হিটলার সম্পর্কে আমাদের চিন্তা ভাবনা প্রভাবিত হয়েছে ব্রিটেন আমেরিকাসহ মিত্রশক্তির দেশের ঐতিহাসিকদের বর্ণনায়। বলা হয় যারা যুদ্ধে জয় লাভ করে তারাই সব সময় ইতিহাস লিখে। History is always written by the winners. তাদের লেখা কিতাবে স্বভাবতই নিজেদের গুনগানে ভরা থাকে।তারা দাবি করে যুদ্ধে নেমেছে গণতন্ত্র মানবাধিকার রক্ষার জন্য, শত্রুকে ধ্বংস না করলে তারা পৃথিবীর বুকে দাঙ্গা ফ্যাসাদ বাঁধাতে থাকবে, এই সব ছেলেভোলানো গল্প। বিজিত দেশে তাদের অত্যাচার অনাচারের কথা বিলকুল চেপে যায়। একই সঙ্গে কিছুটা সত্যের সাথে কাল্পনিক দুষ্কর্মের বয়ান দিয়ে পরাজিত শক্তিকে ইতিহাসের আস্তাকুড়ে নিক্ষেপ করে।
সম্রাট নেপোলিয়নও এক সময় বলেছিলেন, ‘What is history, but a fable agreed upon?” ইতিহাস শুধু সর্বসম্মত চিন্তা-ভাবনায় তৈরি কল্পকথা ছাড়া কিছুই নয়।
হিটলারের খ্যাতি বলেন কুখ্যাতি বলেন দুনিয়াব্যাপী ছড়িয়ে পড়েছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ কেন্দ্র করে। সে যুদ্ধে ঐতিহাসিকেরা প্রধান খলনায়ক হিসেবে হিটলারকে চিহ্নিত করেছেন। অন্যান্য খল নায়কের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ঐতিহাসিকেরা বরাদ্দ রেখেছেন পরাজিত অক্ষশক্তির নেতৃবৃন্দের জন্য। তাদের মধ্যে রয়েছেন ইটালির মুসোলিনি, জাপানের সম্রাট হিরোহিতো এবং তাঁর প্রধানমন্ত্রী তোজো।
স্বভাবতই, বিজয়ী মিত্র শক্তির তিন জন, উইনস্টন চার্চিল, জোসেফ স্ট্যালিন এবং প্রেসিডেন্ট রুজভেল্টের জন্য মহানায়ক কিংবা নায়কের ভূমিকা বরাদ্দ করা হয়েছে। যুদ্ধের শেষ পর্বে রুজভেল্ট ইন্তেকাল করলে কিছুকাল নায়কের ভূমিকায় আসেন ট্রুমান।
উইনস্টন চার্চিল
উইনস্টন চার্চিলের কথাই ধরা যাক। তিনি ভাষণ দিতে ওস্তাদ ছিলেন। পরাজয়ের সম্মুখীন হয়ে যে ভাষণটি দিয়েছিলেন ইতিহাসের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ভাষণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।
We shall fight on the beaches, we shall fight on the landing grounds, we shall fight in the fields and in the streets, we shall fight in the hills; we shall never surrender, and if, which I do not for a moment believe, this island or a large part of it were subjugated and starving, then our Empire beyond the seas, …
বলা বাহুল্য, তার ভাষণ ব্রিটেনকে রক্ষা করতে পারত না। যুদ্ধ শুরু হওয়ার প্রায় দুই বছর পরে জাপানিরা আমেরিকার পার্ল হারবারে তাদের সামরিক স্থাপনা গুঁড়িয়ে দেওয়ার কারণে আমেরিকা মিত্রশক্তির সাথে যোগ দেওয়ার পর বৃটেনের চুপসে যাওয়া পালে হাওয়া লাগে।
চার্চিল ছিল বর্ণবাদী, কট্টর উপনিবেশবাদী। কলোনিগুলোর প্রতি তার ব্যবহার ছিল নির্মম। নিজেদের নাগরিকদের যুদ্ধের ঝুঁকিতে বেশি না পাঠিয়ে কলোনিগুলো থেকে সেনা সংগ্রহ করে যুদ্ধের ময়দানে ঠেলে দেন। ব্রিটিশ ভারত থেকেই ২৫ লক্ষ সেনা পৃথিবীর বিভিন্ন রণাঙ্গনে অক্ষশক্তির সাথে যুদ্ধ করতে পাঠান। তাদের মধ্যে ৮৭ হাজার মৃত্যুর মুখে ঢলে পড়ে। অসংখ্য লোক পঙ্গু হয়ে যায়।
চার্চিলের সবচাইতে বড় অপকীর্তি ১৯৪৩ সালে মানবসৃষ্ট দুর্ভিক্ষে অবিভক্ত বাংলার প্রায় ৭০ লক্ষ মানুষ মারা গেলে তাদের সাহায্য ত করেনই নাই বরং যারা সাহায্য করতে চেয়ে ছিলেন তাদেরকে বিরত রাখেন। তিনি বলেছিলেন, ভারতীয়রা খরগোশের মত জন্মই দিতে জানে, তাদের সাহায্য করে কোন লাভ হবে না। কাঁটা ঘায়ে নুনের ছিটা।
যুদ্ধের মাঝপথে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট রুজভেল্টের কাছে ওয়াদা করলেও তিনি কলোনিগুলোতে ছেড়ে দিতে চাচ্ছিলেন না।
যুদ্ধের পর চার্চিলের কনজারভেটিভ পার্টি হেরে না গেলে এত তাড়াতাড়ি উপমহাদেশের দেশগুলো বৃটেনের কবল থেকে মুক্তি পেত না। গান্ধীজীর অসহযোগ আন্দোলন, তিতুমীরের বাঁশের কেল্লা ,ক্ষুদিরামের ফাঁসি, চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন এসব শুধু গল্পের বইতে স্থান করে নিত। ব্রিটিশদের ভয় হয়েছিল শুধু নেতাজি সুভাষচন্দ্রকে নিয়ে। তার নির্দেশে ব্রিটিশ বাহিনীতে ভারতীয় সেনা ও নৌ সেনারা বিদ্রোহ করার আশঙ্কা ছিল। মূলত এ কারণে ব্রিটিশরা তড়িঘড়ি করে স্বাধীনতা দিয়ে দেশে ফিরে যায়।
তাহলে আমরা উইস্টন চার্চিল কে খলনায়ক হিসেবে চিহ্নিত করতে পারি।
জোসেফ স্ট্যালিন
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মিত্রপক্ষের অন্য তথাকথিত নায়ক জোসেফ স্ট্যালিন। তাকে নায়কের আসনে বসালে ঘোরতর আপত্তি উঠবে। তাকে একজন নিষ্ঠুর ডিক্টেটর হিসেবে গণ্য করা হয়। বুদ্ধিশুদ্ধিও কম ছিল বলে মনে হয়।
যুদ্ধের প্রথম পর্বে তিনি হিটলারের সাথে একটা শান্তি চুক্তি করে বসলেন। অবশ্য প্রথমে চেষ্টা করছিলেন ফ্রান্স এবং বৃটেনের সাথে একটা সমঝোতায় আসতে। তেমন সাড়া না পেয়ে বড্ড অসহায় বোধ করছিলেন। তাই, বিশ্ব যুদ্ধ শুরু হওয়ার অল্প কিছু আগে অনেক চেষ্টা চরিত্র করে হিটলারের সাথে অনাক্রমণ চুক্তি করে ফেললেন।
হিটলারও তাই চাচ্ছিলেন। তার উদ্দেশ্য ছিল পোলান্ডকে কব্জা করা। কোন বড় শক্তি যাতে বাঁধা নাদাঁড়ায় সে লক্ষ্যে তিনি দেশটিকে ভাগাভাগি করে নেয়ার শর্ত রেখে চুক্তিতে সম্মতি দেন। সে সঙ্গে পূর্ব ইউরোপের ছোটখাটো রাষ্ট্রগুলো রাশিয়া জার্মানি নিজেদের জন্য ভাগ বাটোয়ারা করার প্রোগ্রাম বানিয়ে ফেলল।
যুদ্ধ শুরু হলে পোল্যান্ডের একাংশ হিটলার দখল করেন অন্য অংশ রাশিয়া। চুক্তির গোপন শর্ত অনুযায়ী রাশিয়া ফিনল্যান্ডও দখল করে নেয়। এভাবে বেলারুশ লাটভিয়া এবং অন্যান্য কয়েকটি দেশ স্ট্যালিন কুক্ষিগত করে।
পশ্চিম ইউরোপে হিটলার ফ্রান্স বেলজিয়াম সুইডেন নরওয়ে ডেনমার্ক নেদারল্যান্ডস, লাক্সেম্বোর্গ, যুগোস্লাভিয়া ও গ্রীস দখল করে রাশিয়ার সাথে অনাক্রমণ চুক্তি ছুড়ে ফেলে সে দেশে আক্রমণ চালায়। রাশিয়ায় চরম অত্যাচার চালিয়ে সামরিক বেসামরিক লোক হত্যা করে হিটলার পরিশেষে প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি স্বীকার করে পরাজয়ের গ্লানি নিয়ে রাশিয়া জয়ের আশা ত্যাগ করেন।
যুদ্ধের শেষ পর্যায়ে পাল্টা আক্রমণে রাশিয়ার সেনাবাহিনী জার্মানিতে চরম অত্যাচার নির্যাতন চালায়। জার্মানির বিরুদ্ধে প্রতিশোধ এবং তাদের মনোবল ভেঙ্গে দেওয়ার জন্য স্টালিনের উৎসাহ পেয়ে রাশিয়ার সেনাবাহিনী প্রায় ২০ লাখ জার্মান মহিলার শ্লীলতাহানি করে। তাদের অনেকেই আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়।
স্ট্যালিন কে আমরা খলনায়ক হিসেবে চিহ্নিত করতে পারি।
প্রেসিডেন্ট রুজভেল্ট
আমেরিকা প্রথমদিকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জড়াতে চায়নি। তার মনোভাব ছিল, ইউরোপীয়রা নিজেদের মধ্যে বারবার গ্যাঞ্জাম বাঁধালে আমাদের হস্তক্ষেপ করার কি দরকার? তারচেয়ে অস্ত্রশস্ত্র বিক্রি করে কোষাগার বৃদ্ধি করাই উত্তম। ব্রিটেন অনেক অনুনয় বিনয় করেও তাকে যুদ্ধের ময়দানে নামতে পারেনি।
যুদ্ধ শুরুর দুই বছর পরে জাপান পার্ল হারবার আক্রমণ করলে যুক্তরাষ্ট্র যুদ্ধে নেমে পড়ে। তার ফলে যুদ্ধের মোড় ঘুরে যায়। রুজভেল্ট ব্রিটিশ থেকে ওয়াদা আদায় করেন যে যুদ্ধের পর ভারতসহ কলোনিগুলোকে স্বাধীনতা দিবে। তার সদিচ্ছার জন্য তাকে কৃতিত্ব দেওয়াই যায়। তবে তার সেনাবাহিনী জার্মানিতে জুলুম করেছিল বলে অভিযোগ করা হয়। প্রেসিডেন্ট হিসাবে তিনি তা ঠেকাতে ব্যর্থতার কারণে নায়কের আসন বরাদ্দ করা যায় না।
হ্যারি ট্রুম্যান
ইউরোপে যুদ্ধ শেষ হলেও পূর্বে এশিয়ায় জাপান কোণঠাসা হয়ে আসছিল। জাপান চিন্তাভাবনা করছিল আত্মসমর্পণ করার। এ পর্যায় রুজভেল্ট হঠাৎ মারা গেলে ট্রুম্যান প্রেসিডেন্ট পদ গ্রহণ করেন। সেনাবাহিনী দ্বারা জাপানের মূল ভূখণ্ডে আক্রমণ চালিয়ে লোক ক্ষয় এড়াতে তিনি হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে বোমা বর্ষণের নির্দেশ দেন। প্রায় আড়াই লক্ষ লোক প্রাণ হারায়। তাঁকে নায়কের তালিকা থেকে বাদ দেয়া যেতে পারে।
সম্রাট হিরোহিতো প্রধানমন্ত্রী তোজো
হিটলারের অক্ষশক্তি জোটের অন্যতম সহযোগী জাপানের সম্রাট হিরোহিতো এবং তার প্রধানমন্ত্রী তোজো বিজিত দেশগুলোয় চরম মানবাধিকার লংঘন করেছিল। যুদ্ধবন্দীদের উপর নির্দয় ব্যবহার করে অনেককে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়েছিল। যুদ্ধ শুরু হওয়ার আগেই তারা মাঞ্চুরিয়াতে অভিযান চালিয়ে বিশাল অংশ দখল করে গণহত্যায় মেতে ওঠে, প্রচুর অত্যাচার অনাচার করে জনজীবন দুর্বিষহ করে তোলে। সম্রাট হিরোহিতো এবং প্রধানমন্ত্রী তোজোকে খলনায়ক হিসেবে চিহ্নিত করা যায়।
এডলফ হিটলার
সামান্য ছোটখাটো একটা সামরিক কর্মকর্তা থেকে হিটলার তার সাহস ও বুদ্ধিমত্তার কারণে জার্মানির হর্তাকর্তা বিধাতা বা ফুয়েরারে পরিণত হন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে মিত্রশক্তি জার্মানির শতকরা ১৩ ভাগ কেটে নিয়ে অন্যদের বরাদ্দ করে, বিশাল অংকের ক্ষতিপূরণের বোঝা চাপিয়ে দেয়। সে যুদ্ধে ইহুদিরা শত্রুর সাথে হাত মেলানোর কারণে জার্মানির পরাজয়ের অন্যতম কারণ হিসেবে তারা মনে করত।
হিটলার বিধ্বস্ত জাতিকে বুদ্ধি, কৌশল ও বাগ্মিতা দ্বারা অতি অল্প সময়ে জার্মান বাহিনীকে শক্তিশালী করে গড়ে তুলতে সক্ষম হন। সে কারণে ইহুদিদের উপর তার আক্রোশ ছিল। মিত্রশক্তির দাবি করে জার্মানির গ্যাস চেম্বারে ৬০ লক্ষ ইহুদিকে নিশ্চিহ্ন করে দেয়া হয়। ইহুদিদের প্রতি পৃথিবীর মানুষের সমবেদনা আদায়ের জন্য সংখ্যাটা যে বাড়িয়ে বলা হয়েছে তাতে সন্দেহ নেই।
ব্রিটেন ফ্রান্স ছিল তাদের চোখের শুল। অন্যদিকে তাঁর ধারণা ছিল নরডিক নীল রক্তের জাতি হিসেবে তাদের পৃথিবী শাসন করার ক্ষমতা আছে। মোটকথা, অহমিকা সঙ্গে নিয়েই তিনি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সূচনা করেন। এক ঝটকায় আশেপাশে দুর্বল দেশগুলোকে কব্জা করে নেন।
রাশিয়ার সাথে অনাক্রমণ চুক্তি লংঘন করে তিনি সে দেশে অত্যাচার স্টিমরোলার চালু করেন। ইতিহাসের সবচাইতে রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম। সে যুদ্ধে জার্মানি সাত লক্ষ ৭৫ হাজার সেনা হারায়। রাশিয়ার ৮ লক্ষ সেনা হত হয়, আহত ও জার্মানীর হাতে বন্দী হয় ৬০ লক্ষ।
দ্বিতীয় বিশ্বে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে পৃথিবীব্যাপী প্রায় ৮ কোটি মানুষ মারা যায়। সেই যুদ্ধের ক্ষয়ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে লেগে যায় বহু যুগ।
ইউরোপীয় উপনিবেশবাদীদের মূলে আঘাত করে হিটলার তাদের কবল থেকে কলোনিগুলোকে মুক্ত করার পথ খুলে দেয় বটে কিন্তু দীর্ঘ ৬ বছর যাবৎ পুরো দুনিয়াকে এক ধ্বংসাত্মক পরিস্থিতিতে ঠেলে দিয়েছিলেন। সেজন্য তাকে নায়ক বা মহানায়কের আসনে বসানো সমীচীন হবে না।
