October 29, 2025

ব্রিটিশ আমলে হরেক রকমের ধাতব মুদ্রা প্রচলিত ছিল। তার মধ্যে একটি আনা, এখনকার ছয় পয়সার চেয়ে কিছু বেশি, যদিও ক্রয় ক্ষমতার দৃষ্টিকোণ থেকে ছয় টাকারও বেশি। সোজা কোথায় ব্রিটিশ আমলের ৬ পয়সা=এখনকার ৬ টাকা।

ব্রিটিশ আমলে আনা’র পাশাপাশি ছোট মানের মুদ্রাও ছিল —পয়সা, গন্ডা, পাই ইত্যাদি। ক্রমাগত মুদ্রাস্ফীতির কারণে সেসব ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র মুদ্রা কালের গর্ভে হারিয়ে গেছে। এখন তাদের দেখা মেলে শুধু জাদুঘরে।

তবে, সেসব আনা পয়সা রয়ে গেছে আমাদের গানে, কবিতায়, গল্পে। যেমন একটা জনপ্রিয় গান, “সব সখিরে পার করিতে নেব আনা আনা, তোমার বেলায় নেব কানের সোনা”। নায়িকার অহংকারী বাবার ফিল্মের নায়ককে ধমক দিতো, “তোমার এত বড় সাহস, এক পয়সার মুরোদ নেই … “।

তখন ষোল আনার সমান ছিল এক টাকা। তাই তুলনামূলক ধারণা দেওয়ার উদ্দেশ্যে সচরাচর শতকরার পরিবর্তে লোকজন আনা স্ট্যান্ডার্ড বা মানদন্ড হিসেবে গণ্য করত। যেমন, আজ বৃষ্টি আসার সম্ভাবনা প্রায় ‘দশ আনা’, তোমার কথার ‘বারো‌ আনা’ অবান্তর।

এবার ব্রিটিশ আমলের মুদ্রাব্যবস্থার কাহিনী শোনা যাক। একঘেয়েমি কাটানোর জন্য কিছু ছোটখাটো ইন্টারেস্টিং কাহিনী সংযোজন করা হয়েছে।

সতেরোশো সাতান্ন সালে পলাশী যুদ্ধে নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে পরাজিত করে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি একে একে ভারতের বেশ কিছু অঞ্চল দখল করে নেয়। সপ্তদশ ও অষ্টাদশ শতাব্দীতে অধিকৃত কয়েকটি অঞ্চল মুসলিপত্তন, দক্ষিণ সুরাট, মাদ্রাজ এবং কলকাতায় তাদের কলোনিগুলোকে এক একটা প্রেসিডেন্সি হিসেবে ভাগ করে মুদ্রা ইস্যু করা শুরু করে। তারপর মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ছিল বেঙ্গল প্রেসিডেন্সি। তারা মূলত মোগলদের টাকশালে তাদের মুদ্রা খোদাই করত।

পরিশেষে, ১৮৩৫ সালে ভারতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি কর্তৃক অধিকৃত সব কলোনিগুলোর জন্য অভিন্ন মুদ্রা চালু করে। প্রাথমিক পর্যায়ে মোগল বাদশাহ দ্বিতীয় আলমগীর এবং শাহ আলমের নামে মুদ্রা ইসু করা হত।

ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি কর্তৃক প্রবর্তিত প্রাথমিক যুগের মুদ্রা

১৮৩৫ সালে অভিন্ন মুদ্রা ব্যবস্থা চালুর সিকি আনার মুদ্রা

১৮৬২ সালে প্রবর্তিত এক মোহর মূল্যমানের স্বর্ণ মুদ্রা। সামনের পাশে লেখা কুইন ভিক্টোরিয়া, পিছনে মূল্যমান ও তারিখ

তখন যে মুদ্রা ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয স্বাধীনতা লাভের পরও ভারতে ১৯৫৭ এবং পাকিস্তানের ১৯৬০ সাল নাগাদ চালু ছিল। সে সময় কালে মুদ্রার বিভাজন ছিল এরকম।

১ পাই = ১/৩ পয়সা = ১/১২ আনা

এক পয়সা = ১/৪ আনা= ১/৬৪ টাকা

১ আনা = ১/১৬ টাকা

১ মোহর স্বর্ণমুদ্রা= ১৬ টাকা

অবাক কান্ড তাই না? এখন এক টাকা দিলে ভিক্ষুকও বেজার হয়ে যায়। অথচ সে আমলে এক পয়সার তিন ভাগের এক ভাগ কয়েন ছিল ‘পাই’। ‘পাই’ দিয়ে কি কেনা যেত জানা নেই, তবে গোটা দুই রসগোল্লা যে পাওয়া যেত তাতে সন্দেহ নাই। কি সস্তার দিন ছিল তাই না?

সে সুখেই থাকুন। ইশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের মতো মহাপন্ডিত ১৮৪১ সালে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের বাংলা বিভাগের প্রধান হিসাবে মাসে বেতন পেতেন মাত্র ৫০ টাকা। স্কুল জীবনে অসামান্য কৃতিত্বের জন্য স্কলারশিপ পেতেন মাত্র ২ টাকা। তাই, যখন কেউ বলেন আহ্ কি, সস্তার দিনই না ছিল তখন তাঁর মনে থাকে পণ্যের মূল্যের কথা কিন্তু ভুলে যান আয় রোজগারের কথা। অর্থনীতির ভাষায়, People remember the price but forget the income. পাকিস্তান আমলে যারা ছিল ভুখানাঙ্গা, এখন গাড়ি বাড়িওয়ালা তাদের অনেকেরই মুখে শোনা যায়, কী সুখেই না ছিলাম।

শায়েস্তা খানের আমলের টাকায় ৮ মণ পাওয়া যেতা বলে যে কিংবদন্তি আছে তা একই ভ্রান্তির প্রতিফলন। এক জন ভোক্তার দৃষ্টিকোণ থেকে শুনতে ভালই লাগে কিন্তু যিনি কষ্টেসৃষ্টে অনেক খরচ পাতি করে ৮ মন চাল তৈরি করেন তার কথা একবার ভেবে দেখেন না। বলাবাহুল্য, তখন টাকার ক্রয় ক্ষমতা ছিল বহুগুন। এক টাকা জোগাড় করতে অনেক ঘাম ঝরাতে হত। অর্থনীতির ভাষায় একে বলে মানি ইলিউশন।

১৮৫৭ সালে সিপাহী বিদ্রোহ ব্যর্থ হওয়ার পর ভারতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সে সময় নাগাদ দখলকৃত এলাকা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অধীনে নিয়ে নেয়া হয়। তবে, তার আগে থেকেই মহারানী ভিক্টোরিয়া ছবি সম্বলিত মুদ্রায় খচিত হত Victoria Queen বা রানী ভিক্টোরিয়া।

সরাসরি ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের শাসন আনার পর ১৮৭৭ সালে রানী ভিক্টোরিয়া Empress India উপাধি গ্রহণ করেন। ‌ তখন মুদ্রায় খোদিত হত Victoria Empress অর্থাৎ সম্রাজ্ঞী ভিক্টোরিয়া।

রানী ভিক্টোরিয়া ১৮৪৭ সাল থেকে তার মৃত্যু পর্যন্ত সুদীর্ঘ ৬৩ বছর পর্যন্ত গ্রেট বৃটেনের সম্রাজ্ঞীর পদ অলংকৃত করেন। তার রাজত্বকাল ভিক্টোরিয়া আমল বলে বৃটেনের ইতিহাসে উল্লেখযোগ্য স্থান দখল করে রেখেছে। তার উত্তরসূরি রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথ ৭০ বৎসর রাজত্ব করে রানী ভিক্টোরিয়ার রেকর্ড ইতিমধ্যে ভেঙ্গে এখনো রাজ সিংহাসনে সমাসীন রয়েছেন।

ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কাছ থেকে ভারতের শাসনভার গ্রহণের পর ১৮৭৭ সালে সম্রাজ্ঞি ভিক্টোরিয়ার ছবি সম্বলিত প্রবর্তিত মুদ্রা। পূর্বের কুইন ভিক্টোরিয়া স্থানে নতুন বদলে লেখা হয় ভিক্টোরিয়া এম্প্রেস বা সম্রাজ্ঞী ভিক্টোরিয়া

১৮৬২ সালে অভিন্ন মুদ্রা ব্যবস্থা চালুর পর সব ধরনের মুদ্রা

রানী ভিক্টোরিয়ার আমলে দুই আনা আট আনা মূল্যমানের মুদ্রা চালু করা হয়।

রানী ভিক্টোরিয়ার তিরোধানের পর যেসব রাজা ব্রিটিশ সিংহাসনে আরোহণ করেছিলেন তাদের মধ্যে রাজা অষ্টম এডওয়ার্ড বাদে সবার আমলে তাদের ছবি সম্বলিত মুদ্রা প্রচলন করা হয়। ব্রিটিশ আমলে সামনের দিকে যাদের প্রতিকৃতি অঙ্কিত করা হয় তা নিম্নরূপ:

১৮৬২-১৯০১ রানী ভিক্টোরিয়া

মহারানী ভিক্টোরিয়া

১৯০৩-১৯১০ সপ্তম এডওয়ার্ড

সপ্তম এডওয়ার্ড

১৯১১-১৯৩৬ পঞ্চম জর্জ

সম্রাট সপ্তম এডওয়ার্ড

সপ্তম এডওয়ার্ডের প্রতিকৃতি সম্বলিত এক টাকার রৌপ্য মুদ্রা

সম্রাট অষ্টম এডওয়ার্ড ১৯৩৬ থেকে ১৯৩৮ পর্যন্ত অল্প সময়ে রাজত্বকালে কোন কয়েন ইস্যু করা হয়নি। তিনি সিম্সসন নামে এক আমেরিকান তালাকপ্রাপ্তা মহিলার সাথে প্রণয়ে জড়িয়ে পড়ার পর সিংহাসন ছেড়ে প্রেমের জন্য ত্যাগ স্বীকারের অবিস্মরণীয় দৃষ্টান্ত রেখে ইতিহাসের পাতায় স্থান করে নিয়েছেন।‌

  1. মিসেস ওয়ালিস সিম্পসন

সিম্পসন ছিলেন মার্কিন সমাজকর্মী। তিনি দুইবার বিবাহ করেন কিন্তু তাদের সাথে বিচ্ছেদ ঘটে। এক পর্যায়ে তখনকার রাজপুত্র এডওয়ার্ডের সাথে তার সম্পর্ক গড়ে ওঠে। এর দুই বছর পর ১৯৩৬ সালে পিতা রাজা পঞ্চম জর্জের মৃত্যুর পর ৮ম এডওয়ার্ড রাজা হিসেবে ব্রিটেনের রাজসিংহাসনে অভিষেক ঘটান।

ইতোমধ্যে, ওয়ালিস সিম্পসন তার দ্বিতীয় স্বামী আর্নেস্ট সিম্পসনকে তালাক দিলে এডওয়ার্ড তাকে বিয়ে করার প্রস্তাব দেন। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী স্ট্যানলি বল্ডুইন এডওয়ার্ডকে পরামর্শ দেন যে রাজনৈতিক এবং ধর্মীয় কারণে তিনি মিসেস সিম্পসনকে বিয়ে করতে পারেন না। দুই জন জীবিত সাবেক স্বামীর সাথে ঘর করার পর তৃতীয়বারের মতো রাজা এডওয়ার্ড তাকে বিয়ের ইচ্ছে পোষণ করায় সাংবিধানিক সঙ্কট দেখা দেয়।

নাটকটি আরো চূড়ান্তরূপ ধারণ করে যখন রাজা ডিসেম্বর, ১৯৩৬ সালে “এ নারীকে আমি ভালোবাসি” বলে ঘোষণা করে সিংহাসনের মোহ ত্যাগ করে সিম্পসনকে বিবাহ করার পথ পরিষ্কার করে ফেলেন।

ছয় মাস পর ৩ জুন, ১৯৩৭ সালে ফরাসী ধনকুবের চার্লস বেদক্সের সহায়তায় ফ্রান্সের চাতিউ দ্য কেন্ডে গীর্জায় ওয়ালিস এবং এডওয়ার্ড বিবাহ-বন্ধনে আবদ্ধ হন।বাকি জীবন তারা ফ্রান্সে কাটিয়ে দেন। ১৯৭২ সালে এডওয়ার্ড এবং ১৯৮৬ সালে মিসেস সিম্পসন মৃত্যুবরণ করেন।

বর্তমান রাজকুমার যিনি প্রিন্সেস ডায়ানাকে বিয়ে করেছিলেন তিনিও অন্য একজন তালাকপ্রাপ্তা মহিলা ক্যামেলিয়া পার্কারের প্রণয়ে বিয়ের আগে থেকেই মজে ছিলেন। শেষমেষ ডায়ানাকে তালাক দিয়ে ক্যামেলিয়াকে বিয়ে করে এখন পর্যন্ত সুখে শান্তিতে বাস করছেন।

১৯৩৮-১৯৪৭ ষষ্ঠ জর্জ

ষষ্ঠ জর্জ: বর্তমান রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথের পিতা

রাজা রাজাদের আমলে ১৯৩৯ সালে যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে রৌপ্যমুদ্রার পরিবর্তে স্বল্পমূল্যের‌ ধাতুর তৈরি মুদ্রা প্রচলন করা হয়।

এক আনা, আধা পয়সা, ১/৪ আনা, চার পয়সা ১/৪ আনা, ১/২ আনা, ১ আনা, ২ আনা, ৪ আনা বা সিকি, ৮ আনা বা আধুলি বা এক টাকার অর্ধেক, ৫ টাকা, ১ স্বর্ণ মুদ্রা মোহরের ১/৩, ১০ টাকা ২/৩ মোহর, ১৫ টাকা, ১ মোহর, ৩০ টাকা। দুই মোহর মূল্যমানের মুদ্রার দেখা মিলত শুধু জাদুঘরে।

রাজা ষষ্ঠ জর্জ ছিলেন ব্রিটিশ ভারতের শেষ সম্রাট বর্তমান রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথের বাবা। রাজা ১৯৩৬ সালে সিংহাসনে আরোহন করেন এবং ১৯৫২ সালে মৃত্যুবরণ করলে রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথ সিংহাসন আরোহন করেন। রাজার স্বাস্থ্য তেমন ভাল ছিল না। অপরিমিত সিগারেট ফুঁকে ফুসফুসে ক্যান্সার বাঁধিয়ে বসে ছিলেন। সে কারণে ফুসফুসের একাংশ কেটে ফেলা হয়েছিল। মাত্র ৫৭ বছর বয়সে তিনি মারা যান। বাকি আয়ু সম্ভবত কন্যা এলিজাবেথকে দিয়ে যান।

১৯৫২ রাজা যখন মারা যান তখন রাজকুমারী এলিজাবেথ রাষ্ট্রীয় সফরে কেনিয়ায় অবস্থান করছিলেন। সেখানে ন্যাশনাল পার্কের এক গাছের উপরে মাচায় বসে সিংহ, জিরাফ জেব্রা, হাতি, গন্ডারের আনাগোনা দেখছিলেন। বিবিসি রেডিওর মাধ্যমে তার মৃত্যুর খবর সারা দুনিয়ায় জেনে গেলেও রানী জানতে পারেন অনেক পরে। তার সাথে ছিলেন বিখ্যাত শিকারী জিম কর্বেট। তিনি তার ডায়রিতে লিখলেন, রাজকুমারী এলিজাবেথ গাছে উঠলেন রাজকুমারী হিসাবে, নেমে আসেন রানী হয়ে। তখন থেকে তিনি সত্তর বৎসর যাবৎ সিংহাসন আগলে রেখেছেন। এখন পুত্র চার্লসও জীবন সায়ান্নে পৌছে গেছেন, বয়স ৭৩ বছর। সকলের মনে জিজ্ঞাসা তিনি কি আদৌ সিংহাসনে বসার সুযোগ পাবেন? তবে তিনি আশার আলো দেখতে পাচ্ছেন।

রানী এলিজাবেথের ইদানিং করোনা ভাইরাসে ভুগেছেন। পরিবারের দুইজন রাজকুমার নানা ধরনের গ্যাঞ্জাম সৃষ্টি করেছে। তা নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছেন। এসব কারণে স্বাস্থ্য ভালো যাচ্ছে না। সম্ভাবনা রয়েছে প্লাটিনাম জুবিলী উৎসবের পর তিনি প্রিন্স চার্লসকে সিংহাসনে বসার সুযোগ দিবেন।

About Post Author

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Pin It on Pinterest