম হয়েছিলেন। কয়লা খনির শ্রমিকরা কয়েক বৎসর ধর্মঘট চালিয়ে গেলেও তাঁকে তাঁর সিদ্ধান্ত থেকে টলাতে পারেনি।
স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের রপ্তানি আয়ের প্রায় ৮০ ভাগ পাট ও পাটজাত দ্রব্য রপ্তানি করে পাওয়া যেত। এখন তা ক্রমান্বয়ে হ্রাস পেয়ে প্রায় শতকরা ২ ভাগে নেমে এসেছে। এক বিজ্ঞ প্রাক্তন পাটমন্ত্রীকে বলতে শুনেছি “ছালা” বিক্রি করে আর কতদিন পাটকল চালানো যাবে?
এ পরিস্থিতিতে যে সব পাটকল, সরকারি কিংবা বেসরকারি হোক, ভর্তুকি ব্যতীত কিছু পণ্য যেমন কার্পেট ব্যাকিং ও জুট ইয়ার্ন, মোটর গাড়ির প্যাডিং বিক্রি করে আন্তর্জাতিক বাজারে টিকে থাকার সামর্থ্য আছে তাদের ছাড়া অন্য গুলোকে বন্ধ করে দেয়া উচিত।
আদমজী ইপিজেডে জুতা জুট মিলের মত বন্ধ করে দেওয়া পাটকলের জায়গা জমিন, স্থাপনাগুলো রেডিমেড গার্মেন্টস বা অন্য কোন উৎপাদনমুখী কর্মকাণ্ডে ব্যবহার করা যেতে পারে। পাটকলগুলোর ছাঁটাই করা কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সে সব শিল্পে নিয়োগে অগ্রাধিকার দেওয়া যেতে পারে।
