স্লোভেনিয়ার নাম বাংলাদেশের অনেকেই শুনেন নাই। দেশটা ছােট-আল্পস পর্বত ও অ্যাড্রিয়াটিক সাগরের মাঝখানে ক্ষুদ্র এক জনপদ। লােক সংখ্যা মাত্র ২০ লাখ, আমাদের অনেক জেলার চেয়েও কম। আশেপাশের আরও কয়েকটী ক্ষুদ্র দেশ —বসনিয়া, ক্রোয়েশিয়া, সার্বিয়া, আলবেনিয়া, কসােভাে। এদের নাম আমরা প্রায়ই শুনে থাকি ভিন্ন কারণে-ঝগড়া ফ্যাসাদ গন হত্যা, বিশেষ করে মুসলিম নিধনের বধ্যভূমি হিসেবে।
ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জনপদ হলে যা হয়, বড় বড় শক্তিগুলাে তাদের নিয়ে ফুটবল খেলায় মেতে ওঠে—এক দল চায় বল নিজেদের কজায় রাখতে, অন্য দল চায় কেড়ে নিতে।
স্লোভানিয়াকে নিয়ে বল খেলার ফাঁকে চতুর্দশ শতাব্দীতে হ্যাপসবার্গ সাম্রাজ্য এলাকাটি তাদের দখলে নিয়ে নেয়। এর পরপরই ১৩৬১ সালে তুরস্কের অটোমান সাম্রাজ্য স্লোভেনিয়াসহ বলকান এরিযা কব্জা করে ফেলে।
যুগ যুগ ধরে বলকান এলাকায় ঝগড়া ফ্যাসাদ যুদ্ধ-বিগ্রহ লেগেই থাকত।এই এলাকাতেই সার্বিয়ায় Austro-Hungaria সাম্রাজ্যের ভাবী উত্তরাধিকারী যুবরাজকে হত্যার মাধ্যমে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের দামামা বেজে উঠে।
দুই যুগেরও বেশী আগে বলকানের প্রত্যন্ত অঞ্চলে একটি দেশো ভ্রমণের সুযোগ হয়। দেশটির নাম স্লোভেনিয়া।
তখন চাকরি করি সিকিউরিটি প্রিন্টিং কর্পোরেশনে। সাদামাটা বাংলা নাম টাকশাল। অনেকেই মনে করতেন, বাব্বা, টাকশালের ম্যানেজিং ডাইরেক্টর। কত সুথের চাকরি? সকালে অফিসে যাওয়ার পথে সাথে ব্যাগ নিযে যাও–ফেরার পথে ব্যাগ ভরে ফিরে এসাে। সরকারি স্কেলের তৃণসম বেতনে সংসার চালানাের ঝক্কি ঝামেলার কেচ্ছা শুনতে শুনতে কান ঝালাপালা করার দিন শেষ।
সে সুখে থাকুন!!
স্লোভেনিয়া গিয়েছিলাম একটা সিকিউরিটি পেপার বানানো কোম্পানির সাথে আলাপ আলােচনার জন্য। কোম্পানির বাংলাদেশের এজেন্ট, আবুল কালাম সাহেব আমাকে সঙ্গ দিলেন।
যুদ্ধের পর বিশ্ব নেতারা এলাকার এখান থেকে এক খন্ড, সেখান থেকে অন্য এক খন্ড কেটে জোড়াতালি দিয়ে নতুন একটা রাষ্ট্র গঠন করে নাম রাখে যুগােস্লাভিয়া। যুদ্ধকালীন শক্তিশালী নেতা মার্শাল টিটো শক্ত হাতে জোড়াতালি দিয়ে গড়া রাষ্ট্রটি টিকিয়ে রাখতে পেরেছিলেন। তার মৃত্যুর পর যুগােস্লাভিয়া ভেঙ্গে টুকরাে টুকরাে হয়ে যায়। স্লোভেনিয়া সৌভাগ্যক্রমে ১৯৯০ সালে সালে যুগােস্লাভিয়া থেকে আলাদা হয়ে স্বাধীন রাষ্ট্রে পরিণত।
ভেঙ্গে যাওয়া যুগােস্লাভিয়ার অন্য টুকরােগুলাে ততটা ভাগ্যবান ছিল না। বসনিয়া, হার্জেগােভিনা, ক্রোয়েশিয়া আলবেনিয়া কসােভাে রক্তের হােলি খেলায় মেতে ওঠে।
বলকান এলাকার মুসলিম জনতার ওপর নেমে আসে সার্বদের অত্যাচার-নির্যাতনের খড়গহস্ত। কিন্তু ইউরােপ আমেরিকার শক্তিধররা হাত গুটিয়ে তামাশা দেখতে থাকে। বিচিত্র তাদের চিন্তা ধারা। যুদ্ধ লাগিয়ে দিয়ে অস্ত্রশস্ত্র বিক্রি করে তাদের ধন সম্পদের ভান্ডার ভরে তােলে; ধ্বংসলীলা শেষ হলে পুনর্গঠনের জন্য মালপত্র সাপ্লাই দিয়ে নিজেদের অর্থনীতি চাঙ্গা করে।
স্লোভেনিয়ার এক প্রান্তে জার্মান বর্ডারের কাছে রাডিচি নামে এক শহরে ফ্যাক্টরিটা দেখার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। কমিউনিস্ট শাসনের আগে প্রতিষ্ঠিত সুন্দর ফ্যাক্টরিটি কমিউনিস্ট আমলে অব্যবস্থার শিকার হয়ে ধুকে ধুকে চলছিল। ব্যবসা-বাণিজ্য পরিচালনার জন্য ছোকরা টাইপের আনাড়ি ম্যানেজিং ডাইরেক্টরের বুদ্ধি ও অভিজ্ঞতা প্রায় শূন্যের কোঠায়। সম্ভবত পার্টির লোক বলে তাকে সে পদে বসানো হয়েছিল। অকারণেই কমিউনিস্ট প্রথা ভেঙে পড়েনি।
আমাদের কাজকর্ম শেষ করে দেশটির রাজধানী লুবিয়ানায় এসে শহরটা ঘুরে দেখার কৌতুহল হল। ছোট্ট ছিমছাম পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন শহর। একটি রাস্তায় টেলিভিশন স্টেশনের সামনে একটি অভিজাত শ্রেণীর রেস্টুরেন্টের নাম ফলকে চোখ আটকে গেল।
স্লোভেনিয়ার বুড়াের বাংলাদেশ প্রীতি
রেস্টুরেন্টের নামফলকে লেখা ‘Café Bangladesh’
অবাক কান্ড!
বাংলাদেশের নামে রেস্টুরেন্ট থাকতেই পারে–তাতে অবাক হওয়ার কি আছে? কিন্তু, এলাকাটা পাহাড় পর্বত, ঘন বনরাজি বেষ্টিত মধ্য ইউরােপের বলকানের প্রত্যন্ত অঞ্চল যেখানে বাংলাদেশের কারাে পদচিহ্ন আদৌ পড়েছে কিনা সন্দেহ।
সে পাণ্ডব বর্জিত, বরং বলা উচিত বাঙালি বর্জিত দেশে বাংলাদেশ নামের রেস্টুরেন্ট দেখে অবাক হওয়ারই কথা। শহরটির নাম Ljubljana– উচ্চারণ লুবিয়ানা–স্লোভেনিয়ার রাজধানী। নিশ্চিন্ত হওয়ার জন্য চোখ রগড়ে প্রত্যেকটা অক্ষর বানান করে পড়লাম B-A-N-G-L-A D-E-S-H.
রহস্য উদঘাটনে রেস্টুরেন্টে ঢুকে পড়লাম। অকুস্থলে পৌঁছালাম বটে, কিন্তু ভাষার ব্যবধান আমাদের তদন্ত কাজে বাঁধা হয়ে দাঁড়ালাে। কাউন্টারের পিছনে ম্যানেজার জাতীয় একজন বয়স্ক লোক বসে ছিলেন, শূন্য দৃষ্টিতে আমাদের দিকে তাকিয়ে থাকলেন। ইংরেজি ভাষার তার দক্ষতা ইয়েস নাে এবং গুড এই তিন শব্দের মধ্যে সীমাবদ্ধ।
তবে, ডায়লগ চালাতে হলে ভাষার ভূমিকা মাত্র অর্ধেক। বাকি অর্ধেক আকার ইঙ্গিত। নাচন কুর্দন। কিছুটা পারস্পরিক সহমর্মিতা।
আমার সাথী কালাম দক্ষ নৃত্য পরিচালকের মত ডান হাত ভাঁজ করে বুকে লাগিয়ে জানান দিলেন, বাংলাদেশ, অর্থাৎ আমরা বাংলাদেশের লােক। বয়স্ক ম্যানেজার লাফিয়ে উঠে চিৎকার করে উঠলেন বাংলাদেশ’ ‘বাংলাদেশ’।
রেস্টুরেন্টের ভোজনরসিকদের মধ্যে চাঞ্চল্য দেখা গেল। তারা এতদিন শুধু রেস্টুরেন্টের নাম ফলকে বাংলাদেশ শব্দ দেখে এসেছে। এবার সে অজানা মূলুকের জ্বল-জ্যান্ত দু’জনকে দেখে অবাক হওয়ারই কথা।
বৃদ্ধ সিট থেকে আমাদের নিয়ে এক কর্নার টেবিলে বসিযে কফির অর্ডার দিলেন। দূরের একটা টেবিল থেকে দুটো বাচ্চা ছেলে মেয়ে হাজির হল অটোগ্রাফ নিতে।
বৃদ্ধ ম্যানেজার স্লোভেনিয়া ভাষায় কিচিরমিচির করে যা বললেন তা থেকে উদ্ধার করতে পারলাম কযেকটি শব্দ বাংলাদেশ গুড, গুড।। শেষের দিকে তার বাক্যবাণ কিছুটা মন্থর হলে তার থেকে উদ্ধার করা গেল মাত্র দুটো নাম শেখ মুজিব, মার্শাল টিটো।
আমাদের কাছাকাছি একটি টেবিলে বসা ছিলেন একজন টুরিস্ট মহিলা। বৃদ্ধের সাথে আমাদের এত ক্ষণ বাক্য বিনিমযের ব্যর্থ প্রচেষ্টা দেখছিলেন। এবার আমাদের সাহায্যে এগিয়ে এলেন। ইংরেজিতে জিজ্ঞেস করলেন, মে আই হেল্প ইউ? আমার নাম সুসান, অস্ট্রিয়া থেকে এসেছি।
পাশের চেয়ার দেখিয়ে বসতে অনুরােধ করে বললাম, ম্যানেজার কি বলছে একটু যদি বুঝিয়ে বলতেন। সুসান যা বললেন তার সারমর্ম এই বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের যুগােস্লাভিয়া নেতা মার্শাল টিটো বাংলাদেশের প্রতি অকুণ্ঠ সমর্থন জানিয়েছিলেন।
বাংলাদেশকে যেসব দেশ প্রথমে স্বীকৃতি দিয়েছিল তার মধ্যে যুগোস্লাভিয়া ছিল অন্যতম। ২২শে জানুয়ারি, ১৯৭২।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রতি একাত্মতা জানাতে বৃদ্ধ তার রেস্টুরেন্টের সাথে সে দেশের নাম জুড়ে দিয়েছেন। মার্শাল টিটো ছিলেন স্লোভেনিয়ার সন্তান।
দূর দেশে এই বৃদ্ধ বাংলাদেশের প্রতি ভালবাসা জ্ঞাপন করলেও, আমাদের অনেকেই এখনো স্বাধীনতাবিরোধী চিন্তাভাবনা পুষে রেখেছেন। উচ্চবিত্ত উচ্চশিক্ষিত লােকজন দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক হিসেবে আমেরিকা কানাডা অস্ট্রেলিয়ায় সুখের সন্ধানে হাজির হন? টাকা পয়সা লুটে কানাডায় বেগম পাড়া বানিয়ে ফেলেছেন, মালয়েশিয়ায় ঘরবাড়ি কিনে সেকেন্ড হোম বানান।
আসলে কি তারা ‘অতঃপর সুথে শান্তিতে বাস করিতে পারেন? প্রাক্তন সহকর্মী নিতাই দাস সাহা সুলেখিকা ঝুম্পা লাহিড়ীর একটি সাম্প্রতিক কিতাবে তার গবেষণালব্ধ তথ্যের ভিত্তিতে উপসংহার টেনেছেন বিদেশে যতই প্রবাসীরা ফুর্তি ফার্তা করুক না কেন, হৃদয়ের গভীরে তারা অন্তরজালায় ভুগতে থাকে। নিতাই দাসের অনুবাদে ঝুম্পা লাহিড়ীর বয়ান “পশ্চিমা সমাজে আধুনিক নগর জীবনের মানুষের অস্থিরতা,জীবনের লক্ষ্য বা গন্তব্যের অস্পষ্টতা, বিচ্ছিন্নতা , নিঃসঙ্গতা, একাকীত্ব , মানবিক সম্পর্কের মধ্যে আন্তরিকতার অভাব , চোখে মুখে ঔদাসিন্যের ছাপ, একান্ত আপজনের সঙ্গেও ভঙ্গুর বা সম্পর্কের ক্ষণস্থায়ীত্ব , প্রেম ভালোবাসার মধ্য কৃত্রিমতার ছাপ স্পষ্ট।” এ কারণে, পৃথিবীর সবচাইতে সুখী দেশ বলে খ্যাত ফিনল্যান্ডে প্রতি এক লাখ লোকের মধ্যে ১৫ জন আত্মহননের পথ বেছে নেয়। আমাদের দেশে অভাব অভিযোগ সত্বেও ধর্মীয় অনুশাসন, পারস্পরিক সৌহার্দ্য, পারিবারিক দৃঢ বন্ধনের কারণে আত্মহত্যার হার এক লাখে মাত্র ৬ জন।
Café Bangladesh river side
