October 29, 2025

বিদেশ ভ্রমণের সময় অনেক সময় অস্বস্তিকর পরিস্থিতির মধ্যে পড়তে হয়। কখনো বা বিপদও ডেকে আনি। সেসব বিপদ আপদ এবং তা থেকে সাবধানতা অবলম্বনের জন্য হালকা মেজাজে কিছু পরামর্শ রাখা গেল।

অস্ট্রেলিপ্রয়া: অস্ট্রেলিয়াকে বলা হয় Down Under. ইউরোপের মানচিত্র তৈরির কারিগরদের ‌ কেরদানিতে‌  বিশ্ব মানচিত্রে অস্ট্রেলিয়া দক্ষিণ গোলার্ধের একেবারে নিচে‌ নির্বাসিত‌। এ কারণেই ডাউন আন্ডার। প্রথমদিকে তৈরি পৃথিবীর মানচিত্রে ইউরোপের অবস্থান ছিল নিচে। দেখতে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দেশ। পরবর্তীতে নিজেদের বড় করে দেখানোর মতলবে উপরে নিয়ে এসেছে। প্রতিবাদ হিসেবে কয়েকজন অস্ট্রেলিয়ান নিজেদের উপরে রেখে মানচিত্র তৈরী করে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে ছেড়েছিলেন।

অস্ট্রেলিয়ার সব কিছুই উল্টোপাল্টা। উত্তর গোলার্ধে যখন আমরা শীতে কাঁপতে থাকি অস্ট্রেলিয়ানরা তখন গরমে হাঁসফাঁস করে। পশুপক্ষী সব বিচিত্র।  তাদের ভাষা ইংরেজি কিন্তু উচ্চারণ বড্ড গোলমেলে। তার আঁচ পেয়েছিলাম সিডনি ভ্রমণের সময়।

সিডনি পৌছার পর হোটেলের রিসেপশনের  ছোকরার কথা শুনে অবাক, ভীতও বটে…Have you come to die in Australia? সোজা বাংলায়, “তুমি কি অস্ট্রেলিয়ায় মরতে এসেছো?”

মনে মনে ভাবলাম, সে কি কথা, ক্যাপ্টেন কুক প্রায় সাড়ে চারশো বছর আগে অস্ট্রেলিয়া আবিষ্কার করে এদেশের আদি অধিবাসীদের হত্যা ও লুণ্ঠন করে জেকে বসেছিল। এখন তো সে ট্রাডিশন চালু রাখার কথা নয়।

তাদের এ ধরনের হুমকি আক্ষরিক অর্থে নেবেন না।  এ যুগের অস্ট্রেলিয়ানরা সভ্য ও অনেকটা নরম স্বভাবের। কিন্তু ‘to day’ তাদের উচ্চারণে পরিণত হয় to die– Have you come today তাদের উচ্চারণে আমাদের কানে বাজে Have you come to die হয়ে। ইংরেজি a অক্ষর তাদের উচ্চারনের রূপান্তরিত হয় i অক্ষরের মত। অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেট ধারাভাষ্যকারদের ভাষ্যে‌ এ ধরনের উচ্চারণ শোনা যায়।

অস্ট্রেলিয়ার ট্রেডমার্ক পেটে থলে ঝোলানো  নিরীহ চেহারার  দু পায়ে ভর দিয়ে চলা ক্যাঙ্গারু বিস্ময়কর জন্তু। ‌ তবে, তাদের গায়ে পায়ে হাত বুলিয়ে ভালো করে খতিয়ে দেখার কৌতূহল দেখাবেন না। আপনার আদর সোহাগ উস্কানি বলে ভুল করার সম্ভাবনা ষোল আনা। উস্কানি ছাড়াও যদি  কোন ক্যাঙ্গারুকে দাঁত মুখ খেঁচিয়ে তেড়ে আসতে‌ দেখেন তাহলে দ্রুত প্রাণ বাঁচাতে নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজ করেন । ক্যাঙ্গারুর শক্তিশালী পদযুগলের আঘাত বড্ড ভয়ংকর। হাসপাতাল এমনকি মর্গের ঠিকানায় পাঠিয়ে দিতে পারে।

পাকিস্তান: পাকিস্তানের সীমান্ত অঞ্চলের পাঠানরা গায়ে পায়ে ভারি, বিদ্যুতের খুঁটির মতো লম্বা। মহব্বত করে   তোড় জোড় করে আলিঙ্গন করতে এগিয়ে এলে কৌশলে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করবেন। আপনি নিজে গায়ে পায়ে খাটো হলে বুকের পাঁজরের দু একটা হাড্ডি স্থানচ্যুত হওয়ার সম্ভাবনা বাতিল করা যায় না। সৈয়দ মুজতবা আলী তার কালজয়ী ‘দেশে বিদেশে’ গ্রন্থে কাবুল যাত্রার পথে পেশোয়ার রেলস্টেশনে পাঠান বন্ধুর আলিঙ্গনে পিষ্ট হয়ে যেভাবে নাকাল হয়েছিলেন তাঁর স্বভাবসুলভ রসাত্মক বর্ণনা দিয়েছেন।

ভারত: বিদেশে গেলে আপনার মনে হয়তো পছন্দের বিফ স্টিকের স্বাদ গ্রহণের ইচ্ছা জেগে উঠতে পারে। ভারত ভ্রমণের সময় সে ইচ্ছেটা সযত্নে চেপে রাখুন। আপনার ইচ্ছের কথাটা প্রকাশ করলে ওয়েটার চমকে উঠবে, আশেপাশে ভোজনরত লোকজন ভ্রু কুঁচকে তাদের অসন্তোষ প্রকাশ করবেন।

ভুটান: ছোট্ট শান্তিপ্রিয় সৌন্দর্যশমন্ডিত ভুটান টুরিস্টদের আকর্ষণীয় গন্তব্য।  প্রকৃতির সাথে মিলেমিশে একই ঐক্যতানে অনাড়াম্বর জীবনযাত্রা তাদের সুখ শান্তির মূল চাবিকাঠি।

ভুটান বৈচিত্রপূর্ণ দেশ। দেশের সর্বত্র বৌদ্ধমন্দিরের ছড়াছড়ি। বুদ্ধের আরাধনা তাদের দৈনন্দিন কর্মকাণ্ডের অংশ। ছোট বড় অনেক শহরে প্রাচীন এবং মধ্যযুগের দুর্গ রয়েছে। এর নাম জং। এখন জংগুলো প্রশাসনিক কার্যক্রম এবং একই সঙ্গে উপাসনা স্থল হিসাবে ব্যবহার করা হয়।

ভুটানের রাজধানীর থিম্পুতে এ ধরনের একটা বড় জং রয়েছে। সে দেশে  আমরা দলবলসহ একটি জঙ্গে ঢুকতে গেলে গার্ড বাঁধা দিল। আমাদের দলের এক মহিলার মাথায় হিজাব ছিল। তাদের দাবি মাথা ঢেকে জংয়ে প্রবেশ করা নিষেধ। মাথা ঢেকে গেলে নাকি মন্দিরের বুদ্ধ মূর্তি এবং কর্মকর্তাদের অসম্মান করা হয়। এদিকে আমাদের মহিলার দাবি তিনি হিজাব খুলবেন না। শেষমেষ হিজাব পরেই তাকে ঢুকতে দেওয়া হল। উপমহাদেশের অন্যান্য অঞ্চলে হাতে কিছু গুঁজে দিলেই পথ ছেড়ে দেয় কিন্তু ভুটানে দুর্নীতি এখনো মাথাচাড়া দিয়ে ওঠেনি।

বিভিন্ন দেশের কালচার কত বৈচিত্রে ভরা। মুসলিম দেশের কোন মসজিদ মাজারে মহিলাদের মাথা না ঢেকে ঢুকতে দেওয়া হয় না। এক দেশের সম্মান, অন্য দেশের অসম্মান।

থাইল্যান্ড: মেসেজ করে শরীর চাঙ্গা করার কালচার সব দেশেই আছে। ব্যাংককের প্রতিটি রাস্তায় একাধিক মেসেজ পার্লার রয়েছে। অভিধানে মেসেজ পার্লার সম্পর্কে যে বর্ণনা রয়েছে তা ভেবে চট করে ঢুকে পড়বেন না। থাইল্যান্ড ম্যাসেজকে শিল্প পর্যায়ে রূপান্তরিত করেছে। অনেক ধরনের ম্যাসেজ রয়েছে, তার মধ্যে কোন কোনটি রক্ষণশীলদের জন্য অস্বস্তির কারণ হয়ে দেখা দিতে পারে।

সিঙ্গাপুর: সিঙ্গাপুরের আইন কানুন বড্ড কড়া। পরিষ্কার ঝকঝকে রাস্তাঘাট। মনের সুখে সিগারেটে সুখ টান দিয়ে রাস্তায় ফেলে দিবেন না। ভাবছেন আশেপাশে পুলিশ নেই, কেইবা আবার দেখবে? অচিরেই আপনার ভুল ভাঙবে। কোন অদৃশ্যভলোক থেকে একজন পুলিশ উদয় হবে, হাতে ৩০০ ডলার জরিমানার  টিকেট।
লিফটে উঠে ভাবলেন, মুত্রাশয়ের চাপটা বড্ড কষ্ট দিচ্ছে। লিফটে অন্য কেউ নেই; মূত্র বিসর্জনের কাজটা সেরে নেই। সাবধান,  লিফটে মূত্রের গন্ধ  শোঁকার মেশিন লাগানো রয়েছে। এলার্ম বাঁজতেই লিফটের তালা বন্ধ, নিরাপত্তার লোকজন হাজির। হাতে হাতকড়া।

ফিনল্যান্ড: ফিনল্যান্ডের নিজস্ব স্টিম বাথের নাম সৌনা বাথ। আপনার মনে খায়েশ জাগতে পারে, আহ্, ফিনল্যান্ডে যখন এসেছি তখন সৌনা বাথের মজাটা উপভোগ করি না কেন? ব্যাস আপনি ছোটখাটো দোযখের খাতায় নাম লিখে ফেললেন।

সৌনা রুমে বড় একটা হিটার চালিয়ে ১০০° সেলসিয়াস তাপ সৃষ্টি করা হয়। ফেন্সি ড্রেস পরে একটু গরম হবেন তার উপায় নাই। অন্যরা হাসাহাসি করবে। বেশিরভাগ লোকই উদম গায়ে বসে যায়, কেউ একটু কাপড় জড়িয়ে। ‌ কয়েক মিনিটের ভিতর আপনাকে রোস্ট বানিয়ে ছাড়বে। ‌ তারপর ঠান্ডা পানিতে স্নান করে ‌ ফুরফুরে মেজাজে বাসায় ফিরবেন। ‌ একে নাকি রোগ বলাই দূরে থাকে, মেজাজ মর্জি ঠান্ডা, টেনশন গায়েব।

ফিনরা আচার ব্যবহারে ভদ্র কিন্তু গাল গল্প করতে পছন্দ করে না। খেতে বসে গল্প জুড়তে চেষ্টা করলে শুনতে হবে, রেস্টুরেন্টে আমরা কি খেতে এসেছি না গল্প করতে এসেছি?

প্যারিস: ফরাসি এবং ব্রিটিশদের মধ্যে বৈরিতা অনেক পুরনো। ইংরেজি ভাষা জানলেও তারা সে ভাষায় টুরিস্টদের সাথে কথা বলতে পছন্দ করে না। প্যারিস ভ্রমণ করার ইচ্ছা থাকলে টুকটাক কিছু ফরাসি শব্দ শিখে না গেলে পদে পদে ঝামেলা পোহাতে হতে পারে।

লন্ডন: লন্ডনে রেস্টুরেন্টে খেতে বসে কি খাবেন তা নিয়ে চিন্তাভাবনায় পড়ে যাবেন। একেতো স্বাদ ভালো না, তার ওপর বিফ ও পর্কের ছড়াছড়ি। কোন ধর্মে বিফ খাওয়া নিষিদ্ধ, কোন ধর্মে পর্ক। এতসব ঝুট ঝামেলা এড়ানোর উত্তম উপায় ফিস অ্যান্ড চিপস। স্বাদ ভালো দামে কম। সাথে ফ্রেন্স ফ্রাই।

নিউইয়র্ক: আমেরিকার নাম শুনলে চোখের সামনে ভেসে ওঠে নানা রঙের নানা ঢংগের ফাস্টফুড। সোডিয়াম, স্যাচুরেটেড ফ্যাট এবং কোলেস্টেরলে ভরা। খেতে মজা কিন্তু শরীরটা ফুলে ফেঁপে হয়ে ওঠে হাতির মত। রাস্তায় ভিড়ের মাঝে তারা অনেকেই জগন্নাথের রথের মতো শরীরটা টেনে নিয়ে যান।

জগন্নাথ কথাটি ইংরেজি ভাষায় ঢুকে পড়েছে। Juggernaut অর্থ বিশাল আকারের গাড়ি, পথের বাধা বিঘ্ন ভেঙ্গেচুরে এগিয়ে চলে। আমেরিকার মানুষরূপী জগন্নাথের গাড়ির মুখোমুখি সংঘর্ষ হলে হাড় ও মাংস এক হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা বেশি।

সুইজারল্যান্ড: জুরিখ বা জেনেভাতে চকলেটের দোকানে হরেক রকমের চকলেট দেখে চক্ষু জুড়িয়ে যাবে। স্বাদে গন্ধে মন ভরে যায় কিন্তু পকেট হালকা হয়ে উঠে। অন্যান্য দেশে তৈরি একই ব্র্যান্ডের চকলেট সুইজারল্যান্ডে প্রায় দ্বিগুণ দাম। বাস্কেট ভরে‌ বাড়ি ফিরে বাচ্চাদের তাক লাগিয়ে দিবেন সে চিন্তা বাদ দেন। প্রায় একই‌ মানের চকলেট অন্যান্য দেশ থেকে কেনাই বুদ্ধিমানের কাজ।

About Post Author

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Pin It on Pinterest