মোটা দাগে ম্যাডাম বা ম্যাম বলে সম্বোধন করার যে রীতি বহুদিন ধরে চলে আসছে তা এরকম।
- অপরিচিত বয়স্কা মহিলা, বিশেষ করে যারা আপনার চেয়ে বয়সে বড় তাদের ম্যাম বলতে পারেন। বয়সে কিছু ছোট হলে ম্যাম বলা যাবে না এমনটি নয়। তবে, বয়স্ক কেউ একজন কিশোরীকে ম্যাম সম্বোধন করা বেমানান। আমাদের কালচারে তাদের সম্বোধন করা হয় খুকি, মামনি, বেটি ইত্যাদি।
- দোকানে বা শপিংমলে অভিজাত মহিলা গ্রাহক। তবে, যাকে তাকে ম্যাডাম বা ম্যাম বলায় ঝুঁকি আছে। গালাগালি মনে করে দু কথা শুনিয়ে দিতে পারে।
- স্কুলে মহিলা শিক্ষিকা বা স্কুল কর্মকর্তা।
- সামরিক বাহিনীর উচ্চপদস্থ মহিলা।
- বয়স বা অবস্থান নির্বিশেষে মহিলাদের প্রতি শ্রদ্ধার নিদর্শন হিসেবে। এক্ষেত্রেও, স্ট্যাটাস অনুযায়ী বুদ্ধি বিবেচনা প্রয়োগ করা প্রয়োজন। নতুবা অপরিচিত শব্দ শুনে গালাগালি মনে করে লোকজন জড়ো করে উত্তম মধ্যমের ব্যবস্থা করতে পারে।
- ভারত, বাংলাদেশ, পাকিস্তানের মহিলা শিক্ষককে কখনো মিস, কখনো ম্যাম বলে সম্বোধন করা হয়। মজার ব্যাপার, বিবাহিতা মহিলারাও মিস শুনতে ভালোবাসে।
- চিঠিপত্রে মহিলা প্রাপককে dear sir এর পরিবর্তে madam সম্বোধন করা হয়।
- অনেকে মজা করে স্ত্রীকেও ম্যাডাম বা ম্যাম বলে সম্বোধন করে।
ম্যাডামের সংক্ষিপ্ত রূপ ম্যাম, ইংরেজি ভাষায় বানান ma’am. Madam এর সমার্থক শব্দ mesdame.
এসব সম্বোধন ব্যবহারের ক্ষেত্রে আমেরিকা ও বৃটেনের মধ্যে কিছু পার্থক্য রয়েছে। বলা বাহুল্য, ইংরেজি ভাষার বানান পদ্ধতি ও অর্থ সম্পর্কে বৃটেন এবং আমেরিকার মধ্যে বেশ রেষারেষি আছে। এ কারণে জর্জ বার্নাড শ বলেছিলেন, The United States and Britain are two countries separated by a common language.
ব্রিটেনে ম্যাম সম্বোধনটি এখন সচারাচর ব্যবহার করা হয় না। তবে, ইংল্যান্ডের রানীকে প্রথমবার ‘ইয়োর ম্যাজেস্টি’ বলে সম্বোধন করার পর পরবর্তী পর্যায়ে ম্যাম বলে সম্বোধন করার পুরনো রীতি চালু রয়েছে। ব্রিটিশরা বড্ড রক্ষণশীল; পুরনো রীতিনীতি সহজে পরিত্যাগ করতে চায় না।
রানী এলিজাবেথ এবং নাত বউ প্রিন্সেস ক্যাথেরিন (প্রিন্স চার্লস এবং প্রিন্সেস ডায়ানার পুত্রবধূ)
বৃটেনে সামরিক ও নিরাপত্তা বাহিনীর ঊর্ধ্বতন মহিলা কর্মকর্তাদের ম্যাম বলে সম্বোধন করা হয়। এ দুটো ক্ষেত্র ছাড়া ম্যাডাম কিংবা ম্যাম সম্বোধনটি ব্রিটেনে কমই ব্যবহার করা হয়। তবে, সেভাবে সম্বোধন করলে কেউ নাসিকা কুঞ্চিত করে না।
অন্যান্য প্রায় সব দেশেই একই প্রথা। সেনাবাহিনীর সদস্যরা অনেকেই প্রতি বাক্যের মধ্যে দু-তিনটা ‘স্যার’ ঢুকিয়ে দেন। মিলিটারিতে নিয়মানুবর্তিতা কঠোরভাবে পালন করা হয়।
ম্যাডাম সম্বোধনটি সবখানে সম্মানজনক অর্থে ব্যবহার করা হলেও কিছু কিছু কালচারে যেসব মহিলা গণিকালয় পরিচালনা করেন তাদেরও তুচ্ছার্থে ম্যাডাম বলা হয়, কিন্তু সম্বোধন আকারে নয়।
ইউরোপ, আমেরিকারসহ প্রায় অর্ধেক পৃথিবী ভ্রমণের সুবাদে একান্ত বিশিষ্ট ব্যক্তি ছাড়া কাউকে স্যার কিংবা ম্যাডাম বলে সম্বোধন করতে শুনিনি। তবে, মিলিটারিতে স্যার বলার প্রথা এখনও রয়ে গেছে। একবার আমেরিকার বাল্টিমোর থেকে লন্ডন ফ্লাইটে পাশের যাত্রী একজন তরুন মিলিটারি অফিসার আমাকে বারবার স্যার বলে সম্বোধন করছিল। সে বৃটেনে আমেরিকান ঘাঁটিতে যোগ দিতে যাচ্ছিল। একান্ত বিশিষ্ট ভিআইপি ছাড়া বিদেশে আমার শোনা ‘স্যার’ সম্বোধন সেটাই প্রথম।
আমেরিকান ইংরেজিতে ম্যাডাম সম্বোধন অভিজাত সমাজের অনুষ্ঠানে ব্যবহার করা হয়। ম্যাম শব্দটি ব্যবহার করা হয় দৈনন্দিন কথাবার্তায।
একবিংশ শতাব্দীতে শুধু আমেরিকা কেন, সব উন্নত দেশেই স্যার কিংবা ম্যাডাম/ম্যাম সম্বোধনের কালচার প্রায় উঠে গেছে। বেশিরভাগ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নামের প্রথম অংশ (first name) ধরেই সম্বোধন করা হয়। সৌজন্যের খাতিরে কখনো বংশ পদবীর আগে Mr. যোগ করা হয়। যেমন, Brown M Smith নামের কাউকে সম্বোধন করা হয় Mr Smith বলে।
পাশ্চাত্য মহিলাদের স্যার বললে রীতিমতো অপমানিত বোধ করেন। ম্যাডাম বললেও স্বস্তি বোধ করেন না। গুগলের একটা পোস্টে কানাডায় প্রবাসিনী একজন লিখেছেন,”আমার প্রবাস জীবনের শুরুর দিকে একবার একজন আমার বিভাগের অধ্যাপিকাকে ‘ম্যাডাম’ বলে সম্বোধন করেছিলাম। তিনি খুব স্পষ্টভাবে বললেন, ‘খুব খুশী হব যদি তুমি আমাকে “ম্যাডাম” না ডেকে “Dr./Professor Last Name” হিসেবে সম্বোধন করো।’
দুনিয়ার কালচার অনেকখানি সাম্যবাদের দিকে এগিয়ে গেছে কিন্তু বাংলাদেশে চুপিসারে মহিলা কর্মকর্তাদের স্যার বলে সম্বোধন করার কালচার কিসের আলামত তা বলার অপেক্ষা রাখে না। গত বছর একজন তার পোস্টে উল্লেখ করেছেন, একজন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে স্যার না বলায় এক ব্যবসায়ীকে লাঠিপেটা করা হয়েছে বলে খবর বেরিয়েছে। অন্য একজনের উদ্ধৃতি দিয়ে লিখেছেন,” স্যার না বলে ভাই বলেছিলাম, আর ভূমি অফিসার দিল মামলা। সে বলে আমি তোমার কোন জনমের ভাই।”
বাস্তবে, “প্রশাসনের কর্মকর্তাদের স্যার বা ম্যাডাম বলে সম্বোধন করার কোনও বাধ্যবাধকতা নেই” বাংলাদেশের জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন এমন এক মন্তব্য করেন বিবিসির সাথে সাক্ষাৎকারে।
কিভাবে স্যার -ম্যাডাম কালচারে ঢুকে পড়েছে, সে সম্পর্কে প্রফেসর মুনতাসির মামুন ব্যাখ্যা দেন, কর্মকর্তাদের ‘স্যার’ বলার সংস্কৃতি শুরু হয়েছে ব্রিটিশ উপনিবেশিক শাসনকালে। মধ্যযুগেও, মোগলদের দীর্ঘকাল ব্যাপী শাসন আমলে জাঁহাপনা, হুজুর, মহারাজা, নবাব, খান বাহাদুর বাহাদুর, রায় বাহাদুর সম্মানসূচক সম্বোধন প্রচলিত ছিল। ব্রিটিশ আমলে, সেসব সম্মানজনক পাশাপাশি শুরু হয় স্যারের যুগ। দেশ বিভাগের পর সে দাপট সমানে চলছে। বাংলাদেশের নতুন মাত্রা লাভ করেছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লোক প্রশাসন বিভাগের প্রফেসর আমিনুজ্জামান তার একটি গবেষণা গ্রন্থে লিখেছেন, “বড় কর্মকর্তারা যখন কোন আদেশ দেন তার জবাবে অধস্তনরা বলেন ‘স্যার’। হ্যাঁ কিংবা না নয়, শুধু এই একটি শব্দ। যদি জিজ্ঞেস করা হয়, আপনি কী কাজটা করেছেন, কেমন আছেন, তারও উত্তর ‘স্যার’। কোন কিছুর হ্যাঁ সূচক উত্তরই হল স্যার।”
লিবারেশনের আগে উচ্চ পদে মহিলা ছিলই না বলা যায়। বছর পঁচিশ আগে আমার এক আত্মীয়া ৮/৯ বছর বয়সের ছেলেকে নিয়ে দেশের বাড়ি থেকে ঢাকায় এসেছিলেন। মায়ের সাথে রিক্সায় যাওয়ার পথে কয়েকজন মহিলা পুলিশ দেখে অবাক হয়ে ছেলে বলে উঠলো, ‘ওমা, ঢাকায় দেখি ছেমড়ি পুলিশ’। এখন তো মাশাল্লাহ সর্বত্রই তাদের সগর্বে পদচারণা। তাঁরা ম্যাডাম সম্বোধনে সন্তুষ্ট নন, স্যার বলতে হবে। দুনিয়া চলছে একদিকে আর আমরা উল্টোদিকে।
ছবি গুগলের সৌজন্যে
সূত্র:
https://www.bbc.com/bengali/news-58476831