October 30, 2025

পৃথিবীতে বেশ কিছু অঞ্চলের প্রতারকরা প্রতিনিয়ত নয়া নয়া কৌশলে অসতর্ক লোভী মানুষদের ধোকা দিয়ে কোটি কোটি ডলার হাতিয়ে নিচ্ছে। এসব স্বপ্নের ব্যাপারীদের পাল্লায় পড়ে কতজন যে সর্বস্বান্ত হয়েছে তার হিসাব নিকাশ নাই। তাদের মধ্যে চ্যাম্পিয়নদের তালিকায় রয়েছে আফ্রিকা মহাদেশের নাইজেরিয়ার প্রতারক সিন্ডিকেট। বাংলাদেশেও তাদের ব্যাপক আনাগোনা।  

প্রতারকরা ভুয়া এটিএম কার্ড বানিয়ে এটিএম মেশিন থেকে টাকা চুরি করার অভিনব পন্থা আবিস্কার করেছে।‌ সাদা কাগজ ঢুকিয়ে দিলে আসল ডলার-পাউন্ড বেরিয়ে আসবে দাবি করে মেশিন বিক্রি করে। তাদের বাকচাতুর্যে এবং ভুয়া ‌ডেমনস্ট্রেশন‌ দেখে ‌ অনেকেই লাখ লাখ ডলার তাদের হাতে গছিয়ে দেয়। 

জাল কারেন্সি নোট এবং ভুয়া ক্রেডিট কার্ড ‌ তাদের নিত্যদিনের ব্যবসার অমোঘ অস্ত্র।

কখনো কখনো  ইমেইল এবং ফেসবুক আইডি সংগ্রহ করে আপনার পরিচিত বন্ধু সেজে ই-মেল-এ অথবা মেসেজে আকুল আবেদন জানায় যে তিনি কোন বিদেশী এয়ারপোর্টে টাকাপয়সা, ক্রেডিট কার্ড ‌ হারিয়ে আটকা পড়ে আছেন। এ দুর্যোগের মুহূর্তে তাকে রক্ষা করতে হলে‌ ধার হিসেবে ৫০০ ডলার পাঠিয়ে দিলে চির কৃতজ্ঞ থাকবে। একদন্ত ইমেইল পাঠিয়ে বলল সে ইয়েমেনের হুতী বিদ্রোহীদের হাতে আটকা পড়ে আছে। চার হাজার ডলার মুক্তিপণ দিলে ছেড়ে দিবে।

আমি নিজেও দুই-একটা অনুরোধ পেয়েছিলাম। একবার মনে করেছিলাম, আহারে বেচারা, সত্যিই হয়তো আটকা পড়ে আছেন। পরে দেখলাম, মেসেজটি এসেছে নাইজেরিয়ার বাটপারদের‌‌ কোন এক শহর  থেকে।

যদি ভেবে থাকেন যে বোকাসোকা লোকজনই হয়তো তাদের ফাঁদে পা দেয়, তাহলে খোদা আপনার মঙ্গল করুন। মাথাভরা বুদ্ধি ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, সরকারি বেসরকারি কর্মকর্তা, নামকরা ব্যবসায়ী, ঘরের গৃহিণী প্রতারকদের ফাঁদে পড়ে মাথার চুল ছিড়তে থাকে, কিন্তু প্রকাশ করে না। লোকলজ্জার ভয়ে তারা পুরো ব্যাপারটা চেপে যায়।  

প্রতারকদের কর্মকাণ্ড নিউজিল্যান্ড থেকে কানাডা পর্যন্ত বিস্তৃত। প্রতি যতবছর তারা কোটি কোটি ডলার হাতিয়ে নেয়। উন্নত বিশ্বের লোকজন নিজেদেরকে অত্যন্ত বুদ্ধিমান মনে করলেও নাইজেরিয়ানদের ফাঁদ থেকে তারা রক্ষা পায় নাই।

Tech News এর Madhuria chowdhary প্রণীত তালিকায় যে কয়টি দেশের নাম শীর্ষস্থানে রয়েছে তার মধ্যে রয়েছে নাইজেরিয়া, ফিলিপাইনস, ভেনিজুয়েলা, চীন, ব্রাজিল, ইন্দোনেশিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা।ল

https://www.analyticsinsight.net/top-10-scamming-countries-in-the-world-in-2021/

ব্যাংকিং প্রফেশনের সাথে জড়িত বলে এ ধরনের টোপ পেলে অনেকেই চুপিচুপি আমার কাছে বুদ্ধি পরামর্শের জন্য আসেন। তাদের চোখেমুখে দেখতে পাই অনাগত দিনের প্রাচুর্যময় জীবনের স্বপ্ন, মুখে একটুখানি ব্রীড়ার আভাস, চোখেমুখে সোনার খনি আবিষ্কারের আনন্দের ঝিলিক। তাদের গল্প না হয় আরেকদিন করা যাবে।

আমি নিরাশার কথা শুনালে অনেকেই ভেবে বসেন আমি হয়তো তাদের বিশাল সম্পদশালী হওয়ার পথে ঈর্ষান্বিত হয়ে বাঁধার সৃষ্টি করছি।  মানুষের বিচিত্র চিন্তাধারার কুল কিনারা পাওয়া বড় মুশকিল। সারা জীবনের বিশ্বাসেও চিড় ধরে।

আমার এ ছোট্ট গল্পটি ফেসবুকের সখা এবং তাদের মাধ্যমে আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধু বান্ধবদের সাবধান করে দেওয়ার জন্য লেখা। অনেক ধরনের গল্প আছে। তবে, আজ নাইজেরিয়ার প্রতারকদের সুপরিচিত নাটকীয় কৌশলের একটি গল্প শোনানো যাক।

প্রতারকরা প্রথমেই আপনার কাছে একটা ই-মেইল অথবা চিঠি পাঠায়। যারা টোপ গিলে তাদের নিয়ে খেলা শুরু করে। ‌ আমি তাদের কর্মকান্ড সম্পর্কে কাগজে উপসম্পাদকীয় প্রবন্ধ লিখেছি কিন্তু কে শোনে কার কথা? প্রতিনিয়ত মানুষ টাকা পয়সা হারাইছে নিরবে গুমরে মরছে।

শেষমেষ পড়বি ত‌ পড় মালীর ঘাড়ে‌। আমার কাছেই এ ধরনের একটা চিঠি এসে হাজির। তাদের কলাকৌশল জানতে এবং মজা করার জন্য টোপ গেলার ভান করলাম। টেলিফোনে কথোপকথনের নমুনা শুনুন।

প্রতারক: গুড মর্ণিং, মিস্টার আলী। আমার নাম দাবু মোহাম্মদ। আপনি আমাদের প্রস্তাবে সাড়া দিয়েছেন দেখে যারপরনাই আনন্দিত। 

আমি: কি যে বলেন দাবু মোহাম্মদ, খুশি তো আমার হওয়ার কথা। ‌

দাবু: আমাকে শুধুমাত্র দাবু নামে ডাকলে খুশি হব। আমরা তো এখন বন্ধু হতে চলেছি, তাই না? তোমাকেও আমি সৈয়দ বলে ডাকবো। ‌ বন্ধুদের মাঝে এত আনুষ্ঠিকতা থাকা ভালো না।

আমি: ঠিক আছে দাবু, তবে তাই হোক। আমি শুনেছি নাইজেরিয়ার লোকজন খুবই পরোপকারী। মানুষকে রাতারাতি কোটিপতি বানিয়ে দেয়। (বাবু সম্ভবত প্রতারণা বিষয়ে শিক্ষানবিশী করছে। আমার রসিকতাটার মর্ম অনুধাবন করতে পারলো না)।

দাবু: তুমি ঠিকই বলেছ। পরস্পরকে সাহায্য করাই মানব ধর্মের অন্যতম বৈশিষ্ট্য।

আমি: ওকে দাবু, এবার কাজের কথায় আসা যাক। তোমার প্রস্তাবটা আরেকটু ঝালাই করবে কি? আমি বিষয়টা ভালোভাবে বুঝতে চাই।

দাবু; ওকে দোস্ত, আমাদের কোম্পানি তোমার কাছে ৬০ মিলিয়ন ডলার গচ্ছিত রাখতে চায়। নিশ্চয় বুঝতে পারছ আমেরিকান ডলারের কথা বলছি।

আমি: (ইচ্ছে করে বোকার ভান করে বললাম), ডলারের অংকটা লেখতে ৬০ এর পর কয়টা শূন্য লিখতে হবে?

দাবু: কেনরে ভাই তুমি আমার সাথে রসিকতা করছো? আমরা জানি তুমি অনেক টাকার মালিক। তবুও বলছি, ৬০ মিলিয়ন লিখতে ৬০ এরপর আরো ছয়টা 0 লাগাতে হবে।

আমি: ওহ মাই গড! এত্ত টাকা? আমি আমার জীবনে এক মিলিয়ন ডলারও দেখি নাই। কিন্তু আমি ভাবছি আমার কাছে কেন তোমরা এত টাকা রাখতে চাও? তোমরা এত টাকাই বা কোথায় পেলে?

দাবু: আমরা এখন বন্ধুত্বের বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছি, তাই তোমার কাছে স্বীকার করতে দ্বিধা নেই, টাকাটা আমরা পেয়েছি একটা সরকারি প্রজেক্টের বিদেশি কনট্রাক্টরদের কাছ থেকে কিকব্যাক হিসাবে। সোজা কথা, আমরা তাদের প্রজেক্টের কাজটা পাইয়ে দিয়েছি, তারা আমাদের ঘুষ দিয়েছে।

আমি: এত টাকা গচ্ছিত রেখে আমার প্রতি আস্থা রাখার জন্য তোমাদের অনেক  ধন্যবাদ। তবে, জানতে কৌতুহল হচ্ছে আমার নাম তোমরা কোথা থেকে জোগাড় করলে, গাবু ভাই? 

দাবু: গাবু না, দাবু। গাবু আমার ছোট ভাইয়ের নাম। 

আমি: সরি দাবু। তোমার ভাই গাবুও কি তোমাদের পার্টনার?

দাবু: না সে একটা অন্য ধরনের ব্যবসার সাথে জড়িত। সময়মতো তা জানতে পারবে। আর হ্যাঁ, আমরা তোমার সম্পর্কে তথ্য পেয়েছি তোমাদের চেম্বার অব কমার্স থেকে। (ডাহা মিথ্যা কথা। আমি চেম্বারের সদস্য নই)।

আমি: আমি ভাবছি, তোমরা ইউরোপ আমেরিকায় রাখছো না কেন? সুইজারল্যান্ডে ত কাস্টমারের গোপনীয়তা রক্ষা করার ব্যাপারে খুব নাম ডাক আছে।

দাবু: ইউরোপ-আমেরিকায় টাকা-পয়সা জমা রাখা এখন ঝুঁকির ব্যাপার। তারা মানিলন্ডারিং নিয়ে বড্ড তালবাহানা করে। সে কারণে আমরা টাকা পয়সা তৃতীয় বিশ্বের কোন দেশে রাখার চিন্তা করছি। কেউ সন্দেহ করবে না।

আমি: তুমি তো দেখছি দুনিয়ার হালচাল ভালোই বোঝো। যা হোক, তোমাদের টাকা হেফাজত রাখার জন্য আমার কমিশন কত হবে?

দাবু: আমাদের কোম্পানি গচ্ছিত টাকার ১০% কমিশন দেয়ার ব্যবস্থা রেখেছে।  

আমি: ঠিক আছে লাবু, সে‌ হিসেবে আমি কি পরিমান ডলার পাব। অংক-টংক আমার মাথায় তেমন আসে না। ‌

দাবু: এত সোজা অংক তুমি বুঝছো না তা আমাকে বিশ্বাস করতে বল? যাহোক, ৬০ মিলিয়ন থেকে একটা শুন্য সরিয়ে ফেললে থাকে ৬ মিলিয়ন ডলার। এতো সোজা অংক, ক্লাস থ্রিতে পড়ছি।

আমি: ও মাই গড! আমার মাথা চক্কর দিচ্ছে। একটুখানি সুস্থির হয়ে তোমাকে জবাব দিচ্ছি। (কিছু বিরতির পর)।‌ আমি কবুল, কিন্তু কি করে বুঝবো তোমাদের স্টেট ব্যাংক সে বাবদ ফরেন এক্সচেঞ্জ রিলিজ করবে?

দাবু: ওকে, আমি নাইজেরিয়ার স্টেট ব্যাংকের সাথে যোগাযোগ করছি। সে ব্যাংকের গভর্ণর তোমাকে সরাসরি একটা ইমেইল পাঠাবেন। (ডাহা ধাপ্পাবাজি!)।

আমি: ধন্যবাদ দাবু, তোমরা এত ভালো কেন? আমি ৬ মিলিয়ন ডলার হাত দিয়ে ছুয়ে দেখার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছি। এক জমানায় টিভি সিরিয়াল সিক্স মিলিয়ন ডলার ম্যান দেখার ভক্ত ছিলাম। ‌ ভাবতেই ভালো লাগছে, আমি নিজেই সিক্স মিলিয়ন ডলার ম্যান হতে যাচ্ছি।

দাবু: ওকে, সৈয়দ তোমার আশা পূর্ণ হবে। ‌ এটুকুই যদি না করতে পারলাম তাহলে বন্ধুত্বের দাম কি?

সপ্তাহখানেক পরে, গভর্নরের তরফ থেকে একটা ইমেল পাওয়া গেল।‌ তাতে তিনি আশ্বস্ত করেছেন যে কথিত ৬০ মিলিয়ন ডলার বাংলাদেশে ট্রান্সফারের জন্য তিনি অনুমোদন দিয়েছেন। বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়, ইমেইল, গভর্নরের টেলিফোন নাম্বার সবই ভুয়া। সে টেলিফোনে যোগাযোগ করলে তাদের কেউ একজন গভর্নরের পরিচয় দিয়ে অনুমোদনের বিষয়টির সত্যতা স্বীকার করবে‌। ছ

পরের দিন প্রতারকের টেলিফোন পাওয়া গেল।

দাবু: গুড মর্নিং, কেমন আছো বন্ধু? তুমি নিশ্চয়ই আমাদের স্টেট ব্যাংক থেকে বার্তা পেয়েছো, তারা ফান্ড ট্রান্সফারের অনুমোদন দিয়েছে।

আমি: হ্যাঁ, হ্যাঁ আমি ইমেইল পেয়েছি। তাইতো আনন্দের সাগরে ভাসছি। আমার স্ত্রীও আমি টাকাটা কিভাবে খরচ করব, কোথায় বিনিয়োগ করব সে চিন্তা ভাবনায় মশগুল আছি। ‌ দু’জনের মাঝে মতবিরোধ এবং এক পশলা ঝগড়াঝাঁটিও হয়ে গেছে। চিরচারিত ‘ব্যাটেল অফ দা সেক্সেস’ বলতে পারো।

দাবু: তোমাকে শীঘ্রই জানাবো। এখন তুমি আমাকে তোমার ব্যাংকের নাম এবং অ্যাকাউন্ট নাম্বার জানাও।

আমি: ওকে মাই ফ্রেন্ড, আমার একাউন্টের নাম…….. এবং একাউন্ট নাম্বার…..……।

পরের দিন দাবুর ফোন পাওয়া গেলো। ধীরে ধীরে সে বল গোলপোস্টের কাছে নিয়ে এসেছে। এবার গোলে ঢুকানোর পর্ব শুরু হয়ে গেছে।

দাবু: এ প্রান্তে দাবু বলছি আবার। শুনে খুশি হবে ফান্ড ট্রান্সফারের সব ব্যবস্থা পাকাপাকি  হয়ে গেছে। তবে, সামান্য একটু সমস্যা দেখা দিয়েছে। এ বাবদ স্টেট ব্যাংকের গভর্নরকে ৫ হাজার ডলার ঘুষ দিতে হবে। দুর্নীতিবাজ লোক, বুঝতেই তো পারছো। এত সব দুর্নীতি দেখলে ঘেন্না ধরে যায়।

আমি: তুমি সামান্য এ কয়টি ডলারের জন্য উতলা হচ্ছ কেন? আমার ৬ মিলিয়ন ডলার কমিশনের থেকে কেটে রাখতে পারো।

দাবু: হায়রে বন্ধু, তোমাকে কি করে বোঝাবো, নিজেদের তহবিল থেকে সরকারি কর্মকর্তাদের ঘুষ দেওয়া আমাদের কোম্পানির রীতির বিরুদ্ধে। অডিটর আপত্তি তুলবে।

আমি: শুনে আশ্বস্ত হলাম, তোমাদের একজন অডিটরও আছে। তোমার সাথে যতই কথা বলছি ততই অবাক হচ্ছি। তোমরা যে ৬০ মিলিয়ন ডলার অবৈধ উপায়ে অর্জন করে লুকোতে যাচ্ছ তাতে অডিটর আপত্তি তুলবে না?

দাবু: তা নিয়ে তোমাকে চিন্তা করতে হবে না। অডিটরকে সামলানোর উপায় আমাদের জানা আছে। টাকা ঢাললে সব ব্যাটাই হা করে। এটাই দুনিয়ার রীতি।

আমি: তোমাকে অশেষ ধন্যবাদ দাবু, তোমার সাথে পরিচিত হতে পেরে ধন্য হলাম। তবে, তোমার সাথে দেন-দরবার এখানে শেষ করছি। তোমাদের লুটের মাল ৬০ মিলিয়ন ডলার কোথায় রাখবে তা নিয়ে আমার মাথাব্যথা নেই।

দাবু: শোনো, বন্ধু শোনো, প্লিজ টেলিফোন রেখে দিও না। আমার কথা শোনো।

আমি: তোমার কথা কি শুনব বেকুব, তুমি একটা ধরণীর কীট। আমি টয়লেটে যাব। তোমার ৬ মিলিয়ন ডলারের থেকে সেটাই আমার কাছে বেশি জরুরী।

About Post Author

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Pin It on Pinterest