
১৯৩৯ সালে বৃটেনের নেতৃত্বে মিত্র শক্তির সাথে হিটলারের জার্মানির নেতৃত্বে অক্ষশক্তির সাথে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়। যুদ্ধের প্রাথমিক স্তরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দর্শকের ভূমিকা পালন করে চলছিল। মিত্র শক্তির কাছে অস্ত্রশস্ত্র বিক্রি করে ত্রিশ দশকের সর্বনাশা মহামন্দার কবল থেকে মুক্তি পেয়ে তাদের অর্থনীতি ফুলে ফেঁপে উঠছিল।
এদিকে ইউরোপ এবং আফ্রিকায় হিটলারের নেতৃত্বে অক্ষশক্তির ঝটিকা আক্রমণে ব্রিটেন ও তার সহযোগী মিত্রশক্তির সেনাবাহিনী বিধ্বস্ত। ফ্রান্স পোল্যান্ড রোমানিয়া অস্ট্রিয়া ডেনমার্ক বেলজিয়াম সুইডেন এবং অন্য কয়েকটি দেশ জার্মানির পদানত। আক্রমণের ভয়ে কয়েক লক্ষ মিত্র শক্তির সেনা ফ্রান্সের ডানকার্ক থেকে পড়িমরি করে ইংলিশ চ্যানেল পার হয়ে ব্রিটেনে আশ্রয় নেয়। খোদ ব্রিটেন ছিল হিটলারের পরবর্তী টার্গেট। কিন্তু এশিয়ায় জাপানের আগ্রাসী ভূমিকা যুদ্ধে নতুন মাত্রা যোগ করে।
যুদ্ধের প্রথম দুই বছরে ইউরোপে নিজেদের মধ্যে হানাহানি কাটাকাটির ব্যাপারে আমেরিকার তেমন মাথা ব্যাথা ছিল না। যুদ্ধের সরঞ্জাম এবং অন্যান্য পণ্য বিক্রি করেই তারা খুশি। কিন্তু, এশিয়ায় জাপানের আগ্রাসী ভূমিকা আমেরিকাকে যুদ্ধের পথে টেনে আনে।
জাপানের লক্ষ্য ছিল এশিয়ার পূর্ব প্রান্তে ব্রিটিশ, নেদারল্যান্ড ও আমেরিকার যে সব কলোনি ছিল সেগুলো কব্জা করা। কিন্তু পথের কাঁটা ছিল হনুলুলুর পার্ল হারবারে আমেরিকার নৌবহর। সে বাঁধা অপসারণের জন্য জাপান বিশাল বিমান বহর পাঠিয়ে ১৯৪১ সালের ৭ই ডিসেম্বর পার্ল হারবারে মুহুর্মুহু আক্রমণ চালিয়ে ঘাঁটিটি প্রায় নিষ্ক্রিয় করে ফেলে।
এবার আমেরিকার টনক লড়ে। আনুষ্ঠানিকভাবে মিত্রশক্তির পক্ষে যুদ্ধে নেমে পড়ে। অল্প কিছুদিনের মধ্যেই তারা মিত্র শক্তির মুখ্য চালিকা শক্তি হিসেবে দেখা দেয়।
আমেরিকা যুদ্ধের ময়দানে হাজির হলেও জাপান এশিয়ায় প্রাধান্য বিস্তারের লক্ষ্য থেকে মোটেই বিচ্যুত হয় নাই। তারা একের পর এক জনপদ দখল করে চলেছিল। দূরপ্রাচ্য ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার প্রায় সবটাই কব্জা করে নিয়ে এসেছিল। এমনকি ব্রিটিশ ভারতের সীমান্ত কোহিমা মনিপুর অঞ্চলে পৌঁছে গিয়েছিল।
অধিকৃত অঞ্চলে জাপান চরমভাবে মানবাধিকার লংঘন করে। যুদ্ধবন্দীদের অনাহারে-অর্ধাহারে রেখে রাস্তাঘাট কালভার্ট ব্রিজ নির্মাণ করতে অমানুষিক পরিশ্রম করায়। অনেক যুদ্ধ বন্দী মৃত্যুবরণ করে। বলাবাহুল্য, যুদ্ধ এবং অন্য জনগোষ্ঠীর উপর প্রভুত্ব বিস্তারের স্পৃহা মানুষকে পশুর পর্যায়ে নিয়ে যায়। সে জাপানিরাই এখন সৌজন্য ও ভদ্রতার মূর্ত প্রতীক।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানের অধিকৃত দেশ ও অঞ্চল
স্মরণ করা যেতে পারে, জাপানিদের হাতে বন্দি ব্রিটিশ বাহিনীর ভারতীয় সেনা সদস্যদের মুক্ত করে নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু আজাদ হিন্দ ফৌজ নামে একটি সেনাদল গড়ে তুলেন। তাঁর লক্ষ্য ছিল এ বাহিনী নিয়ে জাপানের সহায়তায় ভারত থেকে ব্রিটিশদের বিতাড়ন করা। তার সে স্বপ্ন অপূর্ণ রয়ে যায়। পরবর্তীতে ব্রিটিশ ভারত ছেড়ে যায় বটে কিন্তু ভিন্ন আঙ্গিকে, ভিন্ন কারণে।
কাল ক্রমে, আমেরিকা এবং মিত্রশক্তির মিলিত বাহিনীর কাছে জাপান বিভিন্ন রণাঙ্গনে পরাজয় স্বীকার করে। বাকি থাকে খোদ জাপান। যুদ্ধের শেষ পর্যায়ে ১৯৪৫ সালে পরপর দুটো আণবিক বোমা নিক্ষেপ করে আমেরিকা তাদের দুটো শহর—হিরোশিমা ও নাগাসাকি– গুড়িয়ে দেয়।
হিরোশিমায় মারা যায় দেড় লক্ষ লোক, নাগাসাকিতে পঁচাত্তর হাজার। বেশির ভাগই বেসামরিক লোকজন। জাপানের শক্তি এমনিতেই নিঃশেষ হয়ে আসছিল। এক পর্যায়ে জাপান আত্মসমর্পণ করবে এরকমটা আভাস দিয়ে আসছিল। কিন্তু আনবিক বোমার জোড়া আঘাতের পরপরই আনুষ্ঠানিকভাবে সম্রাট হিরোহিতোর এক রেডিও ভাষণের আত্মসমর্পণ করার ঘোষনা করেন।
যুদ্ধের পর জাপানকে আমেরিকা এবং তার মিত্ররা ঠুঁটো জগন্নাথ বানিয়ে কোণঠাসা করে রেখেছিল। জাপানের সেনাবাহিনী প্রায় নিষ্ক্রিয় করা হয়। তার প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা কার্যত আমেরিকা নিজের হাতে তুলে নেয়।
হাতি কাদায় পড়লে চামচিকাও নাকি লাথি মারে। পরম শক্তিশালী জাপান, যারা যুদ্ধের বেশ কয়েকটি বছর পুরো পৃথিবীকে কাঁপিয়ে দিয়েছিল, যুদ্ধের পর তার অবস্থাও হয়ে যায় চোরাবালিতে আটকা পড়া হাতির মতো।
জাপান আমেরিকার কাছে নতি স্বীকার করে, যুদ্ধের অবসান ঘটায়। বলাবাহুল্য, জাপানকে অনেক অসম্মান সূচক শর্ত মেনে নিতে হয়। এসব শর্তের মধ্যে সামরিক শক্তি সীমিত করার শর্ত ছিল। পরাজিত শক্তির আর কি বা করার ছিল?
আমেরিকার জেনারেল ম্যাক আর্থারের তদারকিতে জাপানের সংবিধান তৈরি করে ৯ ধারায় বলা হয়—জাপান কোনো যুদ্ধ বা অন্য রাষ্ট্র আক্রমণ করতে পারবে না, সমরাস্ত্র তৈরি করতে পারবে না এবং বহির্বিশ্বে সেনাবাহিনী প্রেরণ করতে পারবে না।
জাপানের সামরিক শক্তি খর্ব করার পাশাপাশি তার বড় বড় ব্যবসা প্রতিষ্ঠানকেও টুকরো-টুকরো করে অর্থনৈতিকভাবে পঙ্গু করার ব্যবস্থা নেয়। কিন্তু নিয়তি জাপানকে অর্থনৈতিকভাবে মাথা তুলে দাঁড়াবার সুযোগ এনে দেয়।
এ সময় নব উত্থিত কম্যুনিস্ট পার্টি চিয়াং কাই শেককে চীনের মূল ভূখণ্ড থেকে তাইওয়ানে তাড়িয়ে ঘুমন্ত ড্রাগন চীন সমাজতন্ত্রের ব্যানারে মাথা তুলে দাঁড়ায়। জাপান ও পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর জন্য হুমকি হয়ে দেখা দেয়।
চীনের উত্থানে আমেরিকার টনক নড়ে। যুদ্ধ পরবর্তী পর্যায়ে আমেরিকার নেতৃত্বে পুঁজিবাদী বিশ্ব এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের নেতৃত্বে সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোর সাথে শুরু হয় স্নায়ুযুদ্ধ যা কোল্ড ওয়ার নামে পরিচিত। এশীয় অঞ্চলে কম্যুনিস্টদের আগ্রাসন প্রতিহত করার জন্য আমেরিকা জাপানের প্রতি দমন নীতি পরিবর্তন করে অর্থনৈতিক ও সামরিক দিক দিয়ে শক্তিশালী করে যুদ্ধ পরবর্তী ঠান্ডা লড়াইয়ে মিত্র শক্তি হিসেবে কাছে টেনে নেয়।
জাপানের সমর সজ্জা
যুদ্ধ পরবর্তীতে চীনের উত্থান এবং কোরিয়া যুদ্ধের কারণে জাপানকে নিজস্ব প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা করার সুযোগ করে দেয়া হয় এবং তদনুযায়ী সংবিধান পরিবর্তন করা হয়।
কয়েক দফা সংবিধান সংশোধনের পর জাপান এখন সেল্ফ ডিফেন্স ফোর্স নামে পুরোপুরি নিজস্ব প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তুলেছে। সংশোধিত সংবিধান অনুযায়ী তারা শান্তি বাহিনীতেও সৈন্য পাঠাতেও পারে।
ক্রেডিট সুইস ব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী সামরিক দৃষ্টিকোণ থেকে জাপান চতুর্থ শক্তিশালী রাষ্ট্র। বাজেটে বরাদ্দ অর্থের হিসাবে জাপানের স্থান অষ্টম। জাপান কনভেনশনাল বা প্রচলিত অস্ত্রশস্ত্রে পূবোপুরি সজ্জিত।
তবে সামর্থ্য এবং কলাকৌশল জানা থাকলেও আণবিক অস্ত্রসস্ত্র তৈরির ব্যাপারে জাপানের আগ্রহ নেই। কারণ, জাপানই একমাত্র দেশ যারা আণবিক বোমার ভয়াবহতার শিকার হয়েছে। এ ধ্বংসলীলার যাতে পুনরাবৃত্তি না হয় সেজন্য তাদের একটা সহজাত অনীহা রয়েছে।
২০১৮ সালের হিসাব অনুযায়ী জাপানের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা একটা হিসাব নিম্নে দেওয়া হল।
- সক্রিয় মিলিটারি সদস্য ২,৪৭,১৫০
- রিজার্ভ সদস্য ৫৬,০০০
- ব্যয় মার্কিন ডলার ৪৭.৩ বিলিয়ন
- জিডিপির শতকরা হিসাব ০.৯%
জাপানের কাহিনী শেষ করার আগে ইতিহাসের পাতা থেকে এক চমৎকার অধ্যায় তুলে ধরছি।
ড: রাধা বিনোদ পাল
জাপানিদের চরম দুর্দশার দিনে পরম বন্ধু হিসাবে তাদের পাশে এসে দাঁড়ান আমাদেরই কুষ্টিয়া জেলার এক নিভৃত পল্লীতে জন্মগ্রহণকারি পরবর্তীতে ভারতীয় নাগরিক ড: রাধা বিনোদ পাল।
হতদরিদ্র পরিবারে জন্মগ্রহণ করে তিনি অল্প বয়সেই পিতৃহারা হন। অপরিসীম দুঃখ কষ্টের মাঝেও তিনি পড়াশোনায় কৃতিত্বের সাথে সকল পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন।
তিনি কলকাতা হাইকোর্টের বিচারক এবং পরে ১৯৪৪-৪৬ সাল পর্যন্ত কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ছিলেন। এরপরের সুযোগ আছে বিশ্ব অঙ্গনে নির্ভীক বিচারক হিসাবে অসামান্য খ্যাতি অর্জনের।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ লগ্নে টোকিওতে বিজয়ী মিত্রবাহিনী ট্রাইব্যুনাল গঠন করে জাপানের সমরবিদ জেনারেল হিদেকি তোজোসহ যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে অন্যান্যদের জন্য বিচারের ব্যবস্থা করে।
টোকিও ট্রাইব্যুনালের অন্যতম প্রধান বিচারপতি ছিলেন ড. রাধা বিনোদ পাল। বিচারের একপর্যায়ে রাধা বিনোদ পাল বাদে অন্য সব বিচারপতি জেনারেল তোজো ও এবং অন্যান্য কয়েকজনকে যুদ্ধাপরাধী হিসেবে অভিযুক্ত করে ফাঁসিতে ঝুলানোর সিদ্ধান্ত নেন।
অন্যান্য বিচারপতির ধারণা ছিল, ব্রিটিশদের নির্বাচিত বিচারপতি পালও মিত্রশক্তির পক্ষে অনুগত থাকবেন। অন্যান্য বিচারপতিরা যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির আদেশ দেওয়ার জন্য একে একে তাদের রায় দিতে লাগলেন গিল্টি…. গিল্টি… গিল্টি….। বিচারপতি রাধা বিনোদ পালের টার্ন আসলে বজ্রনিনাদ কন্ঠে রায় দিলেন, নট গিল্টি। ১২শ’ পৃষ্ঠার বেশি ঐতিহাসিক রায় মিত্রশক্তি এমনকি বিশ্বকে হতবাক করে দেয়। আইনের শাসনের প্রতি গভীর শ্রদ্ধাশীল বিচারপতি পাল কর্তৃক পূর্ববর্তী রায়কে বিতর্কিত প্রমাণ করে সবাইকে দায়মুক্ত করার পক্ষে রায় দেন।
তাঁর যুক্তি ছিল জাপান মানবাধিকার লংঘন করেছে ঠিকই কিন্তু মিত্রবাহিনীই বা কম কিসে? জাপান আত্মসমর্পণ করার আভাস দিলেও মিত্রশক্তি তাদের উপর বোমা নিক্ষেপ করে নিরীহ মানুষের জীবন কেড়ে নেওয়ার মানবাধিকার লঙ্ঘনের দায় এড়াতে পারে না। তার যুক্তির আলোকে অন্যান্য বিচারপতিও তাদের মনোভাব নমনীয় করেন।
রাধা বিনোদ পালকে জাপানিরা অত্যন্ত শ্রদ্ধার চোখে দেখে থাকে। কয়েক বছর আগে জাপানি প্রধানমন্ত্রী “মিস্টার আবে” ( যিনি বর্তমান জাপানি প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবের বাবা) ভারতে এসে বিশেষ করে কলকাতায় এসেছিলেন রাধা বিনোদ পালের পুত্রকে জাপানের তরফ থেকে কৃতজ্ঞতা জানাতে।
পরিতাপের বিষয় জাপান মনে রাখলেও উভয় বাংলার জনগণ তাঁর কথা বলতে গেলে ভূলেই গেছে। এ সম্পর্কে একটা মজার তথ্য কয়েকদিন আগে একটা লেখায় পড়লাম। মিস্টার আবে ডক্টর রাধাবিনোদ পালের ছেলের সাথে দেখা করার জন্য যখন তার বাড়িতে যান তখন সঙ্গে ছিলেন একজন মন্ত্রী মহোদয়।
বাড়ির ফটকে রাধাবিনোদ পালের নাম ফলক দেখে বিজ্ঞ মন্ত্রী মহোদয় সঙ্গে আসা পুলিশ কর্মকর্তাকে নাকি জিজ্ঞেস করেছিলেন, কে এই রাধাবিনোদ পাল? খোঁজখবর নিয়ে আমাকে জানাইও তো। এ জন্যই বলে গেঁয়ো যোগী ভিখ পায় না।
(পরিসংখ্যান, ছবি ও মানচিত্র গুগলের সৌজন্যে)