October 29, 2025
আব্রাহাম-লিংকনের-মুখের-দাড়ি-রহস্য

আব্রাহাম লিংকন আমেরিকার ইতিহাসে একটি অনন্য চরিত্র। ‌তিনি কাঠের গুড়ি দিয়ে তৈরি একটি ঘরে দারিদ্র্যের মধ্যে জন্মগ্রহণ করে‌ন। প্রজ্ঞা, বাগ্মিতা ও সততার গুনে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট পদ অলংকৃত করেন।‌ তিনিই সর্বপ্রথম আমেরিকার প্রেসিডেন্ট যিনি সেদেশের অগুনতি নির্যাতিত দাসদের জন্য মুক্তির বারতা বয়ে আনেন।

লিংকন আইন ব্যবসায়ী হিসেবে ক্যারিয়ার শুরু করলেও ১৮৫৪ সালে নতুন রিপাবলিকান পার্টির একজন নেতা হিসেবে রাজনীতিতে প্রবেশ করেন এবং ১৮৬০ সালে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে জয় লাভ করে আমেরিকান ইতিহাসে নব দিগন্তের সূচনা করেন। ‌

আব্রাহাম লিংকন ‌ছিলেন স্বশিক্ষিত; বন্ধু-বান্ধবের পুরনো বই পত্র চেয়ে এনে পড়াশোনা করতেন।‌ তবুও তার ভাষা জ্ঞান এবং শব্দচয়ন ছিল অসাধারণ। তিনি গেটিসবার্গে গৃহযুদ্ধে নিহত সেনাদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে যে বক্তৃতা দিয়েছিলেন ‌ তা আমেরিকা তথা পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে সুষমামণ্ডিত এবং গুরুত্বপূর্ণ ভাষনের তালিকায় স্থান করে নিয়েছে। লিংকনের ভাষনের একাংশ এরকম:

“that these dead shall not have died in vain—that this nation, under God, shall have a new birth of freedom—and that government of the people, by the people, for the people, shall not perish from the earth.”

অনেক দুর্গম পথ এবং দুস্তর বাঁধা বিঘ্ন পেরিয়ে তিনি সাফল্যের বন্দরে পৌঁছাতে পেরেছিলেন।

এ মহামান্বিত রাষ্ট্রনায়কের জীবনের একটি চমৎকার অধ্যায় নিয়ে আজকের এই কাহিনী। কাহিনীটা তার দাড়িকে ঘিরে। আমেরিকার অল্প সংখ্যক প্রেসিডেন্ট্ ছোটখাটো দাড়ি রাখলেও তাঁর মতো জমকালো দাড়ি কেউ রাখেননি।

ছোট থাকতেই লিংকনের চেহারা-সুরত ভালো ছিল না। বন্ধুবান্ধব তা নিয়ে ঠাট্টা-তামাশা করতেন। একবার রাস্তায় এক সুন্দরী মহিলার সাথে তার সাক্ষাৎ হয়। ‌ মহিলা টিটকারি দিয়ে বললেন, তোমার চেহারা এত খারাপ কেন?

লিংকনের উত্তর, ঈশ্বর আমাকে বানিয়েছেন এরকম, আমার কি করার আছে?

তিনি লিংকনকে বললেন, তাহলে অন্তত দয়া করে ঘরেই বসে থাকুন, বাইরে বেরুবার দরকার কি?

তার বিশ্রি চেহারা ইলেকশনে তাকে ভোগাবে বলে অনেকেই সন্দেহ করেছিলেন। এ সময় তার কাছে একটা চিঠি আসে।

১৮৬০ সালের প্রথম দিকে নিউইয়র্ক থেকে গ্রেস বেডেল নামে মাত্র ১১ বছরের এক বালিকা তার কোমল হৃদয়ের ব্যাকুলতা, সরলতা ও উষ্ণতা মিশিয়ে লিংকনকে তাঁর চেহারা মেরামতের জন্য দাড়ি রাখার পরামর্শ দিয়ে একটা চিঠি লিখেন। বাংলা ভাষায় তাঁর ভাবানুবাদ এরকম;

“আমার বাবা এইমাত্র মেলা থেকে আপনার একটা ছবি এনেছেন। আমি মাত্র ১১ বছরের ক্ষুদ্র বালিকা, কিন্তু কায়মনোবাক্যে প্রার্থনা করি আপনি যাতে প্রেসিডেন্ট হন। সুতরাং আপনার মত এক মহান ব্যক্তির কাছে চিঠি লেখার জন্য আমার দুঃসাহস ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।

আমার বয়সী আপনার কি ছোট্ট ছোট মেয়ে আছে? থাকলে তাদের আমার ভালোবাসা দিবেন এবং আপনি নিজে যদি উত্তর নাও দিতে পারেন, তাদের বলবেন আমার কাছে লিখতে।

আমার চার ভাই। তাদের কেউ কেউ আপনাকে ভোট দিবেন। আপনি যদি দাড়ি রাখেন তাহলে বাকিদেরকেও আপনাকে ভোট দিতে রাজি করাতে পারব বলে আশা রাখি। একথা এই কারণে বললাম, আপনার থুতনি বড্ড হালকা-পাতলা, চেহারা বড্ড খারাপ দেখায়। দাড়ি গজালে মুখের চেহারা অনেক গুণ ভালো দেখাবে।

সব মহিলারাই দাড়িওয়ালা পুরুষদের পছন্দ করেন। আপনি দাড়ি রাখলে তাঁরাও আপনাকে ভোট দেওয়ার জন্য তাদের স্বামীদের উৎসাহিত করবেন। (বিশেষ দ্রষ্টব্য: তখন আমেরিকার মহিলাদের ভোটাধিকার ছিল না)।

আমার বাবা অবশ্য আপনাকে ভোট দিবেন। আমি যদি পুরুষ হতাম আমিও আপনাকে ভোট দিতাম। আপনার মুখের চারপাশ দাড়ি দিয়ে ঘিরে থাকলে চেহারাটা খুব সুন্দর দেখাবে। তা হলে আমিও আপনাকে ভোট দেওয়ার জন্য সবাইয়ের কাছে আবদার করতে পারব। আমার নয় সপ্তাহ বয়সি একটা ছোট বোন আছে এবং যার পর নাই দুষ্টু।”

লিংকন বালিকার চিঠিটা উপেক্ষা করেননি। তিনি লিখলেন,

“তোমার ১৫ তারিখে লেখা চমৎকার পত্রটি পেলাম। আমাকে দুঃখের সাথে বলতে হচ্ছে আবার কোন মেয়ে নেই। আমার তিনটি ছেলে আছে–একজন সতের, একজন নয় এবং একজন সাত। তারা এবং তাদের মাকে নিয়েই আমার পুরো সংসার। দাড়িটার ব্যাপারে বলতে হয়, কখনো দাড়ি রাখিনি, এখন যদি দাড়ি গজায় তাহলে লোকজন ঠাট্টা মশকরা করবে না তো?”

দাড়ি রাখার প্রতিশ্রুতি না দিলেও লিংকন রীতিমতো দাড়ি রাখতে শুরু করেন।

নির্বাচিত হওয়ার পর প্রেসিডেন্ট পদে অভিষিক্ত হওয়ার জন্য ইলিনয়ের তার বাসা থেকে ওয়াশিংটন ডিসি যান। ততদিনে তার দাড়ি পুরোপুরি ঘন হয়ে গজিয়ে উঠেছে।

ওয়াশিংটনের উদ্দেশ্যে নিউইয়র্কের মধ্য দিয়ে যাওয়ার পথে ফেব্রুয়ারি মাসের ১৬ তারিখে অল্প সময়ের জন্য ওয়েস্টফিল্ড স্টেশনে যাত্রাবিরতি করেন। রেল স্টেশনে তাঁকে দেখার জন্য প্রচুর লোকজন জমা হয়েছিল। তিনি তাদের আহবান করে বললেন,”আমি আপনাদের মাঝে আসতে পেরে খুবই আনন্দিত, এবং আমি মনে করি আপনারাও খুশি হয়েছেন। তবে আনন্দটা আমারই বেশি। (এ সময় জনতা উল্লাসে ফেটে পড়ল)।

প্রায় তিন মাস আগে এই এলাকার এক বালিকার কাছ থেকে আমি একটা চিঠি পেয়েছিলাম। অত্যন্ত সুন্দর চিঠি যাতে সে আমার চেহারা ধোপদুরস্ত করতে দাড়ি রাখার পরামর্শ দিয়েছিল। অনেকটা সে কারণে আমি দাড়ি রেখেছি। যদি সে এখানে উপস্থিত থাকে আমি তাকে একটু দেখতে চাই। আমার মনে হয় তার নাম ছিল বেডেল।

এক ছোট ছেলে বিস্ময় অভিভূত হয়ে চিৎকার করে বলল,” ঐ তো ও সে ওখানে, মিস্টার লিংকন।”

ফুটফুটে কালো চোখের লজ্জাবনত মেয়েটি মুখে রক্তিম আভা ছড়িয়ে লিংকনের দিকে তাকিয়ে ছিল। প্রেসিডেন্ট কামরা থেকে নামলে জনতা তাকে রাস্তা করে দেয়। নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট তার গন্ডদেশে কয়েকটি চুম্বন এঁকে দিয়ে জনতার উল্লাস ধ্বনির মধ্যে বিদায় নিলেন।

ছবিটি ১৯৯৯ সালে নিউ ইয়র্কের ওয়েস্টফিল্ডে Lincoln-Bedell Statue Park আব্রাহাম লিংকন এবং বেডেলের প্রতিমূর্তি।

About Post Author

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Pin It on Pinterest