আফগানিস্তানের তালেবান ও একজন আলতাফ জান
গত শতাব্দীর নব্বই দশকে কনসালটেন্সি কাজে সপ্তাহ দুয়েক পেশোয়ারে কাটিয়েছিলাম। সেখানে এক রেস্টুরেন্টে একজন আফগান যুবকের সাথে মোলাকাত হয়। যুবক না বলে দৈত্য বলাই ভালো। শরীর খানা মাশাল্লাহ বানিয়েছে বিশাল আকৃতির, টিভি সিরিজের ইনক্রেডিবল হাল্ক।
রেস্টুরেন্টের টেলিভিশনে ভারত-পাকিস্তান ক্রিকেট ম্যাচের সরাসরি সম্প্রচার চলছিল। সে আফগান দৈত্য এবং অন্য কয়েকজন দর্শক চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী দুই টিমের খেলার মাঠের যুদ্ধ দেখছিল। খেলার মাঠের যুদ্ধ হলেও পাকিস্তান-ভারতের ক্রিকেট ম্যাচে সব সময় আসল যুদ্ধের উন্মাদনার আমেজ থাকে। খেলার মাঠের উত্তেজনা টিভি দর্শকদের মধ্যেও ছড়িয়ে পড়ে।
উত্তেজনা সাথে নিয়েই আফগান যুবক দু’খানা হাতলহীন চেয়ার পাশাপাশি রেখে বিশাল বপুখানা উপস্থাপন করে রেখেছে। খেলা দেখার ফাঁকে ইতোমধ্যে দু’প্লেট চিকেন বিরিয়ানি সাবাড় করে ঢেকুর তুলছে।
তার বিশাল লাশের মধ্যে কি মাল আছে তা আবিষ্কার করার জন্য মনটা উসখুস করছিল। ম্যাচে লাঞ্চ ব্রেকের সময় ধারাবিবরণী সাময়িকভাবে বন্ধ হলে ভয়ে ভয়ে হাতটা বাড়িয়ে দিলাম। অক্ষত অবস্থায় ফিরে পাব কিনা সে দুর্ভাবনা অবশ্য ছিল।
সৈয়দ মুজতবা আলীর দেশে বিদেশে গল্পগ্রন্থে পাঠান আহমদ আলীর সাথে পেশোয়ার রেলওয়ে স্টেশনে মোলাকাতের কথা মনে হলো। আগের দিনই সে স্টেশন ঘুরে এসেছি। কল্পনায় দেখেছি, স্টেশনে তিনি পাঠানের বজ্রমুষ্টি থেকে হাতখানি ফেরত পাওয়ার জন্য ছটফট করছেন
সৈয়দ সাহেব আফগান বাদশা আমানুল্লাহর আমন্ত্রণে সে দেশে গিয়েছিলেন গত শতাব্দীর বিশ দশকের শেষ প্রান্তে একটা স্কুলে ছাত্রদের তালিম দিতে। বাদশা তখন আফগানিস্তানকে আধুনিকায়ন করার জন্য ব্যাপক সংস্কার শুরু করেছেন।
আফগানিস্তানের পশতুন জনগোষ্ঠীর আতিথেয়তার জন্য সুনাম আছে। শক্ত আলিঙ্গন, উষ্ণ করমর্দন, বুকে পিঠে হাত বুলিয়ে অতিথিদের বরণ করে নেওয়া তাদের বহু পুরনো ট্র্যাডিশন। তবে, এখনকার পশতুন, যারা পাঠান বা পাখতুন নামেও পরিচিত, তাদের আতিথিয়তায় অনেকখানি চিড় ধরেছে। অতিথিদের আগের মতো শক্ত মুঠোয় লুফে নেয় না।
আমার দৈত্যও অল্পতেই হাত ফেরত দিয়ে মুখে একটুখানি হাসি ফুটিয়ে পরিচয় পেশ করল, ‘আমার নাম আলতাফ জান, আফগান মূলুকের পাঠান।’ আমার পরিচয় পেশ করলাম।
দৌত্য তার নীল চোখ কুঞ্চিত করে ঈষৎ জলদগম্ভীর রবে আওয়াজ দিল, বাংলাদেশ থেকে এ পাণ্ডব বর্জিত দেশে আগমনের হেতু কি?
আমি অবাক। পাঠান কি ক্ষেপে গেছে? জানতাম পাঠানরা বিদেশীদের প্রতি বন্ধুভাবাপন্ন। কিন্তু, বিদেশ-বিভুঁইয়ে কিছুই হলফ করে বলা যায় না। আফগান পাঠান হলেও এখন সে পাকিস্তানি নাগরিক। মশরেকি পাকিস্তান হাতছাড়া হয়ে যাওয়ার দুঃখ পাকিস্তানিদের বুকে জগদ্দল পাথরের মতো চেপে বসে আছে। বীরের জাতি বলে তাদের যে অহংকার ছিল তাতে ফাটল ধরেছে।
অবিভক্ত পাকিস্তানের অরক্ষিত পূর্ব পাকিস্তানে নড়বড়ে সুরক্ষা ব্যবস্থার কথা বললে তারা সান্তনার বাক্য শোনাতো, “ভারত মশরেকি পাকিস্তান হামলা করলে আমরা দিল্লী পর্যন্ত দখল করে নেব।” কিন্তু দিল্লি তো দূরের কথা, একাত্তর সালের মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের পুঁচকে মুক্তির ঠেলা সামলাতেই নাভিশ্বাস উঠেছিল। আশাহত সে বীরের জাতির একজন যদি আমার উপর রাগ ঝাড়তে চায় তাহলে কোন পথে পালাবো মনে মনে হিসাব করছিলাম।
বাস্তবে, পাকিস্তানের বীরত্বের কাহিনী কল্পনাপ্রসূত। আয়ুব খানের আমলে প্রখ্যাত পাঠান বিচারপতি জাস্টিস কায়ানি ব্যঙ্গ করে বলতেন, পাকিস্তানি সিপাহীরা বড়ই বীর, তারা আর কারো সঙ্গে যুদ্ধে জিততে না পারলেও, নিজের দেশকে দখল করে বীরত্বের পরিচয় দিতে দ্বিধা করে না ।
প্রকৃতপক্ষে, যুগে যুগে হিন্দুকুশ পর্বতমালা পার হয়ে শক, হুন, আরব,মোগল, গ্রিক, পাঠান যত জাতি উপজাতি উপমহাদেশে হানা দিয়েছে এখনকার পাকিস্তানের সে অঞ্চলের কেউ বাঁধা দেয়নি। বরং তাদের সাথে যোগ দিয়ে উত্তর ভারতে লুটপাটে নেমেছে। শুধুমাত্র ঝিলাম নদীর এক ছোট রাজা পুরু আলেকজান্ডারের গ্রিক বাহিনীকে রুখে দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। বিদেশি শক্তি প্রতিরোধের আর কোন ঘটনা ইতিহাসে লেখা নাই।
কাবুলি যুবকের জলদগম্ভীর শহর কানে এলো। এবার গর্জনের আভাস। তার অভিযোগ, পাকিস্তান সেনারা আমেরিকানদের যোগসাজশে গত ১৮ বছরে ১৮ লাখ আফগান হত্যা করেছে। আমেরিকানদের সেই পুরনো কৌশল। প্রথমে ইসলামের দোহাই দিয়ে আফগানদের রাশিয়ার বিরুদ্ধে লেলিয়ে দেয়। রাশিয়া বিদায় নিলে ইসলাম রক্ষার দায়িত্ব শিকেয় তুলে গোত্রে গোত্রে লড়াই বাঁধিয়ে শান্ত দেশটিকে মৃত্যুপুরী বানিয়ে ফেলেছে।
তার মতবাদে সায় দেওয়া অথবা দ্বিমত পোষণ করার মধ্যে কোনটি কম ঝুঁকিপূর্ণ, সে সম্পর্কে নিশ্চিত না হতে পেরে মাঝামাঝি অবস্থান নিলাম, “তুমি কি বলতে চাও দুই পরাশক্তির বিদায় নেওয়ার ফলে আফগানিস্তান এখন সুখ শান্তির পথে এগোতে পারে?”
পাঠান দৈত্যের স্বরে এবার কিছুটা ধমকের আভাস, “তোমরা আফগানিস্তান সম্পর্কে খোঁজখবর একটু কমই রাখো। আফগানদের কেউ কি কখনো শান্তিতে থাকতে দিয়েছে? “বুঝলাম আলতাফের বুকে সঞ্চিত অনেক বেদনার কিছুটা হলেও হালকা করতে মনের আগল খুলে দিতে চায়। সদ্য পরিচিত ভিনদেশীর বেদনা উপশমের রীতি আমার জানা ছিল না, কিন্তু তার কাহিনী শুনে যেতে লাগলাম।
আলতাফ বলল, ‘বহু শতাব্দী যুদ্ধবিগ্রহের পর আফগান সবে কয়েক যুগ শান্তির মুখ দেখতে শুরু করেছিল, কিন্তু সে সুখ সইল না। উত্তর দিক থেকে রাশিয়া পূর্ব দিক থেকে আমেরিকা কামান বন্দুক নিয়ে হাজির। পাকিস্তানও সে যুদ্ধে যোগ দিলো আমেরিকার প্রক্সি হিসেবে।
বাঘে মোষে লড়াইয়ে উলুখড়ের মতো জান-মাল হাত-পা হারিয়েছে অগণিত আফগান, উজাড় হয়েছে সবুজ শ্যামল শস্যখেত, বাচ্চারা বইপত্র শিকেয় তুলে হাতে নিয়েছে বন্দুক কামান। যুদ্ধের ডামাডোলে লক্ষ লক্ষ আফগান বর্ডার পার হয়ে পাকিস্তান ও ইরানের রিফুজি ক্যাম্পগুলোতে ধুঁকে ধুঁকে মরছে।
বিশ্ব ইতিহাসের অনেক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার সাক্ষী আফগানিস্তান প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর। একটা আধুনিক পিচঢালা রাজপথ দক্ষিণে কান্দাহার থেকে হিন্দুকুশ পর্বতমালা বরাবর উত্তরে ৫০০ কিলোমিটার দূরে কাবুল পর্যন্ত পৌঁছেছে। ১৯৭২ সালে পাকিস্তান থেকে পালিয়ে সে রাজপথ বেয়ে কান্দাহার থেকে রাজধানী কাবুল যেতে আফগানিস্তানের সুন্দর চিত্র আমাদের মনে আঁকা ছিল। ১৯৭৮ সাল থেকে দুই পরাশক্তি এবং আমেরিকার ফেউ পাকিস্তানের দাপাদাপিতে পুরো দেশটাই ভার্চুয়াল যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত হয়।
একাদিক্রমে বহু বছর যুদ্ধবিগ্রহের কারণে পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের মধ্যে ডুরান্ড লাইন বলে পরিচিত সীমান্ত রেখার দুপাশে পাঠানদের রাজনৈতিক ও সামাজিক অঙ্গনে এসেছে আমূল পরিবর্তন। আইন-শৃঙ্খলা আয়ত্তের বাইরে। খোদ পেশোয়ার শহরে ট্রাফিক সার্জেন্টের সামনেই গাড়ি হাইজ্যাক নিত্যদিনের ঘটনা, প্রতি রাত্রে বাড়িতে হানা দেয় দস্যু-ডাকাত দল।
প্রক্সি ওয়ার পরিচালনার জন্য আমেরিকা কাড়ি কাড়ি ডলার পাকিস্তানে পাঠিয়ে যুগ যুগ ধরে লালিত পাঠানদের মূল্যবোধকে কলুষিত করেছে। উসকে দিয়েছে পার্থিব লোভ লালসা। আতিথিয়তা জায়গায় স্থান করে নিয়েছে বৈরিতা, সরলতার জায়গায় সঠতা এবং লজ্জাহীন উৎকোচ সমাজে ছড়াচ্ছে বিষবাষ্প। সাত সমুদ্রের ওপার থেকে বয়ে আনা অপসংস্কৃতির চাপে পাঠান সংস্কৃতিতে ধরেছে ঘুন। আলতাফ জানের ছোটখাটো বক্তৃতায় ফুটে উঠল পাঞ্জাবীদের প্রতি তার অপরিসীম ঘৃণার বহিঃপ্রকাশ।
আলতাফ জানের আফসোস, পাকিস্তান এখন মিথ্যাচারের উপর ভাসছে। এক কুইন্টাল গমের দাম আড়াই হাজার টাকা। অন্যদিকে, তারা আফগানিস্তান ও কিরগিজস্তানে আধিপত্য বিস্তারের স্বপ্ন দেখছে।
পাকিস্তানে বসে সেদেশেরই বিরুদ্ধে আফগান তনয়ের বিষোদগারে আমি একেবারে অবাক। বুঝা গেল, আফগান তনয়ের বিশাল বপুর মাঝে মাল আছে। আমার মনে যে প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছিল তা বুঝে আরেকপ্রস্থ জ্ঞান দান করল, “পাঞ্জাবীদের কাশ্মিরের প্রতি মহব্বত আছে বলে তোমরা মনে করো বুঝি? কিন্তু ভুল, তারা অভ্যান্তরীণ সমস্যা একটু জটিল হয়ে উঠলে, “কাশ্মীর গেল, কাশ্মীর গেল” বলে রব তোলে। কুল্লে পাকিস্তানিরা অভ্যন্তরীণ সমস্যা ভুলে চির দুশমন ভারতের বিরুদ্ধে জিগির তুলতে লাগে, রেডিও-টেলিভিশনে চলতে থাকে কওমি তারানা। অভ্যন্তরীণ সমস্যা উর্দু ভাষায় বলে ‘আন্দ্রুনি মামলাত’ বিলকুল সাফ।
আমি পাঞ্জাবীদের পক্ষে কিছুটা ওকালতি করার চেষ্টা করলাম। “তাই বলে তুমি সব পাঞ্জাবীদের দোষ দিতে পারো না। তাদের মধ্যেও অনেক ভাল লোক আছে।”
কিন্তু আফগানিস্তানের পাঠান আমার কথায় কান দিল না। আবার সেই কাশ্মীর থিওরি টেনে আনলো। এবার তার আক্রোশ ভারতের প্রতি। “কাশ্মীর নিয়ে হিন্দুস্থান ও কম খেল দেখাচ্ছে না। তাদের ‘আন্দ্রুনি অভ্যন্তরীণ সমস্যা আরো জটিল। ক্ষুধা-দারিদ্র ছাড়াও রয়েছে ভাষাগত জাতিগত সমস্যা। এসব সমস্যার সমাধান করতে ‘কাশ্মীর খতরে মে হায়’ জিগির তুলে দুই দলের মধ্যে বেজে ওঠে রণ দামামা।”
মনে মনে ভাবলাম, কাবুলি বাচ্চার মাথায় রাজনৈতিক ঘোরপ্যাঁচ কি করে ঢুকলো? আন্দাজ করলাম যুদ্ধের ডামাডোলে আফগান বাচ্চারা স্কুল ছেড়েছে দেড় যুগ আগে। নবজাতকের জন্মই হয় গোলাগুলির আওয়াজের মধ্যে। একটুখানি বয়স হলে হাতে তুলে নেয় কালাশনিকভ, স্টেনগান, থ্রি নট থ্রি। লেখাপড়া নাই বা শিখলো তাই বলে বুদ্ধি কম থাকতে হবে এমন কোন কথা কিতাবে লেখা নাই।
আমার চোখে প্রশ্নের আভাস দেখতে পেয়ে আলতাফ জান নিজেই সন্দেহ নিরসন করল, “আমি পেশোয়ার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে এমএ পাস করেছি।”
১৯৭৮ সালে রাশিয়া আফগানিস্থানে প্রবেশ করার পর যে লড়াই শুরু হয় তার উত্তাপ থেকে বাঁচতে পয়সাওয়ালা আফগানরা পাকিস্তানে চলে আসে। পাকিস্তানে বাড়িঘর বানিয়ে স্থায়ী হয়ে বসেছে। ছেলে মেয়েদের স্কুল কলেজের পড়াচ্ছে। পেশোয়ার শহরের অর্ধেক জনসংখ্যা আফগান রিফিউজি। যুদ্ধ থেমে গেলে যে তারা দেশে ফিরে যাবে এমন কোনো লক্ষণ নেই।
চিন্তায় ছেদ পড়ল। আলতাফ পাঞ্জাবিদের বিরুদ্ধে আর এক প্রস্থ বিষোদগার উদগীরণ করল। “ডু ইউ নো মিস্টার আলী, পাঞ্জাবীরা আমাদের উপর প্রতিশোধ নিচ্ছে।”
আমি প্রশ্ন করলাম,”সেকি কথা পাঞ্জাবীরা কিভাবে প্রতিশোধ নিচ্ছে”? আফগান পাঠান একজন বিদেশির কাছে তার মনের আগল খুলে একটুখানি হাওয়া হালকা হওয়ার চেষ্টা করছে। তাকে থামায় কে?
ইউ নো মিস্টার আলী, পাঞ্জাবীরা সেদিনও ছিল বিধর্মী। গজনীর সুলতান মাহমুদএবং মোহাম্মদ ঘোরির ভারত অভিযানের পর পাঠানদের ইসলাম ধর্ম কবুল করায়।
গজনীর সুলতান এবং মোহাম্মদ ঘোরির ইতিহাস আমার জানা ছিল, কিন্তু ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করার জন্য পাঞ্জাবিরা তাদের উপর চটবে কেন? এ কি অদ্ভুত যুক্তি। পাঠান তনয়ের মতিভ্রম হয়নি তো?
আলতাফ নড়েচড়ে বসলো। নতুন করে তার ভার এডজাস্ট করার কারণে চেয়ার দুটো মড় মড় করে করুণ আর্তি জানালো। এবার তার কথা শুনে আরেক প্রস্থ অবাক হলাম। তার বক্তব্য খোলাসা করার জন্য বলল “তোমরা হয়তো বিশ্বাস করবে না কিন্তু পাঞ্জাবীদের আদৌ ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করার ইচ্ছা ছিল না।”
আমার কৌতুহল হল, আফগানিস্তানের পাঠানের বুকে জমাট বাধা আক্রোশের আরো একটা খোঁচা দিয়ে বের করে আনলে কেমন হয়? বললাম, “তুমি পাঠান হলেও বিদেশি আফগান পাঠান।পাকিস্তানে বসে সেদেশের বিরুদ্ধে এতটা নির্ভয়ে কি করে মনের ঝাল ঝাড়ছো?”
আলতাফ জান ইতিহাসের একটি পুরনো অধ্যায়ে নতুন করে খুলে বসলো,”পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের মধ্যে ডুরান্ড লাইনের দুপাশের পশতুনরা ভাই ভাই। পাঞ্জাবির সংখ্যায় বেশি হলেও পাঠানোর সাথে টক্কর লাগাতে সাহস পাবে কোথায়? পুরো হিন্দুস্থান যখন ব্রিটিশের পদানত তখনো পাঠান সম্প্রদায় পাহাড় পর্বত উপত্যকায় ইংরেজ বাহাদুরকে গেরিলা যুদ্ধ কাকে বলে সে সম্পর্কে ভালো শিক্ষা দিয়েছে। ধূর্ত ইংরেজ মনের দুঃখের ডুরান্ড লাইন একে পাঠানদের বিভক্ত করতে চেয়েছিল, কিন্তু পারলো কই। পাঠান ডুরান্ডলাইন মানে না, যখন ইচ্ছা তখন ডুরান্ড লাইন পার হয়।
আমার সন্দেহ হলো পাঠানদের অহংকারের দিন বোধহয় শেষ হয়ে এসেছে। তাদের রক্তে ডলারের নেশা ঢুকেছে। কে জানে কতদিন তারা ধরে রাখতে পারবে তাদের গৌরবময় বীরত্বগাথা?
ইতোমধ্যে, ক্রিকেট ধারা বিবরণ পুনরায় শুরু হয়েছে। কয়েক ওভার যেতেই ইঞ্জামাম আউট, শহীদ আফ্রীদিও প্যাভিলিয়নের দিকে রওনা হয়েছে। দর্শকদের হই হুল্লোড় থেমে গেছে, একে একে কেটে পড়া শুরু হয়েছে।
তালেবানরা তখন সবেমাত্র ক্ষমতা দখল করেছে। পাকিস্তান তাদের সর্বতোভাবে মদদ যোগাচ্ছে। তালেবানদের সম্পর্কে আলতাফের বক্তব্য জানতে কৌতুহল হল। জিজ্ঞেস করলাম, পাকিস্তান তো তালেবানদের মদদ যুগিয়ে ইসলাম ও আফগানিস্তানের মঙ্গলই করছে। তবুও পাকিস্তানের প্রতি তোমার এত আক্রোশ কেন?
আলতাফ জান আবারও উত্তেজিত হয়ে উঠলো,”তুমি স্বার্থন্বেষী মহলের কারসাজির ধরণ কিছুই জানো না। অসৎ মতলব হাসিল করতে এদের ধর্মের দোহাই পাড়তে জুড়ি নেই।”
আমি বললাম, জানি না তা নয়, আমাদের সোনার বাংলায়ও মতলববাজ পলিটিশিয়ানরা ধর্মের দোহাই পেড়ে মসনদে বসার টিকেট যোগাড় করে। আলতাফ সে সাথে একটু জুড়ে দিলো, এটা ম্যাকিয়াভেলি অনেক আগেই বলে গেছে। বুঝলাম রাষ্ট্রবিজ্ঞান সে ভাল করেই পড়েছে।
আফগান পাঠান আবারো মুখ খুলল, তালেবানদের প্রতি পাকিস্তানের কোন দরদ নেই। তাদের নজর আমেরিকার ডলারের দিকে। তাই, আমেরিকানদের খুশি করতে তালেবানদের সুরে তাল মেলানো ছাড়া তাদের কোনো গতি নেই। তবে বাঙালি ভাই, তুমি জেনে রেখো সেদিন বেশি দূরে নয়, আফগানরা তাদের দেশ ধ্বংস ও ভাই ব্রাদাককে হত্যা করার জন্য পাকিস্তানের দিকেই বন্দুকের নল তাক করবে।
উপসংহার
আলতাফের সাথে মতবিনিময়ের পর অনেকগুলো বছর কেটে গেছে। তার ভবিষ্যৎবাণী ভুল হয় নাই। পাঁচ বছর যেতে না যেতেই তালেবানদের সাথে আমেরিকান ও পাকিস্তানের রোমান্স খতম হয়। তালেবানরা ক্ষমতা দখল করে। ক্রমশ পাকিস্তান ও আমেরিকানদের সাথে দূরত্ব বাড়তে থাকে।
২০০১ সালে টুইন টাওয়ার ধ্বংসের পর ওসামা বিন লাদেনের খোঁজে ও তালেবানদের শায়েস্তা করতে জর্জ ডব্লিউ বুশের নেতৃত্বে আমেরিকানরা নতুন করে আক্রমণ সাজায়। অভিযানের নাম দেওয়া হয় Operation Enduring Freedom।
আমেরিকার জানমালের বহু ক্ষয়ক্ষতির পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৪ সাবের ২৮শে ডিসেম্বর প্রেসিদেন্ট ওবামা অফিশিয়ালি যুদ্ধ সমাপ্তি ঘোষণা করেন। তবে, কয়েক হাজার ন্যাটো সামরিক বাহিনী আফগানিস্থানে রয়ে যায়। নিরাপত্তার দায়িত্ব আফগান সরকারের উপর ন্যস্ত করে তারা তাদের ট্রেনিং ও সহযোগিতা করতে।
২০২১ সালে চূড়ান্তভাবে আমেরিকা সেনা প্রত্যাহারের মাধ্যমে যুদ্ধের সমাপ্তি হয়। যুদ্ধে আমেরিকার ব্যয় হয় ২ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার। টাকার হিসাবে ১৭,০০,০০০০ কোটি টাকা, বাংলাদেশের জিডিপির ৭ গুণ।
যুদ্ধের বিভিন্ন সময়ে ৫১টি দেশের প্রায় ৮,০০,০০০ জন সেনাসদস্য আফগানিস্থানে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে।
আমেরিকার প্রতিরক্ষা ডিপার্টমেন্টের হিসাব অনুযায়ী ২,৩৫২ জন সেনা নিহত হয়। অন্য একটা সূত্র মতে এ সংখ্যা ২,৪৪৩। আহত হয় প্রায় ২০,০০০ আমেরিকান সেনা। প্রায় ৬৬,০০০ আফগান সরকারের সেনা এবং পুলিশ যুদ্ধে নিহত হয়েছে।
আফগান বেসামরিক নাগরিক নিহত হয়েছে ৪৭,২৪৫ জন। শুধুমাত্র ২০২১ সালে প্রথম ছয় মাসে ১৬৫৯ আফগান নাগরিক নিহত এবং ৩,৫৩৪ জন আহত হয়েছে। মানবিক সাহায্য সংস্থা লোকজন নিহত হয়েছে ১,৪৪৪ জন। সাংবাদিক নিহত হয়েছে ৭৫ জন। তালেবান ও তালেবান সমর্থিত সরকারবিরোধী যোদ্ধা আফগান যুদ্ধে নিহত হয়েছে ৫১,১৫১ জন।
সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয়, প্রায় ৩ লক্ষ আফগান সেনাকে আমেরিকা প্রশিক্ষণ দিয়ে তাদের উপর প্রতিরক্ষার দায়িত্ব ছেড়ে দিয়ে বিদায় নিলে মাত্র ১০ দিনে তারা তালেবান যোদ্ধাদের কাছে হার মানে।
