October 29, 2025

কাবা শরীফ চুম্বকের মত ইসলাম ধর্মের অনুসারীদের কাছে টেনে নিতে চায়। কিন্তু অনেকেরই সে আহ্বানে সাড়া দেওয়া সম্ভব হয় না। অর্থবিত্ত না থাকলে কাবা শরীফ দর্শনের স্বপ্ন শুধু স্বপ্নই থেকে যায়। আমি যখন কাবা শরীফ দর্শনের সুযোগ পাই, তখন সম্বল ছিল শুধু স্বপ্ন, অভাব ছিলো রাহা খরচের। 

সময় ১৯৭০ সাল। স্টেট ব্যাংকে চাকরির সুবাদে করাচিতে বসবাস। তখন সরকারি-বেসরকারি কর্মকর্তাদের বেতন-ভাতা ছিল অপ্রতুল। কিন্তু কি ছিল বিধাতার মনে, অধমকে ডেকে পাঠালেন কাবা দর্শনে। উপলক্ষ অফিশিয়াল মিশনে তুরস্ক ভ্রমণ।  

সহকর্মীদের কারো কারো চোখে দেখতে পেলাম ঈর্ষা; সিনিয়রদের ডিঙিয়ে বাঙালি বাবুর সৌভাগ্যে ঈর্ষা  হওয়ারই কথা। তখনকার দিনে বিদেশে যাওয়ার সুযোগ ছিল নেহায়েত কম। শুভানুধ্যায়ী কয়েকজন পরামর্শ দিল, ফিরতি পথে কাবা শরীফ দর্শন করে আসো না কেন? নিখরচায় পাপের বোঝা হালকা করার এইতো সুবর্ণ সুযোগ।

প্রথম বিদেশ ভ্রমণ। পদে পদে হোঁচট খাওয়ার পালা। পরিশেষে, খোদা পথের সব কন্টক দূর করে পরম আদরে পৌঁছে দেন কাবার চত্বরে।

আমাদের মনে কাবা শরীফ সম্পর্কে কৌতুহল জন্মাতে শুরু করে ছোট বয়স থেকে। মা-বাবা, পাড়ার মাওলানা, স্কুলে উর্দু টিচার নানা বর্ণের চিত্রিত করেন কাবা শরীফের মহিমা।    

কাবা শরীফকে ঘিরে যত কাহিনী রচিত হয়েছে তা নতুন মহিমা নিয়ে উদ্ভাসিত হয় ৫৭০ খ্রিস্টাব্দে মহানবী হযরত মুহম্মদ (দ:)এর আবির্ভাবের মাধ্যমে। আল্লাহর বাণী প্রচারের জন্য হযরত মুহম্মদ (দ:)যে অবর্ণনীয় নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন সে কাহিনী সে বয়সেই  আমাদের প্রতিনিয়ত বেদনায় সিক্ত করত। 

তুরস্ক থেকে ফেরার পথে মক্কা হয়ে আসতে বাড়তি খরচ পাতির ব্যাপারটা নিয়ে সংশয় ছিল। সহকর্মীরা আশ্বাস দিলেন, জেদ্দা হয়ে আসতে রুট সামান্য হেরফের করতে হবে। বিমান ভাড়া বাবদ বাড়তি টাকা গুনতে হবে না।

তুরস্কে মিশন সম্পন্ন করে জেদ্দায়  বিমান বন্দরে নেমেই নিদারুণ তপ্ত অভিনন্দন জানালো মরুভূমি থেকে উড়ে আসা এলোমেলো হাওয়া; দুই গন্ডে ধেয়ে আসা অগ্নিকুন্ডের অকরুণ চপেটাঘাত। আল্লাহর পথ থেকে বিচ্যুত হলে পরকালে অগ্নি দহনে কি শাস্তি অপেক্ষা করছে হয়তো তারই ড্রেস রিহার্সেল। 

রবি ঠাকুর কেন যে লিখেছিলেন, ‘ইহার চেয়ে হতেম যদি আরব বেদুইন! চরন তলে বিশাল মরু দিগন্তে বিলীন।’ তিনি আরব মুলুকে এসেছিলেন কিনা জানিনা। আসলেও সম্ভবত শীতকালে। তা না হলে জোড়াসাঁকোর রাজপ্রাসাদের আরাম-আয়েশ ছেড়ে বেদুইন হওয়ার দুরাশা পোষণ করতেন না। 

বছরের এ সময়টা জেদ্দা জ্বলন্ত অগ্নিকুন্ডের রূপ ধারণ করে। মরুভূমির তপ্ত হাওয়ার ঝাপটা ও অন্য দু-একটা পরীক্ষার মাধ্যমে তার পবিত্র গৃহে মেহমান হওয়ার যোগ্য কিনা আল্লাহতালা হয়তো তা যাচাই করে দেখতে চেয়ে ছিলেন।  

করাচি থেকে রওনা হওয়ার আগে জেদ্দায়  কম দামি একটা হোটেলের‌ নাম ডায়েরিতে লিখে নিয়ে এসেছিলাম— হোটেল হারামিন। আশ্চর্য হয়ে ভাবলাম এটা কি নাম না গালি? আসলে, নামটা শুনতে গালিই মনে হয়, কিন্তু, নামে কিবা আসে যায়? আমার পকেটে রেস্ত কম। হোটেলের মান কিংবা নাম নিয়ে ভাবার সময় কোথায়?

তখন সরকারি ভ্রমণের জন্য দৈনিক ভাতার পরিমাণ ছিল নগন্য অংকের। দামি হোটেলে উঠার ইচ্ছা থাকলেও সামর্থ্য ছিল না। তা’ ছাড়া আসার সময় বছর চারেক আগে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধা বিবি সাহেবা মোটামুটি একটা লম্বা শপিং লিস্ট ধরিয়ে দিয়েছিলেন। তখন বিদেশ ভ্রমণের সময় নানাজনের ফাইফরমাশ লিখে নিয়ে যাওয়া ছিল অলিখিত নিয়ম।

যখনকার কথা বলছি তখন জেদ্দা ছিল ছোটখাটো ঘুমন্ত শহর; গা ঝাড়া দিয়ে উঠতো  শুধু হজ মৌসুমে। তখনও পেট্রো-ডলারের অঢেল সাপ্লাই শুরু হয়নি,এখনকার  মত আরবরা দুর্বিনীত হয়ে উঠেনি। ইমিগ্রেশন ও কাস্টমের লোকজনের ব্যবহার ছিল ভদ্রজনোচিত।

তবে, পথে-ঘাটে চলা ফেরার সময় ভাষা নিয়ে মুশকিলে পড়তে হয়। আমি আরবি জানি না, ট্যাক্সি ড্রাইভার জানে না ইংরেজি। আমার কথা সে বোঝেনা, তার কথা আমি। আমি তাকে বললাম, ‘হারামিন হোটেল নিয়ে চলো’। সে আমাকে নিয়ে উঠালো ‘আল হারামিন’ হোটেলে। আমার কাঙ্খিত হোটেলের নামের সাথে সামান্য হেরফের কিন্তু ভাড়ার হেরফের অনেক বেশি—প্রায় চার গুণ। 

কি আর করা? উঠে যখন পড়েছি তখন নতুন করে আমার কাঙ্খিত হোটেল খোঁজার ইচ্ছা হলো না। কে জানে, ট্যাক্সিওয়ালা হয় তো এবার পাঁচ তাঁরা হোটেলে নিয়ে উঠাবে। ভাষা না জেনে কতক্ষণ আর হাত-পা নেড়ে আমার অভিপ্রায় তাকে কি করে জানাবো?

আল্লাহ্ এ-সব ছোট-বড় বিপদ-আপদ থেকে সব সময় আমার মুসকিল আসান করেন। এবার তিনি যাকে আমার সাহায্য পাঠালেন তার নাম শামসুল আবেদিন। হোটেলে ওঠার পর দিন তার সাথে মোলাকাত হয় ন্যাশনাল ব্যাঙ্ক অব পাকিস্তানের জেদ্দা ব্রাঞ্চে।

করাচি থেকে আসার আগে ন্যাশনাল ব্যাংক হেড অফিসে আমার ঘনিষ্ঠ এক অবাঙালি কর্মকর্তা পরামর্শ দিয়েছিলেন, প্রয়োজন হলে আমি যেন তাঁদের জেদ্দা শাখার ম্যানেজার হামিদ আলীর সাথে দেখা করি। 

পর দিন সকালে ট্রাভেলার্স চেক ভাঙ্গাতে ব্যাংকে হাজির হলাম। ম্যানেজার হামিদ আলী ভদ্র মানুষ। চা-নাস্তা সহকারে আপ্যায়নের পর জানালেন, একজন বাঙালি কর্মকর্তা সে ব্রাঞ্চে কাজ করেন। তিনি তাকে ডেকে আনলেন। নাম আগেই বলেছি, শামসুল আবেদিন।

শামসুল আবেদিন বেশি কথা না বাড়িয়ে প্রস্তাব দিলেন, এত দামি হোটেলে থাকবেন কেন? আমার বাসায় থাকবেন। দেশ থেকে সরকারি সফরে আসা কর্মকর্তাদের সামর্থ্যের মুরোদ তার অজানা ছিল না।

তার চোখে-মুখে দেখতে পেলাম আন্তরিকতার ছাপ। আমার আপত্তি ধোপে টিকল না। আমার সাথে হোটেলে যেয়ে বাক্স-পত্র গুছিয়ে তার বাসায় নিয়ে উঠালেন। তাঁর স্ত্রীও আমাকে তাদের বহুদিন পর ফিরে-আসা হারানো আত্মীয়ের মত পরিবারের একজন সদস্য হিসাবে বরণ করে নিলেন। তাঁদের ছোট্ট মেয়ে সেতু অচিরেই আমার ন্যাওটা বনে গেল। দীর্ঘ পথ ভ্রমণের ক্লান্তি দূর হয়ে আন্তরিক পরিবেশে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলার সুযোগ হলো। খোদার অসীম কৃপা।

অর্ধ শতাব্দী আগে সে সরলতার যুগে দেশে-বিদেশে অল্প  অপরিচিতকেও আপন করে নিতে দেরি লাগত না। এখন মানুষ কেন যেন বৈষয়িক চিন্তা ভাবনার প্রভাবে আত্মকেন্দ্রিক হয়ে গেছে। নিজ আত্মীয়ও দু’ দিনের জন্য বেড়াতে এলে বিরক্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

শামছুল আবেদিন এর গ্রামার সময় ভালোই কাটছিল, কিন্তু আমার মন ছুটে যেতে চাচ্ছে মক্কায়। এদিকে আবেদিনদের হৃদয়ের উষ্ণতার সাথে তাল মিলিয়ে বাতাসের উষ্ণতা ব্যারোমিটারের শেষ কাটা স্পর্শ করতে উদ্যত। তাঁরা পরামর্শ দিলেন, সন্ধ্যা নাগাদ ধরণী ঠাণ্ডা না হওয়া পর্যন্ত আকাঙ্ক্ষিত কাবা শরীফের দর্শন স্থগিত রাখতে হবে। 

এত কাছে, কিন্তু কত দূরে!

বলা হয়, বিদেশে বাঙালি মাত্রই সজ্জন। তখন জেদ্দায় হাতে গোনা কয়েক জন বাঙালি চাকরি-বাকরি করতেন। বেশির ভাগ ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার। আরব মুল্লুকে বিদেশ থেকে তখনও শ্রমিক রপ্তানি তেমন‌ শুরু হয়নি।

বিদেশি শ্রমিকের ঢল নামে ১৯৭৩ সালে আরব-ইসরাইল যুদ্ধের পর। জ্বালানি তেলের মূল্য কয়েক গুণ বাড়িয়ে আরবের তেলসমৃদ্ধ দেশগুলির পেট্রো ডলারের ভান্ডার ফুলে-ফেঁপে ওঠে। 

আবেদিন বিকালে জেদ্দায় তার পরিচিত ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ারদের ডেকে নিয়ে এলো। দেশ থেকে নতুন কেউ এলে তার সাথে সময় কাটানো, গল্প গুজব করা ছিল তাদের অলিখিত নিয়ম। তাদের সঙ্গে দেশের গল্প গুজব ও পাকিস্তানের সাথে আগামী দিনের বাংলাদেশের শেষ দিনগুলোর রাজনৈতিক যে টানাপোড়েন চলছিল তা নিয়ে আলোচনা হল। তখনো ইন্টারনেট যুগ শুরু হতে অনেক দেরি।‌ সংবাদ আদান-প্রদান হতো ধীর গতিতে। দেশের কাগজ সৌদি আরবে পৌছাতো তিন চার দিন পর।

তাদের আন্তরিকতাপূর্ণ আতিথিয়েতায় আমি মুগ্ধ। এক জন প্রস্তাব দিলেন, আমার বাসায় আপনাকে ডিনারে নিয়ে যেতে পারলে খুবই খুশি হতাম।

ব্যস, প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে গেল।

অন্য একজন পাল্টা প্রস্তাব দিলেন, কেনিয়া থেকে আমার কাছে ফ্রেশ আমের একটা চালান এসেছে। 

অন্য একজন বের করলেন তুরুপের তাস, ঐ সব বিদেশি মাল বাতিল করেন। আমার ভাই ঢাকা থেকে ইলিশ মাছ পাঠিয়েছেন।

তাঁদের আতিথিয়তার বহর দেখে মনে হল বৈরী আবহাওয়া এবং হোটেল বিভ্রাটের জন্য আমার যে অল্প বিস্তর আর্থিক লোকসান হয়েছে সে ক্ষতে স্বস্তির পরশ বুলাতে আল্লাহতালা তাদের পাঠিয়েছেন।

এতক্ষণে সূর্য তার দৈনিক পরিক্রমা শেষ করে লোহিত সাগরের জলে মাথা গুঁজতে উদ্যত। ধরণী ক্রমশ ঠান্ডা হয়ে এসেছে; মরুভূমিতে সূর্যোদয়ের সাথে সাথে আবহাওয়া যেমন দ্রুত উত্তপ্ত হয়, তেমনি সূর্যাস্তের পর দ্রুত ঠাণ্ডা হতে থাকে। 

এবার যে উদ্দেশ্যে আরব মুলুকে এসেছিলাম তার জন্য প্রস্তুতি শুরু করলাম। গৃহকর্ত্রী আলমারি থেকে এহরামের কাপড় বের করে তা কিভাবে পরতে হয় তা একান্ত আপন জনের মত তালিম দিলেন। অথচ পরিচয় মাত্র কয়েক ঘণ্টার।

সূর্যাস্তের পর ট্যাক্সি স্ট্যান্ড থেকে অন্য তিন জন কাবা দর্শনার্থীদের সাথে ট্যাক্সি ভাড়া ভাগাভাগি করে মক্কার উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। জন প্রতি ভাড়া দশ রিয়াল। 

সহযাত্রী তিন জন তিন দেশের মানুষ–সুদান নাইজেরিয়া ও ইয়েমেন থেকে এসেছে। তারাও প্রথম বারের মতো কাবা দর্শনে চলেছেন। 

অভিযাত্রী চার জনের চেহারা, পোশাক-আশাক, ভাষা ভিন্ন। আফ্রিকার দুজনের গায়ের রং মিশকালো, ইয়েমেনির ঝলসানো রুটির মত আমার বাদামি।  তবে, জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবার চিন্তা ভাবনা একই সূত্রে গাঁথা।‌ আকার-ইঙ্গিতে কিছু সৌজন্য বিনিময় হলো।

 বাক্যালাপ না হলেও সবাই একই পথের পথিক, যেন অনেক দিনের চেনা একান্ত আপন জন। মহানবী মানুষ মানুষে ভেদাভেদ বিলোপ করে সবার মাঝে যে সাম্যের সেতু বন্ধন রচনা করে গিয়েছিলেন তারই একটা ক্ষুদ্র সংস্করণ।

জেদ্দা শহর ছেড়ে ট্যাক্সি বিস্তীর্ণ মরু প্রান্তর, মাঝে মাঝে ছোটখাটো পাহাড়ের পাশ দিয়ে উল্কা বেগে ছুটে চলছিল। কল্পনার নেত্রে জেগে উঠছে চৌদ্দশ বছর আগে প্রিয় নবী হযরত মুহম্মদ (দ:) হয়তো  কাছে দুরের উপত্যকায় তাঁর পবিত্র কদম মোবারকের ছাপ রেখে গেছেন। 

দূরে যে পাহাড়গুলো দেখা যাচ্ছে হয়তো তার কোনো একটার নাম হেরা। সে পাহাড়ের গুহায় তিনি বছরের পর বছর ধ্যান করে চলেছেন। পরিশেষে, এক দিন  হযরত জিবরাঈল (আ) আল্লাহর বাণী নিয়ে হাজির হয়ে তাঁকে বললেন, ইকরা বিসমি রাব্বিকাল্লাযি খালাক–”পড় তোমার প্রভুর নামে যিনি তোমাকে সৃষ্টি করেছেন”।  

বাল্যকাল থেকে যে সব পবিত্র স্থানের নাম শুনে এসেছি—কাবা শরীফ, মক্কা নগরী, মিনা, আরাফাত ময়দানের  কাছ দিয়ে ছুটে চলতে চলতে ইসলামের প্রথম যুগের ঘটনাবহুল দৃশ্যগুলো একে একে বায়োস্কোপের পর্দার মতো চোখের পর্দায় ভেসে উঠতে লাগল।

কল্পনায় অনুভব করলাম চৌদ্দশ বছর আগের অনেক নাটকীয় দৃশ্য যখন নবীজি আল্লাহর অসীম করুণার উপর অবিচল আস্থা রেখে জীবন বাজি রেখে খোদার বাণী সবার কাছে পৌঁছে দিচ্ছেন। তাঁর স্বগোত্রীয় কুরাইশদের প্রলোভন, অত্যাচার, অনাচার, যন্ত্রণা কোনটাই তাঁকে সত্যের পথ হতে বিচ্যুত করতে পারেনি।

অনতিদূরে রয়েছে আরাফাত ময়দান। হযরত মুহম্মদ (দ:) চৌদ্দশ বছর আগে বিদায় হজে আরাফাত ময়দানে জলদ গম্ভীর কণ্ঠে পৃথিবীর সকল মানুষকে যে উদাত্ত আহ্বান জানিয়েছিলেন তা মনের পর্দায় প্রতিধ্বনি তুলে চলছিল। 

পৃথিবীতে তাঁর মত পরিশীলিত বাণী কোনদিন আর কারো মুখ থেকে নিসৃত হয়নি। মানুষের মর্যাদা, অধিকার, দায়-দায়িত্ব, নারী পুরুষের সম্পর্ক, দাস দাসীর সাথে একই অন্ন-বস্ত্র ভাগাভাগি করে ব্যবহার সম্পর্কে তিনি যে ঘোষণা দিয়েছিলেন দুনিয়ার অন্য কোন ম্যাগনাকার্টার সাথে তার তুলনা হয় না। 

তিনি দীপ্ত কন্ঠে ঘোষণা দেন, কোন মানুষ অন্য জনের তুলনায় উত্তম নয়, অধমও নয়। সব মানুষ সমান মর্যাদার অধিকারী। “তোমার বংশ মর্যাদা নিয়ে গর্ব করবে না।“

কাবা শরীফে সারা দুনিয়া থেকে লক্ষ লক্ষ মানুষ কয়েক খণ্ড সাধারণ কাপড় পরে হজ ও ওমরা পালন করতে আসেন। মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের প্রতি কৃতজ্ঞতা নিবেদনের ভাষা খুঁজে পাচ্ছিলাম না যে এ বিশাল মঞ্চে তার প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে আমাকে ডেকে এনেছেন পরম আদরে।

মক্কা শহরের উপকণ্ঠে পৌঁছে মনের গভীরে শিহরন বয়ে গেল। তবে, শহরে ঢুকে কিছুটা হতাশ হতে হলো। অতীতের যে-সব মাইলেস্টোন মনের কোণে পুষে রেখেছিলাম তার চিহ্ন খুঁজে পেলাম না। আর দশটা শহরের ম্যাচ বাক্সের মতো দালান কোটার সমারোহ। চারিদিকে দোকানপাট বাণিজ্যিক কার্যক্রমের মহাযজ্ঞ। ওহাবী মতবাদের অনুসারী আরবের নতুন সৌদি শাসকবৃন্দ যত দূর সম্ভব অতীতের স্মৃতি বিজড়িত ঐতিহ্যবাহী চিহ্নগুলি সযত্নে মুছে ফেলেছেন।

তবে, সব কিছু ছাড়িয়ে আমার চিন্তা চেতনায় জুড়ে ছিল পবিত্র কাবা শরীফ। যে কাবার কথা সারাজীবন শুনেছি সে পবিত্র মসজিদের সাথে  সাক্ষাতের মাহেন্দ্রক্ষণ উপস্থিত প্রায়। সহযাত্রীদের মধ্যেও চাপা উত্তেজনা। 

কাবার চত্বরে পৌঁছেও আমাদের আরো দু’টো ধাপ অতিক্রম করতে হল। প্রথমটা চারিদিকে বেষ্টনী দিয়ে তখন নির্মাণের প্রায় শেষ পর্যায়ে সৌদিদের  গড়া নতুন মসজিদ। দ্বিতীয়টা কাবার চারপাশে ঘিরে অটোমান সম্রাটদের তৈরি করা পুরনো মসজিদ।

অবশেষে দৃষ্টির সামনে দাঁড়িয়ে বহু আকাঙ্ক্ষিত কাবা শরীফ স্বর্গীয় আভা ছড়িয়ে প্রাণের মাঝে স্পন্দন জাগিয়ে তুলল। লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক।

কাবা শরীফের সম্মোহনী আকর্ষণ থেকে সম্বিত ফিরে পেয়ে স্মরণে এল হযরত আদম (আ:) এর কথা। স্মৃতির আয়নায় দেখতে পেলাম নিষিদ্ধ ফল ভক্ষণ করার কারণে তাঁকে ও বিবি হাওয়াকে স্বর্গ থেকে পৃথিবীতে নির্বাসিত হওয়ার কাহিনী। তাদের দু’জনকে নির্বাসিত করেছিলেন দূর-দূরান্তের আলাদা আলাদা লোকেশনে।

হযরত আদম (দ) দুনিয়াভর তাঁর সঙ্গিনীকে  খুঁজে বেড়াচ্ছেন। অবশেষে তাঁরা মিলিত হন মক্কার অদূরে মিনা প্রান্তরে। আল্লাহর আদেশে তাঁরা নির্মাণ করেন দুনিয়ার প্রথম উপাসনাগার, পবিত্র কাবা শরীফ। 

তারপর কয়েক যুগ কেটে যায়। তাদের বংশধরদের কলকাকলিতে পৃথিবী মুখরিত হয়ে ওঠে। ক্রমে তারা সত্যের পথ থেকে বিচ্যুত হয়ে নানাবিধ অনাচার ও মনগড়া দেবদেবীর পূজা-অর্চনায় মেতে ওঠে। শাস্তি স্বরূপ মহান আল্লাহ পৃথিবীকে এক মহাপ্লাবনে নিমজ্জিত করেন। সে সাথে বিলীন হয় পবিত্র কাবা শরীফ।

পরবর্তীতে আল্লাহ হযরত ইব্রাহিম (আ) কে পূর্বের স্থানেই কাবা শরীফ পুনর্নির্মাণের আদেশ দেন। তিনি মঞ্চ হিসাবে ব্যবহার করে তার ওপর দাঁড়িয়ে নির্মাণ কাজের  সুবিধার জন্য এক খন্ড পাথর পাঠিয়ে দেন। নির্মাণ কাজের অগ্রগতির সাথে তাল মিলিয়ে পাথর খন্ড স্কাফোল্ডিংয়ের মত স্বয়ংক্রিয়ভাবে উপর-নিচ উঠতে থাকে। হযরত ইব্রাহিম (আ:) এর পায়ের ছাপসহ সে পাথরটি কাবা শরীফের পাশে সুরক্ষিত খাঁচায় হেফাজতের সাথে রাখা হয়েছে।

অতীতের থেকে এবার বর্তমানে ফিরে এলাম। একজন লম্বা কুর্তাওয়ালা আরব আমার চিন্তায় ছেদ টেনে দিলেন। পরিচয় দিলেন, তিনি একজন মুয়াল্লিম, ওমরাহ পালনে আমার গাইড হিসেবে সাহায্য করতে ইচ্ছুক; বলা বাহুল্য, কিছু অর্থের বিনিময়ে। তিনি দোয়া পড়তে পড়তে কাবা শরীফ সাত বার প্রদক্ষিণ করলেন। অর্থ না বুঝলেও তা পুনরাবৃত্তি করতে করতে তার পিছনে পিছনে ছুটে চললাম।

কিছু সময়ের বিরতিতে আমরা কাবার এক কোণে রাখা  কালো প্রস্তুর চুম্বন করলাম। কিংবদন্তি রয়েছে, প্রস্তর খন্ডটি হযরত আদম (আ:) স্বর্গ থেকে নিয়ে এসে ছিলেন। প্রস্তরখন্ডটি স্পর্শ করে শিরদাঁড়ায় আবারো এক দফা শিহরণ বয়ে গেল।  কারণ, পাথরটি নবীজির পবিত্র ওষ্ট মোবারক ও হাতের স্পর্শের নিদর্শন যুগ যুগ ধরে বয়ে চলেছে। পাথরটি কেন্দ্র করে  কুরাইশ বংশের দুই বিবদমান গ্রুপের মধ্যে ঝগড়া ফাসাদও তিনি বিচক্ষণতার সাথে মীমাংসা করে দেন।

হযরত ইব্রাহিম, যাকে আল্লাহ বর্তমান ইরাকের উর শহরে পয়গম্বর করে পাঠিয়েছিলেন, তিনি আল্লাহর নির্দেশে বিবি হাজেরা সহ তার প্রিয় পুত্র হযরত ইসমাইল(আ:) কে আরবের মরু প্রান্তরে এখনকার কাবা শরীফের সন্নিকটে নির্বাসন দিয়েছিলেন।

এক ফোঁটা পানির জন্য দুধের শিশু ইসমাইলের কান্না কল্পনায় শুনতে পাচ্ছিলাম। অন্য্য দিকে, পানির সন্ধানে উৎকন্ঠা নিয়ে বিবি হাজেরা সাফা ও মারওয়া দুই পাহাড়ের মাঝে দৌড়াদৌড়ি করছেন। পরিশেষে আল্লাহ সদয় হয়ে হযরত জিবরাঈল (আ:) কে পাঠালে তিনি পায়ের আঘাতে এক প্রস্রবনের সৃষ্টি করেন যা যুগ যুগ ধরে অফুরন্ত পানির উৎস হিসাবে ইসলাম ধর্মের অনুসারীদের কায়িক ও আধ্যাত্মিক প্রশান্তি যুগিয়ে চলেছে।( কোন কোন বর্ণনা মতে জমজম কূপের সৃষ্টি হয় হযরত ইসমাইল (আ) এর পায়ের আঘাতে।)

পানির জন্য বিবি হাজেরার দুই পাহাড়ের মধ্যে দৌড়াদৌড়ির অবর্ণনীয় কষ্টের কথা স্মরণ করে আমরাও তার পুনরাবৃত্তি করলাম। 

তবে, এখন আধুনিক টেকনোলজি ও সৌদিদের অঢেল অর্থের কল্যাণে‌ দুই পাহাড়ের মাঝে পাকা রাস্তা ও আবহাওয়া নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা করা হয়েছে। কাজেই কংকরময় পথ টুকু সাত বার পাড়ি দিতে বিবি হাজেরার যে কষ্ট হয়েছিল তা শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত রাস্তায় পুনরাবৃতি দায়সারা গোছের আনুষ্ঠিকতায় পরিণত হয়েছে। আনুষ্ঠিকতার শেষ পর্যায়ে মোয়াল্লেম সাহেব আমাকে জমজম কূপের পাশে নিয়ে গেলেন। তিনি কুপ থেকে এক বালতি পানি তুলে পুরোটাই আমার মাথায় ঢেলে দিলেন। জমজমের শীতল পানির স্পর্শে মুহূর্তেই মরুভূমির গরমের উষ্ণতা, সে সঙ্গে শারীরিক ক্লান্তি দূরে ঔ হয়ে গেল। পরনে এহরামের কাপড়ও শুকিয়ে যেতে দেরী হলো না।

তখন জমজম কূপ ছিল মসজিদের খুব কাছে। অল্প একটু সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে জমজম পানির প্রকৃত উৎস দেখা যেত। বছর দশেক পরে যখন আবার কাবা শরীফে ওমরা করার সুযোগ হয় তখন  কুপটি দেখতে পেলাম না। তার প্রবেশদ্বার বন্ধ করে পানির ধারা দূরে সরিয়ে যান্ত্রিক উপায়ে পানি উপরে তোলার ব্যবস্থা করা হয়েছে।

আনুষ্ঠানিকতা শেষে মসজিদেই রাত কাটাবার মনস্থ করলাম। কাছে ধরে একটা হোটেলে উঠা যেত, কিন্তু হোটেল খরচ বাঁচানোর বুদ্ধি মাথা চাড়া দিয়ে উঠলো। পরে বুঝলাম, অর্থ সাশ্রয়ের জন্য স্কিমটি আল্লাহর পছন্দ হয়নি।

রাতে কয়েক দফা কাবা প্রদক্ষিণ করে আত্মীয়-স্বজন বন্ধু-বান্ধব যাদের নাম মনে এলো সবার জন্য আল্লাহর আশীর্বাদ কামনা করলাম। 

রাত বাড়ার সাথে সাথে অনিদ্রা ও ক্লান্তি দেহ‌ মন আছন্ন করে ফেলেছিল। ক্লান্তিতে মাঝে মাঝে চোখ বুজে আসছিল। আশ পাশের কয়েক জনকেও দেখলাম ঘুমানোর চেষ্টা করছেন, কিন্তু কর্তব্যরত পুলিশ ব্যাটনের খোঁচা দিয়ে উঠিয়ে দিচ্ছে। কিছু গালাগালিও হয়তো দিচ্ছে। আরবি ভাষা না জানার কারণে তার মর্ম বুঝতে পারলাম না।

আগেই বলেছি, প্রয়োজনের মুহূর্তে সৃষ্টিকর্তা সব সময় আমাকে সাহায্য পাঠান। এবার যাকে পাঠালেন তিনি একজন পুলিশ। আগের ব্যাটনওয়ালা পুলিশের জায়গায় নতুন শিফটে কাজ করতে এসেছেন। তাঁর বুঝতে দেরী হলো না আমি পাকিস্তানের থেকে এসেছি। পুলিশের চোখ বলে কথা!

“আমার নাম আল্লাহদাদ খান”। উর্দুতে পরিচয় দিলেন। শিকড় বেলুচিস্তানে, সৌদি পুলিশের সদস্য। কিছু সৌজন্যে ও খবরা-খবর বিনিময়ের পর বললেন, তুমি চাইলে একটু ঘুমিয়ে নিতে পারো। আমি থাকতে তোমাকে কেউ কিছু বলবে না। তবে, “মালামাল সাবধানে রেখো”। আমি অবাক, আল্লাহর পবিত্র ঘরের চত্বরে মালপত্র সামলে রাখতে হবে? তবে আল্লাহ দাদ খান পুলিশ মানুষ।‌ তিনি ভালো জানেন।

রাত্রের তৃতীয় প্রহরে গভীর রজনীতে চারদিকে পিনপতন নীরবতা নেমে এল। আমার মনে হল ফেরেশতারা সে নিরবতার মাঝে আল্লাহর মহিমা ঘোষণা করে চলেছেন।

একটু পরেই পূর্বাকাশে সূর্যের লালিমা ফুটে উঠল। মসজিদের বাইরে ওযুখানায় অজু করে জামাতের সাথে ফজরের নামাজ আদায় করলাম।

নামাজ শেষে হঠাৎ খেয়াল হলো, হাত ঘড়িটা ওযুখানায় ফেলে এসেছি। সেখানে খোঁজাখুঁজি করেও সন্ধান পাওয়া গেল না। কেউ নিজের মনে করে পকেটে পুরেছে। 

অদূরে ভদ্র চেহারার মার্জিত পোশাকে একজনকে দেখে মনে হল তিনি হয়তো ইংরেজি জানেন। যুবকের নাম কি বলেছিলেন তা মনে নাই, তবে জানলাম তিনি সিরিয়ার লোক। আমার বৃত্তান্ত শুনে তিনি বললেন, চলো আমরা লস্ট এন্ড ফাউন্ড সেন্টারে দেখে আসি সেখানে কেউ জমা দিয়েছে কিনা। সেখান থেকেও হতাশা নিয়ে ফিরতে হলো।

ভাবছেন, সামান্য ঘড়ির জন্য এত উতলার কারন কি? ঘড়ি নয়, বরং পবিত্র কাবা শরীফে তা হারানোই ছিল দুঃখের কারণ। একবার মনে হল খরচ বাচাবার জন্য কাবার মসজিদে রাত কাটানোর স্কিমটি‌ আল্লাহর পছন্দ হয়নি। তাই তিনি  আমাকে শিক্ষা দিতে চেয়েছিলেন। 

আমার নতুন পরিচিত গাইড এবং এখন বন্ধু বেলুচি পুলিশকে বিষয়টা জানালে কাটা ঘায়ে নুনের ছিটা দিলেন, তুমকো পহেলিই বাতলাইয়া থা– “তোমাকে আগেই বলেছিলাম”? তিনিও আমার সাথে সুরতহালে তদন্ত চালালেন। ফলাফল ‌একই।

জেদ্দার উদ্যেশে ফেরার পথে পবিত্র কাবা শরীফ দর্শনের সুযোগ দেওয়ার জন্য পরম করুনাময় আল্লাহতালার প্রতি কৃতজ্ঞতায় মন ভরে গেল। 

জেদ্দা ফিরে গিন্নির শপিং লিস্ট মিলিয়ে কেনাকাটা করার দায়িত্ব সেরে ফেললাম । করাচীর  উদ্দেশ্যে রওনা দেওয়ার আগে জেদ্দায় প্রবাসী ডাক্তার ইঞ্জিনিয়াররা বিদায় জানাতে হাজির হলেন। সবাই মিলে এয়ারপোর্ট পর্যন্ত  এগিয়ে দিতেও আমার সঙ্গী হলেন। 

এক সময় দেখলাম তারা নিজেদের মধ্যে কি যেন আলোচনা করছেন। যার যার পকেট হাতড়ে  টাকা পয়সা জমা করে এয়ারপোর্টের‌ জুয়েলারি দোকান থেকে সুন্দর একটা ঘড়ি কিনে আমাকে উপহার দিলেন। 

বুঝতে পারলাম, আল্লাহর ইশারায় নতুন ঘড়িটি ছিল হারানো পুরনো ঘড়ির পরিবর্তে উপহার; সে সঙ্গে কাবার মসজিদে রাতে ঘুমানোর অপরাধ ক্ষমা করার ইঙ্গিত।

About Post Author

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Pin It on Pinterest