আমি নিজে রাস্তা ঘাটে কখনো টাকা কুড়িয়ে পাইনি। তবে, স্কুল বয়সে যখন বিড়ি সিগারেট ধরেছি, কল্পনা করতাম রাস্তাঘাটে একটা মোটা মানিব্যাগ পাওয়া গেলে রোজ রোজ ওয়ারড্রবে রাখা বাবার পকেট থেকে অল্পস্বল্প টাকা সরিয়ে ফেলা লাগত না।
বেশি টাকা সরালে ধরা পড়ার ভয় ছিল; একটু-আধটু ধকল শরীরের উপর দিয়ে যাওয়ার কথা নাইবা বললাম। বয়স বাড়লেও সে স্বপ্ন অপূর্ণই রয়ে গেল। শেষমেষ কয়েক বছর আগে বিদেশে ফরেন কারেন্সি ভর্তি একটা মোটা মানিব্যাগ পেয়ে গেলাম। তত দিনে অবশ্য কুড়িয়ে পাওয়া টাকার প্রয়োজন ছিল না। সে গল্পে পরে আসছি।
খুঁজে পাওয়া টাকা কি করতে হবে তা নিয়ে দেশে-বিদেশে আইন-কানুন আছে। অনেক দেশে ধর্মীয় অনুশাসন আছে।
আমেরিকায় বেশিরভাগ স্টেটে আইন মোতাবেক মালিককে খুঁজে পেতে টাকা ফেরত দিতে হবে। অন্যথায় প্রমাণ পাওয়া গেলে চুরির দায়ে অভিযুক্ত করা হয়। না পেলে নিজের এবং পরিবারের সেবায় লাগিয়ে দিতে বাঁধা নাই। ধর্মীয় অনুশাসন নিয়ে তাদের মাথাব্যাথা নাই।
দেশের হুজুরদের জিজ্ঞেস করলে হাদিস কালাম উল্লেখ করে মালিককে ফেরত দেয়ার পরামর্শ দেন, অন্যথায় পরকালে দীর্ঘকালব্যাপী দোযখের অগ্নিকুন্ডে যন্ত্রণা সইতে হবে সে মর্মে হুঁশিয়ার করে দেন। মালিককে খুঁজে না পাওয়া গেলে বিকল্প পথ বাতলে দেন।
এক ছোকরা কিছু টাকা পেয়ে তা হালাল করার মতলবে পাড়ার মসজিদের হুজুরকে জিজ্ঞেস করলে নানা কিসিমের হাদিস বয়ান করার পর দেয়ার পর বললেন, মালিককে খুঁজে না পাওয়া গেলে নেহায়েৎ অভাবগ্রস্থ হলে নিজের কাছেও রেখে দেওয়া যায়। এরকম কোন হাদিস আছে কিনা জানিনা। না থাকলেই বা কি? পাড়াগাঁয়ের গরিব ইমাম; সবার মন জুগিয়ে চলতে হয়। পরিবারের সবাইকে নিয়ে উপোস করার চেয়ে একটু-আধটু গোজামিল দিলে ক্ষতি কী?
হুজুর টাকার মালিককে কিভাবে খুঁজতে হবে সে সম্পর্কে পরামর্শ দিলেন, যেখানে টাকা পাওয়া গেছে সেখানে পর পর তিনদিন উচ্চস্বরে হারানো টাকার কথা বলে মালিককে নিয়ে যাওয়ার আহ্বান জানাতে হবে। সে ছোকরা অকুস্থলে কাছে ধারে যখন কোন লোক থাকে না তখন পরপর তিন দিন ঘোষণাপত্র জারি করে টাকাটা হালাল করে ফেলে। ঘোষণাপত্র পাঠ করেই যখন স্বাধীনতার ঘোষক হওয়া যায় তখন ছোকরাকে দোষ দিয়ে লাভ কি?
টাকা-পয়সা পেলেই যে লোকে তা পকেটে ভরে তা নয়। আমাদের অনেকেরই ধারণা বাংলাদেশে ঈমান-আমল সততা বলে কিছু নেই। বাঙালিরা নিজের দেশকে চটকে বড় মজা পায়।
উচ্চ শ্রেণীর মানুষের সততা ক্ষয় হয়ে আসলেও মধ্যম ও নিম্ন শ্রেণীর লোকের মন থেকে সততা বিদায় নেয়নি। সংবাদ মাধ্যমে প্রায় খবর আসে,গরীব অটোরিকশা বা রিকশাওয়ালারাও তাদের রিকশায় ফেলে যাওয়া কয়েক লক্ষ টাকার ব্যাগ ফেরত দেওয়ার জন্য মালিককে হন্যে হয়ে খুঁজে বেড়ায়।
আমি নিজে ছোটখাটো দোকান থেকে কিছু কিনে বড় অঙ্কের নোট দোকানিকে দিয়ে ভুলে রওনা দিলে বহুবার ডেকে ফিরিয়ে এনে দোকানি বাকি টাকা ফেরত দিয়েছে। আমার ভুলো মন। স্কুল-কলেজে পড়া ভুলে জীবনটা জেরবার করে ফেলেছি। এসমস্ত গরীব মানুষেরা যদি আমায় ভুলো মনের সুযোগ নিত তাহলে দেউলিয়ার খাতায় নাম লেখাতে হত।
বিদেশেও বাঙ্গালীদের সততার সুনাম আছে। যেসব দেশে বাঙালি শ্রমিক আছে সে দেশে, বিশেষ করে অল্প শিক্ষিতদের, অনেক সুনামেরকথা শুনতে পেয়েছি। ইন্টারনেট থেকে তাদের কয়েক জনের অবিশ্বাস্য গল্প শোনানো যাক।
মুকুল আসাদুজ্জামান নিউ ইয়র্কের মেডিকেল স্টুডেন্ট, পড়ালেখার পাশাপাশি ট্যাক্সি চালাতেন। এক দিন ইটালি থেকে আগত এক পরিবার ২১ হাজার ডলার, এবং সেই সাথে বহু মূল্যবান গয়নাগাটি তার ট্যাক্সিতে ফেলে যায়। আসাদুজ্জামান ফেলে যাওয়া ব্যাগ আবিষ্কার করে মালিকের ঠিকানা খুঁজে পান। তিনি ম্যানহাটন থেকে লং আইল্যান্ড দুইবার ৬০ মাইল দূরে ট্যাক্সি চালিয়ে সে টাকা এবং অলংকার ফেরত দেন। শুধুমাত্র ডলারের বাংলাদেশ টাকায় মূল্য ১৭,৮৪, ০০০।
বলাবাহুল্য, ইটালিয়ান পরিবার তার সততা দেখে মুগ্ধ হয়ে পুরস্কার দেওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করলে তিনি বলেন, আমি একজন ধর্মপ্রাণ মুসলিম, আমি যা করছি তার জন্য পুরস্কার নিতে পারি না। তিনি তার মায়ের থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে সততার পথে চলা শিখেছেন বলে জানান।
আসাদুজ্জামানের সততার গল্পটা বিবিসি এবং সংবাদ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। ফেলে যাওয়া ব্যাগটি নিজের কাছে রেখে যাওয়ার ইচ্ছা জেগেছিল কিনা, এক জন সাংবাদিক জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, রেখে দিলে আমার পড়াশোনার জন্য বেশি সময় দিতে পারতাম ঠিকই কিন্তু আমার প্রাণে তা সায় দেয়নি, “but my heart said this is not good”.
২০০৭ সালে ওসমান চৌধুরী নামে এক বাংলাদেশের ড্রাইভার তার ট্যাক্সিতে ৫ লক্ষ ডলারের হীরক আংটি ব্যাগ ফেরত দিয়ে সংবাদ মাধ্যমের শিরোনামে এসে যান। পুরো আমেরিকায় তাঁর সততার কথা ছড়িয়ে পড়ে। হীরকের বাংলাদেশ টাকায় ৫ লক্ষ ডলারের মূল্য ৪.২০ কোটি টাকা।
জাতি ধর্ম নির্বিশেষে সব সমাজেই সৎ মানুষ আছে। ২০১৬ সালে দুবাইয়ে বাংলাদেশি ট্যাক্সি ড্রাইভার লিটন চন্দ্র নেপাল আরব শেখদের ফেলে যাওয়া ব্যাগে ২৫ কেজি স্বর্ণ ফেরত দেন। বাংলাদেশ টাকায় মূল্য সাড়ে ৪ কোটি টাকারও বেশি। নেপালও তার মায়ের কাছে অনুপ্রেরণা পেয়েছেন বলে সংবাদ মাধ্যমকে জানান।
মাত্র ৩ সপ্তাহ আগে দুবাইয়ের প্রবাসী বাঙালি শ্রমিক ৮২ লক্ষ টাকার সমপরিমাণ দিরহাম রাস্তায় কুড়িয়ে পেয়ে তার মালিককে ফেরত দিয়েছেন। দুবাই পুলিশ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে পুরস্কৃত করেছে। খালিজ টাইমস ঘটা করে তার সংবাদ ছেপেছে।
এবার আমার গল্পটা বলে শেষ করব। কয়েক বছর আগে কয়েকজন আত্মীয় স্বজন নিয়ে ভুটান গিয়েছিলাম বেড়াবার উদ্দেশ্যে।
ভুটান খুব ভালো লাগার মত দেশ, সে দেশের লোক অল্পতেই সন্তুষ্ট, সরকার জিডিপি এবং বড় বড় প্রজেক্ট নিয়ে মাথা ঘামায় না, প্রকৃতির সাথে মিলেমিশে বাস করে। ভুটানিদের আইনের প্রতি শ্রদ্ধা লক্ষণীয়। ড্রাইভার দুই মাইল ঘুরে আসবে তবুও ফাঁকা রাস্তা মেয়ে শর্টকাট মারে না। I আইনের লোকজন রাস্তা থেকে ধরে নিয়ে বাপ মার কাছে মুক্তিপণ আদায় করে না।
ভ্রমণ শেষে ফেরার পথে চেক-ইন করে পারো এয়ারপোর্টে ডিপারচার লাউঞ্জে বসে কালো রঙ্গের সোফায় বসে দেখতে পেলাম একটা পেট মোটা কালো মানিব্যাগ। আমাদের কারো ব্যাগ কি না তা দেখার জন্য একটু খুলে দেখলাম জাপানি ইয়েন ,ডলার পাউন্ড এবং ট্রাভেলার চেক মানিব্যাগে ঠাসা। সঙ্গে সঙ্গে ব্যাগটি একটু দূরে পুলিশদের কামরায় দিয়ে বললাম এর মালিককে খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা করুন। তা নিজেদের মধ্যে ভাগ-বাটোয়ারা করে নেয় কিনা সে সম্পর্কে সন্দেহ ছিল। তবে, ভুটানের পুলিশের সততা সম্পর্কে সুনাম আছে।
মিনিট বিশেক পরে সন্দেহ দূর হলো। এক জন পুলিশ অফিসার বের হয়ে বললেন, ব্যাগ থেকে মালিকের ঠিকানা বের করেছেন। তার কাছে যথাশীঘ্র পাঠিয়ে দেওয়া হবে।
তিনি আরও বললেন, তুমি এত টাকা পেয়ে ফেরত দিয়েছো দেখে আমরা সবাই অবাক হয়েছি। তাঁর হিসাব মতে মানিব্যাগে লক্ষাধিক টাকার ফরেন কারেন্সি ও ট্রাভেলার্স চেক ছিল। পুলিশ জিজ্ঞেস করল, তুমি কি ভারতের থেকে এসেছো? তার ভুল ভাঙ্গাতে দেশের জন্য কিছুটা হলেও সুনাম কুড়োবার সুযোগ ছাড়ে কে?
জানতে পারলাম, মানিব্যাগটা ছিল একজন জাপানির। জাপানিদের চোখ খুবই ছোট, তাও ভিতরের দিকে, খোলা না বুজে আছে বুঝা যায় না। সোফায় মানিব্যাগ কেন রেখেছিল জানিনা কিন্তু চলে যাওয়ার সময় কালো সোফায় রাখা কালো মনিব্যাগ তাঁর ছোট চোখের ফোকাস ঠিকমতো পড়েনি। মনিব্যাগটা রেখেই দেশের দিকে রওনা দিয়েছে। খোদা তাদের মাথা ভরা বুদ্ধি দিলেও নয়ন দুটো বড্ড ছোট করে দুনিয়াতে পাঠিয়েছেন। তাই, সব জাপানি ট্যুরিস্টদের হাতে সব সময় একটা ক্যামেরা থাকে। ক্যামেরার লেন্সের মাধ্যমে দুনিয়া দেখে।
