November 10, 2025

জর্ডানের পাতালপুরী: ডেড সি

পানির উপর হাটা-চলা করতে পারলে কি মজাই না হত। সুবিধাও বিস্তর। ব্রিজ তৈরির জন্য কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা ব্যয় করা লাগে না। গরিব দেশকে বিশ্বব্যাংকের কাছে ধর্ণা দিতে হয় না। কিংবা ফেরির জন্য অপেক্ষার প্রহর গুনে হাটুতে চুল গজিয়ে যেত না।

খোদার কি শান, পানির উপর দিয়ে হাঁটা না গেলেও, কোন কোন জলরাশির উপর শরীর এলিয়ে দিব্যি পানিতে ভেসে অলস ভঙ্গিতে পেপার পড়া, রোদ পোহানো যায়। গল্পগুজব করে রাজা উজির মারতেই বা ঠেকায় কে? এ রকম একটা ছোটখাটো সাগর দর্শনে যাওয়ার সুযোগ হয় গত শতাব্দীর আশির দশকে। নাম ডেড সি, বাংলা ভাষায় মৃত সাগর।

স্কুলের ভূগোল বইতে পড়ে স্মৃতির কোঠায় স্বচক্ষে ডেড সি দর্শনের কৌতুহল জমা রেখে ছিলাম। আশির দশকের প্রথম প্রান্তে সে কৌতুহল নিবৃত্ত করার সুযোগ আসে।

ততদিনে বাংলাদেশ থেকে বেশ জোরেশোরে মধ্যপ্রাচ্যে জনশক্তি রপ্তানি শুরু হয়েছে। ১৯৭৩ সালে আরব-ইজরায়েল যুদ্ধের পর তেলের মূল্য বাড়িয়ে আরব শেখরা ফুলে-ফেঁপে উঠেছে। দালানকোঠা, রাস্তাঘাট, দোকানপাট নির্মাণের ধুম লেগে গেছে।‍ এসব কর্মযজ্ঞে প্রচুর লোকবল দরকার। এ সুযোগে বাংলাদেশ থেকে জনশক্তি রপ্তানি বেগবান করার লক্ষে মধ্যপ্রাচ্য সফরে যাবেন শ্রমমন্ত্রী। প্রবাসীদের বিদেশ থেকে অর্থ প্রেরণ সংক্রান্ত সমস্যা দেখার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে মন্ত্রীর সফরসঙ্গী হিসাবে আমাকে নমিনেট করা হয়।

ইউনিফর্ম পরা লোক দেখলে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখি। এমন কি প্রাইভেট সিকিউরিটি কোম্পানির ধোপদুরস্ত লোক দেখলে ভুল করে কোন না কোন সরকারি বাহিনীর লোক মনে করে এড়িয়ে চলি।

এদিকে মন্ত্রীবর আমিনুল ইসলাম সাহেব বিমান বাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত ডাঙ্গর কর্মকর্তা। সে সাথে সামরিক বাহিনীর গোয়েন্দা বিভাগের প্রধান, ডিজিএফআই। ভয়ে ভয়ে ছিলাম।

ভুল ভাঙলো। বয়স এবং ক্ষমতার বিস্তর ব্যবধান সত্ত্বেও প্রথম দর্শনেই একান্ত আপন করে নিলেন। রাত বেরাতে তাঁর ভিআইপি সুটে ডেকে নিয়ে রাষ্ট্রের অনেক ইন্টারেস্টিং কাহিনী শেয়ার করতেন। হোসেন মোহম্মদ এরশাদের নিযুক্ত মন্ত্রী হলেও বঙ্গবন্ধুর প্রতি ছিল আন্তরিক শ্রদ্ধা।

দুবাই, আবুধাবি, ওমান, কাতার, কুয়েত বাহরাইন, সৌদি আরব সফর শেষে আমরা জর্ডানের রাজধানী আম্মানে পৌছাই। ইতোপূর্বে মধ্যপ্রাচ্যের সবকটি দেশে আধুনিক দালানকোঠার একঘেয়ে মিছিল দেখে বোর হয়ে গিয়েছিলাম। এসব দামি দামি আধুনিক দালানকোঠা আমাকে মোটেই আকর্ষণ করে না। জর্ডানে পৌঁছে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলা গেল। আম্মানের ঐতিহ্যবাহী ইমারত এবং পরিবেশ লন্ডন শহরকে স্মরণ করে দেয়।

জেদ্দা থেকে আমাদের সাথে জর্ডান সফরে যোগ দিয়েছিলেন সৌদি আরবে বাংলাদেশের অ্যাম্বাসেডর মহসিন সাহেব। আমার পূর্ব পরিচিত দিলখোলা, তালেবর রাষ্ট্রদূত। জর্ডানে বাংলাদেশের দূতাবাস না থাকায় সে দেশও তাঁর দায়িত্বের অন্তর্ভুক্ত, দুতালির ভাষায় concurrently accredited. আমরা রাষ্ট্রীয় অতিথি। রাজকীয় আদর আপ্যায়ন্যে মুগ্ধ। তবে, আরবি খাবার খেতে খেতে তাতে খাবার-দাবারের প্রতি অনীহা এসে গেছে।

আম্মান বিমানবন্দরে জর্ডানের শ্রমমন্ত্রী স্বাগত জানাবার পর পুলিশ পাহারায় সাইরেন বাজিয়ে আমাদের হোটেলে নিয়ে যাওয়া হল। মন্ত্রীর সাথে ভ্রমণের এটুকুই মজা। অস্বস্তিও কম নয়। মিটিং, ডিনার পার্টি, বিভিন্ন জনের সাথে সাক্ষাৎকার, এসব কারণে সার্বক্ষণিকভাবে পায়ের উপর থাকতে হয। শপিং কিংবা স্বাধীনভাবে এখানে সেখানে ঢু মারার স্পেস বের করা দুষ্কর।

নানা কিসিমের প্রোগ্রামের ফাঁকে মনের আয়নায় শৈশবে ভুগোল বইয়ে পড়া মৃত সাগরের স্মৃতি বার বার উঁকি দিয়ে যেতে থাকে। রাজধানী আম্মান থেকে দূরত্ব ৬০ কিলোমিটার। এত কাছে এসে সে সাগর না দেখে যাওয়া হবে বড় ধরনের ট্রাজেডি। ‌ অভাবিত ভাবে একদিন পরে সে সুযোগ এসে গেল।‌ ডেড সি ভ্রমণে যাওয়ার আগে দেশটির ইতিহাস ও ঐতিহ্যের প্রতি একটু চোখ বোলানো যাক। সে সঙ্গে শোনা যাক আমাদের এক বাঙালি রমণীর স্বপ্নভঙ্গের কাহিনী।

জর্ডান ম্যাপ

জর্ডান পশ্চিম এশিয়ায় জর্ডান নদীর অববাহিকায় এশিয়া আফ্রিকা ও ইউরোপের ত্রি-সঙ্গমে ক্ষুদ্র দেশ। আয়তন ৮৯,০০০ বর্গ কিলোমিটার, বাংলাদেশের দুই-তৃতীয়াংশ, জনসংখ্যা ১ কোটি ১০ লক্ষ। জর্ডানের চারপাশে রয়েছে সৌদি আরব, ইরাক, সিরিয়া, ফিলিস্তিন, ইজরায়েল ও রেড সি।

জর্ডানের ইতিহাস ও ঐতিহ্য বেশ সমৃদ্ধ। যুগ যুগ ধরে নানা সভ্যতা এখানে তাদের পদচিহ্ন রেখে গেছে। গ্রিক ও রোমানদের অনেক স্থাপনার ভগ্নস্তূপ পর্যটনকারীদের দর্শনীয় স্থান। আড়াই হাজার বছর আগে নির্মিত পেট্রা নগরীর শান শওকত এখনো মানুষের বিস্ময়ের উদ্রেক করে। ট্রানস জর্ডান উপত্যাকায় খ্রিস্টান ধর্ম গুরু যীশু খ্রীষ্ট দিব্য জ্ঞান লাভ করেন।

জর্ডান মধ্য আয়ের দেশ। মাথাপিছু আয় ১০,০০ ডলার, বাংলাদেশের তুলনায় পাঁচ গুণ বেশি। দেশটি সকল ধর্মের, বর্ণের মানুষের প্রতি উদার। মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধ-বিগ্রহ হলে জাতি ধর্ম নির্বিশেষে শরণার্থীরা এখানে ভিড় করে। এখন একবিংশ শতাব্দীর তৃতীয দশকে ২১ লাখ ফিলিস্তিন এবং ১৪ লাখ সিরীয় রিফিউজি এখানে বাস করছে। ক্ষুদ্র দেশের জন্য এত বিশাল সংখ্যক রিফিউজি দেশটির জন্য ভারি বোঝা বই কি।

জর্ডানে প্রায় ২ লক্ষ বছর আগে মনুষ্য বসতি শুরু হয়। প্রস্তর যুগ, নয়া প্রস্তর যুগ, ব্রোঞ্জ যুগ পেরিয়ে এসেছে। ইতিহাসের বিভিন্ন পর্যায়ে জনপদটি আসিরিয়, পার্শিয়ান, গ্রিক, রোমান, আব্বাসীয় এবং অটোমান সাম্রাজ্যের অঙ্গভূত হয়।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্রিটিশদের উস্কানিতে আরবরা অটোম্যান সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে। অটোম্যান শক্তি পরাজিত হলে জনপদটি ব্রিটিশ আশ্রিত রাজ্যে পরিণত হয়। পরিশেষে, ১৯৪৬ সালে ব্রিটিশরা স্বাধীনতা প্রদান করলে নতুন নাম হয় হাশেমাইট কিংডম অব জর্ডান। জর্ডানের শাসকবর্গ পয়গম্বর হযরত মোহাম্মদ (স:) এর বংশধর।

দেশটি ব্রিটেনের মতো সাংবিধানিক রাজতন্ত্র। তবে, বাদশাহ বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ বাড়তি ক্ষমতার অধিকারী। আমরা যখন সেদেশে সফরে যাই তখন শাসন ক্ষমতায় ছিলেন বাদশা হোসেন।

দেশটির গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানের ফলে বাদশাহ হোসেনকে বারবার আরব ইসরাইল যুদ্ধের কারণে ঝুট ঝামেলা পোহাতে হয়েছে। ১৯৬৭ সালে যুদ্ধে জর্ডান নদী পশ্চিম তীর হাত ছাড়া হয়ে যায়। সেখানে ইজরায়েলের ইহুদিরা নিজেদের বসতি স্থাপন করে পুরোপুরি হজম করার চেষ্টা করছে।

বাদশা হোসেনের উত্তরাধিকারী নির্ধারিত ছিলেন বাদশাহর ভ্রাতা ‌ হাসান বিন তালাল। ইংল্যান্ডের মতো অপেক্ষমান রাজপুত্রের টাইটেল ক্রাউন প্রিন্স। বাদশার মৃত্যুর ১৯ দিন আগে সিরিয়াল ভঙ্গ করে রাজ্যের ক্ষমতা দেওয়া হয় বাদশার নিজ পুত্র আব্দুল্লাহ-২ এর হাতে। সে সঙ্গে এক বাঙ্গালী কন্যার রানীর মুকুট পরার স্বপ্ন ভেঙ্গে যায়। ভেস্তে যায় জর্ডান রাজবংশের ধমনীতে বাঙালি রক্তের প্রবাহের উজ্জ্বল সম্ভাবনা।

প্রিন্সেস সার্ভাত বর্তমান

পৃন্স হাসান বর্তমান

আমাদের সে কন্যার নাম সার্বাত, বিবাহপূর্ব সারওয়াত নামের আরবি সংস্করণ। আওয়ামী লীগ নেতা এবং অখন্ড পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী সোহরাওয়ার্দী সাহেবের ভগ্নি শায়েস্তা ইকরামুল্লাহর কন্যা। বেগম শায়েস্তা সোহরাওয়ার্দী ইকরামউল্লাহ (১৯১৫–১১) ছিলেন বাঙালি রাজনীতিবিদ, কূটনীতিক এবং লেখিকা। তিনি লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি অর্জনকারী প্রথম মুসলিম মহিলা।

শায়েস্তা ইকরামুল্লাহ ১৯৬৪ থেকে ১৯৬৭ সাল পর্যন্ত মরক্কোতে অখন্ড পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত এবং জাতিসংঘের প্রতিনিধি ছিলেন। সারওয়ত কনিষ্ঠা কন্যা। উৎস বাঙাল মুলুক হলেও দেশবিভাগের আগে থেকে পরিবারটি পাকিস্তানে পাকাপাকি ভাবে বাস করছে। কাগজে-কলমে পাকিস্তানি নাগরিক।

লন্ডনে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় জর্ডানের ক্রাউন প্রিন্স হাসানের সাথে সারওয়াতের পরিচয় হয়। পরিচয় থেকে প্রণয়। শাদি হয় ১৯৬৮ সালে।

প্রিন্স হাসান আম্মান থেকে বিবাহের প্রস্তাব পাঠালে সার্ভাত এ শর্তে রাজি হন যে তাঁকে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রস্তাব পাঠাতে হবে। তার ইচ্ছা অনুযায়ী উচ্চ পর্যায়ের এক ডেলিগেশন নানা উপঢৌকন নিয়ে করাচিতে পৌঁছান।

১৯৬৮ সালে পাকিস্তানের করাচি নগরীতে বিবাহ অনুষ্ঠানটি সংঘটিত হয়। পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান ও জর্দানের বাদশা হোসেন অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন। তারা সাক্ষী হিসেবেও কাবিননামায় স্বাক্ষর করেন। বিবাহ অনুষ্ঠানটি পাকিস্তান টেলিভিশনে সরাসরি প্রচারিত হয়। বিবাহের পর নাম হয় প্রিন্সেস সার্ভাত হাসান।

সময় বয়ে যায়, সিরিয়া লেবাননের মাঝখানে হার্মন পর্বতের ঢালে জন্ম নেয়া জর্ডান নদী আরো কয়েক লক্ষ টন পানি এনে মৃত সাগরের হৃদস্পন্দন টিকিয়ে রেখেছে।

ইতোমধ্যে সার্ভাতের গর্ভে তিনটি কন্যা এবং একটি পুত্র সন্তান জন্ম নেয়। পুত্রের নাম প্রিন্স রশিদ।

গত শতাব্দীর শেষ লগ্নে পরবর্তী বাদশা কে হবেন তা নিয়ে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব শুরু হয়। ১৯৯৮ সালে বাদশা হোসেনের ক্যান্সার রোগ ধরা পড়ে। তিনি ভাই ক্রাউন প্রিন্স হাসানকে প্রতিনিধি হিসাবে রাজ্যশাসনের দায়িত্ব অর্পণ করে লন্ডনে জন্য যান চিকিৎসার জন্য।

দায়িত্ব পেয়ে প্রিন্স হাসান তার ক্ষমতা পোক্ত করার জন্য বেশ কিছু পদক্ষেপ নেন। বাদশা হোসেন চিকিৎসা স্থগিত রেখে দ্রুত ফিরে এসে শাসনভার গ্রহণ করেন। কে রাজ সিংহাসনের উত্তরাধিকারী হবেন তা নিয়ে দেন-দরবার চলে কিন্তু সন্তোষজনক সুরাহা হয় না।

এক পর্যায়ে ভাইয়ের সাথে সমঝোতার মনোভাব নিয়ে বাদশা হোসেন তার ভ্রাতা হাসানকে সিংহাসনে বসাতে রাজি হন এ শর্তে যে হাসানের পর বাদশা হোসেনের পুত্র হামজাকে ক্রাউন প্রিন্স হিসাবে নিযুক্ত করতে হবে। বাদশা হোসেনের উদ্দেশ্য ছিল নিজ বংশের ধারাবাহিকতা বজায় রাখা।

প্রিন্সেস সার্ভাত সে প্রস্তাবে ভেটো দিয়ে দিলেন। তিনি বাদশা হোসেনের পুত্র হামজার আমেরিকান স্ত্রীকে পছন্দ করতেন না। তার ইচ্ছা ছিল হাসানের পরে তার নিজ পুত্র রশিদকে বাদশা পদে বসাবেন। ‌

অনেক বাক-বিতণ্ডার পর বাদশা হোসেন তার মৃত্যুর ১৯ দিন আগে পুত্র আব্দুল্লাহ-২ কে ক্রাউন প্রিন্স নির্বাচিত করেন। আব্দুল্লাহ এখনো জর্ডানের বাদশা হিসাবে রাজকার্য পরিচালনা করছেন। রশিদ, যার ধমনীতে ক্ষীণ হলেও বাঙালি রক্ত প্রবাহিত হচ্ছে, বাদশাহী পদ লাভের বঞ্চিত হলেন‌।

অনেকক্ষণ যাবৎ আমার ডেড সি ভ্রমণ স্থগিত রেখেছি। এবার ‌সেখানে ফিরে যাই।

ডেড সি’র আরবি নাম বাহরা আল মাই-ইত, বাংলায় মৃত সাগর। নামটি ধার করা হয়েছে গ্রিক নেকরা থালাচ্ছা থেকে। অর্থ একই, মৃত সাগর। ল্যাটিন ভাষায়ও তাই, মারে মোরতুম। বাইবেল এবং আধুনিক হিব্রু ভাষায় এ জলরাশির নাম ইয়ামে হামেলা, লবণ সাগর।

বাইবেল কোরআন সাগরটির নাম উল্লেখ করা হয়েছে সডোম সাগর। সডোম একটি অভিশপ্ত জনপদ। ‌ ধর্ম পুস্তক অনুযায়ী সডোম জনপদের লোকজন ছিল সমকামী। তাদের সুপথে আনার জন্য সেখানে আল্লাহ লুত নবীকে পাঠান। তিনি কিছুতেই তাদের অপকর্ম থেকে ফিরিয়ে আনতে পারলেন না। পরিশেষে খোদার আদেশে তিনি দেশ ত্যাগ করেন। তবে তার স্ত্রী লুত নবীর সঙ্গী হতে অস্বীকৃতি জানান। শাস্তিস্বরূপ তাকে একটা লবণের মূর্তিতে পরিণত করা হয়। মূর্তিটা এখনো টিকে আছে। ফেরেশতা জিবরাঈল (আ) জনপদটি মাটি থেকে উঠিয়ে উল্টিয়ে ফেলেন। এর ফলে সৃষ্টি হয় মৃত সাগর। এ কারণে লেকটিকে সি অফ সডমও বলা হয়। সডম নাম থেকে ইংরেজি ভাষায় শব্দ এসেছে sodomy. অর্থ সমকামিতা।

ডেড সি

ডেড সি’ নাম শুনলেই গা ছমছম করে। কল্পনার চোখে ভেসে ওঠে মৃত লোকদের আনাগোনা, সাগরে ভাসছে লাশ! আসলে সাগরটি মোটেও ভয়ংকর নয়; ‘ডেড সি’ ভীষণ সুন্দর, ভ্রমণ পিপাসুদের জন্য আকর্ষণীয় গন্তব্য। জলরাশিটি পৃথিবীর সবচেয়ে নিম্নতম স্থান। সমুদ্র পৃষ্ঠ হতে ৪৩০.৫ মিটার নিচে। পাতালপুরী বৈকি?

৩০ লক্ষ বছর পূর্বে বর্তমান জর্দান নদী, ডেড সি এবং ওয়াদি আরাবাহ অঞ্চল লোহিত সাগরের পানিতে বারবার প্লাবিত হত। এর ফলে একটি উপসাগরের সৃষ্টি হয়। উপসাগরটি একটি সরু সংযোগের মাধ্যমে লোহিত সাগরের সাথে যুক্ত ছিল ।

প্রায় ২০ লক্ষ বছর পূর্বে উপত্যকা এবং ভূমধ্যসাগরের মধ্যবর্তী স্থলভাগ উচ্চতা লাভ করে। ভূমধ্যসাগরের সাথে সংযোগ বিচ্ছিন্ন হযে উপসাগরটি হ্রদে পরিণত হয়। এর ফলে পানির গভীরতা কমতে থাকে। ৭০ হাজার বছর আগে গভীরতা ছিল প্রায় ৬৮০ মিটার। এখন নেমে এসেছে ৪৩০ মিটারে।

‘ডেড সি’র পানি এত ঘন যে তাতে কেউ চাইলে শুয়েও থাকতে পারে। চাই কি, শুয়ে বইও পড়া যায়। কিংবা ল্যাপটপ খুলে নেটে ব্রাউজও করা যাবে। পানি অত্যন্ত লবণাক্ত বলে তলিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে না। লবণাক্ততা শতকরা ৩০% । ফলে পানির ঘনত্ব ১.২৪ কেজি/লিটার। ১ লিটার পানিতে ১.২৪ কেজি লবণ। এত লবণাক্ত হওয়ার কারণ কি?

রেড সি র পানির প্রধান উৎস জর্ডান নদী। আগেই উল্লেখ করেছি, নদীটি সিরিয়া এবং লেবানন সীমান্তে হার্মন পর্বতের ভাল থেকে উৎপন্ন হয়ে ‌ দক্ষিণ দিকে অগ্রসর হয়ে গ্যালিলি সাগরের মধ্যে দিয়ে ডেড সি তে পানি উৎসর্গ করে। জর্ডান নদী ছাড়া আরো কয়েকটি ছোটখাটো ঝর্ণাধারা এসে জলের ধারা মৃত সাগরে এসে জমা হয়। বৃষ্টিপাত খুবই কম, বছরে ২ থেকে ৪ ইঞ্চি।

জর্ডান নদী এবং ঝরনাগুলি যেটুকু পানি নিয়ে আসে তা বেরোবার রাস্তা নেই। পানির সাথে থাকে সোডিয়াম ক্লোরাইড, সোজা বাংলায় লবণ, এবং বেশ কিছু রাসায়নিক উপাদান। সূর্যের তাপে পানি বাষ্প হয়ে উড়ে গেলেও এসব রাসায়নিক দ্রব্য থেকে যায়। যুগ যুগ ধরে ঘন হয়ে চলেছে লবণাক্ত পানি। মাছ কিংবা কোন জলের প্রাণী এখানে টিকতে পারে না। সেকারণে এর নাম ডেড সি।

এত ঘন পানিতে কেউ মনের দুঃখ চাপা দিতে আত্মহত্যা করার চেষ্টা করেছে কিনা জানা নাই। তবে, সে চেষ্টা যে ব্যর্থ হয়েছে তা নিশ্চিত করে বলা যায়। মৃত সাগরের পানি তাকে উপরে ভাসিয়ে রাখবে। রেড সি নিজে মৃত্যু সাগর হলেও অন্য কাউকে মৃত্যুর পথে ঠেলে দিতে ইচ্ছুক নয়। এর একটা বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা আছে বৈকি।

ডেড সি জল সয্যা

পানি লবণের সাথে বন্ধুত্বের বন্ধনে আবদ্ধ হতে পছন্দ করে। সে উদ্দেশ্যে পানির H2O অণুগুলো লবণের অণুগুলোল আশেপাশে ভিড় জমায়। সে কারণে মিঠে পানির তুলনায়‌ লবণাক্ত পানিতে বেশি অনু থাকে।‌‌ লোহা লক্কড়ের মত ভারি বস্তু না হলে সে ঘন পানির বন্ধন বিছিন্ন করে তলিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা কম থাকে।

ডেড সীতে পৌঁছে দেখতে পেলাম মানুষজন ‌দিব্যি হাত পা ছড়িয়ে উপুড় কিংবা চিত হয়ে পানির উপর ভেসে রয়েছে।কেউ পেপার ম্যাগাজিন পড়ছে, কেউ চুপচাপ শুয়ে আছে।

আমাদের ডেলিগেশনের কারো কারো মৃত সাগরে ভেসে বেড়ানোর ইচ্ছে জাগে নি তা নয়। কিন্তু জর্ডান সরকারের রাজকীয় অতিথিদের জন্য সে বালখিল্যতা মোটেই শোভন হবে না বলে বাতিল করা হলো। সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে দু এক আজলা পানি মুখে দিয়ে লবণের ঝাঁজ দেখে কুলি করে ফেরত দিয়ে ডেড সি’কে বিদায় জানালাম।

About Post Author

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Pin It on Pinterest