September 30, 2023

আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে এবং বিনিয়োগ মাধ্যমে হিসাবে আমেরিকান ডলার সব চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কারেন্সি। বাণিজ্যিক এবং অন্যান্য লেনদেন নিষ্পত্তির জন্য দুনিয়াব্যাপী আমেরিকান ডলারের আকাশচুম্বী চাহিদা।

ইউরো এবং জাপানি ইয়েনও গুরুত্বপূর্ণ কারেন্সি কিন্তু আমেরিকান ডলারের ধারে কাছেও আসতে পারেনি।

মার্কিন ডলারের গুরুত্বের কারণে দুনিয়ার সব সেন্ট্রাল ব্যাংক সে কারেন্সিতে তাদের সিংহভাগ রিজার্ভ, প্রায় ৬০% সংরক্ষণ করে। অনেক পিছনে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের অভিন্ন কারেন্সি ইউরো। সে কারেন্সিতে সংরক্ষিত রিজার্ভের পরিমাণ ২০%।

ইউরো একটা গুরুত্বপূর্ণ কারেন্সি হওয়ার সম্ভাবনা ছিল কিন্তু ইউরো জোনে বারবার সংকট দেখা দেওয়ার কারণে সে সম্ভাবনা ক্ষীণ হয়ে গেছে। চিনও একটি গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক শক্তি। তাদের কারেন্সি ইয়ুয়ান গ্লোবাল কারেন্সির মর্যাদা লাভের সুযোগ ছিল কিন্তু চীন সরকার সে দায়িত্ব নিতে প্রস্তুত নয়।

আমেরিকান ডলারের গুরুত্বের অন্যতম কারণ সে দেশের শক্তিশালী অর্থনীতি। ২০২০ সালে আমেরিকার অর্থনীতির অনুমিত আকার প্রায় ২২ ট্রিলিয়ন ডলার। দুনিয়ার প্রায় এক চতুর্থাংশ উৎপাদনের সমপরিমাণ। তাদের প্রাকৃতিক সম্পদ, উন্নত অবকাঠামো এবং অত্যাধুনিক প্রযুক্তির কারণে তারা অর্থনৈতিক পরাশক্তিতে পরিণত হয়েছে।

প্রায় ১৬৭০ বিলিয়ান আমেরিকান ডলার কারেন্সি নোট সার্কুলেশনের রয়েছে। তার অর্ধেকই বিভিন্ন দেশে। অনেক দেশে নিজস্ব কারেন্সি নাই। তারা আমেরিকান ডলার দিয়ে কাজ চালিয়ে নেয়। পূর্ব ইউরোপ ও ল্যাটিন আমেরিকায় দৈনন্দিন লেনদেনের জন্যও মার্কিন ডলার ব্যবহার করা হয়। কম্বোডিয়ার কথা জানি, সে দেশে নিজস্ব কারেন্সির পাশাপাশি মার্কিন ডলারে লেনদেন করা হয়। অল্প কিছুদিন আগে জিম্বাবুয়ের আকাশছোঁয়া মুদ্রাস্ফীতি সামাল দিতে ডলারকে লেনদেনের মাধ্যম হিসাবে ব্যবহার করেছিল।

এর এক অর্থ শুধু কাগজের টাকা ছাপিয়ে মার্কিনরা বিদেশের থেকে তাদের চাহিদা অনুযায়ী কিছু পরিমাণ সেবা ও পণ্য সামগ্রী কিনতে পারে। বলাবাহুল্য, শক্তিশালী দেশের শক্তিশালী কারেন্সি থাকলে অনেক সুবিধাজনক অবস্থানে থাকা যায়। জ্বালানি তেলের মূল্য বেড়ে গেলে আমদানিকৃত তেলের ব্যয় বেড়ে যায় কিন্তু মার্কিন ডলারের বিনিময় হারের কোন ‌বিরূপ প্রভাব পড়ে না। কারণ শেষমেষ তেলের মূল্য বাবদ যে অর্থ পাওয়া যায় তার বেশির ভাগই মার্কিন ডলারে জমা হয়। যাকে বলা হয় পেট্রোডলার। অর্থনৈতিক সংকটের সময় অন্যান্য কারেন্সি মার্কিন ডলার কনভার্ট করার হিড়িক পড়ে যায়।

সারা দুনিয়ায় প্রায় ১৮৫টি কারেন্সি চালু আছে। তার বেশির ভাগই অভ্যন্তরীণ লেনদেনের জন্য ব্যবহার করা হয়। ইউরোসহ উন্নত বিশ্বের অধিকাংশের দেশগুলোর কারেন্সি অবাধে রূপান্তরযোগ্য অর্থাৎ কনভার্টিবল কারেন্সি। সবচেয়ে শীর্ষে রয়েছে মার্কিন ডলার। আন্তর্জাতিক লেনদেনের ক্ষেত্রে মার্কিন ডলারের ভূমিকা ৯০%। যেমন, বাংলাদেশ থেকে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে তৈরি পোশাক রপ্তানি হয়। সে সব দেশের কারেন্সির পরিবর্তে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে আমেরিকান ডলারে মূল্য পরিশোধের জন্য লেটার অব ক্রেডিট খোলা হয়। আমেরিকান ডলারের প্রতি আস্থা এর প্রধান কারণ।

পৃথিবী ব্যাপী ধার-দেনার বেশির ভাগই সংঘটিত হয় মার্কিন ডলারে। ২০০৮ সালে বিশ্বব্যাপী ফাইনান্সিয়াল সংকটের সময় আমেরিকার বাইরের দেশগুলির ব্যাংকের দেনার পরিমান ছিল ২৭ বিলিয়ন ডলার তার মধ্যে একমাত্র আমেরিকান ডলারের পরিমাণ ছিল ১৮ বিলিয়ন ডলার। দেশের বাইরে আমেরিকান ডলারে যে সব ধার দেনা হয় তার একটা আলাদা নাম আছে ইউরো ডলার।

বিনিয়োগের এত প্রশস্ত উৎস আমেরিকার মতো আর কোথাও নেই। আমেরিকান গভর্নমেন্ট দেশে বিদেশে তাদের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনার জন্য প্রচুর অর্থের প্রয়োজন। সে অর্থ ট্যাক্স হিসেবে আদায় করা সম্ভব হয়ে ওঠে না। ঘাটতি পূরণের জন্য ধারদেনা করতে হয়। এ জন্য ইস্যু করা হয় ট্রেজারি বিল এবং অন্যান্য বিনিয়োগ মাধ্যম। বলতে গেলে তাদের অর্থের ক্ষুধা সীমাহীন। মহাশূন্যের ব্ল্যাক হোলের সাথে তুলনা করা যায়। সে কৃষ্ণগহ্বর শোষণ করে নেয় দুনিয়ার সেন্ট্রাল ব্যাঙ্ক অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ফরেন এক্সচেঞ্জ রিজার্ভ ও ব্যালেন্স।

চীন ও জাপান বিশাল অংকের ফরেন এক্সচেঞ্জ রিজার্ভ রয়েছে আমেরিকান ডলারে এ সব ট্রেজারি বিল ও অন্যান্য মাধ্যমে বিনিয়োগ করে। চীন দেশের প্রায় তিন ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার আমেরিকায় বিনিয়োগ করা হয়েছে। জাপানের এক ট্রিলিয়ন ডলার। এতো বিশাল অংকের রিজার্ভ আর কোথায়ই বা রাখবে? কোন দেশেরই বা এত চাহিদা আছে?

সুইজারল্যান্ডের মত অনেক শক্তিশালী দেশ তাদের কারেন্সিতে ব্যালেন্স গড়ে তুলতে নিরুৎসাহিত করে থাকে। কারণ তাদের মনিটারি পলিসি বাস্তবায়ন ব্যাহত হতে পারে। ৭০ দশকে বিশ্বব্যাপী ফরেন এক্সচেঞ্জ মার্কেটে সংকটের কারণে বিদেশি ব্যাংকগুলো সুইস ফ্রাঙ্কের প্রতি ঝুঁকে পড়লে সে দেশের ব্যাংকগুলো জমাকৃত ফ্রাঙ্কের উপর সুদ ত দিতই না বরং বাড়তি চার্জ বা নেগেটিভ ইন্টারেস্ট আদায় করে নিত।

About Post Author

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Pin It on Pinterest