ভদ্রলোক দাবা খেলায় এতটা মশগুল ছিলেন যে বাড়ি থেকে তার ছেলেকে সাপে কেটেছে খবর পেয়ে শুধু মুখ তুলে তাকিয়ে বললেন, সেকি কথা কাদের সাপে কাটল? আসলে তার মন পড়েছিল দাবার ছকে। এতেই বুঝা যায় দাবা খেলায় অখন্ড মনোযোগ দিয়ে মানুষ খেলার মাঝে নিজেকে হারিয়ে ফেলে।
আমারও দাবা খেলার প্রচন্ড নেশা ছিল। গ্রাম থেকে ঢাকায় পড়তে এসে খেলাটা শিখে এতটা নেশা চেপে বসল যে পড়াশোনা মাথায় উঠলা। ফলাফল কি হলো তা তো দেখতেই পাচ্ছেন। বেকার মানুষ, কোরা বাংলায় উত্তর দিয়ে সময় কাটাচ্ছি। দীর্ঘ উত্তরটা ধৈর্য থাকলে পড়ে দেখতে পারেন। নতুবা, লুডু খেলায় মনোযোগ দিতে পারেন। মহিলাদের প্রিয় খেলা, তানারা হাত সাফাইতে দক্ষ। তাদের সাথে খেলতে গেলে আকছারই হার মানতে হয়।
কন্ট্রাক্ট ব্রিজ, সুডোকু, ক্রসওয়ার্ড পাজল, স্ক্রাবল খেলাগুলোও বেশ মনোযোগ কেড়ে নেয়। যথেষ্ট মাথা ঘামাতে হয়। এতে অবশ্য মস্তিষ্ক পরিষ্কার থাকে, জং ধরে যায় না। আমরা আমাদের মস্তিষ্কের ক্যাপাসিটির মাত্র শতকরা ১০ ভাগ ব্যবহার করে থাকি। বাকি ৯০ ভাগ অব্যবহৃত থেকে যায়। মস্তিষ্ক ব্যস্ত রাখলে বয়স বেড়ে গেলেও স্মৃতিভ্রম বা dementia হয় না, Alzheimer’s রোগ ঠেকিয়ে রাখতে সাহায্য করে।দাবা খেলায় যে প্রচন্ড ধৈর্য, অখণ্ড মনোযোগ এবং বুদ্ধিমত্তার প্রয়োজন তা’ বলার অপেক্ষা রাখে না।
বর্তমান বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন কার্লসেন
বর্তমান বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন নরওয়ের Carlsen সব চেয়ে কম বয়সে এ কীর্তি হাসিল করেন। তিনি সাতটি চ্যাম্পিয়নশিপ দখল করেছেন। তার আই কিউ ১৯০–আইনস্টাইনের ১৬০ থেকে প্রায় ৩০ পয়েন্ট বেশি।
গ্যারি কাসপারভ
সব চেয়ে কম ২২ বছর বয়সে রাশিয়ার গ্যারি কাসপারভ বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন খেতাব অর্জন করেন। অনেকেই তাকে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ দাবা প্লেয়ার হিসেবে গণ্য করে থাকেন।১৯৮৪ সাল থেকে ২০০৫ সালে অবসর গ্রহণ পর্যন্ত তিনি এক নম্বর রেংকিং দখল করে রাখেন। তাঁর আই-কিউ হিসাব করা হয়েছে ১৯০।
ববি ফিশার
দাবা খেলার অন্যতম বর পুত্র আমেরিকার ববি ফিশার যিনি ১৯৭২ সালে প্রথম বারের মতো তাঁর দেশের জন্য বিশ্ব চ্যাম্পিয়নের খেতাব এনে দিয়েছিলেন তাঁর আই কিউ ছিল ১৮১। বলে রাখা ভাল, ১৩৫ এর বেশি আই কিউ হলেই আপনাকে জন সংখ্যার ৯৯ শতাংশের বেশি মানুষের চেয়ে বুদ্ধিমত্তার অধিকারী বলে মনে করতে পারেন।
মাত্র ১৩ বছর বয়সে যে গেমটিতে তিনি জয়লাভ করেছিলেন তাকে বলা হয় “The Game of the Century”। ১৪ বছর বয়সে সবচেয়ে বয়োকনিষ্ঠ ব্যক্তি হিসেবে আমেরিকার দাবা চ্যাম্পিয়ন, ১৫ বয়সে তখন পর্যন্ত বয়োকনিষ্ঠ হিসেবে গ্র্যান্ডমাস্টার খেতাব অর্জন করেন। ১৯৭২ সাল নাগাদ তাঁর রেটিং ছিল ২৭৮৫, তখনকার বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন বরিস স্প্যসকির চেয়ে ১২৫ পয়েন্ট বেশি–রেটিং তালিকায় প্রথম বারের মতো ইতিহাসের প্রথম ও দ্বিতীয় জনের মধ্যে সবচেয়ে বেশি পার্থক্য। এত প্রতিভাবানদের জীবন যে মসৃণ গতিতে চলে না তা বলার অপেক্ষা রাখে না। নানা ঘটনা প্রবাহের কারণে তিনি দাবা খেলা ছেড়ে দেন, রেখে যান অবিস্মরনীয় প্রতিভার স্বাক্ষর।
আই কিউ নিয়ে যখন কথা উঠলো তখন দেশভেদে তার একটা চিত্র দেখা যাক না কেন? হিসাবে গোঁজামিল নেই তা নয় তবে একটা আন্দাজ পাওয়া যায়।
সিঙ্গাপুরিয়ানদের আইকিউ ১০৮। দূর প্রাচ্যের হংকং, তাইওয়ান,কোরিয়ানদের আইকিউ সিঙ্গাপুরের কাছাকাছি। জাপানের ১০৫। চীনের ১০৪। জার্মানি ও বৃটেনের ১০০। যুক্তরাষ্ট্রে মার্কিনিদের ৯৮। ক্রান্তীয় গিনির লোকজনের আইকিউ সবচাইতে কম ৫৬। উপমহাদেশে বাংলাদেশ ভারত পাকিস্তানের আই কিউ ৮০ এর কাছাকাছি।
ডোনাল্ড ট্রাম্প দাবি করেন তার আই কিউ ১৪৫ কিন্তু অনেকে তা মানতে চান না। তাদের ধারণ ১২০ থেকে১৩০। লন্ডনের মেয়র পাকিস্তানি বংশোদ্ভূত সাদিক খান যার সাথে বহুদিন যাবত আমেরিকার প্রেসিডেন্টের বাক যুদ্ধ চলছে তিনি ট্রাম্পের ঐ দাবি নাকচ করে দিয়েছেন।
মোটকথা, বুদ্ধিমত্তার সাথে দাবা খেলার একটা অঙ্গাঙ্গী সম্পর্ক রয়েছে। ফরাসি একজন চিত্রশিল্পী যিনি দাবা খেলায় পারদর্শী ছিলেন বলেছিলেন, সব শিল্পী দাবা খেলোয়াড় নয় কিন্তু সব দাবা খেলোয়াডই শিল্পী।
বাংলাদেশের নিয়াজ মোরশেদ ১৯৮৭ সালে দক্ষিণ এশিয়ায় প্রথম গ্র্যান্ডমাস্টার খেতাব অর্জন করেন।
দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম গ্র্যান্ডমাস্টার নিয়াজ মোরশেদ।
পরবর্তীতে অনেকেই এ খেতাব অর্জন করলেও ভারতের অত্যন্ত প্রতিভাবান গ্র্যান্ড মাস্টার র্বিশ্বনাথ আনন্দ সবাইকে ছাড়িয়ে নকআউটসহ তিনটি ফরম্যাটের সবগুলোতেই বিশ্ব চ্যাম্পিয়নের খেতাব অর্জন করেন। ইতোপূর্বে এ কৃতিত্ব অন্য কেউ অর্জন করতে পারেননি। পরে অবশ্য ২০১৩ সালে নরওয়ের Magnus Carlson কাছে পরাজয় বরণ করেন।
পাঁচবার বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন বিশ্বনাথ আনন্দ
ছবি
রানী হামিদ
মহিলা দাবা খেলার জগতে বাংলাদেশের রানী হামিদ একটা বিস্ময়কর প্রতিভার নাম। তিনি সেই কোন যুগ থেকে এ খেলায় লেগে আছেন তাঁর লেখাজোকা নাই। ১৯৮৫ সালে তিনি ফিদে আন্তর্জাতিক মহিলা মাস্টার খেতাব পান। তিনি ২০ বার বাংলাদেশের মহিলা চ্যাম্পিয়ন হন। এছাড়াও ৩ বার ব্রিটিশ মহিলা দাবা প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়ন হন। রানী হামিদ শেষ বার ২০১৯ সালে ৭৫ বছর বয়সে বাংলাদেশের ২০ তম মহিলা চ্যাম্পিয়নশিপের পুনরুদ্ধার করেন। তিনিই বর্তমান মহিলা চ্যাম্পিয়ন। এত দীর্ঘ সময় আর কোন মহিলা দাবা খেলছেন বলে মনে হয় না। দাবা ফেডারেশন খোঁজ খবর নিয়ে তাঁর নাম গিনেস বুক অব রেকর্ডে তোলা যায় কিনা খতিয়ে দেখতে পারেন। ইতিপূর্বে, বাংলাদেশের জোবেরা রহমান লিনু ১৯৭৯ থেকে ২০০১ টেবিল টেনিসে বাংলাদেশে ১৬ বার চ্যাম্পিয়ন হয় বিশ্বরেকর্ড গড়ে গিনেস বুক অব রেকর্ডে স্থান করে নিয়েছেন।
দাবা খেলা নিয়ে নিজস্ব ভান্ডার ও গুগলের সাহায্যে কিছু বিচিত্র তথ্য পেশ করা গেল।
- জীবন থেকে বড় খেলার নাম দাবা। বিশ্বে যত এটম আছে, দাবা খেলায় তার চাইতে চালের variation বা রকমফেরের সম্ভাবনা বেশি, প্রায় ৩১,৯০০ কোটি।
- দাবা খেলা গড়ে ৩৮ চাল এবং ১০ থেকে ৬০ মিনিট পর্যন্ত স্থায়ী হয়ে থাকে। দাবা খেলার ইতিহাসে এ পর্যন্ত ২৬৯ চাল দেওয়ার রেকর্ড রয়েছে। খেলাটি অবশ্য ড্র হয়েছিল।
- ড্র দাবি করার পূর্বে বিভিন্ন কম্বিনেশন সব চেয়ে বেশি সংখ্যক ৫,৯০০ চাল দেওয়া সম্ভব। বলা বাহুল্য, এতগুলো চাল দিতে অনন্ত কাল পর্যন্ত লেগে যেতে পারে। শুধু মাত্র প্রারম্ভিক বা ওপেনিং মুভ দেওয়ার জন্য ১,০০০ ও বেশি রকমফের রয়েছে।
- অনেক খেলোয়াড়দের চোখ বাঁধা অবস্থায় খেলার এতটা দক্ষতা রয়েছে যে প্রত্যেকটি মুভ তাদের মনের কোণে গেঁথে থাকে। গ্র্যান্ডমাস্টারের চোখ বেঁধে একই সঙ্গে ৫০ টিরও বেশি খেলোয়াড়দের সাথে খেলার রেকর্ড রয়েছে।
- দক্ষতার দৃষ্টিকোণ থেকে রাশিয়ার সাথে আর কারো তুলনা হয় না। রাশিয়ায় রয়েছে ২৫০ টির বেশি গ্র্যান্ডমাস্টার।
- ১৯২৩ সালে আমেরিকার ফ্রাংক মার্শাল নিউইয়র্ক সিটিতে সর্বপ্রথম আন্তর্জাতিক খেলায় রাশিয়ানদের বিরুদ্ধে জয় লাভ করেন।
- চেক মেট শব্দটি এসেছে আরবি ভাষার ‘শাহ মাত’ থেকে। অর্থ রাজা কুপোকাত।
- আন্তর্জাতিক নিয়ম অনুযায়ী প্রথম চাল হিসাবে pawn দুই ঘর এগোতে পারে। ১২৮০ স্পেনে সর্বপ্রথম এই নিয়ম চালু করা হয়। তার আগে এক ঘর পর্যন্ত চাল দেয়ার বিধান ছিল।
- একজন জার্মান চিকিৎসক ইমানুয়েল লস্কর ১৮৯৪ থেকে ১৯২০ সাল নাগাদ সবচেয়ে দীর্ঘকালব্যাপী ২৭ বছর যাবৎ বিশ্ব চ্যাম্পিয়নের খেতাব ধরে রেখেছিলেন।
- বিভিন্ন সময়ে ইসলাম, ইহুদি, ক্যাথলিক, পিউরিটান ধর্মে দাবা খেলা নিষিদ্ধ ছিল। দ্বাদশ শতাব্দীতে একজন ধর্মযাজক দাবা খেলার নেশায় খেলাটি ছাড়তে পারেননি। প্যারিসের পোপ দাবা খেলার জন্য তাকে পদ থেকে অপসারণ করার হুমকি দিয়েছিলেন। তিনি দাবা খেলার বোর্ড ভাঁজ করে বইয়ের মত সাজিয়ে রাখতেন। সেই থেকে ভাঁজ করা বোর্ডের প্রচলন।
- ইংরেজি ভাষায় লিখিত পুস্তকের মধ্যে দ্বিতীয় যে বইটি লেখা হয় তা ছিল দাবা সম্পর্কে। ১২৭৪ সালে বইটির ফরাসি সংস্করণ প্রকাশ করা হয়।
- দাবা খেলার উৎপত্তি ভারত উপমহাদেশে। তখন তা ছিল রাজা বাদশার খেলা। ইউরোপে উচ্চ বংশের রাজা মন্ত্রী রানী বিশপ নাইটদের বিনোদনের মাধ্যমে সময় কাটানোর জন্য দাবা খেলতেন।
- ইউরোপের উচ্চস্তরের লোকজনের নাম অনুসারে দাবার গুটির নামকরণ করা হয়েছে। ইন্ডিয়ান সিস্টেমর কিস্তি বা নৌকা আন্তর্জাতিক পরিভাষায় তা rook বা castle অর্থাৎ দুর্গ, পিল বা হাতি=bishop, ঘোড়া÷knight. মন্ত্রী=queen.
- দাবার ছকে সবচেয়ে নিম্নমানের সদস্য বড়ে, হিন্দি উর্দুতে পেয়াদা, ইংরেজিতে pawn. সবচেয়ে দুর্বল কিন্তু শেষপ্রান্তে পৌঁছতে পারলে হয়ে যায় শক্তিশালী কুইন। বাস্তব জীবেনও এ ধরনের বহু উদাহরণ রয়েছে। ব্যাভারিয়ান সেনাবাহিনীতে একজন নিম্ন পদের লেন্স কর্পোরাল হিসাবে যোগ দিয়ে হিটলার জার্মানির ফুয়েরার, দুনিয়া কাঁপানো সমর নায়কে পরিণত হন।
