October 30, 2025

পশ্চিম বাংলাসহ বাংলাদেশের মত সুস্বাদু শাক-সবজি এবং মাছ মাংসের সন্ধান কোথাও মেলেনি। শুধু ইউরোপ আমেরিকা নয়, বাংলাদেশ থেকে যতই পশ্চিমে যাবেন শাকসবজি মাছ-মাংসের দাম যতই বাড়তে থাকে স্বাদ ততই কমতে থাকে। প্রধান কারণ, বাংলাদেশে জলবায়ু এবং সবুজের সমারোহ। দ্বিতীয় কারণ, এখানে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে প্রাকৃতিক নিয়মে চাষবাস করা হয়। সারের ব্যবহার ততটা নয়। জেনেটিক্যালি মডিফিকেশন প্রযুক্তি এখনো আসেনি।

ঢাকার অলিতে গলিতে প্রতিদিন সকালে যে লাখখানেক ভ্যান গাড়ি সদ্য জমি থেকে তোলা শাকসবজি নিয়ে বের হয় তা দেখলে মন ভরে যায়। আমেরিকা-ইউরোপের শপিংমল, সুপার মার্কেট এবং গ্রোসারি স্টোরে সাজিয়ে গুছিয়ে লেবেল লাগিয়ে রাখা বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে উৎপাদিত এবং কোল্ডস্টোরেজে সংরক্ষিত শাকসবজি দেখতে অভিজাত মনে হলেও স্বাদহীন, কিন্তু মুল্য বহুগুণ। বাংলাদেশের পিয়াজ, রসুন, মরিচ দেখতে ছোট কিন্তু তাতে বিদেশ থেকে আমদানি করা ডাঙ্গর সাইজের তুলনায় অনেক বেশি ঝাঁজ।

বছর কয়েক আগে আমার এক আত্মীয় সুইডেনের স্টকহোমে শপিং মল থেকে বাংলা টাকা হিসাবে ৬০ টাকা দিয়ে একটা শুকনো বেগুন কিনে মহা খুশি। বলল, রান্না না করে কয়েক দিন নাকে শুকে দেশের গফরগাঁওয়ের বেগুনের কথা মনে করবে। সেখানে গিয়েছিল পড়াশোনা করতে; টাকা পয়সার টানাটানি। তাই ঘ্রাণে অর্ধভোজন পদ্ধতির আশ্রয়। ‌সে দেশে বেগুনের বাহারি নাম অবারজিন, ইতালি আমেরিকায় এগ প্লান্ট। নামেই শুধু বাহার।

তাছাড়া, আমাদের দেশের মত নানা রকম মসালা ব্যবহার করে স্বাদ বাড়ানোর ধৈর্য এবং সময় কোথায়। আমেরিকায় স্টেটভেদে সর্বনিম্ন মজুরি ঘন্টায় গড়ে প্রায় ১০ ডলার। ৮ ঘন্টা কাজ করে দিন শেষে দিতে হয় ৮০ ডলার, টাকার হিসাব ছয় হাজার টাকারও বেশি। তাই খাবার তৈরীর ক্ষেত্রে শর্টকাট পন্থা।

আমাদের পদ্মার ইলিশ এবং বোম্বাই করাচিতে যে ইলিশ পাওয়া যায় তা স্বাদে গন্ধে আকাশ পাতাল পার্থক্য। চেহারা সুরতে আমাদের ইলিশের চেয়ে কিছু কম নয় কিন্তু ঘাসের মত স্বাদহীন। তাদের ইলিশের নাম পাল্লা হলেও আমাদের ইলিশের সাথে পাল্লা দেওয়ার ক্ষমতা নেই।

শাক-সবজি মাংসের ক্ষেত্রে একই কথা। ছাগল সম্প্রদায়ের মধ্যে পৃথিবীতে সবচেয়ে সেরা কুষ্টিয়ার ব্ল্যাক বেঙ্গল গোট। পাকিস্তান আমলে যারা এদেশে কাটিয়ে গিয়েছে তারা বাংলাদেশে এলে হন্যে হয়ে তার খোঁজ করে বেড়ায়।

রসনা তৃপ্তির জন্য তুরস্কের খাবারের সুনাম আছে। তাদের বিভিন্ন কিসিমের কাবাব দেশ-বিদেশের রেস্টুরেন্টের মেনুতে পাওয়া যায়। তুর্কি মোঘলরা সে রেসিপি উপমহাদেশে এনে স্থানীয় মালমশলা সহযোগে আরো বেশি উপাদেয় করেছে। কিন্তু সে দেশে শাকসবজি মাছ তরিতরকারি তেমন পাওয়া যায় না; পেলেও সুস্বাদু নয়। আমাদের দেশে হিন্দু বিধবা মহিলারা যে নিরামিষ ডিশ তৈরি করে, সৈয়দ মুজতবা আলীর ভাষায় তা তুলনাহীন। স্বর্গের মেনুতে সরষে বাটা ইলিশ মাছের উল্লেখ নাই বলে তিনি সেখানে যাবার আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছেন বলেও লিখেছেন।

ইটালি পিজ্জা আবিষ্কার করেছে কিন্তু রোমে তা‌ খেয়ে হতাশ হতে হয়েছে। আমাদের রুচির সাথে সামঞ্জস্য রেখে দেশে তৈরি পিজ্জা বরং বেশি সুস্বাদু মনে হয়।

ইউরোপে, বিশেষ করে লন্ডনে, যে সমস্ত কারি শপের সামনে ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্ট বলে নাম ফলকে লেখা থাকে তার বেশির ভাগই পরিচালনা করে সিলেট অঞ্চলের লোকজন। রন্ধনশিল্পের সে দেশে তারা প্রচুর মেডেল প্রশংসা কুড়িয়েছে। রাজকীয় প্রাসাদে ও তাদের ডাক পড়ে। ২০১৫ সালে সিলেটি কন্যা নাদিয়া হোসেন ব্রিটিশ টেলিভিশনের ‘বেক অফ’ কম্পিটিশনে সারা বৃটেনের মধ্যে চ্যাম্পিয়ন হয় তাদেরই শিখিয়েছে কি করে তাদের দেশেরই জনপ্রিয় স্নাক কেক তৈরি করতে হয়। রানীর জন্মদিনের কেক তৈরি করার জন্যও তার ডাক পড়ে।

ব্রিটেনে সিলেটের লোকজন রন্ধনশিল্পে যেমন দক্ষ তেমনি রেস্টুরেন্ট ব্যবসা পরিচালনার ক্ষেত্রে অত্যন্ত প্রফেশনাল। চাহিদা মোতাবেক ডিশ তৈরি, সাজানো-গোছানো এবং ডেকোরেশনে পিছিয়ে থাকে না। তারা বাংলাদেশ থেকে বেশিরভাগ শাকসবজি মাছ মাংস আমদানি করে খাদ্যসমগ্রী আকর্ষণীয় করে তোলে। ইউরোপের অন্যান্য শহরেও তাদের তৈরি খাবারের জনপ্রিয়তা রয়েছে। তাদের তুলনায় লন্ডনের স্থানীয় রেস্টুরেন্টের খাবার ব্লান্ড। উপায়ন্তর না দেখে ফিশ এন্ড চিপস খেয়ে বের হয়ে আসতে হয়। আইটেমটা মন্দ নয়। সস লাগিয়ে খেতে বেশ ভালোই লাগে।

আমেরিকার অবস্থা আলাদা। জ্যাকসন হাইটস‌ এবং আশেপাশের এলাকায় দেশীয় উপকরণ দিয়ে তৈরি খাদ্য সামগ্রীতে অনেকটা দেশের খাবার স্বাদ পাওয়া গেলেও ম্যানহাটন এলাকার পরিস্থিতি ভিন্ন। সেখানে রান্নাবান্নার কাজ করে বেশির ভাগই দেশ থেকে আয় রোজগারের সন্ধানে কিংবা পড়তে যাওয়া ছেলেপেলে। কোন রকম রান্না শিখে কাজে লেগে যায়। পড়াশোনা শেষ হলে কিংবা ভালো চাকরি পেলে অন্যত্র চলে যায়। ম্যানহাটন এলাকায় সম্ভবত তিন নম্বর এভিনিউয়ের লাগোয়া একটা স্ট্রিটে অনেকগুলো বাংলাদেশী পরিচালিত রেস্টুরেন্ট লাইন ধরে নিউইয়র্কবাসির রসনা তৃপ্তি যোগায়। বেশির ভাগই সাদা ও কালো কাস্টমার।

এরকম একটা রেস্টুরেন্টে খাবার সুযোগ হয়েছিল। দেশ থেকে এসেছি বলে তাদের আদর-আপ্যায়ন অভিভূত কিন্তু খাবারের মান ততটা ভালো নয়। শুনলাম সেটাই নাকি ম্যানহাটন এলাকায় বাংলা খাবারের সব চাইতে ভালো রেস্টুরেন্ট। রেস্টুরেন্টে কয়েকজন মেডিকেল স্টুডেন্ট, দেশ থেকে ডিগ্রী নিয়ে গিয়েছে কিন্তু নতুন করে আবার পড়াশোনা করে আমেরিকায় ডাক্তারি করার সুযোগ পাবে। তার আগে রেস্টুরেন্টে হাত পুড়িয়ে রান্নাবান্নার তালিম নেওয়া আর কি।

বলতে দ্বিধা নেই, প্রথম প্রথম সিঙ্গাপুর ব্যাংককে স্থানীয় খাবার খেয়ে খুব ভাল লেগেছিল। পরে জানতে পারলাম এসব খাবার বিচিত্র সব পশুর চর্বি দিয়ে তৈরি করা হয়। সেই থেকে সেসব খাবার বাতিল।

চীন দেশে যাওয়া হয়নি তবে শুনেছি সেদেশে খানদানি চীনা খাবার আমাদের রুচির সাথে মিলে না। আমাদের দেশে যে চীনা খাবার পাওয়া যায় আসল চাইনিজ থেকে আলাদা। কোরিয়া, ফিলিপাইনে ত সারমেয় প্রাণীর মাংস খুবই জন প্রিয়। শুনলেই গা ঘিনঘিন করে।

মায়ের হাতে রান্না খাবারের সাথে আর কোন খাবারের তুলনা হয় না। ‌ প্রায়ই এরকম একটা মন্তব্য শুনেছিলাম বাংলাদেশে আসা এক জাপানি কর্মকর্তার কাছে। নানা দেশের খাবারের কথা আলোচনার পর তিনি উপসংহার টানলেন, ‘দিন শেষে আমার গিন্নির হাতের রান্না খাবার সব চাইতে ভালো’। আমাদেরও নিজেদের দেশের খাবারের প্রতি পক্ষপাতিত্বমূলক মনোভাব আছে।

অল্প বেতনের চাকুরীতে টাকা পয়সার টানাটানি থাকলেও চাকুরির সুবাদে কিংবা সেমিনার ওয়ার্কশপে যোগ দিতে গোটা চল্লিশেক দেশের খাবারের স্বাদ গ্রহণ করার সুযোগ পেয়েছি। পরের ধনে পোদ্দারি বলা যায়। বিদেশে যতই দামি দামি খাবার খাওয়া হোক না কেন, দু’দিন বাদে দেশের অতি সাধারণ খাবারের কথা মনে পড়ে।

অতিরঞ্জন না হলে গল্প জমে না। আমার লেখায়ও অতিরঞ্জন আছে। তবে, সৈয়দ মুজতবা আলীর অতিরঞ্জনের কাছে আমার লেখাটা নেহায়েৎ পানসে। রসোত্তীর্ণ সাহিত্যের ক্ষেত্রে তাঁর সাথে অন্য কারো তুলনা হয় না। সুসাহিত্যিক শঙ্করের কথায় রস সাহিত্যের ক্ষেত্রে তাঁর মত কেউ অতীতে ছিলেন না, ভবিষ্যতেও হবেন না। পঞ্চতন্ত্রে তার ‘আহারাদি’, বিশেষ করে রসগোল্লা নিয়ে অন্য একটা গল্পে অতিরঞ্জনের যে মুন্সিয়ানা দেখিয়েছেন তা আমাদের মত অর্ধশিক্ষিত লোকের পক্ষে অনুকরণ বা অনুসরণ সম্ভব নয়।সরষে বাটা ইলিশ মাছের কথা তাঁর একাধিক গল্পে উল্লেখ রয়েছে। আমার লেখাটায়ও তার থেকে ধার করা কিছু মাল মশলা সংযোজন করেছি। ওইটুকুই যা। তাঁকে অনুসরণ করার মত এলেম নাই।

About Post Author

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Pin It on Pinterest