অবিশ্বাস্য মনে হতে পারে কিন্তু আজ থেকে ১০ হাজার বছর আগে জলবায়ুর পরিবর্তনের কারণে সাহারা অঞ্চলে প্রচুর বৃষ্টিপাত হতে থাকে। সবখানেই পানির থেকে জীবনের স্পন্দন জেগে ওঠে। সে-ভাবেই সাহারা ভূখণ্ডের তৃণভূমির ফাঁকে ফাঁকেও কিছু বৃক্ষরাজির মাথা তুলে দাঁড়ায়। কোথায় কোথায় জনবসতিও গড়ে ওঠে এবং পরিণত হয় নানা ধরনের জন্তু-জানোয়ার পশুপাখির বিস্তীর্ণ চারণভূমি।
সাহারার শ্যামল প্রান্তরে প্রায় ৫,০০০ বছর সুখে-শান্তিতে কাটানোর পর জীবজন্তু এবং ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা জনপদে নেমে আসে বৃষ্টিহীন সাহারার চরম উষ্ণতা। তারা ক্রমে ক্রমে দক্ষিণ দিকে সরে গিয়ে আফ্রিকার বিভিন্ন অঞ্চলে নতুন ঠিকানা খুঁজে পায়।
সাহারার পাথর চিত্রগুলো মরুকরণের আগেও মানব উপস্থিতির প্রমাণ বহন করে চলেছে।
মূলত পৃথিবীর ঘূর্ণনের অক্ষ রেখা সামান্য সরে যাওয়ার ফলেই সাহারা অঞ্চলে মরুকরণের সূচনা হয়েছিল। ফলে আজ থেকে চা্র- পাঁচ হাজার আগের সাহারা ভূখণ্ড সাভানা তৃণভূমি থেকে মরুভূমিতে পরিণত হয়। কেন এই জলবায়ু পরিবর্তন হলো সেদিকে দৃষ্টি দেয়া যাক।
বিগত কয়েক লক্ষ বছর ধরে সাহারা ভূখন্ড ২০,০০০ বছর পর পর একবার মরুভূমিতে পরিণত হয়। তারপর আরো ২০,০০ বছর পরে সাভানা তৃণভূমিতে পরিণত হয়। পৃথিবী তার অক্ষের উপর সূর্যের চারপাশে ঘুরতে ঘুরতে এক পর্যায়ে এমন অবস্থানে আসে যে উত্তর আফ্রিকার মৌসুমী বায়ু দিক পরিবর্তন করে ভূখন্ডটিতে বৃষ্টিপাত ঘটায়। পরিণত হয় সাভানায়। পরিবেশবিদরা ধারণা করছেন এলাকাটি আরো পনের হাজার বছর পরে তৃণ ভূমিতে পরিণত হবে, ১৭,০০০ সালে।
স্যাটেলাইট থেকে তোলা ছবিতে সাহারা মরুভূমি
সাহারা মরুভূমি পৃথিবীর শুষ্কতম স্থান। এর প্রায় অর্ধেক অঞ্চলে বার্ষিক গড় বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ২ সেন্টিমিটারের নিচে। এমনকি কিছু এলাকায় কোনো কোনো বছর কেটে যেতে পারে একেবারে বৃষ্টিবিহীনভাবে। বাকি অঞ্চলগুলোতে অবশ্য গড় বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ১০ সেন্টিমিটারের উপরে।
দিনের বেলা তাপমাত্রা গড়ে ৪৬ থেকে ৫৪ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে ওঠানামা করে, কিন্তু রাতের বেলা কখনও কখনও তাপমাত্রা হিমাঙ্কের নিচে ৬ ডিগ্রী অবধি নেমে যায়। মজার ব্যাপার হলো সাহারায় কিছু কিছু স্থানে, বিশেষ করে পাহাড়ের চূড়াগুলোতে, শীতকালে তুষারপাতও দেখা যায়!
সাহারা মরুভূমির দৃশ্য
রবি ঠাকুরের কবিতায় পড়েছি, ইহার চেয়ে হতেম যদি আরব বেদুইন চরণতলে বিশাল মরু দিগন্তে বিলীন। কবির কল্পনার মরুভূমির সবটাই ধুধু বালু প্রান্তর। কিন্তু সাহারা মরুভূমিতে মাত্র ৩০% বালি আর বাকি ৭০% হল কংকর আচ্ছাদিত। এমনকি ভূগর্ভস্থ পানির এক বিশাল ভান্ডারও রয়েছে। ভূগর্ভস্থ পানির কারণে সাহারায় অজস্র মরুদ্যানের সৃষ্টি হয়েছে যাদের সম্মিলিত আয়তন প্রায় ৮০ হাজার বর্গমাইল। শুধুমাত্র মরুদ্যান এলাকা বাংলাদেশের ৫৬ হাজার বর্গমাইলের চাইতে প্রায় দেড় গুণ।
সাহারা মরুভূমির একটি মরুদ্যান
এছাড়া কিছু কিছু নদীরও দেখা মেলে। তবে নদীগুলো ঋতুনির্ভর ও বিচ্ছিন্ন। কম পক্ষে ২০টির মতো হ্রদ রয়েছে গোটা সাহারায়। এগুলোর মধ্যে একমাত্র সাদ লেকই সাদুপানির লেক, বাকিগুলো লোনা।
সাহারা মরুভূমির একটা লেক
সাহারায় জীববৈচিত্র্য তুলনামূলকভাবে কম। তারপরও বিচিত্র রকমের প্রাণীর দেখা মেলে। সবাই সাহারার কঠিন পরিবেশে বেঁচে থাকার জন্য সহনশীল ও কষ্টসহিষ্ণু। অ্যাডাক্স নামের হরিণ জাতীয় একটি প্রাণী তো প্রায় বছরখানেক পানি পান না করে বেঁচে থাকতে পারে। এছাড়াও রয়েছে শিংওয়ালা ভাইপার কুমির ও বিভিন্ন রকমের মরুভূমির সরীসৃপ, শিয়াল ও হরিণ। এমনকি চিতা বাঘেরও দেখা মেলে সাহারায়।
সাহারা মরুভূমিতে অ্যাডাক্স হরিণ
অতীতে কোনো এক সময় সাহারা মরুভূমি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে আসা বিস্তীর্ণ তৃণভূমি এখন সাভানা তৃণভূমি নামে পরিচিত। সাহারা মরুভূমির দক্ষিণ অঞ্চল সহিল নামে পরিচিত। এর দক্ষিণে সুদানে অবস্থিত তৃণভূমিকে সাভানা বলা হয়। এই তৃণভূমির চারপাশ ঘিরে রয়েছে কালাহারি মরুভুমি। এখানে বিভিন্ন ধরনের জেব্রা, জিরাফ এবং ফ্ল্যামিংগো ও অন্যান্য জীবজন্তুর পশুপাখির বিচরণ ক্ষেত্র। পৃথিবী যদি আরও ১৫ হাজার বছর টিকে যায় তাহলে সেখানে এ সব প্রাণী ও পশু পাখির কলকাকলিতে আবার মুখরিত হয়ে উঠবে। পৃথিবীর ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা এখানে আস্তানা গাড়বে।
আফ্রিকা মহাদেশের বর্তমান সাভানা তৃণভূমি্র আদলে ১৫ হাজার বছর পরে সাহারা অঞ্চল কেমন হতে পারে তার দুটো কল্পিত চিত্র দেখুন
আফ্রিকার সাভানা তৃণভূমির জন্তু-জানোয়ার
সাভানা তৃণভূমিতে বৃক্ষরাজি
এই অঞ্চল ঘাসে ঢাকা থাকলেও অল্পবিস্তর ছোটো বড় গাছেরও দেখা মেলে। বছরে প্রায় ৫৯ ইঞ্চি বৃষ্টিপাত হয় এই অঞ্চলে। অন্যান্য তৃণভূমির চেয়ে তুলনামুলক এই তৃণভূমি বেশি উত্তপ্ত থাকে। অনেক সময়ই ভয়ঙ্কর দাবানল এই তৃণভূমিতে। বন্য প্রাণীদের মধ্যে এই তৃণভূমিতে জেব্রা, জিরাফ, হাতি, হরিণ, ফ্ল্যামিংগো ইত্যাদি বেশি দেখা যায়।
