October 29, 2025

আমাদের উপমহাদেশের কথাই ভাবুন না কেন?

  • আজও রাজধানী দিল্লিতে ‌এখনকার রাষ্ট্রপতি ভবনে বসে রানী এলিজাবেথের প্রতিনিধি হিসাবে একজন ভাইসরয় অখন্ড ভারতবর্ষের দণ্ডমুণ্ডের কর্তা হিসাবে শাসনভার পরিচালনা করতেন।‌
  • জেলায় জেলায় শ্বেতাঙ্গ এবং তাদের সাথে এদেশের কিছু সংখ্যক আই সি এস অফিসার জেলা প্রশাসক হিসেবে ভারতে ব্রিটিশ রাজত্ব স্থায়ী করার জন্য‌ যা কিছু দরকার সে‌ জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতেন।
  • বেশির ভাগই অফিস-আদালতে তাদেরই কর্তৃত্ব থাকতো। প্রদেশগুলোর সার্বিক শাসন ব্যবস্থা পরিচালনার দায়িত্বভার থাকতো ব্রিটিশ গভর্নর কিংবা লেফটেন্যান্ট গভর্নরদের হাতে।
  • কবি-সাহিত্যিকরা ইংল্যান্ডের রাজা বা রানীকে ভারত ভাগ্য বিধাতা বলে আবাহন করতেন।
  • ব্রিটিশ পদলেহী জমিদার, নওয়াব, তালুকদার, মজুমদার, রায় বাহাদুর, খান বাহাদুর, দেশীয় রাজা, মহারাজা সবাই ব্রিটিশ রাজের বিরুদ্ধে আন্দোলন ঠেকাতে যত্নবান হতেন।
  • চট্টগ্রামের অস্ত্রাগার লুণ্ঠন তিতুমিরের বাঁশের‌ কেল্লা, হাজী শরীয়তুল্লাহ এর ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন, ক্ষুদিরামের মত দুই ‌চারটি বোমাবাজি ব্রিটিশ রাজের কূটকৌশল ও স্টিম রোলারের নীচে ধুলিস্যাৎ হয়ে যেত।
  • উপমহাদেশের বিভিন্ন জায়গায় ব্রিটিশ ক্লাবের বাইরে নোটিশ টাঙানো থাকতো “নেটিভ এবং কুকুরের প্রবেশ নিষেধ।”
  • প্রথম মহাযুদ্ধে ব্রিটিশের পালের হাওয়া চুপসে যাওয়ার ফলে ভারতে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন চাঙ্গা হতে পেরেছিল। ধূর্ত ব্রিটিশ কিছুটা স্বায়ত্তশাসন প্রদান, হিন্দু মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে ডিভাইড এন্ড রুল পলিসি, নিপীড়ন নির্যাতন এবং কূটকৌশলের মাধ্যমে সে সব আন্দোলন স্তিমিত করে এনেছিল।
  • দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধ তাদের নৌকার পালের হাওয়া শুধু চুপসেই দেয়নি মাস্তুলও ভেঙ্গে দিয়েছিল। দুটো যুদ্ধ ব্রিটিশদের একান্ত কাবূ না করে ফেললে ‌‌‌‌ স্বাধীনতার স্বপ্ন স্বপ্নই রয়ে যেত।
  • ব্রিটিশরা উপমহাদেশের সম্পদ লুট করে নিজেদের দেশকে সমৃদ্ধশালী করতে থাকত কিন্তু অন্য দেশকে বোঝাতে চেষ্টা করত তারা অসভ্য ভারতীয়দেরকে সভ্য করার মিশনেই এদেশে রয়ে গেছে।

ভারতের মতো ইন্দোনেশিয়া এখনো নেদারল্যান্ডের কলোনী হয়ে টিকে থাকতো, ফিলিপাইনে আমেরিকা রাজত্ব চলতে থাকতো। অটোমান সাম্রাজ্যের পরাজয়ের পর তাদের থেকে কেড়ে নেয়া কুয়েত, বাহরাইন ও অন্যান্য ‌আরব দেশগুলো পশ্চিমা বিশ্বের খপ্পর হতে মুক্তি পেয়ে একটুখানি নিঃশ্বাস ফেলার সুযোগ পেত না।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধ না হলে আরব মুলক অটোমানদের কব্জায় থাকতো। পশ্চিমা বিশ্বের ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে এক কালে ইসলামের দুশমন নজদ এলাকার সৌদিরা আরবের ভাগ্যবিধাতা হিসাবে পরিণত হতে পারতেন না। তাদের ধ্বংসাত্মক ওহাবী নীতির হাত থেকে রক্ষা পেয়ে ইসলামি যুগের নিদর্শন জান্নাতুল বাকি এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাগুলো এখনো দেখতে পাওয়া যেত। সেগুলো তারা নির্মমভাবে গুড়িয়ে দিয়েছে।

বিশ্ব যুদ্ধ না হলে আফ্রিকার ছোট-বড় সব দেশই এখনো‌ ঔপনিবেশিক শক্তির যাঁতাকলে নিষ্পেষিত হতে থাকত।‌ মোট কথা, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সূচনা করে এডলফ হিটলার পশ্চিম বিশ্বের সাম্রাজ্যবাদী শক্তির হাত থেকে কলোনিগুলোকে মুক্তির দিশা দেখিয়েছে।

প্রথম মহাযুদ্ধে চারটি সাম্রাজ্যের পতন ঘটিয়েছিল — ১৯১৭ সালে রাশিয়ান সাম্রাজ্য, ১৯২২ সালে অটোম্যান সাম্রাজ্য, ১৯১৮ সালে অস্ট্রো-হাঙ্গেরিয়ান সাম্রাজ্য এবং জার্মান সাম্রাজ্য। ব্রিটিশ এবং অন্যান্য সাম্রাজ্যবাদী শক্তিরও বেশ খর্ব হয়েছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ফলে তারা এতটা রক্ত শূন্য হয়ে পড়েছিল যে তাদের পক্ষে কলোনীগুলো টিকিয়ে রাখা আর সম্ভব হচ্ছিল না।

এক কথায় বলা যায়, প্রথম মহাযুদ্ধের পর‌ ঔপনিবেশিক শক্তির যেটুকু বাকি ছিল হিটলার তার মূলে আঘাত হানেন। সে সঙ্গে নিজে ‌বিশ্বকে পদানত‌ করার যে প্ল্যান প্রোগ্রাম রচনা করেছিলেন তা-ও ভেঙ্গে যায়।

দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের পর ইউরোপের অর্থনীতি একেবারে ভেঙ্গে পড়ে। চারিদিকে হাহাকার, অন্ন বস্ত্রের অভাব, ঘরবাড়ি যোগাযোগ ব্যবস্থা অবকাঠামো বিধ্বস্ত। পশ্চিম ইউরোপের পূনর্গঠনের জন্য আমেরিকার সাহায্যের হাত এগিয়ে দেয় যা‌ মার্শাল প্ল্যান নামে পরিচিত হয়। রাশিয়ায় সাহায্য গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানায়।

সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলোর দাপট খর্ব হলেও নতুন দুটো শক্তির উত্থান ঘটে– আমেরিকা ও সোভিয়েত ইউনিয়ন। শুরু হয় ঠান্ডা লড়াইয়ের যুগ– আণবিক শক্তির যুগ।‌ উভয় দেশই তাদের নিজস্ব প্রভাব বলয় গড়ে তোলে। ইউরোপ দ্বিধাবিভক্ত হয়–আমেরিকার নেতৃত্বে পশ্চিম‌ জোট এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের নেতৃত্বে পূর্ব জোট। দুই ব্লকে দুটো ‌ দুটো অর্থনৈতিক জোন। অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর পশ্চিম ইউরোপীয় ব্লকে গঠন করা হয় একটি শক্তিশালী অর্থনৈতিক জোট যা এখন ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন নামে পরিচিত।

ইউনিয়ন গঠনের ফলে ইউরোপের দূই পরাশক্তি জার্মানি ফ্রান্স ফ্রান্সের মধ্যে বহুকাল ধরে যে বৈরিতা ছিল তার অবসান হয়েছে।পূর্ব ইউরোপে সোভিয়েত ইউনিয়নের নেতৃত্বে গঠন করা হয়েছিল কমেকন। কিন্তু‌ সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে যাওয়ার ফলে সে সব দেশ এখন স্বাধীন হয়ে গেছে। তাদের অনেকে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নে যোগ দিয়েছে। ব্রিটেনে ইউনিয়নের সদস্য কিন্তু বেশির ভাগ ব্রিটিশবাসী ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন থেকে সরে আসার জন্য গণভোটে রায় দিয়েছে। বহুল আলোচিত এ রায়কে ব্রেক্সিট নামে অভিহিত করা হয়।

প্রথম মহাযুদ্ধের ফলে উত্থান ঘটে কমিউনিস্ট রাশিয়ার যা সোভিয়েত ইউনিয়ন নামে পরিচিত‌ ছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পটভূমিতে উত্থান ঘটে চীনের। ১৯৪৯ সালে চীনের কমিউনিস্ট পার্টি চিয়াং কাইশেকের থেকে ক্ষমতা দখল করে নেয়। চীন কালক্রমে সামরিক ও অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে অন্যতম শক্তিশালী দেশ হিসাবে পরিগণিত হয়েছে ‌।

যুদ্ধবিধ্বস্ত ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর মধ্যে ব্রিটেন ছিল অন্যতম। তাদের সম্পদের প্রায় এক চতুর্থাংশ এ যুদ্ধে ব্যয় করা হয়। দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধে স্যার উইনস্টন চার্চিলের বলিষ্ঠ নেতৃত্ব মিত্র বাহিনীর জয়লাভের জন্য উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছিল। কিন্তু যুদ্ধের পর চার্চিলের কনজারভেটিভ পার্টি শোচনীয়ভাবে পরাজয় বরণ করে। ‌ক্লিমেন্ট এটলির নেতৃত্বে লেবার পার্টি শতকরা ৬০ ভাগ ভোট পায়। ‌ ধারণা করা হয়, কট্টরপন্থী চার্চিল ক্ষমতায় থাকলে এত শীঘ্র এবং সহজে ভারতের স্বাধীনতা মিলতো না।

যুদ্ধের ফলে জার্মানি দুই ভাগ হয়ে যায় পূর্ব জার্মানি ও পশ্চিম জার্মানি।পূর্ব জার্মানি থাকে সোভিয়েত ইউনিয়নের নিয়ন্ত্রণে পশ্চিম জার্মানি আমেরিকান নিয়ন্ত্রণে।যুগোস্লাভিয়া একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে। ‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌ মিত্রশক্তিগুলো জাপানের নিয়ন্ত্রণ ভার গ্রহণ করে। একে একে , কোরিয়া, সিন্গাপূর, সিঙ্গাপুর‌, মালয়েশিয়া, বার্মা জাপানের দখলমুক্ত হয়।

দু’টো বিশ্ব যুদ্ধের ফলে পৃথিবীর মানচিত্রের আমুল পরিবর্তন হয়ে যায়। রাজনীতি, সমাজনীতি, অর্থনতি সব বিষয়ে নতুন যুগের সূচনা হয়। উদ্ভাবন করা হয় নানাবিধ মারণাস্ত্র, যার মধ্যে আণবিক বোমা অন্যতম এবং তা বহন করে মানুষ মারার জন্য হরেক রকমের রকেট।

About Post Author

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Pin It on Pinterest