October 29, 2025
পৃথিবীর ম্যাপে উত্তর মেরুকে কেন উপরে দেখানো হয়

দেয়ালে টাঙানো ম্যাপ দেখতে দেখতে এতটা অভ্যস্ত ‌ হয়ে গিয়েছি যে‌ আমাদের মনের কোণে গেঁথে গিয়েছে সূর্যমন্ডলের তৃতীয় গ্রহটি বোধহয় দেখতে চিরকাল এমনি ছিল এবং ভবিষ্যতেও থাকবে।‌ এরূপ ভাবনার পিছনে কি যুক্তি আছে তা নিয়ে মাথা ঘামিয়ে লাভ কি? অনেকেই মেনে নিয়েছেন শিক্ষা দীক্ষায় অর্থ-বিত্তে শক্তি-সামর্থ্যে উন্নত ইউরোপ আমেরিকা মাথার উপরে থাকবে তাতে অবাক হওয়ার কি আছে?‌ আমরা ভাবতে শিখেছি এভাবেই তো হওয়া উচিত ছিল।

পৃথিবী নামক গ্রহের আসলে কি উপর-নীচ আছে?‌ না, নাই।‌ মহাশূন্য বা চন্দ্রপৃষ্ঠে থেকে পৃথিবীর দিকে তাকালে কারো হয়তো উত্তর মেরু নজরে আসবে, কারো দক্ষিণ মেরু। কাকে উপরে রাখতে হবে, কাকে নিচে তা নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগতে থাকবেন। উত্তরকে মাথার উপর রাখতে হবে তার সপক্ষে কোন বৈজ্ঞানিক যুক্তি নাই।

উত্তরকে পৃথিবীর ছাদ হিসাবে দেখানোর পিছনে রয়েছে দীর্ঘ ইতিহাস, জ্যোতির্বিজ্ঞান, রাজনীতি,‌ ইউরোপিয়ানদের অহংবোধ, শ্রেষ্ঠত্বের বড়াই এবং কয়েক যুগ ধরে জমে থাকা উত্তরের জনগণের মানসিক ভ্রান্তি ও হীনমন্যতা। 

যে যুগে যখন মানুষ পৃথিবী ভাবতে শিখেছে তখন সে ভাবেই চিত্রায়িত করেছে। ১৪,০০০ বছর আগে প্রাগৈতিহাসিক যুগের মানুষ পাহাড়ের গুহায়, প্যাপিরাস পাতায়, পাথরের বুকে, কাগজে এবং এখন কম্পিউটারের স্ক্রীনে যার যার অবস্থান থেকে পৃথিবীর চিত্র এঁকে চলেছে।

মানচিত্র নির্মাণের এত দীর্ঘ ইতিহাসে মাত্র বিগত কয়েক শত বৎসর মাত্র উত্তরকে মাথায় চড়িয়ে মানচিত্র আঁকার চর্চা চালু হয়েছে। খোদ পশ্চিমের দেশের বিজ্ঞজনেরা উত্তরকে পৃথিবীর ছাদ বানানোর যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। 

বিবিসি কর্তৃক প্রচারিত নিবন্ধে লন্ডনের কুইন মেরি ইউনিভার্সিটির মানচিত্র ঐতিহাসিক ‌ জেরি ব্রোটনের বক্তব্য উল্লেখ করে বলা হয়েছে মানচিত্র নির্মাণের দীর্ঘ ইতিহাসে প্রায় কোনো ম্যাপেই উত্তরকে পৃথিবীর ছাদে স্থান দেয়া হয়নি। পশ্চিমে সূর্য অস্ত যায়  সে কারণে পশ্চিমকেও কোন ম্যাপে খুব একটা ছাদে উঠানো হয় নাই। 

তবে, প্রাথমিক যুগে চীনারা এ ধারা থেকে সরে এসে কেন উত্তরকে উপরে স্থান দিয়েছিল ব্রোটন তা নিয়ে দ্বিধাগ্রস্ত। তিনি ভেবেচিন্তে বের করেছেন চীনারা তখন কম্পাস ব্যবহার করা শিখে গেছে। তবে, তাদের কম্পাসের কাঁটা দক্ষিণমুখী ছিল। সে কারণে দক্ষিণকে উপরে স্থান দেওয়ার কথা। কিন্তু চীনের সম্রাট বাস করতেন উত্তরে। তাই উত্তরকে তারা আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত করে উত্তর মুখী মানচিত্র তৈরি করে।

মানুষ তার নিজস্ব অবস্থান থেকে কোনদিকে বা কার দিকে তাকাবে এক এক কালচার বিভিন্নতার কারণে ম্যাপের দিক সেভাবেই এঁকেছে। প্রাচীন মিশরীয়রা সূর্য পুব দিকে উঠে বলে সে দিককেই উপরে স্থান দিয়েছিল।

প্রাথমিক যুগে যারা ‌ ম্যাপ তৈরীর কাজে হাতে নিয়েছিলেন তাদের  একজন গ্রিক ‌ টলেমিকে (খ্রিস্টাব্দ ৯০-১৬৮) কৃতিত্ব দেওয়া হয় প্রথম এটলাস প্রণয়নকারী হিসাবে। তিনি উত্তরমুখী করেই এটলাস তৈরি করেছিলেন।

ইসলামের প্রাথমিক যুগে আরবদের প্রভাব ও কালচার গড়ে উঠেছিল মক্কা শরীফের উত্তরে। সেখান থেকে তাদের দৃষ্টি দক্ষিণমুখী থাকার কারণে মানচিত্রে দক্ষিণকে উপরে রেখেছিল। সে ধারা থেকে সরে এসে ১১৫৪ সালে মোঃ আল ইদ্রিসি ম্যাপ উল্টো করে একে উত্তরকে উপরে রেখেছিলেন।‌ 

সমসাময়িক খ্রিস্টানদের প্রনীত ম্যাপে জেরুজালেম মধ্যস্থল রেখে গার্ডেন অফ ইডেন এর দিকে মুখ করে পূর্বকে ওপরে রেখেছিলেন।

তাহলে, সবাই কখন একমত হয়ে উত্তরকে প্রাধান্য দিয়েছিলেন? কেউ হয়তো ভাবতে পারেন ইউরোপিয়ান আবিষ্কারক কলম্বাস, ম্যাগেলান উত্তরের ধ্রুবতারা দেখে জাহাজ পরিচালনা করতেন।‌সে কারণে বোধ হয় উত্তরকে উপরে উঠিয়ে নেয়া হয়েছে। ব্রোটন মনে করেন, কলম্বাস সে দৃষ্টিতে পৃথিবী দেখেন নাই। তিনি মনে করতেন পূর্বের দিকেই স্বর্গের ঠিকানা, সেইটাই পৃথিবীর উপরে, উত্তরে নয়। 

১৫৬৯ সালে Mercator নামে এক ম্যাপ মেকার কর্তৃক প্রণীত ম্যাপে উত্তরকে উপরে উঠিয়ে আনার মাধ্যমে হয় শুরু হয় উত্তরের প্রাধান্য। উত্তর কেন প্রাধান্য দেয়া হয়েছে সে সম্পর্কে তিনি যেসব খোঁড়া যুক্তি দাঁড় করিয়েছিলেন ব্রোটন তা নাকচ করে দেন। তিনি বলেন, উত্তর মেরু আমাদের জন্য এত গুরুত্ব নয় যে সেদিকে আমাদের যেতে হবে। 

তিনি মনে করেন ইউরোপিয়ানরা তখন দুনিয়ার চষে বেড়াচ্ছিল। উত্তর গোলার্ধের অনেক জনপদ, অনেক ভূখণ্ড তাদের হাতছানি দিচ্ছিল। 

 নতুন শক্তিতে বলিয়ান হয়ে দিকে দিকে নতুন ভূখণ্ড আবিষ্কারের মত্ত। প্রিন্টিং প্রেস চালু চালু হয়েছে। দেদার মানচিত্র ছাপানোর সুযোগ এসে গেছে।   উত্তরকে পাদপ্রদীপের আলোয় আনতে তাদের ঠেকায় কে?

যে কারণেই হোক না কেন,ব্রোটন উত্তরকে উপর রাখার কোন যুক্তি নেই বলে  মনে করেন। তিনি বলেন, ১৯৭৩ সালে নভোচারীদের তোলা ম্যাপে দক্ষিণকে উপরে রাখা হয়েছিল কারণ তারা সে দিক দিয়ে পৃথিবীর পরিক্রমণ করছিলেন। পৃথিবীর বাইরে থেকে দেখলে পৃথিবীসহ সব গ্রহকে একই আকৃতির দেখায়। কোন গ্রহেরই উপর-নিচ খোঁজার যুক্তি নেই। 

 লন্ডনস্থ ইম্পেরিয়াল কলেজের জ্যোতির্বিজ্ঞানীও বলেন নভোচারীদের বোঝার কোন উপায় নেই, কোন দিক উপরে কোন দিকে নিচে  “As far as we astronomers can tell, there really is no ‘up’ or ‘down’ in space,” he says.

যুক্তরাষ্ট্রের গেটিসবার্গ কলেজ অফ পেনসিলভানিয়ার প্রখ্যাত মনস্তত্ত্ববিদ ব্র্যায়ান মেয়ার  বলেন মানুষ অবচেতন মনে ভেবে বসে থাকে উত্তর উপরে দক্ষিণ নিচে। ইতিবাচক চিন্তার ফলে যারা মনে করে উপরে বসে আছে।

 তিনি মনে করেন উত্তরের যা কিছু তা  উন্নত,‌ দক্ষিণের পচা, এ চিন্তা তাদের মনে ঘুরপাক খেতে থাকে। 

তিনি পরীক্ষার জন্য ছাত্রদের একটা সুন্দর কল্পিত শহরের ছবি দেখিয়ে বললেন এটা কোথায় হতে পারে। সবাই  উত্তরের দিকে দেখাতে থাকেন। অন্য একটা গ্রুপকে এক দল অনগ্রসর লোকদের দেখিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, এরা কোথাকার বাসিন্দা। বলাবাহুল্য সবার আঙ্গুর দক্ষিণের দিকে ঝুঁকে পড়লো। 

কাজেই প্রশ্নের উত্তর সহজভাবে বলা যায় ঐতিহাসিকভাবে সুপেরিয়রিটি কম্প্লেক্স ব্যতীত উত্তর গোলার্ধ কে উপরে ছড়িয়ে দেওয়া‌ ছাড়া আর কোন কারন নাই

About Post Author

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Pin It on Pinterest