November 29, 2023

কুষান সম্রাট কনিষ্কের ভাস্কর্যে তাঁকে সব সময় মুণ্ডহীন দেখানো হয়। কিন্তু কেন? এ সম্পর্কে ইন্টারনেট থেকে কুড়িয়ে পাওয়া দুটো আজব সম্ভাবনার কথা বলে শুরু করা যায়, বলা বাহুল্য কৌতুকচ্ছলে।

(১) ভাস্কর্যটি গড়ার পাথর ও অন্যান্য উপকরণ ফুরিয়ে যাওয়ার কারণে ভাস্কর মাথাটি বানাতে পারেননি।

(২) কনিষ্ক বোঝাতে চেয়েছেন ভারতবর্ষ শাসন করতে মাথার প্রয়োজন হয় না। ‌

হারানো মুন্ডু নিয়ে এ ধরনের নানা জল্পনা-কল্পনা, রসিকতা, রূপকথার বেড়াজাল ডিঙিয়ে আসল কারণ কি তা হলফ করে কেউ বলতে পারবে না।

তবে, এ কথা জানা যায় মূর্তিতে মুন্ডু না থাকলেও, আসল মানুষটির মাথায় ছিল তীক্ষ্ণ বুদ্ধি, হৃদয়ে নির্ভীকতা, শৌর্যবীর্যে অতুলনীয়, শিল্পকলার প্রতি একান্ত অনুরাগ এবং শাসনকার্যে দূরদর্শিতা।

মৌর্য সাম্রাজ্যের অন্তিম লগ্নে যে কয়টি রাজবংশ পাদপ্রদীপের আলোয় আসে তাদের মধ্যে কুষাণ সাম্রাজ্যের কনিষ্ক ছিলেন উজ্জ্বলতম নক্ষত্র। তিনি শকাব্দ সন প্রবর্তন করেন এবং বৌদ্ধ ধর্ম প্রসারে, বিশেষ করে চীন দেশে, মহামতি বুদ্ধের পরেই সবচেয়ে বড় অবদান রেখে গেছেন।

ইন্দো-আর্য জনগোষ্ঠীর কুষাণদের আদি বাসভূমি মধ্য এশিয়া। সেখান থেকে তারা বর্তমান আফগানিস্তান, উজবেকিস্তান এবং তাজিকিস্তান সাম্রাজ্য স্থাপন করে প্রথম শতাব্দীতে উত্তর ভারতের বেনারস পর্যন্ত তাদের সাম্রাজ্য বিস্তৃত করেন। রাজধানী পুষ্পপুরা (বর্তমান পেশোয়ার), তক্ষশীলা এবং মথুরা। তাদের ভাষা গ্রিক ব্যাকট্রিয়ান ও সংস্কৃত।

বিশাল কুষাণ সাম্রাজ্য

কনিষ্কের জন্ম ৭৮ খ্রিস্টাব্দে রাজত্বকাল আনুমানিক ১২০ থেকে ১৪০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত।

সম্রাট কনিষ্কের রাজ দরবারে ছিলেন এক ঝাঁক উজ্জল পন্ডিত ও গুণী ব্যক্তি। তাদের মধ্যে ছিলেন আয়ুর্বেদ শাস্ত্রের জনক চরক এবং অশ্বঘোষ, বসুমিত্র, নাগার্জুন। চীনা পরিব্রাজক হিউয়েন সাঙ তার দরবারে কিছুদিন কাটিয়ে গিয়েছেন। গ্রিক শিল্পকলা দ্বারা প্রভাবিত মৌর্য এবং কুশান উভয় রীতির সাথে ভারতের মথুরা স্টাইলের শিল্পকলার রীতির মেলবন্ধন করে কনিষ্ক শিল্পকলার ক্ষেত্রে এক নতুন ব্যঞ্জনা সৃষ্টি করেন।

কুষাণ সম্রাট কনিষ্ক ও তার প্রচলিত স্বর্ণমুদ্রা

মূর্তিতে মুন্ডু না থাকলেও কনিষ্ক দেখতে কেমন ছিলেন তা তাঁর অন্য একটা মূর্তি এবং স্বর্ণমুদ্রায় খচিত মস্তিষ্কের প্রতিচ্ছবি থেকে জানা যায়। তাই তার স্টাচুতে মুন্ডু না থাকলে কি বা আসে যায়? তবে মহা প্রতাপশালী কনিষ্ক বলে কথা। স্ট্যাচু থেকে মাথা কি হলো তা নিয়ে কথা উঠবে না তা কি করে হয়?

তার মুন্ডুহীন প্রতিমূর্তি ১৯১১ সালে মথুরার কাছে এক গ্রামে পন্ডিত রাধাকৃষ্ণ আবিষ্কার করেন। ব্যস, দলে দলে শিল্পবোদ্ধারা স্টাচুটির বিচার-বিশ্লেষণ শুরু করলেন। মজার ব্যাপার, প্রথম দিকে কনিষ্কের হারানো মাথা নিয়ে কেউ তেমন মাথা ঘামান নি। পায়ের বুট এবং গায়ের কোট নিয়ে যত গবেষণা চলল।

এক পন্ডিত চেহারা-সুরত দেখে রায় দিলেন কনিষ্ক অত্যন্ত সুঠাম দেহের অধিকারী ছিলেন। মথুরার গরম আবহাওয়ায় কনিষ্কের ভারী বুট এবং মোটা জাব্বা জোব্বা দেখে একজন ইউরোপীয়ান পন্ডিত মহাফাঁপরে পড়ে গেলেন। শেষমেষ সিদ্ধান্ত টানলেন, কনিষ্ক পোশাকটি তার জন্মভূমি থেকে আনিয়েছিলেন এবং আচার-অনুষ্ঠানে পরতেন। তিনি পোশাকের সেলাই ও কারুকার্যে সম্রাট কনিষ্কের কর্তৃত্ব ও ক্ষমতার ছাপ দেখতে পেলেন।

তাই বলে হারানো মাথা নিয়ে কারো যে মাথা ব্যাথা থাকবে না তা নয়। একজন পন্ডিত রায় দিলেন সম্ভবত পরবর্তী শাসকরা মাথাটা কেটে ফেলেছেন। অন্য পণ্ডিতরা সে দাবি নাকচ করে বললেন, তাঁর দেহটা অক্ষত রেখে শুধু মাথার উপর কেন এত আক্রোশ?

শশাঙ্কের অন্য একটা স্ট্যাচু

দিন গড়ায়, ঐতিহাসিক ও পণ্ডিতেরা নানা ধরনের তথ্য হাজির করেন। বাংলা সাহিত্যের প্রখ্যাত সাহিত্যিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ও সে মিছিলে শামিল হয়েছিলেন।

তিনি যা কিছু ছিটেফোঁটা ঐতিহাসিক তথ্য রয়েছে তার সাথে কল্পনার মিশেল দিয়ে দীর্ঘ কাহিনী বিন্যাস করেছেন। তাঁর গল্পের চুম্বক এরকম।

সম্রাট কনিষ্ক অতি তুচ্ছ কারণ দেখিয়ে দক্ষিণের এক নিরপরাধ রাজা সত্যবাহনের রাজ্য আক্রমণ করেন। ‌ যুদ্ধের পূর্বে সত্যবাহনকে শর্ত দেয়া হয়েছিল, তোমার দুটো হাত কর্তন করে ফেলো নতুবা যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হও।

সত্যবাহনের মন্ত্রীরা তার একান্ত অনুগত ছিলেন।‌এ যুগের মন্ত্রীদের মত ক্ষমতার পালাবদলের সাথে সাথেই আনুগত্য পরিবর্তন করে ফেলতেন না। কনিষ্কের দরবারে হাজির হয়ে মন্ত্রীরা আবেদন রাখলেন, আমাদের রাজা এতই সাদাসিধে মানুষ যে কিভাবে রাজ্য চালাতে হয় তা জানেনই না, তাই আমরাই রাজ্য চালাই। আপনি চাইলে আমাদের হাত কেটে ফেলেন। ক্ষমতাবানরা কবেই বা অল্পে সন্তুষ্ট হন? তিনি সত্যবাহনের রাজ্য আক্রমণ করে বসেন। মন্ত্রি সভার সদস্যবৃন্দ রাজাকে জঙ্গলে লুকিয়ে রেখে তার জায়গায় একটা মূর্তি স্থাপন করে রাখেন।

কনিষ্কের শুধু অস্ত্রবলই ছিল না জাদু বলও ছিল। তিনি মূর্তির হাত দুটো কেটে ফেলেন। তার মন্ত্রীবর্গ জঙ্গলে পৌঁছে দেখেন তাদের প্রিয় রাজার হাত দু’টো কাটা পড়েছে, রাজার প্রাণহীন দেহ পড়ে আছে।

সত্যবাহনের মৃত্যুর পর তাঁর যোদ্ধারা কনিষ্কের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে। কিন্তু কনিষ্কের দেহরক্ষীদের কাটিয়ে তাঁর কাছে পৌঁছানো সম্ভব হলো না। তারা প্রাসাদের বাইরে স্থাপিত কনিষ্কের মুন্ডু কেটে নিয়ে চলে যায়। কর্তিত মুন্ডুতে লাথি মেরে প্রতিশোধ স্পৃহা পূর্ণ করতে রাণীমাকে মুন্ডুটি উপহার দেন।

কোরা ইংরেজি ভার্সনে নানা সূত্র উল্লেখ করে একজন লিখেছেন, কনিষ্ককে এক প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে উৎখাত করা হয়। তার আত্মীয়-স্বজন, বডিগার্ড এক যোগে প্রাসাদে ঢুকে‌ তাকে হত্যা করে। এ ধরনের হট্টগোলের মাঝে যা হয়, তাদের কয়েক জন মিলে তার মূর্তি থেকে মাথা বিচ্ছিন্ন করে ফেলে। ইদানিংকালেও আমরা সাদ্দাম হোসেন ও লেনিনের মূর্তি টেনে হিচড়ে নামিয়ে ফেলার দৃশ্য দেখেছি।

চৈনিক ঐতিহাসিকরাও লিখেছেন যে বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করলেও সে ধর্মের অহিংসা নীতি পরিত্যাগ করে কনিষ্ক যুদ্ধ-বিগ্রহ চালিয়ে যেতে থাকেন‌ এবং বৈদিক যুগের কিছু কিছু মূর্তিরও পূজা করতেন। তার ফলে বৌদ্ধ ধর্মের প্রতি তাঁর আনুগত্যের উপর সন্দেহ জমতে থাকে। রাজদরবারে ও জনসাধারণও সমালোচনামুখর হয়ে ওঠে। এ কারণে তাঁর সেনাবাহিনী বিদ্রোহ করে তাকে হত্যা করে।

গুগল থেকে আহরিত ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে একটা লেখা অনেকখানি বিশ্বাসযোগ্য বলে মনে হয়। সংক্ষেপে তা এ-রকম।

বৌদ্ধ ধর্ম এবং ভারতীয় সংস্কৃতি চীন দেশে এবং পূর্বের অঞ্চলগুলিতে প্রসারের ক্ষেত্রে মৌর্য সম্রাট অশোকের পরেই সব চেয়ে বেশি অবদান রেখেছিলেন মহারাজা কনিষ্ক।

কনিষ্কের ঘনিষ্ঠ বিখ্যাত ব্যক্তিবর্গের লেখা বিশ্লেষণ করে বোঝা যায় কনিষ্ক নিজেই তাঁর মূর্তি মুণ্ডহীন রাখতে চেয়েছিলেন। এটা ছিল তার জীবন দর্শনের প্রতিফলন। তিনি বলতে চেয়েছেন বিশ্বব্যাপী বুদ্ধের আদর্শ, ধর্ম-কর্ম ও জীবন দর্শন ছড়িয়ে দেয়ার ক্ষেত্রে তাঁর ভূমিকা একটা বাহন (yaan) মাত্র। এ কর্মযজ্ঞে তার মুখমন্ডল কিংবা মস্তিষ্ক কোন গুরুত্ব বহন করে না।

স্পষ্টত, মহামতি বুদ্ধের আদর্শ কনিষ্ককে ঘনিষ্ঠভাবে প্রভাবিত করেছিল। বুদ্ধ বলেছিলেন কেউ যেন তাকে পুজো না করে। তাঁর এই চিন্তার প্রতিফলন পাওয়া যায় বুদ্ধেরও একটি মুন্ডহীন ‌ প্রতিমূর্ত যা কনিষ্কের সময় মথুরায় পাওয়া যায়।

বৌদ্ধ দর্শনে ‌ মানব দেহ শুধুমাত্র আত্মার বাহ্যিক আবরণ বা পরিচ্ছদ; দেহের ভূমিকা গৌণ, মুখ্য ভূমিকা আত্মার। তাই মানব জাতির দুঃখ বেদনা লাঘবের জন্য তিনি যে মন্ত্র প্রচার করেছিলেন তার কৃতিত্ব নিতে চাননি।

মহামতি বুদ্ধের শিক্ষায় উদ্ভূত হয়ে বিনয় প্রকাশের জন্য কনিষ্ক চেয়ে ছিলেন তাঁর মূর্তি যেন মুণ্ডহীন করে গড়া হয়। সম্ভবত এ কারণে এ-‌পর্যন্ত কনিষ্কের যত মূর্তি পাওয়া গেছে তা সবই মস্তিষ্কবিহীন।

About Post Author

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Pin It on Pinterest