মুদ্রার বিনিময় হার নির্ধারণ কিভাবে হয়?
মূলত ক্রয় ক্ষমতার ভিত্তিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক কর্তৃক অথবা মার্কেটের চাহিদার সরবরাহের টানাপোড়েনে যে কোনো কারেন্সির মুদ্রার মান নির্ণীয় হয়। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মনিটরি পলিসি অর্থাৎ মুদ্রানীতি ব্যাংকের বিনিময় হারের উপর প্রভাব ফেলে।
উন্নত দেশগুলির মুদ্রার মান বিশ্ব মুদ্রা বাজারে অন্যান্য পণ্যের মত চাহিদা ও সরবরাহের ভিত্তিতে নির্ণীত হয়ে থাকে।এ ধরনের বিনিময় হারকে বলে floating exchange rate. বিনিময় হার নিয়ন্ত্রণের জন্য সে দেশের সেন্ট্রাল ব্যাঙ্ক সাধারণত সরাসরি হস্তক্ষেপ করে না। তবে, অভ্যন্তরীণ মুদ্রানীতি পরিবর্তন করে ভোক্তার পন্যের চাহিদা নিয়ন্ত্রণ করে তাদের কারেন্সির বিনিময় হার স্থিতিশীল পর্যায়ে রাখতে যত্নবান থাকে।
যেমন বাজারে মুদ্রাস্ফীতি দেখা গেলে সুদের হার বাড়িয়ে দেওয়া হয়, অথবা কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাজার থেকে বাড়তি টাকা একাধিক উপায় তুলে নেয়। অন্যান্য দেশ যাদের কারেন্সি তত শক্তিশালী নয় তাদের অনেকেই ডলার, ইউরো, ইয়েন জাতীয় শক্তিশালী কারেন্সির সাথে নিজেদের কারেন্সির গাঁটছড়া বেঁধে রাখে। একে বলে পেগিং, pegging। যে কারেন্সির সাথে গাঁটছড়া বাঁধা হয় সে কারেন্সির বিনিময় হারের পরিবর্তন হলে নিজেদের কারেন্সিরও বিনিময় হারে পরিবর্তন হতে থাকে। তবে বড় ধরনের উত্থান-পতন রোধ করার জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক অবস্থা বিশেষে মার্কেটে ফরেন এক্সচেঞ্জ সাপ্লাই অথবা ক্রয় করে বিনিময় হার স্থিতিশীল রাখার চেষ্টা করে।
কোন কারেন্সির বিনিময় হার দুটো ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করা যেতে পারে। একটা অফিসিয়াল বিনিময় হার যার ভিত্তিতে মার্কেটের দৈনিক ফরেন এক্সচেঞ্জ ক্রয় বিক্রয় হয়। একে বলে Nominal exchange rate. অন্যটি সে কারেন্সির অভ্যন্তরীণ ক্রয় ক্ষমতার ভিত্তিতে। তাকে বলে purchasing power parity ভিত্তিতে নির্ণীত বিনিময় হার। এ হারে কোনো লেনদেন হয় না। শুধু কোন কারেন্সির অভ্যন্তরীণ ক্রয় ক্ষমতা কত তা প্রকাশ করতে তুলনামূলক হিসাবের জন্য ব্যবহার করা হয়। আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিল এবং বিশ্ব ব্যাংক বিভিন্ন দেশের জিডিপি এবং মাথাপছু আয় নির্ণয় করতে দুটো বিনিময় হার ব্যবহার করে থাকে।বিশ্ব ব্যাংকের হিসাব মতে ২০২০ সালে বাংলাদেশের মাথাপিছু অনুমিত আয় ২০৬৮ মার্কিন ডলার। অর্থনীতির ভাষায় একে বলে নমিনাল মাথা পিছু আয়।অন্যদিকে purchasing power parity বা ক্রয় ক্ষমতার ভিত্তিতে বাংলাদেশে মাথা পিছু আয় ৫,৪৫৩ মার্কিন ডলার। অর্থাৎ বাংলাদেশের বর্তমান বিনিময় হারের ভিত্তিতে বছরে মাথাপিছু আয় করে ২০৬৮ মার্কিন ডলার। কিন্তু ক্রয় ক্ষমতার ভিত্তিতে ৫,৪৫৩ মার্কিন ডলার। অর্থাৎ নমিনাল বিনিময় হারে (যা এখন প্রতি ডলারের প্রায় ৮৪ টাকা)র তুলনায় ক্রয় ক্ষমতার ভিত্তিতে বাংলাদেশ টাকার মান ৫৪৫৩÷২০৬৮=২.৬৪ গুন বেশি।উদাহরণ স্বরূপ, বাংলাদেশ এক কেজি বেগুন কিনতে লাগে ৬০ টাকা। শহর ভেদে ভারতেও তাই। আমেরিকা এবং অন্যান্য ইউরোপীয় দেশ বেগুনকে বলে brinjal বা egg plant ব্রিটেনে aubergine। যে নামেই হোক না কেন আমেরিকায় এক কেজি বেগুন কিনতে লাগবে সে দেশের ডলারর সমপরিমাণ বাংলাদেশ টাকার ১০০-১৫০ টাকা। তেমনি আমাদের দেশের সাদামাঠা জাম্বুরাকে বলে grape fruit যা আমাদের দেশে পাওয়া যায় ২০-৩০ টাকায়। পল্লী এলাকায় অনেক সময় জাম্বুরা গাছের নিচে বাগানে পড়ে থাকে। আমেরিকার অভিজাত শপিংমলগুলোতে তার গায়ে লেবেল লাগিয়ে দাম রাখা হয়েছে অন্তত এক ডলার—আমাদের দেশের ৮৪ টাকার সমান। ঢাকা শহরে প্রতিদিন অলিতে গলিতে প্রায় লাখ খানেক ভ্যান গাড়িতে সুন্দর সুন্দর তাজা তরকারি বিক্রি করে। লন্ডনের অক্সফোর্ড স্ট্রিটে অথবা নিউইয়র্কের ম্যানহাটনে বড় বড় শপিং মলে এতো সুস্বাদু তরিতরকারি পাবেন না কিন্তু ফেন্সি লেবেল লাগিয়ে সাজিয়ে গুছিয়ে রাখে। দেখতে চমৎকার লাগে কিন্তু স্বাদে গন্ধে বাংলাদেশের তরি-তরকারির সাথে তুলনা হয় না। তবুও, তা কিনতে কয়েক গুণ বেশি দাম দিতে হবে।তেমনি, আপনি হয়তো একজন কাজের মেয়েকে মাসিক বেতন দিচ্ছেন ৮,০০০ টাকা। কিন্তু আমেরিকায় একজন সার্বক্ষণিক কাজের বুয়া, যাকে পশ্চিমবঙ্গে বলে কাজের মাসি, রাখতে হলে গুনতে হবে প্রায় দেড় লক্ষ টাকা। ভারতে বর্তমান বিনিময় হারে ($১=৭৮. ৫০) ১,৩৮,০০০ রুপি। এ কারণে, বাংলাদেশের মধ্যবিত্ত পরিবারের বাড়ির গিন্নি রান্নাবান্না, ধোয়া-মোছার কাজের দায়িত্ব এক বা একাধিক কাজের বুয়াদের হাতে ছেড়ে দিয়ে দিব্যি বেড়াতে বেরোন কিংবা টেলিভিশনে নিশ্চিন্তে সিরিয়াল দেখেন।কিন্তু, আমেরিকায় খুব বড়লোক না হলে মধ্যবিত্ত, এমনকি উচ্চ মধ্যবিত্ত, লোকজন কাজের বুয়া রেখে নিজেরা হাওয়া খেয়ে বেড়ানোর মতো বিলাসিতা করার সুযোগ নাই। আমেরিকায় কোম্পানি থেকে ঠিকা ঝি ভাড়া করা যায় বটে কিন্তু তিনি আসেন দামি গাড়িতে চড়ে, ঘন্টা প্রতি তার মজুরি কম পক্ষে ১৫ ডলার, বাংলাদেশ টাকার ১,২৭৫ টাকার সমপরিমাণ। ভারতে ১,১৭৮ রুপি।বুঝেন ঠেলা। এ জন্য, স্বামী স্ত্রী মিলে রান্না-বান্না, ধোয়ামোছা, বাথরুম, কমোড পরিষ্কার করে। অনেক ক্ষেত্রে দু’জনকেই চাকরি করে খরচ মেটাতে হয়।নিউ ইয়র্কে পুরুষদের চুল কাটতে গড়ে দিতে হয় ৩৭ ডলার, বাংলাদেশ টাকার ৩১৮০ টাকা, ভারতের তিন হাজার রুপির কম। আমেরিকা, কানাডায় অনেক স্ত্রী স্বামীর চুল কেটে থাকে।আবার, রিকশায় চড়ে আপনি রিকশওয়ালাকে ধরা যাক ১০০ টাকা দিলেন।মনে মনে হয়তো ভাবছেন এতোটকু রাস্তার জন্য ১০০ টাকা? কি যে হলো দেশটার? আমেরিকায় রিক্সা নাই (আটলান্টা এলাকায় টুরিস্টদের জন্য কিছু রিকশা চলাচল করে) কিন্তু তাকে যে পরিমাণ হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম করতে হয় তার সমান পরিশ্রমের বিনিময়ে যেমন বাড়িতে রং করা, গাড়ি মেরামত করার জন্য তাকে দিতে হবে ১,০০০ থেকে ৪,০০০ টাকা।কিছু কিছু ক্ষেত্রে অবশ্য আমদানিকৃত পণ্যের মূল্য আমেরিকার তুলনায় বাংলাদেশে বেশি। যেমন যে কম্পিউটার আপনি বাংলাদেশ ১,০০,০০০ টাকায় কিনতে পারেন আমেরিকায় তার হতে পারে মূল্য ৭০,০০০ টাকা। কিন্তু আপনি তো রোজ রোজ কম্পিউটার কিনতে যাবেন না। প্রসাধন ও অন্যান্য আমদানিকৃত বিলাস দ্রব্যের ব্যাপারে একই কথা। অথচ আপনাকে রোজ বাজারে যেতে হয়, রিক্সায় চড়তে হয়, ছেলে মেয়ের স্কুলের বেতন, টিফিনের টাকা দিতে হয়। এ-সব খাতে সিংহ ভাগ অর্থ ব্যয় হয়। আগেই বলেছি, এসব খাতে ব্যয় ভার বাংলাদেশে সস্তা।এ সব বিষয়ে মধ্যবিত্ত পরিবারের শপিং লিস্টের উপর ভিত্তি করে অভ্যন্তরীণ ক্রয় ক্ষমতার নিরিখে বাংলাদেশ টাকা আমেরিকার ডলারের চাইতে গড়ে ২.৬৪ গুন বেশি মুল্যবান। তার অর্থ বাংলাদেশে আপনি আমেরিকার তুলনায় ২০০ ডলার হোক কিংবা ২০০০ ডলার হোক একজন মধ্যবিত্ত শ্রেণীর পরিবার হিসাবে অফিশিয়াল বিনিময় হারে তার সমপরিমাণ বাংলাদেশ টাকায় গড়ে ২.৬৪ গুন বেশি স্বাচ্ছন্দে বাস করতে পারবেন। ধনী ও দরিদ্রের মধ্যে স্বাচ্ছন্দ্যের পরিমাণ হেরফের হবে। কারণ ধনীদের তুলনায় গরিবদের শপিং লিস্টে আমদানিকৃত পণ্যের পরিমাণ খুবই নগণ্য।শুধু আমেরিকা কেন, ডলার, ইউরো, জাপানি ইয়েন কিংবা অন্যান্য ফরেন কারেন্সির সমপরিমাণ বেতন পেয়ে ব্রিটেন ,জার্মানি, ফ্রান্স জাপানের মতো উন্নত দেশের তুলনায় কম বেশি অধিকতর স্বাচ্ছন্দ অনুভব করবেন।
