
সুইজারল্যান্ডের নাম শুনলে কল্পনার দৃষ্টিতে ভেসে ওঠে আল্পস পর্বতমালার পাদদেশে মধ্য ইউরোপের ছোট একটা সৌন্দর্যমন্ডিত দেশ। দু’শোরও বেশি পর্বত শৃঙ্গ, প্রায় দশ কিলোমিটার পর পর একটি লেক, দিগন্ত বিস্তৃত ঢেউ খেলানো ফসলের ক্ষেত, ছবির মত কান্ট্রিসাইড।
সে দেশেরই এক কোম্পানির আতিথ্য গ্রহণের জন্য সুইজারল্যান্ডের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে আমার ভ্রমণের আয়োজন।
কোম্পানির বিলাসবহুল লিমোজিন চঞ্চল গতিতে কখনো পাহাড়ি, কখনো সমতল ভূমির পীচ ঢালা মসৃণ রাস্তা বেয়ে চলছে। কিছু দূর যেতেই ক্রমে দৃষ্টির সীমানায় উদ্ভাসিত হতে থাকে অনিন্দ্য সুন্দর এক হ্রদের তট রেখা। হ্রদের দু’পাশে মহাকালের নিষ্কলঙ্ক সৌন্দর্যমন্ডিত বনভূমি ও দিগন্ত বিস্তৃত ঢেউ তোলা মনভোলানো শস্য ক্ষেত।
এ অপরূপ সৌন্দর্যের বর্ণনা দেয়া হয়ত সম্ভব কিন্তু তার জন্য প্রয়োজন আরব্য রজনীর গল্পের শেহেরজাদির কল্পনা শক্তি।
সুইজারল্যান্ডের উত্তর পূর্ব প্রান্তে জার্মান সীমান্ত ঘেঁষা উলফসবার্গ শহর থেকে আমার গন্তব্য ফ্রান্সের সীমান্তে লুজ্যন শহর—আড়াআড়ি ভাবে দেশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে, নানা কালচার ও ভাষা-ভাষী জনপদ অতিক্রম করে পথ চলা।
পিচ ঢালা মসৃণ রাজপথে বিভিন্ন দেশের নম্বর প্লেট লাগানো গাড়ির মিছিল। পশ্চিম ইউরোপের দেশগুলো একে অন্যের জনপথ দিয়ে চলাফেরা করলে কেউ তেড়ে আসে না। সামনে পিছনে তাকালে নজরে আসে দশ দেশের দশ রকম নম্বর প্লেট লাগানো গাড়ি সারি বেঁধে রাজপথ দিয়ে ছুটে চলেছে।
ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন গঠনের ফলে পশ্চিম ইউরোপ বলতে গেলে এক দেশে পরিণত হয়েছে। সুইজারল্যান্ড ইউনিয়নের সদস্য না হলেও দ্বিপাক্ষিক চুক্তির মাধ্যমে ইউনিয়নের সাথে একই সূত্রে নিজেদের জড়িয়ে রেখেছে। এক কালের ছবি ইউনিয়নের বলয়ভুক্ত পূর্ব ইউরোপের বিভিন্ন দেশও সে মিছিলে শামিল হয়েছে।
বরফাচ্ছাদিত আল্পস পর্বতের পাদদেশে প্রায় সাত হাজার হ্রদের দেশ সুইজারল্যান্ড ট্যুরিস্টদের মক্কা বলে খ্যাত। শীত মৌসুমে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে স্কি প্রেমিরা সুইজারল্যান্ডে আল্পস পর্বতের স্কী রিসোর্টগুলোতে ভিড় জমায়। গ্রীষ্মকালে জেনেভা লেকে জল কেলির জন্য জড়ো হয় হাজার হাজার মানুষ।
আল্পস পর্বতের ঢাল বেয়ে স্কি খেলা কিংবা সুইজারল্যান্ডের সৌন্দর্য উপভোগ করা আমার প্রোগ্রামে ছিল না। সে সব বিলাসিতা বড় লোকের কারবার। সুইজারল্যান্ড ব্যয় বহুল দেশ। সরকারি স্কেলে বেতনভুক ছা-পোষা চাকুরে সে দেশ ভ্রমণের দুরাশা শুধু স্বপ্নেই ভ্রমণ করতে পারে। তবে, বিধাতার সদয় দৃষ্টি থাকলে স্বপ্নও সত্যি হয়।
বাংলাদেশ ব্যাংকে চাকরির শেষ লগ্নে ১৯৯৬ সালে এক বিখ্যাত সুইস ব্যাংকের আয়োজিত সেমিনারে যোগ দেয়ার আমন্ত্রণ পেয়ে সুইজারল্যান্ডের ভ্রমণ করার সুযোগ পাওয়া গেল। সেমিনারের বিষয় বস্তু ছিল ফান্ড ম্যানেজমেন্ট। এ সাবজেক্টে সুইসদের থেকে কেই বা ভালো জানে?
শতাব্দীকাল ধরে দুর্নীতিবাজ ডিক্টেটর, রাজনৈতিক নেতা, আমলা, ট্যাক্স ফাঁকি দেওয়া ব্যবসায়ী, কালো টাকার মালিক সুইজারল্যান্ডের ব্যাংকে নাম-ধাম গোপন রেখে শুধু নম্বর সাপ্লাই দিয়ে ব্যাংক হিসাব খুলে আসছে। এখন অবশ্য আন্তর্জাতিক চাপের মুখে সুইসরা গোপনীয়তা অনেকখানি শিথিল করতে বাধ্য হয়েছে।
সুইস ব্যাংকে কালো টাকা জমার কৃতিত্বের জন্য আমাদের ‘গর্ব’ করার কারণ আছে–কালো টাকার মালিকদের লিস্টে এদেশের অনেকেই স্থান করে নিয়েছেন।
সুইস ব্যাংকের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত সপ্তাহব্যাপী সেমিনারে যোগ দেয়ার জন্য আগ্রহ ভরে অপেক্ষা করছিলাম। প্রোগ্রাম মোতাবেক এক শুভ সকালে সুইজারল্যান্ডের উদ্দেশ্যে লন্ডন রওনা হওয়া গেল।
সময় নিষ্ঠতার ব্যাপারে সুইসরা বাড়াবাড়ি রকমের সচেতন। লন্ডন থেকে রওনা হয়ে সুইস এয়ার কাঁটায় কাঁটায় জুরিখ এয়ারপোর্টে নোঙ্গর ফেলল। সেখান থেকে সুইস ব্যাংক লাক্সারি বাসে তুলে প্রায় একশ মাইল দূরে সেমিনারের ভেন্যু উলফসবার্গে আমাদের জমা করে দেয়।
ইউরোপের অন্যান্য দেশের তুলনায় সুইজারল্যান্ড অনেক দিক দিয়ে আলাদা। ছোট্ট পার্বত্যময় দেশ, আয়তনে বাংলাদেশের প্রায় এক তৃতীয়াংশ, লোকসংখ্যা ৮৫ লক্ষ–ঢাকা শহরের অর্ধেকের চেয়েও কম।
সুইজারল্যান্ড যাকে বলে ল্যান্ড-লকড কান্ট্রি- চার পাশে অন্যান্য দেশ দিয়ে ঘেরা, বিদেশের সাথে পণ্য আমদানি রপ্তানি করার জন্য অন্য দেশের পোর্ট ব্যবহার করতে হয়। প্রাকৃতিক সম্পদ বলতেও তেমন কিছু নেই। তা সত্ত্বেও সুইজারল্যান্ড অত্যন্ত সমৃদ্ধশালি দেশ—মাথাপিছু (নমিনাল) আয় মার্কিন ডলার ৮৩,৭১৬–একমাত্র লাক্সেম্বোর্গ তাদের ওপরে রয়েছে। বাংলাদেশের তুলনায় সুইজারল্যান্ডের মাথা পিছু জিডিপি কত তা হিসেব করতে ক্যালকুলেটর বিগড়ে যাবে। এ দুর্মূল্যের বাজারে অত লস সইবে না।
সুইসরা অবশ্য চিরকাল সমৃদ্ধশালী দেশ ছিল না। পশ্চিম ইউরোপের অন্যান্য দেশের মতো তারা ছিল ধর্মান্ধ, কুসংস্কারে নিমজ্জিত হত দরিদ্র জনপদ। ইউরোপের সব দেশেই উচ্চশ্রেণীর ভূস্বামীরা দরিদ্র কৃষকদের বিনা মজুরিতে তাদের জমিজমা চাষ করিয়ে নিত। ইনকুইজিশনের নামে ফ্রান্স, স্পেন, পর্তুগাল ও অন্যান্য দেশের হাজার হাজার মানুষকে খুঁটিতে বেঁধে পুড়িয়ে মেরে ফেলা হত। ধর্ম গুরুরা কুসংস্কারে নিমজ্জিত পাবলিকের কাছে অর্থের বিনিময় স্বর্গের টিকিট বিক্রি করতো। আমাদের ধর্ম গুরুরাও প্রকারান্তরে এখন সে কম্মোই করে চলেছেন।
ইউরোপ মহাদেশের অত্যাচার অনাচারের অভিশপ্ত পুরীর নিগড় ভেঙ্গে সুইজারল্যান্ডই সর্ব প্রথমে স্বাধীনতার স্বাদ গ্রহণ করতে পারে।
বহু বৎসর যাবত সাম্রাজ্যবাদীদের অত্যাচারে নিষ্পেষিত হয়ে ত্রয়োদশ শতাব্দীতে সুইস ভূমি দাসরা পরাক্রমশালী অস্ট্রো-হাঙ্গেরির হ্যাপসবার্গ সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে স্বাধীন জনপদে পরিণত করে।
সুইজারল্যান্ডের ছোট ছোট ক্যান্টনগুলো পঞ্চদশ শতাব্দীর শেষ নাগাদ একত্রিত হয়ে কনফেডারেশন গঠন করে দেশটিকে রিপাবলিক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে। তখনও ইউরোপের অন্যান্য দেশে রাজা মহারাজা সদর্পে কৃষক শ্রমিকদের উপর নিপীড়ন অব্যাহত রেখেছে।
সুইজারল্যান্ডের শক্তি ও প্রগতির উৎস গণতন্ত্র ও নিরপেক্ষতার প্রতি অবিচল আস্থা, উচ্চ মানের শিক্ষা ব্যবস্থা, কর্মপটুতা।
সুইজারল্যান্ড পৃথিবীর একমাত্র প্রত্যক্ষ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রবক্তা—গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে সব নাগরিকেরই মতামত গ্রহণ করা হয়। নাগরিকেরা ভোট দিয়ে শাসনতন্ত্র পরিবর্তন করতে পারে। অন্যান্য দেশের পার্লামেন্টের মত আবোল-তাবোল বক্তৃতার ধুম্রজালে ও ক্ষমতার টানা-পড়েনে জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষা চাপা পড়ে যায় না।
সুইজারল্যান্ড অন্যদের মত সার্বক্ষনিক সেনাবাহিনী ও বিশাল অস্ত্র ভান্ডারও গড়ে তোলেনি। তবে, মাতৃভূমির স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্য দু’তিনে দিনের মধ্যে প্রয়োজনীয় ফাইটিং ফোর্স গড়ে তুলতে পারে। দেশের সব সক্ষম নাগরিক নিবিড় সামরিক প্রশিক্ষণ নিয়ে রিজার্ভ হিসেবে প্রয়োজনের মুহূর্তে শক্তিশালী প্রতিরক্ষা ব্যুহ গড়ে তুলতে প্রস্তুত থাকে।
আমাদের সেমিনারের জন্য নির্ধারিত স্থান ছিল শহরের কলকাকলি থেকে দূরে ছায়া ঢাকা, পাখি ডাকা কনস্টান্স হ্রদের কিনারে, ওক, এলমস ও পপলার বনভূমির প্রান্তে।
লেকের অপর প্রান্তে দেখা যায় জার্মানির নাম না জানা একটা শহর। এপারে একটু দূরে দেখা যায় পাহাড়ের উপর একটি দুর্গের অস্পষ্ট রূপরেখা। দূর্গটি স্মরণ করে দেয় কৃষকদের এক কালের ভাগ্য নিয়ন্তা লর্ডদের প্রতাপ ও জাঁক জমকের কাহিনী।
সুইসরা কি ভাবে বাণিজ্যিক সম্ভাবনা্য সদ্ব্যবহার করতে হয় তা ভালো ভাবেই জানে। তারা দুর্গটি ফেলে রাখেনি। সেটিকে বিলাসবহুল রেস্টুরেন্টে রূপান্তর করেছে সে দুর্গে আমাদের ডিনারের আয়োজন করা হলো।
খাবারের মেনু ছিল নয়া যুগের, কিন্তু সিঁড়ি দরজা-জানালা, ঢাল-তলোয়ার সজ্জিত রেস্টুরেন্টে ছিল মধ্য যুগের আবহ। সময়ের পরিসরে নির্যাতিত কৃষককুলের কাহিনীর উপর পর্দা পড়েছে বটে কিন্তু কান পেতে শুনলে হয়ত এখনো শোনা যাবে অন্ধকূপ থেকে ভেসে আসা তাদের করুন আর্তনাদ।
কল্পনায় অতীত দিনের নাইট, লর্ডস ও ব্যারনদের অশরীরী আত্মার উপস্থিতিতে ঘন্টা দুয়েক মধ্য যুগের পরিবেশে আমাদের ডিনার পর্ব সম্পন্ন করলাম।
সেমিনার শেষে এবার ফেরার পালা। তবে, ঢাকা থেকে আসার আগে আমাকে লুজ্যন শহরে একটা সুইস কোম্পানি ভিজিট করে আসার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। কোম্পানিটি বাংলাদেশের টাকশালের জন্য যন্ত্রপাতি সাপ্লাই দেয়। আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন কোম্পানিটি পৃথিবীর অন্যান্য অনেক দেশেও মেশিনপত্র সাপ্লাই দিয়ে থাকে। সেমিনার থেকে ফিরে আমাকে টাকশালের দায়িত্ব নেওয়ার কথা বলা হয়েছিল। তার আগে কিছুটা অভিজ্ঞতা সঞ্চয়ের জন্য এ সফরের আয়োজন।
লুজান শহর সেমিনার ভেন্যু উলফসবার্গ থেকে প্রায় আট শ’ কিলোমিটার দূরে। পথ পাড়ি দিতে হবে এক প্রান্তের জার্মান ভাষা-ভাষীর জনপদ থেকে অপর প্রান্তে ফরাসি ভাষা-ভাষী জনপদে।
আমাকে লুজ্যনে নিয়ে যাওয়ার জন্য কোম্পানি থেকে পাঠানো গাড়ির জন্য ডরমিটরিতে বসে অপেক্ষা করছি। কাঁটায় কাঁটায় দরজায় নক পড়লো। সুইস সময় নিষ্ঠতার আরেকটা উদাহরণ।
দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে আছেন দামি পোশাকে সুসজ্জিত অভিজাত চেহারার ভদ্রলোক। বয়স ৬০ বছরের কাছাকাছি। হাতে ভিজিটিং কার্ড। একবার মনে হল, ইনি কি কোম্পানির ম্যানেজিং ডাইরেক্টর? অন্তত ডাইরেক্টর?
পোশাক আশাক দেখে কে কোন পেশার লোক তা ঠাহর করতে আকছারই ভুল করে ফেলি। দেশের অফিস আদালতে আউটসোর্সিং কোম্পানি থেকে সাপ্লাই করা ইউনিফর্ম পরা হৃষ্টপুষ্ট স্মার্ট সিকিউরিটির লোক দেখে পুলিশ অফিসার বলে ভুল হয়। জলপাই রংয়ের ছোপ ছোপ ইউনিফর্ম দেখে আর্মি অফিসার মনে করে ‘সামাজিক দূরত্ব’ রক্ষা করে চলি। কাকস্য পরিবেদনা!
আগন্তুক তার ভিজিটিং কার্ড ধরিয়ে দিলেন। নাম লেখা রয়েছে ভন বুয়ের। জার্মান ভাষায় লেখা তার পদবীর মর্ম বুঝতে পারলাম না। আইডেন্টি ক্রাইসিস। আমার না, ভন বুয়েরের।
আগন্তুকের আইডেন্টি সম্পর্কে দ্বিধা দ্বন্দ্ব নিয়েই তার পিছনে পিছনে চললাম। তিনি আমার ব্যাগটাও নিজে বহন করে নিয়ে চললেন। ভাবলাম, এটা বোধ হয় সুইস ভদ্রতার একটি তরিকা।
পার্কিং লটে এসে তিনি যে গাড়ির দরজা খুলে বসতে আহ্বান জানালেন তার চেহারা সুরত দেখে অবাক। ঘোর কৃষ্ণ বর্ণ, চকচকে চেহারার বিলাস বহুল লিমোজিন। লম্বায় এক মাইল নয়, তবে প্রায় একটা বাসের সমান। ছয় দরজা, তিন সারি সিট। বাহনটি রাজা মহারাজাদের মানায়। মিস্টার বুয়ের এয়ার ইন্ডিয়ার সর্দারজির মত মাথা সামনের দিকে ছয় ইঞ্চি ঝুঁকে, ডান হাত বুকে চেপে, তমিজের সাথে আসন গ্রহণের জন্য আহ্বান জানালেন।
বিলাসবহুল গাড়ি ও এত সব আচার অনুষ্ঠানের আয়োজনে দেখে মনে পড়লো ঢাকায় রিক্সায় চলা ফেরার অভিজ্ঞতার কথা–অপ্রশস্ত নড়বড়ে সিট, বৃষ্টি-বাদলে ভিজে একাকার, ভগ্ন স্বাস্থ্য রিক্সাওয়ালা, গায়ে তার ছিন্ন বস্ত্র, কপালে জমতে থাকে বিন্দু বিন্দু ঘাম। এখানে আমার জন্য আয়োজন করা হয়েছে বিলাসবহুল লিমোজিনে রাজা মহারাজার মতো পথ চলা।
আগেই বলেছি, বিধাতার ইচ্ছা থাকলে এক দিনের জন্যও সিংহাসনে বসা যায়।
ধারণা করেছিলাম, আমার কল্পিত ম্যানেজিং ডিরেক্টর ভন বুয়ের আমার পাশেই বসবেন—দু’জনে গপ্পো-সপ্পো করে সময় কাটাবো। কিন্তু তিনি বসলেন স্টীয়ারিং-এ, ড্রাইভারের সিটে। সন্দেহ নিরসনের জন্য আবার ভিজিটিং কার্ড খুলে ভালো করে দেখলাম। তাতে লেখা রয়েছে Von Buer, chauffeur de…..। ইংরেজি-জার্মান উভয় ভাষায় ড্রাইভারকে সোফার বলা হয়। এত ক্ষণে ভুল ভাঙলো।
ভন বুয়ের ভদ্র মানুষ।অল্প স্বল্প আলাপ হলো। কিছুদিন আগে ক্যান্সার রোগে তার স্ত্রী মারা গেছেন। ছেলে মেয়েরা আলাদা সংসার পেতেছে। তিনি দ্বিতীয় বিবাহ করেন নাই, কিন্তু গার্লফ্রেন্ড আছে। ফিরতি পথে যখন আমাকে জুরিখ এয়ারপোর্টে পৌঁছে দিতে আসেন তখন সে মহিলাকেও সাথে নিয়ে এসেছিলেন।
সুইজারল্যান্ডে চারটা ভাষা চালু রয়েছে—ফরাসি, জার্মান, ইটালিয়ান এবং রোমানস নামে ল্যাটিন ভাষার এক শাখা। প্রথম তিনটা ভাষা অফিসিয়াল ভাষা হিসাবে ব্যবহার করার জন্য সমান মর্যাদা দেয়া হয়। গণতন্ত্রকামী জনগণ ভাষা নিয়ে মারামারি কাটাকাটি করে না। ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’ গান গেয়ে শহীদ দিবস পালন করার প্রয়োজন হয় না। বস্তুত, উপমহাদেশের মত জাতপাত, ছোয়া-ছুয়ি ভাষা, শিয়া-সুন্নি, কাদিয়ানী, আহলে হাদিস, হিন্দু-মুসলমান ও ছোটখাটো বিষয় নিয়ে বিতর্ক, কখনো বা ফতোয়া জারি করে খুনোখানি বাঁধায় না।
লুজ্যনে পৌঁছে মনের অজান্তে ভালো লাগার অনুভূতি দোলা দিয়ে গেল। ছোট শহর, আদব কায়দা ফরাসিদের মতো, লোকজন বন্ধুভাবাপন্ন। উলফসবার্গের কাঠখোট্টা জার্মান ভাষার তুলনায় লুজ্যনের ফরাসি ভাষা কোমল ও শ্রুতিমধুর।
পথে-ঘাটে পরিচিত-অপরিচিত যে-ই সামনে পড়ুক পড়ুক না কেন অভিবাদন জানাতে দ্বিধা করেনা। অভিবাদনের ভাষাও শ্রুতিমধুর ব’সোয়া (bo jour)।
কোম্পানির চত্বরে পৌঁছে আমার আরেক দফা অবাক হওয়ার পালা। প্রবেশ দ্বারে উচু দণ্ডের মাথায় পতপত করে উড়ছে আমাদের প্রিয় লাল সবুজের জাতীয় পতাকা। আমার সম্মানে!!
ভালো করেই জানি, সেলিব্রিটি নই, সেলিব্রিটি বলে ভান করার ইচ্ছেও নাই। তবুও, সুইস ব্যবসায়িক বুদ্ধি বলে কথা। তারা গ্রাহকদের হৃদয়ের (এবং পকেটের) কাছাকাছি কিভাবে পৌঁছানো যায় সে কলাকৌশল ভালো জানে। তবে, ভদ্রতা বজায় রেখে।
লুজ্যনে অন্য এক কোম্পানির ম্যানেজিং ডাইরেক্টর তাঁর বাসায় ডিনারের জন্য নিমন্ত্রণ জানিয়ে রেখেছিলেন। তাঁর কোম্পানি টাকশালে টাকা ছাপানোর কালি সরবরাহ করে থাকে।
ছিমছাম গোছানো বাড়ি ঘর। গৃহকর্তা পরিচয় করিয়ে দিলেন তার স্ত্রী ও দুই ছেলে মেয়ের সাথে। ছেলেটার বয়স সম্ভবত দশ, মেয়েটির আট। মেয়েটির চেহারা দেখে অবাক। চেহারায় প্রাচ্যের ছাপ, চুলের রং কালো, গায়ের রং বাদামি।
আমার চোখে বিস্ময়ের ভাব দেখে গৃহকর্তা মৃদু হেসে বললেন, তিনি কিছু দিনের জন্য একটা কাজে বাংলাদেশে কাটিয়ে ছিলেন। সে সময় মেয়েটিকে একটা অনাথাশ্রম থেকে দত্তক নিয়েছিলেন।
মেয়েটির সাথে কথা-বার্তা বলার ইচ্ছা হল, কিন্তু সে ফরাসি ছাড়া অন্য কোন ভাষা জানে না। শুধু তার পিঠ চাপড়ে আদর করলাম। লক্ষ্য করলাম, সে খুব একটা কাছে ঘেষতে চাচ্ছে না। হয়তো মানুষে-মানুষে, জাতিতে জাতিতে ভেদা-ভেদের সূক্ষ্ম মর্ম এখনো বুঝে উঠতে পারে নাই। অথবা, তার মনে অভিমান জমে ছিল কেন তাকে নিজ দেশ থেকে আমরা অন্য এক দেশে ঠেলে দিয়েছি। দেশের অন্য কাউকে দেখেছে কিনা জানি না কিন্তু অবচেতন মনে হয় তো মাতৃভূমির এক অজানা ব্যক্তির সাথে একাত্মতা অনুভব করে থাকবে।
গাড়িতে বসে পেছন ফিরে তাকিয়ে দেখলাম, মেয়েটা ব্যালকনিতে বিষন্ন মুখে এক নেত্রে আমার যাত্রা পথের দিকে তাকিয়ে আছে।
লুজান ছেড়ে আসার অনেক পরেও বারবার তার বিষন্ন মুখের আদল মনের কোণে উঁকি দিচ্ছিল।