November 29, 2023

সময়কাল: খ্রিস্টপূর্ব ২৬০০ থেকে ৯০০ খ্রিস্টাব্

অবস্থান: বর্তমান মেক্সিকো, গুয়াতেমালা, এল সালভেদর, বেলিজ

প্রায় সাড়ে চার হাজার বছর আগে মধ্য আমেরিকায় বিশাল এলাকা জুড়ে প্রাচীন পৃথিবীর ‌‌অবিশ্বাস্য রকমের সমৃদ্ধ মায়া সভ্যতা প্রস্ফুটিত হয়ে ওঠে। পুরাতত্ত্ববিদদের অনুমান মোতাবেক মায়া সভ্যতা যখন উন্নতির মধ্য গগনে তখন তাদের জনসংখ্যা পৌঁছে যায় এক কোটিতে।

সেন্ট্রাল আমেরিকায় মায়া সভ্যতার অবস্থান

মায়াদের প্রাচীন শহর ইউকাতান ছিল সে সাম্রাজ্যের শেষ রাজধানী খ্রিষ্টপূর্ব (২০০০-২৫০ খ্রিষ্টাব্দ)। এ সভ্যতা টিকেছিল প্রায় ২,৫০০ বছর। প্রায় ১,৫০০ বছর পূর্বে বর্তমান ইংল্যান্ডের দ্বিগুণ জায়গা জুড়ে

মায়া সভ্যতার সুদীর্ঘ সাড়ে চার হাজার বছর স্থায়ী কালকে তিনটি যুগে বিভক্ত করা হয়ে থাকে। (১) প্রি-ক্লাসিক যুগ (২) ক্লাসিক যুগ, ও (৩) পোস্ট ক্লাসিক যুগ।

প্রাচীনত্বের বিবেচনায় মেসোপটেমিয়া, সিন্ধু অববাহিকা এবং মিসরের সভ্যতার চেয়ে কিছুটা পিছিয়ে থাকলেও মায়ারা সভ্যতার পথে যাতায়াত শুরু করার প্রায় এক হাজার বছর পরে চীন সে পথে গুটি গুটি পায়ে হাঁটতে শুরু করে।পরাক্রমশালী পারস্য ও রোমানদের সভ্যতার উন্মেষ ঘটে আরও দুই হাজার বছর পরে। একমাত্র গ্রিক ও রোমান সভ্যতা ছাড়া ইউরোপের বাকি অঞ্চলের জনপদ ছিল অন্ধকারাচ্ছন্ন। ইউরোপে সে অঞ্চলে আনুমানিক ১৭৬০ খ্রিস্টাব্দে শিল্প বিপ্লবের মাধ্যমে সভ্যতার সূচনা হয়। প্রাচীনত্বের বিবেচনায় অন্যান্য সভ্যতার তুলনায় বলা যায় একেবারে শিশু সভ্যতা।

যখন গুটিকয়েক প্রাচীন সভ্যতার বাইরে মানুষ জানত না কীভাবে আবাস গড়তে হয়, সে সময়ে মায়ানরা গড়ে তুলেছিল উঁচু উঁচু স্থাপনা, সমৃদ্ধ করেছে জ্ঞান-বিজ্ঞানের জগত, উদ্ভাবন করেছিল অবাক করা অনেক কিছু, যা ঐ সময়ের তো বটেই, এ যুগের মানুষকেও বিস্ময়ে অভিভূত করে।

দুনিয়ার রীতি–সাম্রাজ্য ও সভ্যতা ধীর লয়ে শুরু হয়, এক সময় সমৃদ্ধির মধ্য গগনে পৌঁছে যায়, তারপর শুরু হয় পতন। মায়া সভ্যতা উন্নতির মধ্যগগনে পৌঁছে তার দীপ্তি ক্রমান্বয়ে ক্ষীণ হয়ে এক সময় বিস্মৃতির অতলে হারিয়ে যায়। পুরাতত্ত্ববিদেরা ঊনবিংশ শতাব্দীতে মায়াদের রেখে যাওয়া স্থাপনা, পুঁথি পত্র ও অন্যান্য আলামত বিচার-বিশ্লেষণ করে তাদের অবিশ্বাস্য সমৃদ্ধির কথা শুনিয়ে দুনিয়ার মানুষকে চমকে দেন।

পোশাক-আশাক

তখনকার লাগসই প্রযুক্তি ব্যবহার করে তারা পশুর চামড়া ও পশম দিয়ে তৈরি কাপড়চোপড় পরতো।‌ গ্রীষ্মকালে পুরুষেরা উদোম গায়ে থাকলেও শীতকালে নারী পুরুষ নির্বিশেষে কম্বল দিয়ে তৈরি পোশাক পরতো। মেয়েদের মত ছেলেরা লম্বা চুল রাখতো।

বিবাহিত মেয়েরা শরীরে উল্কি লাগিয়ে ‌ নো ভ্যাকান্সি‌ নোটিশ টানিয়ে দিত। ভুট্টা দিয়ে তৈরি খাদ্য ‌ ছিল তাদের প্রোটিনের প্রধান উৎস।

জ্যোতির্বিদ্যা‌

মায়াদের চিন্তা ভাবনা শুধু মাটির দুনিয়ায় আবদ্ধ ছিল না। আকাশের গ্রহ, নক্ষত্র, চন্দ্র-সূর্য কিভাবে উৎপত্তি হয়েছে ও তাদের গতিবিধি সম্পর্কে নানা তথ্য তারা রেখে গেছে। মঙ্গল ও বৃহস্পতি তাদের অনুসন্ধিৎস দৃষ্টি এড়ায়নি।

মায়াদের তৈরি জ্যোতির্বিজ্ঞান সম্পর্কিত জটিল চিত্র

মায়া ক্যালেন্ডার

মায়ানরা সময় গণনার ক্ষেত্রে অদ্ভুত বিচক্ষণতার পরিচয় রেখে গেছে। তাদের হিসাব মতে এক বছর সমান ৩৬৫.২৪২০ দিন। বহু শতাব্দী পরে অনেক হিসাব-নিকাশ, যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে আধুনিক যুগে বের করেছে এক বছরের সমান ৩৬৫.২৪২৫‌। প্রকৃত সময়ের এত কাছাকাছি কি করে তারা পৌঁছেছিল তা ভাবলে অবাক লাগে।

বিশটা প্রতীক এবং দশটি সংখ্যাবিশিষ্ট মায়াদের তৈরি ক্যালেন্ডার

চান্দ্রমাস ও চান্দ্র বছরের ব্যাপ্তিও তারা নিখুঁত ভাবে নির্ণয় করেছিল। অথচ বেশি দিনের কথা নয়, ষষ্ঠদশ শতাব্দীতেও সূর্যের চারপাশে পৃথিবী চক্কর দেয় বলে মতবাদ প্রকাশ করার জন্য গ্যালিলিওকে ভ্যাটিকানের ধর্ম পণ্ডিতেরা ফাঁসিতে চড়ানোর মতলব করেছিল।

লিখন পদ্ধতি

ধারণা করা হয়, খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম শতাব্দী থেকেই মায়ানরা ভিন্ন স্টাইলে হায়ারোগ্লিফিক পদ্ধতিতে ছবি এঁকে ক্যালেন্ডার তৈরি করত। সমস্ত আমেরিকান সভ্যতার তুলনায় মায়ারা লেখার জন্য সবচেয়ে উন্নত পদ্ধতি আবিষ্কার করেছিল। সে পদ্ধতি গ্লাইফস নামে পরিচিত। এ পদ্ধতিতে ছবি ও চিহ্নের মাধ্যমে কোনো বর্ণ বা শব্দের প্রকাশভঙ্গি নির্ণয় করা হতো।

লেখার জন্য মায়ানরা প্রায় ৭০০টিরও অধিক গ্লাইফস ব্যবহার করত। আশ্চর্যজনকভাবে মায়ানদের ব্যবহৃত গ্লাইফসের প্রায় ৮০ শতাংশ বর্তমান সময়ে এসেও পাঠোদ্ধার করা গেছে। মায়ারা তাদের ইতিহাস এবং ঐতিহ্য সম্পর্কে সচেতন ছিল। তাই তারা তাদের ইতিহাস এবং ঐতিহ্যের বিবরণ পিলার, দেয়াল এবং পাথরে খোদাই করে লিখে রাখত। শুধু তা-ই নয়, তারা বইও লিখত। বইয়ের বেশিরভাগ জায়গা জুড়েই থাকত ঈশ্বর, প্রাত্যহিক জীবনযাপন এবং রাজাদের নানা কথা।

লেখার জন্য গ্লাইফাস

ওষুধ

মায়ারা রোগ ব্যাধির কারণ নির্ণয় করার টেকনিক এবং ধর্মোপদেশ ও বিজ্ঞানের তাত্ত্বিক জ্ঞানের উপর ভিত্তি করে রোগ উপশমের উপায় বের করেছিল। কেটে ছিঁড়ে গেলে সেলাই, হাড় ভাঙলে প্লাস্টার, দাঁতে ক্যাভিটি বা ছিদ্র হলে ফিলিং করার টেকনিক রপ্ত করেছিল। তারা দেড় হাজারেরও বেশি গাছপালা থেকে ওষুধ তৈরি করতো।

ধর্ম ও বিজ্ঞান ভিত্তিক চিকিৎসা পদ্ধতি

শিল্পকর্ম

মায়াদের শিল্পকলা ছিল যুগের তুলনায় অনেক অগ্রসর। কাঠের শিল্পকর্ম, কাচের শিল্প, মৃণ্ময় পাত্র, পাথরের শিল্পকর্ম, দেয়াল লিখন আজও মানুষের মনে বিস্ময় উদ্রেক করে।

মায়াদের দৃষ্টি নন্দন শিল্পকলার

মায়াদের জটিল বিস্ময়কর শিল্পকর্ম

মুখোশ

মায়ানরা বিশ্বাস করত পাতাল থেকে দৈত্য এসে তাদেরকে মেরে ফেলতে পারে। এসব দৈত্যদের ভয় দেখাতে মায়ানরা বিভিন্ন মুখোশ পরত। তাদের মুখোশগুলো ছিলো মূলত দৈত্যদের ভয়ের প্রতীক। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি। পাতাল থেকে নয়, আটলান্টিকের ওপার থেকে স্প্যানিশ দর্সুরা এসে তাদের শেষ চিহ্নটুকু ধূলায় মিশিয়ে দেয়।

ভয়ঙ্কর মুখোশ

পিরামিড

অন্যান্য সমসাময়িক সভ্যতার তুলনায় মায়ারা সাংস্কৃতিক দৃষ্টিকোণ থেকে অনেক উন্নত ছিল। মায়া এবং আজটেকরা অনেকগুলো পিরামিড তৈরি করেছিল যার কয়েকটি মিশরীয় পিরামিডের চেয়ে বড়।

মায়াদের তৈরি বিশালাকৃতির পিরামিড

মায়া সভ্যতা কি করে হঠাৎ পতন শুরু হলো এবং তারা কোথায় বা হারিয়ে গেল ইতিহাসের এক রহস্য হিসেবে রয়ে গেছে। তবে, তাদের বংশধররা এখনো সেন্ট্রাল আমেরিকায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে।

About Post Author

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Pin It on Pinterest