ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ প্রান্তে ইউরোপের ছোট দেশ বেলজিয়ামের রাজা লিওপোল্ড-২ আধুনিক রিপাবলিক অব কঙ্গোকে ব্যক্তিগত সম্পত্তি হিসেবে শাসন করার ক্ষমতা পেয়ে যান। রাজা মধ্য আফ্রিকার সে দেশটির নাম পাল্টে রাখলেন কঙ্গো ফ্রি স্টেট। নামেই শুধু ফ্রী, বাস্তবে রাজার অমানুষিক অত্যাচারে জর্জরিত দুর্ভাগ্য জনগোষ্ঠী।
রাজা ১৮৮৫ সাল থেকে ১৯০৮ নাগাদ বেলজিয়ামের থেকে ৮৬ গুন বড় সে দেশটির প্রাকৃতিক সম্পদ লুণ্ঠনের মহাপরিকল্পনা তৈরি করেন। প্রথমে তিনি হাতির দাঁত বা আইভরি সংগ্রহের কাজ হাতে নেন। আইভরির উৎস শুকিয়ে আসলে তার নজর পড়ে সে দেশের রাবার গাছের প্রতি।
তখন বিশ্ব বাজারে রাবারের চাহিদা বেড়ে গেছে। এবার রাবার সংগ্রহের কাজে নেমে পড়েন।
দেশটিকে কয়েকটি অংশে ভাগ করে তিনটি কোম্পানিকে রবার সংগ্রহের জন্য বরাদ্দ করেন। নিজের জন্যও একটা অংশ রেখে দেন। মুনাফা বৃদ্ধির জন্য রাজার কর্মচারী ও কোম্পানিগুলো যে যার খুশিমতো চরম নৃশংসতার নৃশংসতার আশ্রয় নেয়। এজন্য তাদের কাউকে কোন কৈফিয়ত দেয়া লাগত না।
এসব নির্মম নৃশংসতার জন্য ব্যবহার করা হতো স্থানীয় কালো মানুষদের। প্রশাসনের আদেশ-নির্দেশ প্রতিপালনের জন্য আফ্রিকার গোষ্ঠী প্রধানরদের নিজ নিজ এলাকায় দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। স্থানীয়দের নিয়ে গড়ে তোলা Force Publique নামে সামরিক বাহিনীকে রাবার সংগ্রহ ব্যবস্থা বাস্তবায়নের জন্য দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল। একাত্তর সালে বাংলাদেশে রাজাকার বাহিনীর আফ্রিকান সংস্করণ।
আশেপাশের দু-একটা দেশে থেকেও মানুষ নিয়ে আসা হত। এ সুযোগে ক্রিমিনালরাও প্রশাসনের সাথে হাত মিলিয়ে লুটপাট হত্যাকাণ্ড ধর্ষণ অত্যাচারে মেতে ওঠে।
রবার সংগ্রহের জন্য দাস শ্রমিকদের লাগিয়ে দেয়া হতো। স্থানীয় শ্রমিক সংগঠনের জন্য তারা কৃষ্ণাঙ্গ কর্মচারীদের নিয়োগ দিয়েছিল। তাদের বলা হত capitas।
স্থানীয় প্রত্যেক জনগোষ্ঠীকে রাবার সংগ্রহের জন্য অযৌক্তিক কোটা নির্ধারণ করে দেয়া হতো। কোটা পূর্ণ না করতে পারলে অত্যাচারের খড়গ নেমে আসতো। রাজার পেটুয়া বাহিনীর কর্মকর্তারা মহিলা এবং বাচ্চাদের আটক করে রেখে তাদের স্বামী এবং পিতাকে রাবার সরবরাহের জন্য বাধ্য করতো। চাবুক, হত্যা, অনাহারে মেরে ফেলা, ধর্ষণ ও নারীদের যৌনদাসী হিসেবে ব্যবহার করা ছিল নিত্যনৈমত্তিক ব্যাপার।
কোন জনগোষ্ঠী বাঁধা দিলে তাদের গ্রাম জ্বালিয়ে ধূলায় মিশিয়ে লোকজনকে হত্যা করে নিশ্চিহ্ন করা হত। কত সংখ্যক মানুষ হত্যা করা হয়েছে তার প্রমাণ স্বরূপ তাদের হাত কেটে প্রশাসনের কাছে পেশ করতে হতো। প্রশাসন যে পরিমাণ বুলেট এ কাজের জন্য দিয়েছে তা সঠিকভাবে ব্যবহার করা হয়েছে এটা নিশ্চিত করার জন্যই এ ব্যবস্থা। শেষমেষ অনেক ক্ষেত্রে রাবারের পরিবর্তে পেটুয়া বাহিনী ঝুড়ি ভরে কাটা হাত কোম্পানির কর্মচারীদের নিবেদন করত। কোটা পুরাণের পরিবর্তে আশেপাশের গ্রামের হানা দিয়ে হাত কেটে এনে কোম্পানিকে দেখানো হত।
যে সব শ্রমিক তাদের কোটা পূরণ করতে ব্যর্থ হত তাদের ওপর নেমে আসতো নির্মম অত্যাচার, কেটে ফেলা হতো হাত অথবা পা। যুবকদের বাধ্য করা হতো তাদের নিজেদের মা বোনকে মেরে ফেলতে অথবা তাদের সামনে ধর্ষন করতে আদেশ দেয়া হতো। কোটা পূরণে ব্যর্থ গোষ্ঠী প্রধানরাও তাদের হাত থেকে রক্ষা পায়নি। একপর্যায়ে ৪৪ জন উপজাতি প্রধান তাদের হাতে আটকা আটক ছিল।
কঙ্গোর সমাজে মনুষ্যত্ব এতটাই রসাতলে গিয়েছিল যে তাদের একজন মানুষের মাথা দিয়ে তার ফুলের বাগানের বেড়া তৈরি করেছিল।
রাজা এবং কোম্পানিগুলোর জন্য এ ব্যবস্থা অত্যন্ত লাভজনক হিসেবে দেখা দেয়। কোম্পানিগুলোর বিনিয়োগের অর্থ এক বছরেই উঠে আসে। ১৮৯৬-১৯০৫ সময় কালে রাজার ভান্ডারে জমা হয় ৭ কোটি বেলজিয়ান ফ্রাংক।
ঐতিহাসিক Jean Stengers রাজ্য শাসিত কঙ্গোর নাম দিয়েছিলেন, “veritable hells-on-earth”, প্রকৃত অর্থে দুনিয়ার নরক।
রাজা এবং তার সাঙ্গপাঙ্গদের এ নির্মম অত্যাচারের কাহিনী অন্যান্য ইউরোপীয় উপনিবেশবাদীদের কাছে পৌঁছালেও তেমনটি কানে দেয়নি। পরে ইংল্যান্ডের এক মানব দরদী দরদী ব্যক্তি উদ্যোগে ইউরোপ-আমেরিকার অন্যান্য মানবতাবাদী ব্যক্তির প্রবল সমালোচনার কারণে বেলজিয়াম সরকার ১৯০৬ সালে রাবার সংগ্রহের সে প্রথা বাতিল করেন।
ততদিনে রাজার এবং কোম্পানির পেটুয়া বাহিনীর অত্যাচারে রোগ শোকে দুর্ভিক্ষে হতভাগ্য কঙ্গোর কোন কোন হিসাব মতে প্রায় ৭৫% জনসংখ্যার এক কোটি লোক পৃথিবীর বুক থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে।
পরবর্তীতে, কঙ্গোর প্রবাদপুরুষ সমাজতান্ত্রিক নেতা প্যাট্রিস লুমুম্বা দীর্ঘ সংগ্রামের পর দেশটি ১৯৬০ সালে স্বাধীনতা লাভ করে। কিন্তু পরের বছর উপনিবেশবাদীদের চক্রান্তে তাকে হত্যা করা হয়। তার সম্মানে রাশিয়ায় মস্কোতে একটা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম রেখেছিল প্যাট্রিক লুমুম্বা ইউনিভার্সিটি। বর্তমান নাম Peoples’ Friendship University of Russia” ।
