October 29, 2025

কাঞ্চনজঙ্ঘা দুহিতা দার্জিলিং

ভারত সফর সংক্রান্ত ট্রাভেল গাইডে বর্ষাকালে দার্জিলিং ভ্রমণে যেতে নিষেধ করে–মেলা বৃষ্টি, ক্যাটস এন্ড ডগস, ভ্রমণের আনন্দই মাটি।

মাটি না বলে পানিই বলা ভালো। কিন্তু সুযোগ সব সময় আসে না। বাচ্চাদের স্কুল, বড়দের অফিস থেকে ছুটি ছাঁটা সব মৌসুমে পাওয়া যায় না। ভ্রমনসূচী তৈরি করার জন্য সম্ভাব্য ভ্রমণেচ্ছু আত্মীয় স্বজনদের সাথে একটা জরুরি বৈঠক ডাকা হল। হিসাব-নিকাশ করে দেখা গেল আখেরে সে জুলাই মাসই সবার জন্য সুবিধাজনক।

আলোচনার প্রথম পর্বে কিছু সন্দেহ, কিছু দ্বিধা-দ্বন্দ্ব থাকলেও সবাই এক বাক্যে জুলাই মাসের অনুকূলে ভোট দিল। কয়েক জন সদস্য অবশ্য সংশোধনী প্রস্তাব রাখলেন, দার্জিলিং হিল স্টেশনে জুলাই মাসের অনিশ্চয়তা ও সম্ভাব্য আপদ বিপদ বিবেচনা করে আমাদের যাত্রা ভ্রমণ না বলে অভিযান বলাই সঙ্গত হবে। ‌ সে প্রস্তাবও পাশ হলে।

সব মিলিয়ে নারী-পুরুষ শিশু বৃদ্ধ আট জন সদস্য অভিযানে সামিল হওয়ার জন্য নাম দাখিল করল। নানা বয়সের, ভিন্ন ভিন্ন মতের‌ লোকজন নিয়ে অভিযাত্রী দল গড়া হলো। কনিষ্ঠতম সদস্যের নাম সৈয়দ জারিফ নাফি, বয়স চার বছর।

আমার বুদ্ধিবৃত্তি সম্পর্কে অনেকেরই সন্দেহ থাকলেও জ্যেষ্ঠ সদস্য হওয়ার কারণে অভিযান পরিচালনার গুরু দায়িত্ব আমার উপর অর্পণ করা হল। গুরুদায়িত্ব বটে–দলবল নিয়ে ভ্রমণ করতে গেলে কত দিক সামলাতে হয় তার হিসাব-নিকাশ নাই। একজন বলে এটা দেখব, অন্য জন বলে, না ওটা। কেউ পছন্দ করে চাইনিজ, কেউ দেশি। দলপতি ভেটো দিলে বিদ্রোহ করার হুমকি আসে। অনেক গুণের মধ্যে বাঙ্গালীদের এটাও একটা মহৎ গুন। কোন নেতাকে শ্রদ্ধা ভালোবাসা জানিয়ে একেবারে আকাশে তুলে দেন, তারপর কিছুদিন পর ভালোবাসায় ভাটা নামে, এক ঝাঁক বুলেট ঢুকিয়ে তাঁর বুক ঝাঝরা করে ফেলে।

প্রায় দুই যুগ আগের সে সফরনামা লিখতে বসে আমার মনে সন্দেহ ছিল বাড়ির এত কাছে‌ হিল স্টেশন দার্জিলিং ভ্রমণ সম্পর্কে কোন যুৎসই আকর্ষণীয় গল্প তৈরি করা সম্ভব কিনা? অনেক দিন আগে কোন দূর দেশ ভ্রমণের কাহিনী বাস্তবের সাথে কল্পনার মিশেল দিয়ে রসঘন করে লেখার সুযোগ থাকে। ভ্রমণ না করেও বিশ্বাসযোগ্য কাহিনী খাড়া করতে বাঁধা নেই। শোনা যায়, শেক্সপিয়ার ভেনিসে যান নাই কিন্তু মার্চেন্ট অব ভেনিস নামে একখানা উত্তম নাটক লিখেছিলেন।

তা ছাড়া, অন্য কোন বিদেশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য বর্ণনায় বাড়াবাড়ি করলে বিবেক বাধা দেয়–তোমার নিজের এত সুন্দর দেশ থাকতে বিদেশ প্রেম নিয়ে এত মাতামাতি কেন, বাপু?

জানি, অনেকেই আতকে উঠবেন, কিন্তু প্রায় অর্ধেক পৃথিবী ভ্রমণ করে আমার মনেও প্রত্যয় জন্মেছে আমার দেশের চেয়ে আর কোন সুন্দর দেশ নেই–সকল দেশের রানী সে যে আমার জন্মভূমি শুধু কবির কল্পনা নয়। বাজি ধরতে চান? ঠিক আছে, আমার সব সহায়-সম্পত্তি বাজি রাখতে রাজী। (তবে, সহায় সম্পত্তি আদতে আছে কিনা তা জানতে পেলে আমাকে দোষ দিবেন না।)

যতই সুন্দর হোক না কেন, সমতল ভূমির লোকজন দূর পর্বতের হাতছানি উপেক্ষা করতে পারে না। কিন্তু নব্বই দশকের শেষ দিনগুলোতে গণতন্ত্রের অতন্দ্র প্রহরী বিরোধী দল কথায় কথায় হরতাল ডেকে নিজ নিজ গৃহে লক ডাউন হয়ে অবস্থান করার জন্য পরামর্শ দিত। কত‌ ঠুনকো আমাদের গণতন্ত্র?

দু’দিনের হরতাল শেষে বিরোধী ও ক্ষমতাসীন উভয় দল পাবলিককে অভিনন্দন জানায়–এক দল সফল হয়েছে, অন্যদল বানচাল হয়ে গেছে দাবি করে।‌ মাঝখানে জনগণের ভোগান্তি–পেট্রোল বোমা, বাসে আগুন, গাড়ি ভাঙচুর, লাশের মিছিল। ‘গণতন্ত্র’ মজবুত করতে তা নাকি মোক্ষম দাওয়াই।

তাদের এ দাবি দাওয়ার পর্ব শেষ হলে ভ্রমনসূচী চূড়ান্ত করতে অভিযাত্রী দলের স্থগিত মিটিং পুনরায় ডাকা হল। এ পর্বে শুরু হয়ে গেল মতদ্বৈততা যার রেশ চলেছিল অভিযানের শেষ পর্ব পর্যন্ত।

আমার শ্যালক মহোদয়, যার বেশ কিছু ব্যার্থ মিশন পরিচালনার ‘এলেম’ রয়েছে, তার দুই ভগ্নি–অন্য অর্থে, আমার শালিকাদ্বয়ের সমর্থনে দ্রুত নিজেকে বিরোধীদলীয় নেতার পদে নির্বাচিত করে ফেলল। বিরোধী দল না থাকলে গণতন্ত্রকে নাকি মজবুত হয় না। জিজ্ঞেস করলাম, এটা কার বাণী?

ঠোঁটের কোণে একটুখানি দুর্বোধ্য হাসির আভাস জাগিয়ে বলল, কেন দেশনেত্রীর?

নবনির্বাচিত বিরোধীদলীয় নেতার ভূগোল সম্পর্কে জ্ঞান দেখলাম বেশ টনটনে। অনেকেরই এ ব্যামোটা রয়েছে।‌ শ্যালকের মত তাদের ধারনা, ভারতের হিল স্টেশনগুলোতে যেতে কলকাতা হয়ে যাওয়াই একমাত্র রুট।

আসলে কলকাতা থেকে শিলিগুড়ি যত দূর, ঢাকা থেকে বুড়িমারী হয়ে প্রায় সমান দূরত্বে শিলিগুড়ির অবস্থান। কলকাতা থেকে ট্রেনে গেলে লাগে ১২ ঘন্টা। ঢাকা থেকে তার চেয়ে কম সময়ে এবং অল্প খরচে সরাসরি শিলিগুড়ি যাওয়া যায়। মাঝখানে ফাউ হিসাবে‌ তখনকার নবনির্মিত যমুনা ব্রিজ দেখার বাড়তি আকর্ষণ। অভিযাত্রী দল ইতিউতি করে প্রস্তাবটি মেনে নিল।

ঢাকা থেকে বিলাসবহুল কোচে রংপুর পর্যন্ত যেতে রাস্তাটি ছিল, যাকে বলে সিল্কের মত মসৃণ। পরিপাটি ইউনিফর্ম পরা সুপারভাইজার, বিমান ভ্রমণের সাথে মিল রেখে যাত্রার প্রারম্ভে পবিত্র কোরআন থেকে কিছু অংশ তেলাওয়াত শেষে রংপুরে পৌঁছানোর সময় (এক্সপেক্টেড টাইম অব এরাইভাল), পথিমধ্যে কোথায় কোথায় যাত্রা বিরতি এসব বৃত্তান্ত বয়ান করতে লাগলেন।

ঘন্টা কয়েক পর বঙ্গবন্ধু ব্রিজ দৃষ্টিসীমায় আসলে অভিযাত্রী দলের মধ্যে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ল। স্বপ্নের ব্রিজ বৈকি–সব রাজনৈতিক দল দাবি করে সে স্বপ্ন প্রথমেই দেখেছিল তাদেরই দলের নেতা। যমুনা ব্রিজ (লেভি) ট্যাক্স নামে যে জনগণের টাকায় তা করা হয়েছে তাদের কেউ স্বপ্নের‌ ভাগ ছেড়ে দিতে রাজি নয়। তবে, ব্রিজের নাম কি রাখা হবে তা নিয়ে বেশ কিছু পিংপং খেলা জনগণকে উপহার দেয়া হয়। গণতন্ত্র বলে কথা!

কিছুক্ষণ পরে স্মার্ট সুপারভাইজার আবারো মাইক্রোফোনে ঘোষণা দিলেন, মিনিট বিশেক পরে আমরা স্বল্প সময়ের বিরতি দিব; সেখানে হাইওয়ে ইনে আপনারা যার যার ‘প্রয়োজনীয় কর্ম’ সম্পাদন করে নিবেন।‌

হাইওয়ে ইনে প্রয়োজনীয় কর্ম সম্পাদনের জন্য ছিল বেশ অনেকগুলো ঝকঝকে পরিষ্কার টয়লেট এবং খাদ্য সামগ্রীর সমাহার। দেশটি অর্থনৈতিক উন্নয়নের পথে এগিয়ে যাচ্ছে তারই আলামত।

রংপুরে রাত্রিবাসের পর মাইক্রোবাসে গন্তব্যস্থলের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করলাম। তিস্তা ব্যারেজের কাছে পৌঁছে আমাদের ড্রাইভার মোস্তাক বারবার বলছিল, অল্প কিছুক্ষণ পরে আপনারা দেখতে পাবেন তিস্তা ব্যারেল। আমরা তাকে ব্যারেজ এবং ব্যারেল এর মধ্যে কি পার্থক্য তা বোঝাতে চেষ্টা করলাম কিন্তু সে তা মানতে রাজি না।

মনে মনে ভাবলাম, তার হয়তো যুক্তি আছে। ব্যারেজ তৈরি করতে কয়েক ব্যারেল টাকা লেগেছে, কিন্তু জলসেচের জন্য ফায়দা হয়েছে নেহায়েত নগণ্য। রাজনৈতিক উদ্দেশ্য নিয়ে তৈরি করা এ-সব প্রজেক্টর বেশির ভাগ ক্ষেত্রে একই কাহিনী।

ব্যারেজ পার হওয়ার পর রাস্তার বেহাল অবস্থা দেখে মনে হল চন্দ্রপৃষ্ঠে অভিযান ভ্রমন বোধ হয় তার চাইতে আরামদায়ক ছিল। চন্দ্রপৃষ্ঠের মত রাস্তার এপাশ থেকে ওপাশ রয়েছে বিশাল সব সুগভীর খাদ। গাড়ির ঝাঁকুনিতে আমাদের হাড়গুলো বুকের পাঁজর থেকে বেরিয়ে এদিক ওদিক ছড়িয়ে পড়ার উপক্রম। সড়ক বিভাগের অদক্ষতা, অবহেলা ও দুর্নীতির ‘গুনগান’ করতে করতে আমরা অখন্ড শরীরে কোন রকম রাস্তাটি পার করতে পারলাম।

ড্রাইভারকে জিজ্ঞেস করলাম, রংপুর থেকে বুড়িমারী যাওয়ার আর কোন রাস্তা ছিল কি?

সে বলল, আছে, লালমনিরহাট দিয়ে যাওয়া যায়। দেখা গেল এ পথে তার অনেক দিন ধরে যাওয়া আসা নাই। তার এক বন্ধু নাকি এ রুটে আসার জন্য পরামর্শ দিয়েছিল।

জিজ্ঞেস করলাম, তার সাথে ইদানিং তোমার কোন ঝগড়া-ঝাঁটি হয়েছে কিনা?

ঠোঁটের কোণে একটুখানি হাসির আভাস মিলিয়ে গেলে বলল, তেমন কিছু না তবে যদি এক পিসে রংপুর ফেরত যেতে পারি, তাকে পৃথিবীর থেকে বিদায়ের ব্যবস্থা করব।

অভিযাত্রী দলের সদস্যরা বুড়িমারী নামের উৎস নিয়ে গবেষণার দিকে মনোযোগ দিল। নানা জনের নানা মতের শেষে সর্বসম্মতিক্রমে সিদ্ধান্ত নেয়া হলো যে হয়তো কোন বৃদ্ধা এ-পথ দিয়ে যাবার পথে গাড়ির ঝাঁকুনির চোটে মৃত্যুবরণ করেছিলেন। তখনকার দিনে নামকরণের দাবি নিয়ে তেমন কোন রাজনৈতিক নেতা ছিল না। তাই, বৃদ্ধার বিদেহী আত্মার সম্মানে চেকপোস্টের নাম রাখা হয় বুড়িমারী।

চেক পোস্টে তেমন কোনো জনসমাগমে দেখা গেল না। মাঝে মাঝে দু একজন মাত্র লোক চেকপোস্ট পার হয়ে যাচ্ছিল। তাদের বেশির ভাগই গার্জিয়ান–সন্তানদের পড়াশোনার জন্য শিলিগুড়ি, কার্শিয়াং, দার্জিলিং পৌঁছে দিতে চলেছেন। আমরা আবার আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার প্রতি ‘যথাযথ শ্রদ্ধা’ জানাতে ভুললাম না। আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার প্রতি সম্মান জানিয়ে চেক পোস্টের কর্মকর্তা পাসপোর্টে সিল দিল Burimari Chak post. Chak post না বলে Choke post অর্থাৎ গলা চেপে ধরে অর্থ আদায়ের পোস্ট, বলা ভালো। ‌

সীমান্তের এপার ওপার দু’দেশের তিন ডিপার্টমেন্টের তিন‌ সেট করে মোট ছয় সেট‌ কর্মকর্তাদের কিছু না কিছু চাহিদা পূরণ করতেই হয়। তবে, চাঁদার হার খুবই কম ছিল। বেনাপোলে মত নয়, যেখানে গলা চেপে অর্থ আদায়ের ব্যাপারে তানারা মনগড়া আপত্তি, বিস্মৃত আইনের দোহাই দিয়ে চাঁদা আদায়ের ব্যাপারে নব নব পন্থা উদ্ভাবনে সৃজনশীলতার পরিচয় দিয়ে দুঃস্বপ্নের চেকপোষ্ট বানিয়ে ফেলেছেন।

বুড়িমারীতে তেমন কোন ঝামেলা না হলেও, ওপারে চ্যাংড়াবন্দ চেক পোষ্টে ঢুকতেই বিএসএফের এক কঠিন চেহারার বিহারী (আপামর বাঙ্গালীদের কাছে সব অবাঙালিই বিহারী) আমাদের পথ আগলে দাঁড়ালেন। পাসপোর্ট দেখার দায়িত্ব তার নয়, তবুও স্কুল ছাত্র ফাইনাল পরীক্ষার আগে যেভাবে পড়া তৈরি করে সেভাবে অখণ্ড মনোযোগ দিয়ে তিনি আমাদের পাসপোর্ট প্রত্যেকটি পাতা উল্টে পাল্টে দেখতে লাগলেন।‌ মনে মনে ভাবলাম, তিনি হয়তো আমাদের পাসপোর্টে কোন সৌন্দর্য আবিষ্কার করতে পেরেছেন যা এতদিন আমাদের নজর এড়িয়ে গেছে। আমরা তার মতলব বুঝি নাই তা নয় কিন্তু ভান করলাম কিছুই বুঝি নাই। শেষমেষ ধৈর্য হারিয়ে বিরক্ত মুখে পাসপোর্টগুলো ফেরত দিলেন।

তিনি মনে করেছিলেন, বাঙালির কি নির্বোধ, ইঙ্গিতটিও‌ বোঝেনা। খোদা মালুম, যে সব কাজ কাস্টমস ও ইমিগ্রেশনের দায়িত্ব তারা সে কাজে নাক গলাতে কেন আসে? আমাদের উপমহাদেশের এই ছোট্ট দুনিয়ায় সরকারি কর্মকর্তারা নিজস্ব ‘ঢেউ গোনার’ কায়দা কানুন বেশ ভালো ভাবেই রপ্ত করেছেন।

চ্যাংড়াবন্দের ইমিগ্রেশন অফিসার বেশি টালবাহানা না করে সরাসরি ‌ মুখে উচ্চারণ করলেন ‘প্রতি পাসপোর্টের জন্য বিশ রুপি’। স্থল পথে ভারত ভ্রমণের অভিজ্ঞতা নাই। ভাবলাম, এরা কি মগের মুল্লুক পেয়েছে? ঝগড়া করার ইচ্ছা ছিল কিন্তু বিএসএফের সে লোকটার পেছনে আমাদের অনেক ধৈর্য্য ব্যয় করেছি। নতুন করে ধৈর্য পরীক্ষা দেওয়ার ইচ্ছা ছিল না। মনকে সান্তনা দিলাম, চাহিদা এমন কিছু না– মাত্র বিশ টাকা। এত সামান্য বিষয় নিয়ে ঝগড়াঝাঁটির পথে আর গেলাম না।

পরবর্তী পর্যায়ে ইন্টারভিউ দিতে হলো একজন স্মার্ট সুদর্শন কাস্টম অফিসারের সাথে। তার সৌজন্যবোধের অভাব ছিল না কিন্তু ফরেন এক্সচেঞ্জ সম্পর্কে তার আগাধ জ্ঞানের ভান্ডার থেকে জ্ঞান বিতরণ করতে চেষ্টা করলেন। ‌

মার কাছে মামা বাড়ির গল্প আর কি। ‌ এ সাবজেক্টে চুল পাকিয়েছি। বললাম, তুমি তো যত সব পুরনো আইন-কানুন আউড়ে চলেছ। নব্বই দশকে রিজার্ভ ব্যাংক সে সব বাধা-নিষেধ তুলে দিয়েছেন সে খবর রাখলে ভালো হতো। ভেবে চিন্তে কিছু না পেয়ে প্রশ্ন করল, বাংলাদেশ টাকা কি ফরেন এক্সচেঞ্জ? আমি বললাম, তোমাদের কাছে সব বিদেশের টাকাই ফরেন এক্সচেঞ্জ। উলুবনে মুক্তা ছড়ানোর চেষ্টা করলাম না। শেষ মেষ ভদ্রভাবে অনেকটা নিরাশ হৃদয় আমাদের ছাড়পত্র দিলেন।

পরে ভেবে দেখলাম, অল্প কিছু অর্থের বিনিময়ে সহজে যেখানে ছাড়পত্র পাওয়া যায় তা নিয়ে এত গ্যাঞ্জামের দরকার ছিল না। তবে বিবেকের কাছে জবাবদিহির প্রশ্নটা মাথা থেকে সহজে নামানো যায় না।

আমাদের অভিযাত্রী দল দুটো চেক পোস্টের মাঝখানে নো ম্যান্স ল্যান্ডে অতিক্রম করতে বেশ কিছু থ্রিল অনুভব করতে লাগলো। ‌ নো ম্যানস ল্যান্ডে মানুষ থাকার কথা নয় কিন্তু সেখানে দেখলাম এক ঝাঁক দালাল। ‌

এখনকার অবস্থা জানিনা, কিন্তু দুই দশক আগে ভারতের সর্বত্র– বিমানবন্দরে, রেল স্টেশনে, শপিং কমপ্লেক্সে–এদের প্রচুর আনাগোনা ছিল। ‌ প্রত্যেক দল‌‌ দালাল আমাদের দায় দায়িত্ব বুঝে নিতে তৈরি ছিল। তারা কাস্টমের‌ বেড়াজাল ডিঙ্গোতে, ফরেন এক্সচেঞ্জ ভাঙ্গাতে, গাড়ি ঘোড়া ভাড়া করতে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে প্রস্তুত। এ কাজের জন্য কিছু দালালি মেলে।

এদের দোষ দেই না। চাকরি-বাকরি জুটাতে না পেরে পেটের ধান্দায় এ কাজে নামতে বাধ্য হয়। তবে, তারা আন্তরিকভাবে যথাসাধ্য সাহায্য করতে চেষ্টা করে।‌ ঢাকার বন্দুক ঠেকিয়ে চাঁদা আদায় করা মস্তানদের তুলনায় তাদের চাহিদা খুব বেশী নয়।

সফরসঙ্গীদের কয়েক জন অতি উৎসাহী সদস্য শিলিগুড়িতে রাত কাটানোর জন্য কয়েকটি হোটেলের নাম লিখে নিয়ে এসেছিল। প্রত্যেকেরই দাবি তার নির্বাচিত হোটেলটাই শ্রেষ্ঠ। ঐক্যমতে পৌঁছানো সম্ভব হলো না; বাংলাদেশ কালচারে ঐক্যমতে পৌঁছানোর জন্য যতটুকু ধৈর্যের প্রয়োজন তার বড্ড অভাব।‌

সুশাসনের জন্য গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা মানুষের একটা উমদা আবিষ্কার, কিন্তু নানা জনের নানা মতের দুর্লঙ্ঘ্য বাঁধা অতিক্রম করে ঐক্যমতে পৌঁছতে অনেক কাঠখড় পোড়ানো লাগে।

পরিশেষে সিদ্ধান্ত হলো, তর্কবিতর্কের প্রয়োজন নেই; শহরে প্রথমেই যে হোটেলটা দেখতে পাবো সেখানেই আমরা উঠবো।

হোটেলের বাইরে নাম লেখা অপ্সরা, দেবালোকের জাদুকারিনী সুন্দরী নারী–অপ্সরার রানী। নামটা যত সুন্দর হোটেলটি ততটা সুন্দর মনে হলো না। তবে, স্বল্প বাজেটের টুরিস্টদের জন্য একেবারে ফেলনা নয়।

হোটেলে ঢুকে হাত পা ধুয়ে শহরটি রেকি করার জন্য রাস্তায় বেরিয়ে পড়লাম। রাস্তায় কয়েকজনকে দেখলাম অভিযাত্রী দলের দিকে আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে আছে। অবশেষে বছর ত্রিশেক বয়সের একজন যুবক আমাদের কাছে এগিয়ে আসলেন। গলার স্বরে এক গামলা মধু ঢেলে জিজ্ঞেস করলেন, আপনারা কোথা থেকে এসেছেন, কোথায় যাবেন? এতক্ষণে বুঝলাম, তিনি দালালদের একজন।

তাঁরা সারা শিলিগুড়িতে ট্যুরিস্টদের খোঁজে ঘুরে বেড়ান। তাঁরা দাবি করেন, আপনি চাইলে দার্জিলিং গ্যাংটক অথবা থিম্পু যেতে আলিফ লায়লা যুগের ম্যাজিক কার্পেটেরও ব্যবস্থা করতে পারেন। অথবা, সে সব লোকেশনে স্বপ্নের হোটেলে থাকার জন্য আগে ভাগেই বুক করে দিতে পারেন।

আমার নাম আবু সাঈদ, জন্মস্থান সিলেট। যুবকটি পরিচয় দিলেন। বুঝলাম, আমাদের সাথে ধর্ম ও জন্মভুমির একাত্মতা ঘোষণা করে মন জয় করতে চেয়েছিলেন।

পরীক্ষা করার ইচ্ছা হল।

–তুমি সিলেটের লোক শুনে খুশি হলাম। তা বাবা, সিলেটি ভাষায় উচ্চারণে যে কারিশমা রয়েছে তোমার তো সে রকম কিছু দেখলাম না।

–কি যে বলেন স্যার কারিশমা কাপুর সিলেটের হতে যাবেন কেন? তিনি তো বোম্বের নায়িকা।

–আমি সে কারিশমার কথা বলছি না। সিলেটি উচ্চারণের মাধুর্যের কথা বলছি।

–আমি স্যার, অনেক অল্প বয়সেই সিলেট ছেড়েছি। উচ্চারণের সে মাধুর্যও আমাকে ছেড়ে চলে গেছে।

ধারণা করলাম তার সিলেটের সাথে কোনদিন সম্পর্ক ছিল না এবং তাঁর নাম যা বললেন তাও সঠিক নয়। কিন্তু এও ঠিক, তাকে রুজি রোজগারের ধান্দায় লেগে থাকতে হয়, কাস্টমার পাকড়াও করতে নানা রকমের কলাকৌশল অবলম্বন করতে হয়। তার জন্য সহানুভূতি অনুভব করলাম। জানালেন, তার অফিস খুব কাছে। সেখানে তার বসের সাথে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার জন্য সবিনয়ে আমন্ত্রণ জানালেন।

বস তার স্বরে আর এক প্রস্থ বাড়তি মধু ঢেলে স্বাগতম জানিয়ে দার্জিলিংয়ের কয়েকটি হোটেলের মনোগ্রাহী ছবি দেখিয়ে ইমপ্রেস করতে লাগলেন। তার কেসটা মজবুত করতে, আমার শ্যালকের সুন্দরী স্ত্রীর দিকে নজর রেখে জানালেন, আমি শীঘ্রই বিখ্যাত সিনেমা পরিচালক ঋত্বিক ঘটকের সাথে যৌথ প্রযোজনায় একটা ফিল্মের জন্য নায়িকা খুঁজছি। আপনাদের যদি আপত্তি না থাকে…।

তাঁকে থামিয়ে দিয়ে বললাম, থাক অনেক হয়েছে, এবার আসি। কোন আশ্বাসবাণী না শুনিয়েই হোটেলে ফিরে এলাম।

তবে আমাদের দালাল-কাম-উঠতি-ফিল্ম মেকার ধৈর্য হারাবার লোক নন। তিনি এখানে সেখানে আমাদের সামনে উদয় হয়ে নতুন নতুন লোভনীয় প্রস্তাব দিতে লাগলেন। তাঁর কান্ড দেখে সহানুভূতি হোক কিংবা অন্য কোনো কারণে অভিযাত্রী দলের প্রবল আপত্তি উপেক্ষা করে দার্জিলিংয়ে আমাদের জন্য একটা হোটেল বুক করার অনুমতি দিলাম। আমার শ্যালক যিনি অভিযাত্রী দলের ক্যাশিয়ারের দায়িত্ব গ্রহণ করেছিল দালালকে কিছু অগ্রিম অর্থ প্রদানের জন্য নির্দেশ দিলাম। আমাদের টিম মেম্বারদের কাছে কৈফিয়ৎ দিলাম, তাঁর পরিবার-পরিজন রয়েছে, কিছু টাকা না পেলে তারা হয়তো ক্ষুধার্ত থাকবে।

নির্বোধের মত আমার হঠকারি সিদ্ধান্তের কারণে অভিযাত্রী দলের মধ্যে প্রথম বারের মতো বিদ্রোহের আভাস দেখতে পেলাম। তবে, জানতাম, সবাই আমার প্রিয় জন, আমার সিদ্ধান্তের ফলাফল যাই হোক না কেন, তারা সহ্য করে নেবেন।

পরদিন সকালে দালাল-কাম-ফিল্ম ডাইরেক্টর তাঁর আসল চেহারায় দেখা দিলেন। তিনি মান্দাতার আমলের একখানা জীপ গাড়ি, যার তার ক্ষয়ে যাওয়া টায়ার যে কোনো মুহূর্তে ফেটে যেতে পারে, তা নিয়ে হোটেলের গেটে হাজির হলেন। সে গাড়িতে তিনি আমাদের দার্জিলিং যাওয়ার ব্যবস্থা করেছেন।

তাঁর বিস্ফারিত ঠোঁটের দুই কোণে মৃদু হাসির ঝলক তুলে জানালেন, মালিক চালিত জিপ স্যার, মালিক চালিত জিপ।

–তুমি নিশ্চয়ই ফাজলামি করছো। বিশ্ব যুদ্ধের সময়কার এ গাড়ির মালিক হয়তো বহু বছর আগে পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে অন্য জগতে হাল আমলের নতুন মডেলের গাড়ি চালাচ্ছেন।

–সমস্যা নাই স্যার, মালিক চালিত গাড়ি। তিনি আবার সেই পুরাতন বুলি ছাড়লেন।

ততক্ষনে আমার ধৈর্য শেষ সীমায় পৌঁছে গেছে। বললাম, তুমি এখান থেকে ভাগো। না হলে, শিলিগুড়িতে পরেশ পাল নামে আমার পরিচিত একজন পুলিশ অফিসার আছেন। তোমাকে জেলের ভাত খাওয়াবেন।

তাকে কিছুটা নার্ভাস মনে হল। মিউমিউ করে বলল, সরি স্যার, আপনাদের জন্য আরেকটি গাড়ির ব্যবস্থা করছি।

পরের গাড়িটা ছিল অনেকটা মানানসই। পথিমধ্যে ড্রাইভারের কাছে জেনেছিলাম, গাড়ির মালিক থেকে দালালি পাবে একশত টাকা।

দালালকে বারবার দয়া-দাক্ষিণ্য দেখাবার জন্য অভিযাত্রীদের মাঝে অসন্তোষ দেখা গেল। আমি সান্ত্বনা দিলাম, মাত্র এক শত টাকার ব্যাপার। তা নিয়ে মাথা গরম করার দরকার নেই।

৬৫ কিলোমিটার দার্জিলিংয়ের পাহাড়ি রাস্তায় আমাদের জীপ যতই উপরের দিকে উঠতে লাগলো ততই আমাদের মনে পর্যায়ক্রমে কখনো উত্তেজনা কখনো শঙ্কা দেখা দিতে লাগলো। গোর্খা ড্রাইভার যত দ্রুত রাস্তার বাঁক পার হচ্ছিল, রাস্তার পাশে কয়েক হাজার ফুট নিচে গভীর গিরিখাত দেখে আমাদের হার্টবিট ততোই দ্রুত হতে লাগলো।

কিছুক্ষণ পর আমাদের মাইক্রোবাস পাহাড়ি রাস্তা বেয়ে কার্শিয়াং শহরে ডিপোজিট করে বলল, আপনারা এখানে চা নাস্তা খেয়ে নিতে পারেন।

কার্শিয়াং থেকে দুর দিগন্তে দেখা যায় হিমালয়ের পাদদেশ থেকে বঙ্গোপসাগর পর্যন্ত আমাদের প্রিয় মাতৃভূমিসহ অবিস্মরনীয় বিস্তৃত সমতলভূমি। কাছের ধারের এক রেস্টুরেন্টে ঢুকে পড়লাম। ওয়েটার বলল তাদের মম নাকি খুবই জনপ্রিয় স্ন্যাক। সেখানে প্রথম বারের মতো মম খেয়ে প্রথমবারের মতো দলপতির সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্তের জন্য অভিনন্দন জানাতে লাগলো।

কলকাতা থেকে টয় ট্রেনে দার্জিলিং

দার্জিলিঙে পৌছে আমাকে আবার অভিযাত্রী দলের রোষানলে পড়তে হল। নাম হোটেল ফ্লোরা কিন্তু ফুলের কোন নাম গন্ধ নেই। মেঝে স্যাঁতস্যাঁতে এবং সবচেয়ে বড় কথা ট্যাপের পানির কোন ব্যবস্থা নেই।

আমাদের সামনে একটাই পথ খোলা ছিল। অগ্রিম টাকার মায়া ত্যাগ করে নতুন করে অন্য একটি হোটেল খোঁজা। কিন্তু মুষলধারে বৃষ্টি আমাদের পরিকল্পনার পথে বাঁধা হয়ে দাঁড়ালো। পাহাড়ি বৃষ্টি, ক্যাটস এন্ড ডগস না বলে এলিফ্যান্ট এন্ড বাফেলো বললেই ঠিক হয়।

আমাদের সৌভাগ্য বলতে হবে, সকালে উঠেই দেখি পরিষ্কার ঝকঝকে আকাশ। ‌ সৃষ্টিকর্তা তার সকরুণ হাতের ছোঁয়ায় মেঘ সরিয়ে‌ আমাদের জন্য ঘন নীল আকাশ এবং অদূরে হিমালয় পর্বতমালার অপূর্ব সৌন্দর্য উপভোগ করার সুযোগ করে দেন।

দার্জিলিংয়ে টুরিস্টরা কি কারণে ভিড় জমায়? বলার অপেক্ষা রাখে না, দার্জিলিং মনোরম হিল স্টেশন, চারপাশে ঘিরে রয়েছে পাইন ও পপলার গাছের সারি। সমতল ভূমির লোকদের জন্য দার্জিলিংয়ের প্রধান আকর্ষণ বরফাচ্ছাদিত হিমালয় পর্বতের ক্ষণে ক্ষণে রং বদলাবার রাজসিক দৃশ্য এবং খন্ড খন্ড মেঘের মিছিল।

আমরা সমতল ভূমির লোকেরা মেঘ দেখতে পাই আকাশের অনেক উপরে, ধরাছোঁয়ার বাইরে। অন্যদিকে, দার্জিলিংয়ের দেখা যায় নিচের উপত্যকা থেকে ধীর লয়ে পাইন গাছের ফাঁক গলিয়ে উপরের দিকে উঠে আসতে। মনে হল তারা যেন আমাদের সাথে লুকোচুরি খেলতে উৎসুক। দলছুট এক খন্ড মেঘ অভিযাত্রী দলকে ছেয়ে ফেলল। সবাইকে ভিজিয়ে দিয়ে যাবে কিনা তা নিয়ে ভীত হয়ে উঠলো। কিন্তু মেঘ খণ্ডটি সবাইকে কুয়াশার পরশ বুলিয়ে আপন পথে রওনা হল। রেখে গেল মিষ্টি অনুভূতি।

দার্জিলিং এমনিতে খুবই উপভোগ্য সৌন্দর্যমন্ডিত হিল স্টেশন‌ কিন্তু অনেকেই সেখানে আরো নতুন নতুন টুরিস্ট স্পট আবিষ্কার করতে ঝুঁকে পড়ে।

আসলে সেখানে উল্লেখযোগ্য স্পট একটাই আছে–টাইগার হিল–যেখান থেকে হিমালয় পর্বতমালার শুভ্র বরফাচ্ছাদিত চুড়া এবং তার পাদদেশের উপত্যকার সৌন্দর্য উপভোগ করা যায়। কিন্তু প্রায় মেঘে ঢেকে থাকার জন্য সবার ভাগ্যে তা দেখা হয়ে ওঠে না। আমাদের ভাগ্য খারাপ বলতেই হবে কিন্তু সবাই শপথ নিলাম দেশে ফিরে হিমালয় পর্বত শৃঙ্গ দেখতে পাই নাই সে কথা কাউকে বলব না। দার্জিলিংয়ে যেয়ে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখতে না পারাটা লজ্জার কথা।

টাইগার হিল সূর্যোদয়ের সময় কাঞ্চনজঙ্ঘা দৃশ্য দেখতে দর্শনার্থীদের ভিড়

দার্জিলিংয়ের চা বিশ্ব বিখ্যাত

সকালে হোটেল থেকে বেরিয়ে রাস্তায় দেখলাম দার্জিলিংয়েও টাউটের অভাব নেই। হোটেলের ম্যানেজার, রেস্টুরেন্টের ওয়েটার, ফোন বুথে বাসাটা বসা টাক মাথা বয়স্ক লোক সবাই দার্জিলিংয়ের আকর্ষণীয় টুরিস্ট স্পট গুলো দেখার জন্য গাড়ি ভাড়া করতে সাহায্য করার জন্য ব্যস্ত।

তাদের বলতে শুনলাম, পাঁচ পয়েন্ট, সাত পয়েন্ট। খোদায় মালুম আর কত কি পয়েন্ট। ‌আমরা একটা পয়েন্টের কথাই জানতাম। ষাটের দশকের বঙ্গবন্ধুর ছয় পয়েন্ট যা কালক্রমে এক পয়েন্ট গিয়ে দাঁড়ায়–স্বাধীন বাংলাদেশ।

পরে দেখা গেল টুরিস্ট পয়েন্টগুলোয় এমন কিছু দেখার মতো নেই। কিন্তু ট্যাক্সি মাইক্রোবাস ওয়ালারা সেগুলো এত সুন্দরভাবে বর্ণনা দেয় যে‌ টুরিস্টরা সহজেই আকর্ষণ অনুভব করে। আমার অভিযাত্রী দল তাদের কথায় মজে গেল। তারা সব পয়েন্ট দেখতে চায়, পয়েন্ট বাই পয়েন্ট।‌বাঁধা দেওয়ার চেষ্টা করলাম না। এবার পূর্ণমাত্রায় বিদ্রোহ করে বসলে সাত হাজার ফুট উচ্চতা থেকে পতন শরীরের জন্য আরামদায়ক নাও হতে পারে।

পয়েন্ট দেখার শুরুতেই অভিযাত্রী দলের আগ্রহে ভাটা পড়তে লাগলো। ‌ রাস্তার পাশে পড়ে থাকা একটা সাদামাটা বড় সাইজের পাথরের ফেন্সি নাম–তেঞ্জিং রক। ড্রাইভার বললেন, এটা প্রথম পয়েন্ট। দ্বিতীয়টা ছিল একটা ছোট পার্ক। তাও আবার বন্ধ। ‌ তার পরেটার নাম শুনলাম তিব্বত রিফিউজি ক্যাম্প।‌ রিফিউজি ক্যাম্পে কি দেখা যেতে পারে তা ভেবে পেলাম না। সেখানে না ছিল দেখার মত কোন ক্যাম্প, না ছিল কোন রিফিউজি। একটা শুধু সুভেনিয়র শপ যেখানে রিফিউজিদের তৈরি কিছু কুটির শিল্পের পণ্য দ্রব্য। দাম আকাশচুম্বী।

দলের সদস্যরা এবার ড্রাইভারকে টিজ করতে লাগলো। পথে কোনো গরু কিংবা বড় গাছ থেকে দেখিয়ে ড্রাইভারকে জিজ্ঞেস করল, এগুলোও কি এক একটা পয়েন্ট? নেপালি ড্রাইভারের রসবোধ কম নয়। বলল, জী ম্যাডাম আপনি যেটা বলেছেন তাও একটা পয়েন্ট।

আরেকটি পয়েন্ট হিমালয় মাউন্টেনিয়ারিং ইনস্টিটিউট। সেখানে হেঁটে ওঠার দীর্ঘ পথ, পঁচিশ তলা বিল্ডিংয়ের সমান। কষ্টে-সৃষ্টে সেখানে উঠে দেখা গেল হিমালয় পর্বতের কয়েকটা শৃঙ্গের রিলিফ ম্যাপ এবং পাহাড়ে উঠার যন্ত্রপাতি ও সরঞ্জাম। টিম তাতেই সন্তোষ প্রকাশ করতে লাগলো, পাছে আমি বলি, আগেই বলেছিলাম না।

তেনজিং মেমোরিয়াল, হিমালয়ান মাউন্টেনেয়ারিং ইনস্টিটিউট

সপ্তম পয়েন্ট রক গার্ডেনের বৃত্তান্ত কি? অনেক দূরের পথ, অতিরিক্ত ভাড়া পাঁচ’শ রুপি। সেখানে রক আছে ঠিকই, কয়েকটি ঝর্ণাধারাও পাহাড় থেকে নেমে এসেছে। অবশ্যই ভালো লাগলো কিন্তু এত দূর এসে বাড়তি খরচ করে পয়েন্টটি দেখে অভিযাত্রী দল অনেকখানি নিরাশ। তবুও, ক্যামেরায় ক্লিক করে ডজন দুই ফিল্মের রোল খতম করে ফেলল। দেশে ফিরে কিছু একটা দেখানোর মত থাকা চাই।

রক গার্ডেন

ফোয়ারার ছবি ভালো আসলেও কারো মুখের ছবি ভালো হল না। বেলা বয়ে গেছে, সবার মুখ ক্ষুধার তাড়নাই শুকিয়ে আমচুর। সে শুকনো মুখে ভালো ছবি হবে কি করে? সে পয়েন্টে একটা ছোট রেস্টুরেন্ট ছিল বটে কিন্তু তাতে পাওয়া যায় শুধু সেদ্ধ ডিম, সাথে চা। তাতে খিদে মিটলো না বরং আরো খানিকটা উসকে দিল। কবি সুকান্তের ভাষায়, ক্ষুধার ‌ যন্ত্রণায় আমাদের দুনিয়া গদ্যময়। মানচিত্র খেতেও রাজি।

আমরা যখন ডেরায় ফিরে এলাম তখন সূর্য পটে বসতে শুরু করেছে। প্রস্তাব দিলাম, আমরা কি আধা ঘন্টা অপেক্ষা করতে পারি?‌ ততক্ষণে ডিনারের সময় হয়ে যাবে। সবাই আর্তনাদ করে উঠলো, ততক্ষণ পর্যন্ত আমরা কেউ টিকে থাকতে পারবো না। কাছে ধারে যে রেস্টুরেন্ট পাওয়া গেল সেখানে ঢুকে পড়লাম।

রেস্টুরেন্টে সাধারণ কিন্তু আমাদের ক্ষুধা অসাধারণ। তারা কি সে ক্ষুধা ‌মেটাতে পারবে?‌ এদিকে নেপালি ওয়েটার, না জানে ইংরেজি কিংবা বাংলা। আমরা নিজেদের মধ্যে কি খাব তা নিয়ে আলোচনা করতে লাগলাম- রুটি না ভাত, চিকেন না মাটন, অমলেট না ডিম সিদ্ধ। ওয়েটারকে দেখলাম মাথা নেড়েই চলছে। পরে বুঝেছিলাম, মাথায় ঘিলুর বালাই নাই।

খাবার তালিকা চূড়ান্ত করে অর্ডার দেওয়ার আগেই সে কিচেনে উধাও হয়ে গেল। আমরা আলোচনায় যে সব খাদ্যদ্রব্যের নাম করেছিলাম একে একে টেবিলে জমা করতে লাগল। পরিশেষে খাদ্যের স্তুপ কাঞ্চনজঙ্ঘার রূপ নিল। সকালে সে মাউন্টেন পিক আমরা মিস করলেও, টেবিলের ভাত-রুটি, চিকেন-মটন, অমলেট-ডিম সেদ্ধ দিয়ে তৈরি করা কাঞ্চনজঙ্ঘা দ্রুত শেষ হয়ে গেল।

সবচেয়ে বেশি কৃতিত্ব দেখিয়েছিল, লিডার অব দি অপজিশন আমার শ্যালক। অনেকেই তার প্লেটে বাড়তি ভাত চালান দেওয়ার ফলে সেখানে নতুন করে একটা এভারেস্ট পর্বত দাঁড়িয়ে গেল।

আমরা ভাবলাম সে কি এ পর্বত কিভাবে ডিঙোতে পারবে?‌ আমাদের অবাক করে দিয়ে মিনি পর্বতটি কার উদরে গায়েব হয়ে গেল।

ছোট সাইজের ছোট শালিকা বা কম কিসে? কেউ কেউ তাদের ডিমের বহর থেকে একটা করে ডিম তার প্লেটে উঠিয়ে দিল। সেখানেও সাতটা ডিমের একটা ছোটখাটো পাহাড় গড়ে উঠলো। সেও সেগুলো যথাস্থানে চালান করে দিল।

দার্জিলিংয়ের সফরনামা এখানেই শেষ।পরের দিন আমরা আরেকটা টুরিস্ট স্পট মিরিকের পথে রওনা হলাম।

সফরসঙ্গীদের টালবাহানার কথা বাড়িয়ে বললেও দার্জিলিংয়ের তিন দিন আমোদ ফুর্তি নাটক অতি নাটক সব মিলিয়ে আনন্দময় স্মৃতি নিয়ে দেশে ফিরে আসি।

ছবি গুগলের সৌজন্যে।

About Post Author

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Pin It on Pinterest