
আফ্রিকার একটা সুন্দর প্রবাদ, Until the lions know how to write, every story will glorify the hunter. অর্থাৎ যতদিন সিংহ লিখতে না পারবে, ততদিন পর্যন্ত প্রতিটি গল্প শিকারীকে মহিমান্বিত করে রাখবে।
এ প্রবাদের সমার্থক অনেক প্রবাদ এবং বাগধারা সব ভাষাতেই আছে। ইংরেজি ভাষায় একটা প্রবাদ আছে, History is a propaganda usually written by the winning side–ইতিহাস একটি প্রোপাগান্ডা যা সাধারণত লিখে থাকে বিজয়ী দল।
ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী চার্চিল অনুরূপ একটি উক্তি করেছেন বলে শোনা যায়, History is written by the victors. তিনি নাকি কমন্স সভার এক অধিবেশনে বলেছিলেন, তোমরা অতীতের কথা ভুলে যাও, আমি নতুন করে ইতিহাস লিখব। যুদ্ধে জয়লাভের কারণে তার কীর্তিকলাপের কথা চাপা পড়ে গেছে, বিশেষ করে ১৯৪৩ সালে মানবসৃষ্ট দুর্ভিক্ষের ফলে অবিভক্ত বাংলার লক্ষ লক্ষ মানুষ অনাহারে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ার পিছনে তার ন্যক্কারজনক ভূমিকা।
এ সব প্রবাদের উৎস সম্পর্কে সন্দেহ থাকলেও, জার্মান গেস্টাপো নেতা Hermann Wilhelm Göring যুদ্ধাপরাধের বিচারের জন্য গঠিত নুরেমবার্গ ট্রায়ালে বলেছিলেন, Der Sieger wird immer der Richter und der Besiegte stets der Angeklagte sein, এর মোটামুটি অর্থ বিজেতারা সবসময় বিচারকের আসনে বসে, এবং পরাজিতের ভাগ্যে জোটে অপরাধের কালিমা।
অষ্টাদশ শতাব্দীতে স্কটল্যান্ডে যুদ্ধে কত লোক মারা গেছে তার হিসেব চাপা পড়ে গেছে। সে সম্পর্কে বলা হয়ে থাকে —-it is the victors who count the dead. বিজয়ীরা মৃতদের হিসাব গণনা করে। অর্থাৎ বিজিতদের সে সম্পর্কে কথা বলার অধিকার থাকে না।
ঊনবিংশ শতাব্দীতে আমেরিকার গৃহযুদ্ধে দক্ষিণের এক বিচ্ছিন্নতাবাদী বলেছিলেন, সব অঙ্গরাজ্যের বিচ্ছিন্ন হওয়ার অধিকার থাকা উচিত। কেন সম্ভব নয় সে সম্পর্কে বললেন,
In all revolutions the vanquished are the ones who are guilty of treason, even to the historians, সকল বিপ্লবে পরাজিতরাই দেশদ্রোহের জন্য অভিযুক্ত হন, এমনকি ঐতিহাসিকদের কাছে।
প্রাচীন যুগ থেকে অনেক উন্নত সভ্যতাকে ধ্বংস করে, অন্য জনগোষ্ঠী তাদের ইতিহাস কালচার বিকৃত করে নতুন ইতিহাস লিখে গেছেন। কলোনিয়ল যুগে আফ্রিকা এশিয়া আমেরিকা এবং অস্ট্রেলিয়ার স্থানীয় জনগণকে দুমড়ে-মুচড়ে লুটপাট করে নতুন ইতিহাস লিখে স্থানীয়দের চিত্রিত করেছে white man’s burden হিসেবে। তারা নাকি ভারত উপমহাদেশে জ্ঞানের প্রদীপ জ্বেলে সভ্য করে গেছে। অথচ ১৯৪৭ সালে যখন তারা উপমহাদেশ ছেড়ে যায় তখন শিক্ষার হার ছিল মাত্র শতকরা ১২ জন।
তারা তড়িঘড়ি করে কেন উপমহাদেশ ছেড়ে যায় তার ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী এটলি বলেছিলেন তারা ভয় করছিলেন নেতাজী সুভাষ চন্দ্র সিগন্যাল দিলে আর্মি এবং নেভির ভারতীয় সদস্যরা বিদ্রোহ করে বসতে পারে। অন্যদের ভূমিকা সম্পর্কে বলেছেন মিনিমাম। অথচ ইতিহাসে নেতাজি অবাঞ্চিত।
আমেরিকা আবিষ্কারক হিসাবে কলম্বাসকে একজন মহাবীরের আসনে স্থান দেওয়া হয় কিন্তু লুটপাটের এবং লোভ লালসার শিকার হয়ে ক্যারিবিয়ান এলাকার এখনকার বাহামা এবং এল সালভেদরে ৫০ হাজার নারী-পুরুষ আত্মহত্যা করে। কয়েকশো স্থানীয় দাস হিসাবে ইউরোপে চালান করে দেয়া হয়,.যাদের বড় অংশ পথে মারা পড়ে। একই কাহিনী ভাসকো ডি গামা, ম্যাগেলান এবং অন্যান্য আবিষ্কারকের লেবাসে জলদস্যুদের যারা রাষ্ট্রীয় আশীর্বাদ নিয়ে দস্যুবৃত্তি করত।
আফ্রিকান প্রবাদের অনুরূপ বাংলা ভাষায় কিছু প্রবাদ ও বাগধারা রয়েছে। যেমন, ঝড়ে বক মরে ফকিরের কেরামতি বাড়ে। যার ধন তার নয়, নেপোয় মারে দই।
যে সিংহকে উপলক্ষ করে প্রবাদটির উৎপত্তি হয়েছে সে সম্পর্কে বলা যায়, নিরস্ত্র বাঘ-সিংহ বন্দুক রাইফেল দিয়ে হত্যা করে তার পাশে দাঁড়িয়ে ফটো তুলে কাগজে খবর ছাপা হয়। কিন্তু অসম যুদ্ধে নিরস্ত্র বাঘ সিংহের পক্ষে কথা বলার কেউ থাকেনা।
যদি কাউকে আধুনিক অস্ত্র ছাড়া সিংহের সাথে লড়াই করার কৃতিত্ব দিতে হয় তাহলে তার দাবিদার হতে পারে আফ্রিকার নির্ভীক মাসাই যোদ্ধারা।