November 29, 2023

এক চিলতে দ্বীপ হয়েও সিঙ্গাপুর ও হংকংয়ের বিস্ময়কর সাফল্যে অবাক হওয়ারই কথা।

মালয়েশিয়ার লেজে এক চিলতে দ্বীপ সিঙ্গাপুর

মালয়েশিয়া সিঙ্গাপুর যুগল-বন্ধন

সিঙ্গাপুর প্রায় ১০০ বছর ব্রিটিশ নিয়ন্ত্রণে ছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপান সিঙ্গাপুর দখল করে নিলে ব্রিটিশদের কর্তৃত্ব শিথিল হয়ে পড়ে। ১৯৬৩ সালে সিঙ্গাপুর ব্রিটিশ শাসন থেকে মুক্ত হয়ে মালয়েশিয়ার সাথে যোগ দেয়। নাম হয় ফেডারেশন অব মালয়েশিয়া।

দুই ভূখণ্ডের মিল মহব্বত বেশি দিন টেকে নাই। প্রধান কারণ, জাতিগত বিভেদ। সিঙ্গাপুরের দুই-তৃতীয়াংশ ছিল চাইনিজ , এক-তৃতীয়াংশ মালয় বংশোদ্ভূত। দুই গ্রুপের ধর্ম ও কালচার আলাদা। দুই দলের মধ্যে মারামারি কাটাকাটি লেগেই থাকত। একত্রিত হওয়ার দুই বছরের মধ্যে বিদায়ের ঘন্টা বেজে উঠল। ত্যাক্ত বিরক্ত হয়ে ১৯৬৫ সালে মালয়েশিয়া সিঙ্গাপুরকে ফেডারেশন থেকে বহিষ্কার করে দেয়।

মালয়েশিয়া বহিষ্কার করে দেওয়ার পর সিঙ্গাপুরের সমস্যা ছিল পাহাড় পরিমাণ। দ্বীপের দুইপাশে দুইটি বৈরী রাস্ট্র ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়ার দ্বারা কর্তৃক কোণঠাসা, নগরীর ৩০ লক্ষ লোকের মধ্যে বেশির ভাগই বেকার, দুই-তৃতীয়াংশ লোকের বাস বস্তিতে।

অন্যদিকে, প্রাকৃতিক সম্পদের অভাব, পানি সরবরাহ পয় প্রণালীর বালাই নেই, অবকাঠামো নড়বড়ে। সিঙ্গাপুরের সে দুঃখের দিনগুলোতে মুক্তির বারতা নিয়ে দৃশ্যপটে উদয়‌ হন একজন দক্ষ এবং দূরদর্শী নেতা লী কুয়ান। জাতিগত বিবাদ-বিসংবাদ ভুলে সিঙ্গাপুরের লোকজন তাকে নির্বাচিত করেন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে।

প্রধানমন্ত্রীর পদ গ্রহণ করে সমস্যা জর্জরিত সিঙ্গাপুরের অর্থনৈতিক দুর্দশা দূর করতে লী আন্তর্জাতিক সাহায্য প্রার্থনা করলে কেউ সাড়া দেয়নি। এ হতাশাজনক পরিস্থিতিতে নিজেদের ঘর নিজেরাই সামলানোর দায়িত্ব ঘাড়ে নেন লী কুয়ান।

লী কুয়ান ১৯৬৯

১৯২৩ সালে লী কুয়ান এ বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন।

বিশ্বায়ন এবং বাণিজ্য

ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আমলে সিঙ্গাপুরের অর্থনীতির মূল শক্তি ছিল ব্যবসা বাণিজ্য। এক দেশের পণ্য আমদানি করে অন্য দেশে চালান করা। ধারনের ব্যবসার পোশাকি নাম entrepot—আড়তদারি বলাই ভালো। এ-ভাবে দালালি করে কতই বা নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা যায়? কর্মসংস্থান সৃষ্টি করার উপায় শিল্পায়ন কিন্তু সিঙ্গাপুরে এজন্য কোন ট্রাডিশন ছিল না, দক্ষ জনবলের অভাব ছিল। শিল্প পণ্য বিক্রি করবেই বা কার কাছে? দুপাশে দুটো রাষ্ট্র সিঙ্গাপুরের প্রতি নাখোশ। বড্ড কঠিন অবস্থা।

উপায়ান্তর না দেখে সিঙ্গাপুর আশে পাশের দেশগুলো পাশ কাটিয়ে বৃহত্তর বিশ্ব অর্থনীতির অঙ্গনের প্রতি দৃষ্টি প্রসারিত করে। লী কুয়ান ইউরোপ-আমেরিকার উন্নত দেশগুলোর সাথে বাণিজ্য সম্পর্ক জোরদার করেন এবং বহুজাতিক কোম্পানীদের শিল্প স্থাপনের জন্য সাদরে আমন্ত্রণ জানান।

কেন্দ্রীভূত ক্ষমতা

সিঙ্গাপুর নিরাপদ, দুর্নীতিমুক্ত এবং সহনীয় ট্যাক্সের হার ব্যবস্থা গ্রহণ করে বিদেশি বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর বিনিয়োগের জন্য আকর্ষণীয় বাতাবরণ তৈরি করে।

এজন্য অবশ্য নাগরিকদের অনেক মৌলিক অধিকার খর্ব করা হয়। স্বৈরাচারী সরকার বললেও অত্যুক্তি হয় না। তবে এও ঠিক, অমলেট বানাতে হলে ডিম ভাঙতে হয়। হুমায়ূন আহমেদের ভাষায়, মারের উপর ঔষধ নেই।

লী কুয়ান ডিম ভাঙ্গা নীতি অবলম্বন করেন। কাউকে মাদক ব্যবসা কিংবা দুর্নীতির জন্য ধরা পড়লে ফাঁসির মঞ্চে ঝুলিয়ে দেওয়া হয়। ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বহু শ্রমিক ইউনিয়ন একীভূত করে একটি মাত্র ট্রেড ইউনিয়ন গঠন করা হয়েছে। তারা সংঘর্ষের পরিবর্তে সরকারের সাথে সহযোগিতা করে। এক একটা রাজনৈতিক দলের লেজুড়বৃত্তি করার জন্য ট্রেড ইউনিয়নের কোনো সুযোগ রাখা হয় নাই। সিঙ্গাপুরের পার্লামেন্টে লীর রাজনৈতিক দলের একচ্ছত্র অধিপতি। অভিমান করে সমাজতান্ত্রিক পার্টি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেনি। তাতে লীর বয়েই গেল। বরং আপদ দূর হলো। দুই-এক জন বিরোধী দলের সাংসদদের পার্লামেন্টে বসে হাই তুলে ঝিমোনো ছাড়া তেমন কোনো দায়িত্ব ছিল না।

দক্ষিণ এশিয়ার মত সমাজতন্ত্র, বৈজ্ঞানিক গণতন্ত্র, ধর্মের জিগির তুলে কেউ রাজনীতি কলুষিত কিংবা অর্থনৈতিক পরিবেশ নষ্ট করলে সোজা জেলে পাঠিয়ে দেয়া হয়। লোয়ার কোর্ট, হাইকোর্ট, সুপ্রিম কোর্ট, আপিল বিভাগ, রিট পিটিশন নানা বাহানায় আইনের জাল থেকে রেহাই পাওয়ার উপায় নেই। ২০১০ সালে লী আমেরিকার এক সংবাদপত্রে বিবৃতি দেন যে, ‘আমি বিনা বিচারে দীর্ঘদিন কাউকে কাউকে আটকে রাখার জন্য দুঃখিত, কিন্তু দেশের স্বার্থটাই আমার কাছে বড় কথা।

কঠোর আইনের শাসন

সিঙ্গাপুরে আইনের শাসন বড় কড়া। রাস্তায় চকলেটের মোড়ক বা সিগারেটের বাকি অংশ রাস্তায় ফেললে জরিমানা ৩০০ সিঙ্গাপুর ডলার। (সিঙ্গাপুর ডলার ১=টাকা ৬৪, ইন্ডিয়ান রুপি ৫৫)। বিচিত্র কঠোর আইনের আরো কয়েকটা শোনা যাক। সে দেশে যাওয়ার আগে তা জানা থাকলে কাজে লাগবে।

সিঙ্গাপুরে ‌ রাস্তায় গান-বাজনা বা কুরুচিপূর্ণ সংগীত চর্চা করলে জরিমানা ও তিন মাস পর্যন্ত জেলের ঘানি টানতে হতে পারে। অন্য কারো ওয়াইফাইয়ে‌ সংযোগ করে হ্যাকিং করলে তিন বছরের জেল, ১০,০০০ ডলার জরিমানা।

রাস্তায় কবুতরকে উচ্ছিষ্ট খাবার খাওয়াতে নিক্ষেপ করলে জরিমানা ৫,০০০ ডলার। পাবলিক টয়লেট ব্যবহার করে ফ্ল্যাশ না করে সটকে পড়লে জরিমানা ১৫০ ডলার।

জনসমাগমস্থলে ধূমপান করলে জরিমানা অন্তত ১৫০ ডলার। চুইংগাম নিষিদ্ধ; দোকানি চুইংগাম বিক্রি করলে জরিমানা ১০,০০০ ডলার।

রাস্তায় থুতু ফেললে জরিমানা ১,০০০ ডলার‌। কেউ দেখছে না ভেবে থুথ ফেললে, কোন এক অদৃশ্যালোক থেকে পুলিশ এসে হাজির হবে।

ফাঁকা লিফট পেয়ে মূত্রাশয়ের চাপ লঘু করতে যদি ভেবে থাকেন কেউ তো আর দেখছে না, কাজটা সেরে নেই, তাহলে ধরা খেয়ে যাবেন। লিফটে পেশাবের গন্ধ শোকার যন্ত্র লাগানো আছে। ব্যস, লিফটের দরজা বন্ধ পুলিশ এসে হাজির। তারপর জেল-জরিমানা।

এজন্য বলা হয় সিঙ্গাপুর ফাইন সিটি। ফাইনের এক অর্থ সুন্দর, অন্য অর্থ জরিমানা।

সিঙ্গাপুরের অবস্থান দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার কেন্দ্রস্থলে, ব্যবসা বাণিজ্য শিল্প প্রসারের জন্য অবকাঠামো উন্নত। অবকাঠামো উন্নয়নের জন্য কোন বাঁধা আমলে আনে নি। স্থানাভাবের কারণে মালয়েশিয়া থেকে মাটি কিনে এনে সমুদ্র ভরাট করে সিঙ্গাপুরে অত্যাধুনিক চাঙ্গি এয়ারপোর্ট তৈরি করেছ।

সিঙ্গাপুর চাঙ্গি এয়ারপোর্ট। মালয়েশিয়া থেকে মাটি আমদানি করে সমুদ্র ভরাট করে তৈরি করা হয়।

চাঙ্গি এয়ারপোর্ট সংলগ্ন ফ্লাওয়ার গার্ডেন

অর্থনৈতিক সাফল্য

কঠোর দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসন এবং বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ সিঙ্গাপুরের অর্থনৈতিক উন্নয়নের মূল চাবিকাঠি। ১৯৬০ সালে মাথাপিছু আয় ছিল মাত্র মার্কিন ডলার ৩২০। এখন সে দেশ পৃথিবীর সবচেয়ে দ্রুত অর্থনৈতিক বৃদ্ধির তালিকায় স্থান করে নিয়েছে। ২০২১ সালে সিঙ্গাপুরে অনুমিত মাথাপিছু আয় ৬২,০০০ মার্কিন ডলার। অবিশ্বাস্য অর্জন বৈকি!

মানবসম্পদ উন্নয়ন ও অবকাঠামো

শিল্প-বাণিজ্য উন্নয়নের পাশাপাশি সিঙ্গাপুর মানব সম্পদ উন্নয়নের দিকে গুরুত্ব দিয়ে থাকে। প্রচুর সংখ্যক টেকনিক্যাল স্কুল খুলেছে, বিদেশ থেকে এক্সপোর্ট এনে তথ্যপ্রযুক্তি পেট্রোকেমিক্যাল ইলেকট্রনিক এবং অন্যান্য প্রয়োজন মোতাবেক দক্ষ জনবল গড়ে তুলেছে। আমাদের দেশের মত উদ্দেশ্যহীন ভাবে বাস্তবতাবিমুক ডিসিপ্লিনে সর্বোচ্চ ডিগ্রী নিয়ে বেকারত্বের অভিশাপ বয়ে বেড়াতে হয় না।

সিঙ্গাপুরের বন্দর ব্যবস্থা অত্যন্ত উন্নত। ওজনের ভিত্তিতে পণ্য ওঠানামা হিসেবে পৃথিবীর মধ্যে দ্বিতীয়, শুধু মাত্র সাংহাই বন্দরের পিছনে। উপমহাদেশের অনেক পণ্য বড় বড় জাহাজে প্রথমে সিঙ্গাপুরে এনে ছোট লাইটার জাহাজের মাধ্যমে যার যার দেশে পাঠিয়ে দেয়।

সিঙ্গাপুর সমুদ্র বন্দর। সিঙ্গাপুরের দুটো সমুদ্র বন্দর পৃথিবীর মধ্যে দ্বিতীয় ব্যস্ততম বন্দর।

পর্যটন শিল্প উন্নয়ন করার জন্য অনেক ধরনের আকর্ষণীয় ভ্রমণ কেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে। বছরে প্রায় এক কোটি ভ্রমণপিপাসু মানুষ সিঙ্গাপুরে আসে। সম্প্রতি পৃথিবীর মধ্যে সবচাইতে বহুমুখী দুটো ক্যাসিনো উদ্বোধন করা হয়েছে।

আলো ঝলমল বিলাসবহুল হোটেল

সিঙ্গাপুরের ব্যাংকিং ব্যবস্থা অত্যন্ত উন্নত এবং যুগোপযোগী। সুইজারল্যান্ডের অনেক আমানত এখন সিঙ্গাপুরে পাড়ি জমিয়েছে। বাংলাদেশের কালো টা আন্তর্জাতিক অর্থ এবং ফরেন এক্সচেঞ্জ মার্কেটে লেনদেনের জন্য সিঙ্গাপুর অন্যতম প্রধান কেন্দ্র।

চিকিৎসা ক্ষেত্রে আশেপাশের দেশ থেকে অজস্র মানুষ ভিড় জমায়। সে ভীড়ে যোগ দেয় বাংলাদেশের বিত্তবানরা। শোনা যায়, একবার লি কোয়ান কোন একটা রোগে অসুস্থ হয়ে পড়লে তিনি বিদেশে চিকিৎসা করার প্রস্তাব নাকচ করে দেন। নিজ দেশেই সে অসুখের চিকিৎসার জন্য দ্রুত ব্যবস্থা করার নির্দেশ দেন। ব্যবস্থা সম্পন্ন হলে তিনি সিঙ্গাপুরে চিকিৎসা গ্রহণ করে সুস্থ হন।

আন্তর্জাতিক মানের বিশ্ববিখ্যাত মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতাল

দীর্ঘ ২৫ বছর কঠোর হস্তে শাসন ব্যবস্থা পরিচালনা করে লী ১৯৯০ সালে প্রধানমন্ত্রিত্ব ছেড়ে দেন তবে ক্যাবিনেট মন্ত্রী হিসাবে ২০০৪ সাল নাগাদ শাসনকার্যের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত ছিলেন। ২০১০ সালে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।

About Post Author

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Pin It on Pinterest