সেন্ট্রাল ব্যাঙ্কে কর্মের সুবাদে বিচিত্র সব মিশনে বিদেশ ভ্রমণ করার সুযোগ হয়েছে। সে ধারাবাহিকতায় ১৯৮১ সালে এক ডেলিগেশনের সদস্য হিসাবে অস্ট্রেলিয়ায় যাওয়ার সুযোগ হয়।
দেশে তখন চলছে ক্রান্তিকাল । চট্রগ্রামে জিয়াউর রহমানের নিহত হওয়ার পর তার ভাইস প্রেসিডেন্ট জাস্টিস আব্দুস সত্তার অটো প্রমোশন পেয়ে রাষ্ট্রপতির পদে অধিষ্ঠিত হন। তার দুর্বল নেতৃত্বের কারণে মন্ত্রী-সান্ত্রীরা যে যার মত করে খাচ্ছিলেন।
অন্যদিকে, প্রধান সেনাপতি হোসেন মোহাম্মদ এরশাদ ক্ষমতা দখলের জন্য তক্কে তক্কে ছিলেন। পরের বছরই তিনি জাস্টিস সত্তারকে ল্যাং মেরে নিজেই গদি দখল করে বসেন। আমার এ গল্পটা সত্তার সাহেবের আমলের।
ডেলিগেশন অন্যান্য সদস্য সবাই বাংলাদেশ বিমানের কর্মকর্তা। আমাদের মিশন ছিল অস্ট্রেলিয়ান এয়ারলাইন্স কোয়ান্টাস থেকে একটা কি দু’টো পুরনো বোয়িং ৭৪৭ বিমান ক্রয় করা।
সিডনি বিমানবন্দরে কোয়ান্টাস এয়ারলাইন্সের যে দু’জন সদস্য আমাদের এয়ারপোর্টে রিসিভ করতে এসেছিলেন, তাদের অভ্যর্থনার ভাষা শুনে আমরা অবাক, We’re glad to welcome you to Australia to die……. সোজা বাংলায় তোমরা আজ অস্ট্রেলিয়া মরতে আসার জন্য সাদর সম্ভাষণ জানাচ্ছি।
ডেলিগেশনের মেম্বাররা পরস্পরের মুখ চাওয়া চাইয়ি করছিল, ব্যাটারা বলে কি? আমরা এসেছি প্লেন কিনতে, বিদেশ বিভুঁইয়ে তাদের হাতে প্রাণ সঁপে দেওয়া আমাদের এজেন্ডার মধ্যে ছিল না।
বললাম বটে, কিন্তু সন্দেহ গেল না। বিদেশ-বিভুঁইয়ে কার মনে কি আছে, কখন কি ঘটে যায় তা কি আর বলা যায়? আবার দেশটাও অস্ট্রেলিয়া যেখানে ইংলিশম্যানরা দুই শ’ বছর আগে আদিম অধিবাসীদের উপর অত্যাচারের স্টিমরোলার চালিয়ে প্রায় বিলুপ্ত করে ফেলেছিল। স্মরণে এল উপনিবেশবাদের সে অন্ধকার যুগের কথা।
১৭৭৮-৭৯ সালে ক্যাপ্টেন কুক অস্ট্রেলিয়া মহাদেশ আবিষ্কার করে ব্রিটিশ রানীর নামে দখল নিয়ে নেয়। আদিম অধিবাসী, যারা অ্যাবরিজিন নামে পরিচিত, বাঁধা দেওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু ইউরোপিয়ানদের কামান, বন্দুক, ছল-চাতুরির সাথে পারবে কেন? নতুন ভূখণ্ড দখলে নিয়ে তারা লুটপাটের উৎসবে লেগে যায়।
ইংরেজরা আদিবাসীদের জমি জাতি, সুন্দরী নারীদের কেড়ে নিয়ে পরিকল্পিত ভাবে হত্যা করে তাদের প্রায় নির্মূল করে ফেলে। কয়েক বছর আগে অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী তাদের কাছে ক্ষমা চান। নাকের বদলে নরুন!!
শুরুতেই যা মনে করেছিলাম জানের প্রতি হুমকি, আসলে তা ছিল ইংরেজি ভাষার প্রতি হুমকি। ইংরেজি ‘a’ অক্ষর তাদের উচ্চারণে হয়ে যায় ‘i’. today হয়ে যায় to die. এ উচ্চারণ বিভ্রাট ছিল আমাদের ভীতির কারণ।
এ মিশনে আমার ভূমিকা ছিল উড়োজাহাজ কেনা কাটার জন্য চুক্তিতে ফাইনান্সিয়াল ক্লজগুলো সম্পর্কে সলা পরামর্শ দিয়ে বাংলাদেশ ডেলিগেশনকে সাহায্য করা। এ সাবজেক্টে আমার এলেম যে খুব টনটনে তা নয়। তবে, আমাদের দেশে সরকারি কেনা কাটার জন্য এক্সপার্টদের তেমন কিছু ভূমিকা থাকে না। সিদ্ধান্ত আগেই উপর মহলে নেওয়া হয়, এক্সপার্টের কাজ হয় তার সমর্থনে একটা গল্প খাড়া করা।
শুনেছি, আমেরিকার কোন এক অতি ক্ষমতাবান প্রেসিডেন্ট সিদ্ধান্ত নিজেই নিয়ে নিতেন। মন্ত্রি সভায় এসে তার সহকর্মীদের উদ্দেশ্যে বলতেন, ভদ্র মহোদয়গণ, এ বিষয়ে আমার সিদ্ধান্তটা এই, আপনারা এখন তার স্বপক্ষে কি কি যুক্তি আছে তা বের করেন– Gentlemen, this is my decision. Now you find the arguments.
আমার ধারণা ছিল, বিমান কেনার সিদ্ধান্ত আগেই হয়েছিল, ডেলিগেশনের কাজ ছিল তার স্বপক্ষে যুক্তি বের করে তাতে সিল মারা। ডেলিগেশনে বাংলাদেশ বিমানের কয়েক জন সিল মারার দলে ছিলেন। কাজেই যুক্তি খুঁজতে যাওয়ার ব্যাপারে আমার কোন দিলচসপি ছিল না। কিন্তু একটা নতুন মহাদেশ ভ্রমণের সুযোগটা বা কম কিসে?
অস্ট্রেলিয়াকে বলা হয় ডাউন আন্ডার। ইউরোপের ম্যাপ বানানেওয়ালারা নিজেদের বড়ত্ব জাহির করতে দেশটিকে ম্যাপের একেবারে নিচে ঠেলে দিয়েছে। নিজেদের দেশগুলো ওপরের দিকে রেখে ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে বড় করে দেখিয়েছে।
ম্যাপ দেখলে মনে হবে উত্তর আমেরিকা আফ্রিকার চাইতে বড়। বাস্তবে, নর্থ আমেরিকাকে আফ্রিকা মহাদেশের পেটে ঢুকিয়ে দেওয়ার পরেও ভারত, আর্জেন্টিনা ও তিউনিসিয়া ঢুকানো যায়। তারপরও আরো কিছু খালি জায়গা বেঁচে থাকে। একেই বলে ‘আপনা হাত জগন্নাথ’।
ম্যাপ বানানেওয়ালাদের কেরদানিতে স্ক্যান্ডিনেভিয়াকে ভারতীয় উপমহাদেশের চেয়ে বড় দেখায। বাস্তবে, পুরো স্ক্যান্ডিনেভিয়ার চেয়ে ভারতীয় উপমহাদেশ তিন গুণ বড়।
উত্তর গোলার্ধের অন্যান্য দেশের তুলনায় অস্ট্রেলিয়ার সব কিছুই উল্টাপাল্টা। পশ্চিমা বিশ্ব যখন ঠান্ডায় জমতে থাকে অস্ট্রেলিয়ায় তখন প্রখর সূর্য তাপে পুড়তে থাকে। কদিন আগেও ফরেস্ট ফায়ারে মাইল কে মাইল বন-জঙ্গল, বাড়িঘর পুড়ে সাফ হয়ে যায়।
অস্ট্রেলিয়া প্রায় একাই একটা গোটা মহাদেশ কিন্তু বাংলাদেশের চেয়ে ৫০ গুণ বড়। লোক সংখ্যা মাত্র আড়াই কোটি। ঢাকা শহরের চেয়ে কিছু বেশি। সেদেশের শতকরা ৮০ জন বাস করে প্রশান্ত মহাসাগরের তীর ঘেঁষে সরু এক ফালি ভূখণ্ডে। বেশির ভাগই বড় বড় কয়েকটি শহরে।
পূর্ব উপকূলে অস্ট্রেলিয়ার বুক চিরে বিস্তৃত সাড়ে তিন হাজার কিলোমিটার দীর্ঘ পর্বতমালার নাম গ্রেট ডিভাইডিং রেঞ্জ। এর পশ্চিমে বিশাল ভূমি, যাকে বলা হয় আউট ব্যাক, প্রায় জনশূন্য। তবুও, তাদের দেশে বিদেশিদের সহজে ঢুকতে দিতে চায় না। এ ধরনের মতলবকে বলে dog in the manger,খড়ের গাদায় কুত্তা খড় নিজে খায় না, অন্য কাউকেও খেতে দেবে না।
মিশনের এক রসিক সদস্য মন্তব্য করলেন, আমাদের নোয়াখালীর সুযোগ সন্ধানী ভ্রাতাদের সুযোগ দিলে তারা এ বিরাণ এলাকাকে শস্য শ্যামল করে সুশোভিত করতে পারতেন। মিশনে নোয়াখালীর একজন সদস্যের আপত্তির মুখে প্রস্তাবটি উইথড্র করা হলো।
অস্ট্রেলিয়া সম্পর্কে আমাদের কৌতুহল বাড়তে থাকে স্কুল জীবনে ভূগোল বই পড়ার সময়।
প্রায় ২৫ কোটি বছর আগে সমস্ত মহাদেশগুলো একটিই ভূখণ্ড ছিল। বিজ্ঞানীরা এখন তার নাম রেখেছে Pangaea—প্যাজিয়ো। সে সময় থেকেই মহাদেশগুলো আস্তে আস্তে পরস্পরের থেকে দূরে সরে যেতে থাকে। সে পর্যায় নাম হয় গন্ডোয়ানাল্যান্ড। ভূ-বিজ্ঞানীরা দূরে সরে যাওয়ার প্রক্রিয়াকে নাম দিয়েছেন আন্তঃমহাদেশীয় প্রবাহ (Inter-continental drift).
এ থিওরির মূল প্রতিপাদ্য এই যে প্রত্যেকটি মহাদেশ এবং কিছু কিছু ভূখণ্ড আলাদা ভাবে এক একটা প্লেটের উপর ভাসছে। পৃথিবী নামক গ্রহটি সৃষ্টির প্রথম প্রথম পর্যায়ে প্লেটগুলো মিলেমিশে একসঙ্গে থাকলেও যিনি বিশ্বব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টি করেছেন তাঁর স্কিম অনুযায়ী ২৫ কোটি বছর আগে ধীরে ধীরে আলাদা হতে থাকে।
এ থিওরির স্বপক্ষে বিজ্ঞানীরা অনেকগুলো প্রমাণ দাখিল করেছেন। তার একটি ম্যাপ দেখলেই বোঝা যায়। আফ্রিকা মহাদেশের পশ্চিম উপকূলের সাথে দক্ষিণ আমেরিকার পূর্ব উপকূল জোড়া দিলে একেবারে ভাঁজে ভাঁজে মিলে যায়।
আমাদের উপমহাদেশ আফ্রিকার মাদাগাস্কার এলাকা থেকে আলাদা হয়ে এশিয়া ভূখণ্ডের সাথে মুখোমুখি হয়। আফ্রিকার থেকে আসা দল ছাড়া ভূমি খণ্ডটিকে ছাড় দিবে কেন? দুই ভূখণ্ডের ঠেলাঠেলিতে জেগে ওঠে হিমালয় পর্বতমালা। এখনো হিমালয় আস্তে আস্তে উঁচু হয়ে চলেছে। উর্দ্ধ গতির ফলে হিমালয়ের পাদদেশের অনেক জনপদে ঘনঘন ভূমিকম্প হতে থাকে।
আন্তঃমহাদেশীয় প্রবাহের প্রক্রিয়ায় অস্ট্রেলিয়া দক্ষিণ দিকে রওনা দক্ষিণ মেরুর দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে যায়। সে ভূখণ্ডে বিচিত্র সব পশু পক্ষী উদ্ভব হতে থাকে। তাদের মধ্যে ক্যাঙ্গারু এবং কোয়ালা, ওয়ালাবি, প্লাটিপাস বিশেষ ভাবে নজর কাড়ে।
প্লাটিপাসের চামড়ায় খড়কুটো ভরে স্টাফ করে ইংল্যান্ডে নিয়ে গেলে সেখানকার প্রাণিবিদরা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে, এটা সত্যি সত্যি কোন প্রাণী নাকি, না আমাদের সাথে কৌতুক করছ? অন্য একটা মায়াবী প্রাণী কোয়ালা গাছে বাস করে। তার খাবার দাবারের মেনুতে রয়েছে বাছাই করা ইউক্যালিপটাস গাছের পাতা। অস্ট্রেলিয়ান এয়ারলাইন্স কোয়লাকে তাদের লোগো হিসাবে ব্যবহার করে।
অস্ট্রেলিয়ান এয়ারলাইনসের বিমান বহরে ছিল শুধু বোয়িং 747। দুনিয়ার এক কর্নারে অবস্থান বিধায় নানা কিসিমের বিমান কিনে মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণের ঝক্কি ঝামেলা লাঘব করতে তাদের এ আয়োজন। বিমান পুরনো হয়ে গেলে তারা মাঝে মাঝে বহর থেকে ঝেড়ে ফেলে।
আমাদের মিশন ছিল তাদের বিমান বহর থেকে দু-একটা বয়স্ক বিমান কেনা। এ-সব মৃত্যু পথ যাত্রী বিমান কেনার পিছনে কি রহস্য ছিল তা নিয়ে মাথা ঘামানোর প্রয়োজন নাই। জেনেই বা কি লাভ? রহস্যের শিকড় অনেক গভীরে। রহস্যের জমাট বাঁধতে থাকুক। আমরা বরং মহাদেশটি নতুন করে আবিষ্কারের দিকে মনোযোগ দেই।
বিমান ভ্রমণে এখন কোন বৈচিত্র অনুভব করি না। সেই পুরনো কাসুন্দি। প্লেনের দোর গোড়ায় বিগত যৌবনা এয়ার হোস্টেসের লিপস্টিক রঞ্জিত ওষ্ঠাধরে একটু খানি কৃত্রিম হাসি, সিট বেল্ট বাঁধুন, নো স্মোকিং, লেডিস অ্যান্ড জেন্টলম্যান সম্বোধন করে বড় একখানা লেকচার, এয়ারক্রাফট সমুদ্রে নাক গুজলে লাইফ জ্যাকেট পরে কিভাবে পানিতে নেমে বাঁশি বাজাতে থাকবেন। এভাবে কেউ বাঁশি বাজাতে বাজাতে কখনো বেঁচে আসতে পেরেছে কিনা জানা নাই। তবুও আশার শেষ নেই। লেকচারে তাই কান দেই না।
খানা-পিনা সাপ্লাই দেয়ার এ ব্যাপারে এয়ারলাইন কোম্পানিগুলো বেশ উদার। আমরা কোয়ানটাসের সৌজন্যে বিনা ভাড়ায় ফার্স্ট ক্লাসের প্যাসেঞ্জার। তাই খানা-পিনার স্পেশল ব্যবস্থা।
বয়স্ক বিমান গছানোর জন্য এত সব স্পেশল আয়োজন; কন্যাদায়গ্রস্ত পিতার যেমন বেশি বয়স্ক মেয়ের বিয়ে-শাদির ব্যাপারে আলোচনার বর পক্ষের মন টলাতে বাজার থেকে ঝেঁটিয়ে এক গাদা মিষ্টি কিনে নিয়ে আসে।
সিডনির সাথে দৃষ্টি বিনিময় করে অস্ট্রেলিয়ার সাথে আমাদের প্রথম পরিচয় ঘটে। পরে ভাষা বিভ্রাট নিয়ে আরো কিছু রং তামাশা চলে। তবে, ইংরেজি তাদের মাতৃভাষা। তারা যে ভাবেই বলুক না কেন আমাদের কিই বা আসে যায়? আমরা বরং সিডনির সাথে একটু পরিচিত হই।
সিডনির পত্তন শুরু হয় ১৭৮৮ সালে। প্রথমেই বৃটেনের বড় বড় ক্রিমিনালদের ঝেঁটিয়ে এনে এখানে নির্বাসন দেয়। এক ঢিলে দুই পাখি মারা—দাগী জেল ঘুঘুরা যাতে জেল থেকে পালিয়ে ইংল্যান্ডে ফিরে আসতে না পারে, এবং একটা নতুন বসতি স্থাপন করা। নিয়মিত বসতি শুরু হয় আরো অনেক পরে। দাগি আসামি নির্বাসনের সে স্মৃতিময় দিনগুলোর স্মৃতির স্মরণে এ ধরনের তিনটি বসতি তারা এখনো অবিকৃত রেখে দিয়েছে।
অস্ট্রেলিয়ানরা কি তাদের এ-সব দুর্ধর্ষ ক্রিমিনাল পূর্ব পুরুষদের জন্য বিব্রত বোধ করে?
কোয়ানটাসের তরফ থেকে আমাদের সার্বক্ষণিক গাইড ছিলেন মিল্টন লালাইস। আদি নিবাস গ্রীস, অস্ট্রেলিয়ায় অভিবাসী। তার পারিবারিক ইতিহাসের রেকর্ডে কোন ক্রিমিনাল ছিল না। তিনি মৃদু হেসে বললেন, তারা আদৌ বিব্রত বোধ করে না। বরং তাদের পূর্বপুরুষদের কীর্তি কাহিনী ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে বলতে গর্ব বোধ করে।
মিল্টন ঠিকই বলেছিলেন। পরের দিনগুলোতে আমরা কারো কারো সাথে কথা বলে শুনতে পেলাম, আমার গ্রেট গ্রেট গ্রেট গ্র্যান্ডফাদার দশ জন লোককে খুন করে অস্ট্রেলিয়ায় নির্বাসনে এসেছিল। কেউ এসেছিল ট্রেন ডাকাতি অথবা ভয়ানক অপরাধ করে।
বলা হয় Crime doesn’t pay- অপরাধ করে লাভ হয় না, কিন্তু উত্তর পুরুষদের জন্য গর্ব করার একটা সুযোগ রেখে যায়।
মানুষের মনস্তত্ত্ব বড্ড অদ্ভুত। অতীতের কুখ্যাত ক্রিমিনালদের নায়কের আসনে বসিয়ে গুন গান করতে ভালোবাসে। ইতিহাসের সবচেয়ে কুখ্যাত কিলার আলেকজান্ডার দি গ্রেট, এট্টিলা দি হুন, চেঙ্গিস খান, হালাকু খান, তৈমুর লং এবং আধুনিক যুগের হিটলারকে নিয়ে রোমান্টিক গল্প ফেঁদে বসে। কারো কারো মূর্তি বানিয়ে পূজা করতে বসে।
এমন-কি আমাদের সোনার বাংলায় কারো কারো ইতিহাসের সব চাইতে কুখ্যাত কিলার ইয়াইয়া খান ও তার দোসর ভুট্টোর জন্য দরদ উথলে পড়ে। বিচিত্র সব বিকৃত মানসিকতা।
আমাদের হোস্ট কোয়ান্টাস কিংস ক্রসে একটা চল্লিশ তলা ফাইভ স্টার হোটেলে বাসস্থান ঠিক করে রেখেছিলেন। সেখান থেকে দেখা যেত সিডনির দুটো বিখ্যাত ল্যান্ডমার্ক–অপেরা হাউস ও সিডনি ব্রিজ। অদূরে দৃশ্য গোচর হত প্রশান্ত মহাসাগরের রুপালি ঢেউয়ের অনিন্দ্য সুন্দর দৃশ্য।
হোটেলের নিচে কিংস ক্রস এলাকায় পৃথিবীর আদিমতম ব্যবসার জন্য কুখ্যাতি রয়েছে। আমরা রাস্তায় হাঁটতে বেরোলে আটো সাটো ড্রেস পরিহিতা যুবতী কন্যারা আমন্ত্রণ জানাতো, ‘ডু ইউ ওয়ান্ট এ ডেট?’ এ ডেট মানে খেজুর নয়, অন্য কিছু।
আমাদের টিম লিডার ক্যাপ্টেন নজরুল সাত্ত্বিক মানুষ। তিনি ধমক-ধামক দেওয়ার জন্য বাংলাটাই চালিয়ে যেতেন। তাতেই দ্রুত কাজ হতো। শিকারি সন্ধানীরা লেজ গুটিয়ে পালিয়ে যেত।
গুটি কয়েক ল্যান্ডমার্ক ছাড়া সিডনিকে আর দশটা মহানগর থেকে আলাদা করার কিছুই নেই—উচু উচু দালান কোঠা, শপিং মল, ট্র্যাফিক জ্যাম এবং দুনিয়াব্যাপী অতি পরিচিত ম্যাকডোনাল্ড, কেন্টাকি চিকেন নামের ফাস্টফুড রেস্টুরেন্ট। সেখানে সাশ্রয়ী মূল্যে আমাদের রুচি অনুযায়ী খাবার পাওয়া যেত। হোস্ট কোম্পানি আমাদের থাকার জায়গা দিয়েছেন কিন্তু খাওয়া দাওয়ার দায়িত্ব আমাদের নিজের। সে কারণে সস্তা খাবারের খোঁজ।
সপ্তাহান্তে ছুটির দিনে আমাদের জন্য সিডনি থেকে একশ’ কিলোমিটার দূরে একটা টুরিস্ট স্পটে ভ্রমণের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। গাড়ি বহর নিয়ে যাওয়ার পথে দেখলাম পুরো শহরে উৎসবের আমেজ বয়ে যাচ্ছে। জায়গায় জায়গায় আগামী দিনের ব্রাডম্যানরা ক্রিকেট খেলায় মেতে রয়েছে। ক্রিকেটে অস্ট্রেলিয়ানদের জান পোতা।
টুরিস্ট স্পটের প্রধান আকর্ষণ তিনটি পাহাড়ের চূড়া–নাম থ্রি সিস্টার্স পিকস (Three sisters’ peaks)। জায়গাটার নামকরণ হয়েছে অতীতের এক কিংবদন্তিকে আশ্রয় করে।
কিংবদন্তিটা ঠিক মনে নেই, তবে তার সাথে জড়িত ছিল এক জন রাজা এবং তার তিন সুন্দরী রাজকন্যা। তিনি অবশ্য রাজা ছিলেন অস্ট্রেলিয়ার আদিম অধিবাসীদের এক জনপদের যাদের খাটো করার জন্য শ্বেতাঙ্গ ইংরেজরা তকমা লাগিয়ে ছিল নরখাদক, হেড হান্টার ও অ্যাবরিজিনাল। ইংরেজদের সেই পুরনো ফন্দি–If you want to kill a dog give it a bad name—কোন কুত্তা কে মারতে চাইলে তার একটা জঘন্য নাম রেখে দাও।
আদিম জনপদ হোক, তবুও ত তিনি রাজা। তাঁর আছে রাজপ্রাসাদ, উজির, নাজির, কোটাল, রানী এবং তিন জন সুন্দরী রাজকন্যা। তবে, অন্যান্য মহাদেশের রাজাদের মত তার হাতিশালে হাতি ছিল না, ঘোড়াশালে ছিল না ঘোড়া। ইউরোপীয়দের হানা দেওয়ার আগে এ-সব জীবজন্তু অস্ট্রেলিয়ায় ছিল না।
বলাই বাহুল্য, তিন সুন্দরী রাজ কন্যার পাণি গ্রহণের জন্য কাছে দূরের রাজপুত্রদের মিছিল লেগে গেল। কিন্তু রাজকন্যাদের যে কপালে দুঃখ লেখা ছিল, তা খন্ডাবে কে? পাণি প্রার্থীদের মিছিলে সামিল হলো সমুদ্রের বহু দূর ওপার থেকে এক চোখা দুষ্ট দৈত্য–হাতে বন্দুক-কামান, মনে শয়তানি, আচরণে নিষ্ঠুর।
দুষ্টু দৈত্য রাজাকে প্রস্তাব দিল, তোমার রাজকন্যাদের আমার চাই—হ্যাঁ, তিন জনকেই। কিন্তু তিনি তো বাবা, ফিল্মের বাবাদের মত তাকে জানিয়ে দিলেন, আমি বরং তাদের কেটে গাঙ্গে ভাসিয়ে দেব তবুও তোমার মত লাফাঙ্গার সাথে শাদী দিব না।
দুষ্টু দৈত্য গোস্বা করে রাজ্যটিকে ধুলিস্যাৎ করে দিলো এবং মন্ত্র বলে রাজকন্যা তিনটিকে পাথর বানিয়ে দিল। তাদের তিন বোনের প্রতিচ্ছবি একই সমান্তরালে পাহাড়ের চুড়ায় দেখা যায়। দৈত্যটি আর কেউ নয়—ইংরেজ হানাদারদের একটি রূপক চরিত্র। এ বর্ণনাটা আমার নিজের কল্পনা। থ্রি সিস্টার্স পিক সম্পর্কে বিকল্প কয়েকটি কিংবদন্তি চালু আছে।
সিডনি ভ্রমণের শেষ পর্যায়ে অস্ট্রেলিয়ান বিমান কোম্পানি আমাদের সম্মানে বিদায়ী নৈশ ভোজের আয়োজন করে। লক্ষ্য করলাম অনুষ্ঠানে অস্ট্রেলিয়া দলের প্রধান বারবার বাংলাদেশ বিমানের নাম বলছিল, বাংলাদেশ বেইমান। একবার মনে হল তাদের কাছ থেকে বিমান কেনার জন্য বোধহয় আমাদের সাথে আলাপ-আলোচনায় সন্তুষ্ট নয়।
তবে, বুঝতে পারলাম আমাদের এয়ারলাইনের নাম বাংলাদেশ বিমান অস্ট্রেলিয়ান উচ্চারণে হয়ে গেছে বাংলাদেশ বেইমান। এক অর্থে এ বিশেষণটা ভুল না ।অব্যবস্থা ও দুর্নীতির আখড়া, সময়মতো সিডিউল রক্ষা করতে পারে না।
তবুও, বিমান আমাদের জাতীয় পতাকা বহন করে দূর-দূরান্তে যাত্রী বহন করে। তাই, এ অপবাদ মেনে নেই কেমন করে?
ভুলটা ধরিয়ে দিলে তারা বারবার আন্তরিকভাবে ক্ষমা চেয়ে আশ্বস্ত করলেন এর পর আর এ-রকম ভুল হবে না। কিন্তু ফের অস্ট্রেলিয়ার আদিম অধিবাসীদের বুমেরাং এর মত দল প্রধানের প্রতিশ্রুত ‘সঠিক’ উচ্চারণটি আমাদের কাছে ফিরে এলো—‘বাংলাদেশ বেইমান’।
ও খোদা, আবারো??
গল্প তো হলো, কিন্তু বিমান কেনার কি হলো? না বিমান কেনা হলো না। কারণটা অবশ্য বিমানকে বেইমান বলার জন্য নয়। কারণটা আরো গভীরে।
সরকার পরিবর্তনের ফলে জাস্টিস সত্তারের যে মন্ত্রী মহোদয় বিমান কেনার নীল নকশা এঁকে পকেট ভারী করার ধান্দায় ছিলেন, কিছুকাল জেল খেটে পরে আবার জন সেবায় আত্মনিয়োগ করতে থাকেন। তার সাঙ্গপাঙ্গদের কয়েক জনকে শাস্তির আওতায় আনা হয়।
নটে গাছটি মুড়োনোর আগে বলে রাখা ভালো গল্পটা প্রাণবন্ত করার জন্য ভাষা বিভ্রাট নিয়ে কিছুটা অতিরঞ্জন করা হয়েছে। গল্পের বাকিটায় কোন ভেজাল নাই।
