October 29, 2025
চীন-আমেরিকা-অর্থনৈতিক-সমীকরণ

পৃথিবীর তাবৎ দেশ তাদের ফরেন এক্সচেঞ্জ রিজার্ভের সিংহভাগ মার্কিন ডলারে রূপান্তর করে রাখে। সব দেশের চেয়ে চীনের রিজার্ভের পরিমাণ সবচেয়ে বেশি,৩.২ তিন ট্রিলিয়ন ডলার। অনেক পিছনে দ্বিতীয় স্থানে জাপানের ফরেন এক্সচেঞ্জ রিজার্ভ ১.২ ট্রিলিয়ন। তৃতীয় স্থানে সুইজারল্যান্ডের রিজার্ভের পরিমাণ ১.০ ট্রিলিয়ন।

চীন দেশের ফরেন এক্সচেঞ্জ রিজার্ভের বিশালত্ব অনুধাবন করতে উল্লেখ করা যেতে পারে বাংলাদেশের ৪২ মিলিয়ান ফরেন এক্সচেঞ্জ রিজার্ভের তুলনায় তাদের রিজার্ভ প্রায় ৭৬ গুণ বেশি।

চীনের বিশাল রিজার্ভের দুই-তৃতীয়াংশ অর্থাৎ সিংহভাগই মার্কিন ডলারে গচ্ছিত রয়েছে। গচ্ছিত রয়েছে বললে ভুল হবে, বিনিয়োগ করা হয়েছে। বেশির ভাগ মার্কিন সরকারের ট্রেজারি বিল এবং অন্যান্য সরকারি দায় বিশিষ্ট বিনিয়োগ মাধ্যমে। কিছু পরিমাণ ডলার আমেরিকাসহ বিভিন্ন দেশের ব্যাংকে জমা আছে, কখনো ডিপোজিট হিসেবে কখনো ঋণ হিসেবে। ‌

দেশের বাইরে আমেরিকান ডলার বিদেশস্থ দুটো আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মধ্যে লেনদেন হলে তাকে বলা হয় ইউরো ডলার। ইউরো ডলার কিন্তু ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের অভিন্ন কারেন্সি ইউরো থেকে আলাদা। ইউরো ডলার আলাদা কোনো কারেন্সি নয়। ‌ ইউরো ডলার অকৃত্রিম ‌আমেরিকান‌ ডলার, কিন্তু লেনদেন হয় বিদেশস্হ প্রতিষ্ঠানগুলোর মাধ্যে। আর্থিক বিনিয়োগ ছাড়াও চীন ‌ আমেরিকার বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রপার্টি ও অন্যান্য মাধ্যমে বিনিয়োগ করে রেখেছে।

অন্যভাবে বলা যায়, মার্কিন সরকার তার ব্যয়ভারের একটা বিশাল অংক চীনের থেকে ধার করে নির্বাহ করে থাকে। চীন এ অর্থ যোগান না দিলে জনগণের থেকে ট্যাক্স আদায় করতে হতো।

এ ব্যবস্থা অবশ্য উভয় পক্ষের জন্য লাভজনক। চীন বিনিয়োগ করে মুনাফা পাচ্ছে। অন্যদিকে, ট্রেজারি বিল ও অন্যান্য বিনিয়োগের মাধ্যমে চীনের থেকে প্রকারান্তরে ডলার ধার-কর্জ করে আমেরিকা তার জনগণকে বাড়তি করের বোঝা বহন করা থেকে রেহাই দিয়েছে। সে সঙ্গে দুনিয়া ভর দাদাগিরি করছে। পরের ধনে পোদ্দারি যাকে বলে।

রিজার্ভ বিনিয়োগের অন্যতম মাধ্যম স্বর্ণ। চীন ডলারের বিনিময় স্বর্ণ কিনে জমা রাখতে পারে। কিন্তু এত স্বর্ণ মার্কেট থেকে কেনা সম্ভব নয়। চীনের বর্তমান গোল্ড রিজার্ভের পরিমান এমনিতেই যথেষ্ট—১৯৪৮ টন। চীন মার্কেটে ঢোকা মাত্রই স্বর্ণের দাম আকাশে উঠবে। তাছাড়া, স্বর্ণের মূল্য বড্ড অস্থির। আপাত লোভনীয় চকচকে ধাতু সাধারণ পাবলিক মূল্যবান মনে করলেও রিজার্ভ বিনিয়োগের জন্য আদর্শ মাধ্যম নয়।

বলা বাহুল্য, চীন মার্কিন ডলার অন্যান্য কারেন্সিতে রুপান্তর করতে শুরু করলে ডলারের বিনিময় হার নিঃসন্দেহে ধ্বস নামবে। তাতে চীনেরই ক্ষতি। তার রিজার্ভের অন্তর্নিহিত মূল্য অর্থাৎ ক্রয় ক্ষমতা আনুপাতিক হারে কমে যাবে। নিজের পায়ে নিজে কুড়াল মারার অবস্থা।

দ্বিতীয়তঃ, এত বিশাল অংকের অর্থ অন্য কোন দেশে, অন্য কোন কারেন্সিতে পার্ক করার খুব একটা সুযোগ নেই। কোন দেশেরই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো এত টাকার ক্ষুধা নেই।

অন্য কোন দেশ চাইবে না তাদের দেশে মার্কিন ডলারের বন্যায় ভেসে যাক। বিপুল পরিমাণ বিদেশী অর্থ অনুপ্রবেশের ফলে তাদের মুদ্রার ব্যবস্থাপনা তছনছ হয়ে যাবে। সেসব দেশের ব্যাংকগুলো এত ডলার নিয়ে করবেই বা কি? সেকারণে সুদ দেওয়া তো দূরের কথা, নেগেটিভ ইন্টারেস্ট রেট আরোপ করতে থাকবে।

উদাহরণস্বরূপ, ১৯৭১-৭২ সালে আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিল কর্তৃক প্রবর্তিত par value system ভেঙ্গে পড়লে মার্কিন ডলার কয়েকটি শক্তিশালী কারেন্সি যেমন জার্মান মার্ক, সুইজারল্যান্ড ফ্রাংক, জাপানিজ ইয়েনে রূপান্তরের হিড়িক পড়ে যায়। মার্কিন ডলারের অধঃপতন ঠেকাতে সে সব দেশের সেন্ট্রাল ব্যাঙ্ক নিজ নিজ কারেন্সির বিনিময়ে ডলার কিনতে কিনতে ক্লান্ত হয়ে হাল ছেড়ে দেয়। অন্যদিকে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোও বাড়তি ডলার ক্রয় করতে অনীহা দেখায়। সে সঙ্গে নেগেটিভ ইন্টারেস্ট রেট চালু করে। একেবারে বেহাল অবস্থা।

তৃতীয়তঃ, আমেরিকায় চীনের একটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাবসায়িক পার্টনার। দুই দেশের মধ্যে গত বছরে আমদানি রপ্তানির পরিমাণ ছিল ৫৫৮ বিলিয়ন‌। বেশির ভাগই চীন থেকে আমেরিকায় রপ্তানি হয়। বাণিজ্যিক ভারসাম্যের পাল্লা চীন দেশের অনুকূলে। মার্কিনরা চীন থেকে আমদানির ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ অথবা বাড়তি কর আরোপ করে প্রতিশোধমূলক ব্যবস্থা নিলে চীনের বাণিজ্যে ধ্বস নামবে।

চতুর্থত: আমেরিকা শক্তিশালী দেশ, একমাত্র পরাশক্তি। বিদেশি মালিকাধীন টাকা বাজেয়াপ্ত করার জন্য সে দেশে বেশ কিছু আইনও আছে। ‌ একান্ত বিপদ দেখলে যেকোনো একটা অজুহাত দেখিয়ে চীনের টাকা বাজেয়াপ্ত করতে পারে।

দু’দেশের মধ্যে যতই উত্তপ্ত বাক্যবিনিময় হোক না কেন চীন এবং আমেরিকা উভয়ের স্বার্থে কেউ হঠকারী সিদ্ধান্ত নিবে না।

About Post Author

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Pin It on Pinterest